বাইশে শ্রাবণ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাইশে শ্রাবণের আয়োজনে রবিঠাকুরের কথাসাহিত্য ও কবিতা নিয়ে লিখেছেন এই সময়ের দুজন কথাশিল্পী ও কবি

উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের চরিত্রদের নিরুদ্দিষ্ট হতে বা আক্ষরিক অর্থে হারিয়ে যেতে না দেখলেও কয়েকটি বহুলপঠিত গল্পে প্রধান চরিত্রের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো কি বিশেষভাবে তাৎপর্যবাহী? সচেতনভাবেই কি রবীন্দ্রনাথ চরিত্রদের নিরুদ্দেশে পাঠিয়ে গল্পের ইতি টেনেছেন—তাদের আর কিছু করার নেই বলে, না তাদের নিরুদ্দিষ্ট হওয়াকে উপলক্ষ করেই গল্পগুলোর গল্প হয়ে ওঠা, যেভাবেই দেখা হোক, মূল বিষয়টা লোকচক্ষু থেকে তাদের সংগোপনে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া লেখকের চিন্তাজগতের কোনো বিশেষ প্রবণতার ইঙ্গিতবাহী কি না, এ কৌতূহল অস্বাভাবিক নয়।
প্রবণতার কথা এ জন্য বললাম, যে গল্পগুলো এখানে প্রাসঙ্গিক, সেগুলো কাছাকাছি সময়ে লেখা এবং সব কটাই রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক জীবনের গোড়ার দিকের রচনা। ‘অতিথি’, ‘আপদ’, ‘স্বর্ণমৃগ’, ‘মহামায়া’, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ ইত্যাদি গল্পে চরিত্রদের নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার বিষয়টি এসেছে, এবং যদিও হারিয়ে যাওয়া এসব চরিত্রকে নিয়েই গল্পগুলো পল্লবিত হয়েছে, কোনো গল্পেরই মূল বিষয়-আশয় তাদের নিরুদ্দেশযাত্রাকে কেন্দ্র করে বেড়ে ওঠেনি বা তারা যখন নিরুদ্দিষ্ট হয়, সে ঘটনাকেও পল্লবিত হতে দেখি না। ভেঙে বললে যা দাঁড়ায়, চরিত্রগুলো একপর্যায়ে—অবধারিতভাবে গল্পের শেষে—হারিয়ে গেলেও এর কোনো পূর্ব ইশারা মেলে না। ‘অতিথি’ গল্পের তারাপদ ছাড়া প্রায় সবক্ষেত্রেই মানুষজন এই হারিয়ে যাওয়ার পেছনে তাদের বিড়ম্বিত জীবনকে দায়ী করবে, যদিও বিড়ম্বনার ধরনধারণে রকমফের যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে তাদের মানসিক প্রতিক্রিয়ার ভিন্নতা।
‘অতিথি’র তারাপদের ঘটনা অন্যদের থেকে ব্যতিক্রমী। তার হারিয়ে যাওয়া ঠিক নিরুদ্দিষ্ট হওয়া নয়, গল্পে তার হারিয়ে যাওয়া শেষ কথা নয়, সে নিশ্চয় কোথাও না কোথাও উদয় হবে ফের হারিয়ে যাবে বলে। বন্ধনহীন জীবনই তার কাম্য। ফলে সে নিরুদ্দিষ্ট হয়, বারবার হয়, এবং গল্পের শেষে তার যে হারিয়ে যাওয়া তা প্রকৃতপক্ষে তার মুক্তির নামান্তর। তারাপদের এ মুক্তি তথাকথিত কোনো বন্দিত্ব থেকে নয়, বৈরাগ্যভাব থেকে তো নয়ই, বরং তার স্বাধীন, অমুখাপেক্ষী অন্তরের অপ্রতিরোধ্য তাড়নাই এর জন্য দায়ী। লেখকের এ জন্য কোনো খেদ নেই, পরিতাপ নেই। বরং সে যে উন্মাতাল প্রকৃতির আহ্বানে সাড়া দিতে গিয়ে নিজেও দিশেহারা, উন্মাতাল এই তথ্যটিই গুরুত্ববহ—লেখকের কাছে, এবং ক্ষণিক বিহ্বলতা কাটিয়ে, পাঠকের কাছেও। মানুষের চিত্তচাঞ্চল্য জাগাতে প্রকৃতির এমন উচ্চকিত তোড়জোড় রবীন্দ্রনাথের অন্য কোনো রচনায় কি পাওয়া যাবে? ‘দেখিতে দেখিতে পূর্ব দিগন্ত হইতে ঘন মেঘরাশি প্রকাণ্ড কালো পাল তুলিয়া দিয়া আকাশের মাঝখানে উঠিয়া পড়িল, চাঁদ আচ্ছন্ন হইল—পুবে বাতাস বেগে বহিতে লাগিল, মেঘের পশ্চাতে মেঘ ছুটিয়া চলিল, নদীর জল খল খল হাস্যে স্ফীত হইয়া উঠিতে লাগিল—নদীতীরবর্তী আন্দোলিত বনশ্রেণীর মধ্যে অন্ধকার পুঞ্জীভূত হইয়া উঠিল, ভেক ডাকিতে আরম্ভ করিল, ঝিল্লিধ্বনি যেন করাত দিয়া অন্ধকারকে চিরিতে লাগিল। সম্মুখে আজ যেন সমস্ত জগতের রথযাত্রা—চাকা ঘুরিতেছে, ধ্বজা উড়িতেছে, পৃথিবী কাঁপিতেছে; মেঘ উড়িয়াছে, বাতাস ছুটিয়াছে, নদী বহিয়াছে, নৌকা চলিয়াছে, গান উঠিয়াছে...’