১ মে সরদার ফজলুল করিমের জন্মদিন

সরদারের অপ্রকাশিত দিনলিপি

সরদার ফজলুল করিম (১ মে ১৯২৫—১৫ জুন ২০১৪), প্রতিকৃতি: শিশির ভট্টাচার্য্য
সরদার ফজলুল করিম (১ মে ১৯২৫—১৫ জুন ২০১৪), প্রতিকৃতি: শিশির ভট্টাচার্য্য

ছোটখাটো দেহের প্রচণ্ড আশাবাদী মানুষ সরদার ফজলুল করিম মনে করতেন, তাঁর পুরো জীবনটাই লাভের: ১১ বছরের জেলজীবন, ৫৮ দিনের অনশন, বিলেতের বৃত্তির আমন্ত্রণপত্র ছিঁড়ে ফেলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়া—তাঁর হিসাবে অভিজ্ঞতার কোনো কিছুই লোকসান নয়। তিনি বহুমাত্রিক মানুষ। বাংলাদেশে দর্শনশাস্ত্রের অন্যতম পুরোধা।

সরদার ফজলুল করিমের বেশ কয়েকটি দিনলিপি প্রথম আমার হাতে আসে ২০১৩ সালের ১২ জুন, যেখানে আছে তাঁর নয় দশকের রোজনামচা। আফসানা করিম স্বাতীর সৌজন্যে প্রাপ্ত এবং বিভিন্ন সময়ে লেখা সরদারের এই নয় দশকের এই দিনলিপিতে আছে অনেক কিছু। এ দিনলিপিগুলো থেকে নির্বাচিত দিনলিপি সংকলিত করে মাওলা ব্রাদার্স থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে সরদার ফজলুল করিম: দিনলিপি। তবে এখনো প্রকাশের আলোর মুখ দেখেনি, এমন দিনলিপির পাতাও অজস্র—২৫৮৮ পৃষ্ঠা।

সরদার ফজলুল করিমের দিনলিপিজুড়ে ইতিহাস, জীবনদর্শন, সমাজভাবনা, রাজনীতি প্রভৃতি প্রসঙ্গের পাশাপাশি আছে বিভিন্ন ব্যক্তিকে নিয়ে তাঁর স্মৃতিকথামূলক লেখা। এখানে পত্রস্থ হলো সরদারের অপ্রকাশিত দিনলিপি থেকে তিনটি লেখা, যার মধ্য দিয়ে তিনি তুলে ধরেছেন সোনালি অতীতের কীর্তিমান কয়েকজন ব্যক্তির অবয়ব।

‘মুজিব মিল গিয়া’

মঙ্গলবার, ২৩ জুলাই ২০০২

সরদার ফজলুল করিমের দিনলিপির পৃষ্ঠা

যাওয়া-আসার পথে মুস্তাফা (মুস্তাফা নূরউল ইসলাম) বেশ বিস্তারিতভাবে তাঁর সমকালে নজরুল গ্রন্থ রচনার পরিশ্রম, বাংলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যাতায়াত, পরিশ্রম প্রভৃতির কথা বলছিলেন। তাঁর পরিশ্রম ও আন্তরিকতার বিষয়টি আমার মনে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।

অধ্যাপক সালেহ আহমদ সাহেবের ’৭১-এর সেই কাহিনিটিও স্মরণীয় এবং বিশেষ তাৎপর্যের কাহিনি। সেই সময়ে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সেই ১৯৭১-এ। অধ্যাপক জোহার (শহীদ শামসুজ্জোহা) হত্যাকাণ্ড ওই কালেই ঘটেছিল। ’৭১-এর ২৫ মার্চের আক্রমণের পর রাজশাহীতে পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা গ্রেপ্তার হন (সালেহ আহমদ)। তাঁর সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বোধ হয় গণিতের অধ্যাপক মুজিবর রহমানও।

অধ্যাপক সালেহ বললেন, অধ্যাপক মুজিবরকে পাকিস্তানি বাহিনীর জিজ্ঞেস, ‘তোমকো নাম বাতাও, কেয়া নাম?’
অধ্যাপক মুজিব বললেন, ‘মুজিবুর রহমান’।
অমনি বর্বর বাহিনী তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বলল, ‘মিল গিয়া’, ‘মুজিব মিল গিয়া।’

তাঁদের দুজনকে নির্যাতনের জায়গা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্টহাউসের ৭ নম্বর রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। সালেহ সাহেব অধ্যাপক মুজিবের ওপর অকথ্য নির্যাতনের কথা বললেন। বললেন, অধ্যাপক মুজিবের ওপর নির্যাতনের মধ্য দিয়ে আমার ওপর নির্যাতন হয়তো কমই হয়েছিল।

যুদ্ধ শেষে অধ্যাপক মুজিব মুক্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আর তখন স্বাভাবিক মানুষ নন। তিনি তাঁর নাম বদল করে নাম রাখলেন দেবদাস। এখনো তিনি বেঁচে আছেন কি না, তার হদিস (সালেহ) সাহেব দিতে পারলেন না।

এমন কত কাহিনি রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের, তা আমরা জানিনে।

সন্তোষের মা: আমার মাসিমা

সন্তোষ গুপ্তর মা কিরণবালা গুপ্তা

শুক্রবার, ২০ জুন ২০০৩

এখন সকাল নয়টা। মাঝেমধ্যে প্রথম আলো আসে না। আজ শুক্রবার প্রথম আলো এসেছে। না এলে রাস্তার স্টল থেকে প্রথম আলো কিনে আনতাম।

গতকালই প্রথম আলোতে গেলে সাজ্জাদের (সাজ্জাদ শরিফ) ঘরে তাঁরই বিভাগের সহযোগী জাফর রাশেদ (জাফর আহমদ রাশেদ) বলেছিলেন, ‘সরদার ভাই, শুক্রবারের প্রথম আলোতে, সন্তোষ বাবু (সন্তোষ গুপ্ত) ‘আমার মা’ বলে একটি স্মৃতিচারণা করেছেন, পড়বেন।’

আজ সকালে অন্য লেখা পড়ার আগে সন্তোষের ‘আমার মা’ই আগে পড়লাম।

এখানেও সন্তোষ কঠিন মানুষ। সন্তোষের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ‘আপনি-তুমি’র। সন্তোষ না কথায়, না লেখায়—নিজের কথা বলতে চান না। অথচ সন্তোষকে আমি বলি, সব্যসাচী লেখক, সাংবাদিক। ওঁর মস্তিষ্কে তথ্যের খনি। বাসায় কাগজের তথ্যের নথি রাখে কি না জানিনে। কিন্তু তাঁর কলমের মাথায় তথ্যের সন-তারিখের কোনো অভাব ঘটে না। দু-এক সময়ে যে এখনো তাঁর সঙ্গে কোনো অনুষ্ঠানে দেখা হয় না, এমন নয়। কিন্তু আজকাল অনেক দিন যাবৎ সন্তোষের সঙ্গে দেখা হয়নি।

সন্তোষ কারোর সঙ্গে স্মৃতিচারণাও হয়তো করেন না। তাই তাঁর আজকের স্মৃতিচারণাটিতে তাঁর মায়ের কথা বলাতে আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কেবল আফসোস, সন্তোষ আরও বলতে পারতেন। তাহলে তাঁর মা এবং আমার এক মাসিমাকে আরও ভালো করে আমি পেতাম।

এই মাসিমার (কিরণবালা গুপ্তা) সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটেছিল সেই ১৯৪৯ সালে সন্তোষের তাঁতীবাজারের বাসায়। ২৫ ডিসেম্বরের হয়তো দু-এক দিন আগে। আত্মগোপন অবস্থায়। চালাকচর থেকে আমার এক সাথি গোপনে, রাতের অন্ধকারে সন্তোষের বাসায় আমাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন, একটি সাংগঠনিক আলোচনার জন্য। সন্তোষ যে তখন পূর্ব পাকিস্তানের কারাগারে তথা আইজি দেখলে সাধারণত দৌড়ে পালায় না; অব প্রিজন বা ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন অফিসে কর্মরত ছিলেন, তা আমি জানতাম না। ওই বাসা থেকে সন্তোষই কেবল বাইরে যাতায়াত করতেন, আমরা কেউ নয়। হয়তো দুদিন কিংবা তিন দিনের জন্য কয়েকজন নেতৃস্থানীয় কর্মী বাসাটিতে সমবেত হয়েছিলেন। সন্তোষের বাসাটি ছিল তখনকার প্রায় নিষিদ্ধ এবং গুপ্ত কমিউনিস্ট পার্টির গোপন কার্যকেন্দ্র।

রবি গুহ। ছবিটি অলকানন্দা গুহের সৌজন্যে প্রাপ্ত

আমি মনে করতে পারছিনে, ওই দিনটিতে—২৫ ডিসেম্বর—বাসাটিতে কে কে ছিলেন। আমি ছিলাম, সন্তোষ তো বটেই। ঘটনাটি ঘটেছিল দুপুরের পরে বিশ্রামের সময়ে। রানু চ্যাটার্জির নাম আমার এখনো স্মরণ আছে। ঢাকা জেলার প্রখ্যাত কৃষকনেতা অজিত চ্যাটার্জির স্ত্রী। সন্তোষ বাদে আর কে কে ছিলেন, আজও কি বলতে নিষেধ আছে? সেদিন নিষেধ ছিল। তাই মাসিমা জানেননি, তাঁর স্নেহধন্যদের একটি ছিল অন্য ধর্মের আত্মগোপনকারী। তিনি জানলেও তাঁর স্নেহতে যে কোনো ঘাটতি পড়ত না, তা আমি বিশ্বাস করি। মায়েরা এমনই তার ছেলে যাকে ঘরে আনে, তাকেই মা বিশ্বাস করে, আর ভালোবাসে।
পুলিশ যখন সন্তোষকে আঘাত করে, মাসিমাও তখন পুলিশকে আঘাত করেছিলেন, একটি রান্না করার কাঠ দিয়ে।
আমাদের সঙ্গে মাসিমাও সেদিন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। জেলখানায় আমাদের নেওয়ার পরে আর তো তাঁকে দেখতে পাইনি। তাঁকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া হয় মেয়েদের ওয়ার্ডে। ছেলে সন্তোষও কত দিন পরে অনুমতির ভিত্তিতে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ভেতরে দেখা পেয়েছিল মায়ের, তা আমি জানিনে।
তখন ঢাকা জেলে রাজবন্দীদের জীবনের তাগিদে দীর্ঘ ৫৮ দিনের অনশন ধর্মঘট চলছিল। আমি, সন্তোষ এবং বোধ হয় বারী সাহেব, জ্ঞান চক্রবর্তী, মনু মিয়া—২৬ ডিসেম্বর থেকে অনশন শুরু করেছিলাম। এই অনশনের ২০ দিনের দিন কমরেড শিবেন রায় শহীদ হন।

কারাগারে নেওয়ার পরে, হয়তো পরের দিনই আইজি অব প্রিজন আমীর হোসেন রাজবন্দীদের পরিদর্শনে আসেন। আমাদের বন্দীদের লাইনে তিনি তাঁর সন্তোষকে দেখে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে যে বাক্য উচ্চারণ করেন তার অর্থ: তুমিও ব্লুটাস!

অনশনের পরে সন্তোষকে ঢাকা জেল থেকে বিচ্ছিন্ন করে অন্যত্র বদলি করা হয়। আমাকেও এক সহবন্দী সফির সঙ্গে (বর্তমানে সাংবাদিক সফিউদ্দীন) চালান দেওয়া হয় সিলেট জেলে।

সন্তোষ, আমি একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছি। ১৯৪৮ সাল থেকেই পূর্ব পাকিস্তান সরকার বেআইনিভাবে কমিউনিস্ট কর্মীদের ব্যাপক হারে গ্রেপ্তার করে কারাগারগুলো ভর্তি করে ফেলে।

সেই পর্যায়টি ১৯৪৮ থেকে যুক্তফ্রন্টের ১৯৫৪ সালের নির্বাচন পর্যন্ত তো বটেই, তার পর পর্যন্ত বিস্তারিত ছিল। এই পর্যায়ের বিশদ বিবরণ আমাদের কারোর স্মৃতিচারণায়ই আসেনি। সন্তোষ কেন যেন এই পর্যায়ের মধ্যে যেতেই চান না। অথচ সন্তোষই বহু তথ্যের আকর। সন্তোষ যে শেষ পর্যন্ত আমাদের মাসিমা সম্পর্কে একটু স্মৃতিচারণা করেছেন, তার জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে আনন্দবোধ করছি।

তা ব্যতীত সন্তোষ আমাদের সবার অনন্য এক পৃষ্ঠপোষক সাংবাদিক কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস সম্পর্কেও কিছু স্মৃতির উল্লেখ করেছেন, সে জন্যও তিনি আমাদের ধন্যবাদের পাত্র। তাঁর আরও বলা উচিত, বলা প্রয়োজন। কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের মতো একজন পৃষ্ঠপোষক লাভ করা সেকালে আমাদের ভাগ্যের ব্যাপার ছিল, অথচ তিনিও আজ বিস্মৃত।

রাজ্জাক স্যারের ত্রিরত্ন

শুক্রবার, ১১ মার্চ ২০০৫

একবার মনে হয়েছিল যে, সন্‌জীদা (সন্‌জীদা খাতুন) তথা মিনু ওর কথামতো আজ আমার বাসা খোঁজ করে আসবে রবিদা তথা আমার রবি গুহের (সরদার ফজলুল করিমের সুহৃদ ও চল্লিশ দশকের ঢাকার কমিউনিস্ট আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী; পরে কলকাতায় স্থায়ী হয়েছিলেন) ব্যাপারে কিছু স্মৃতিকথা জোগাড়ের জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসেনি। হয়তো আগামীকাল শনিবার ১২/৩ (১২ মার্চ) তারিখে আসবে।

কিন্তু কোন স্মৃতিকথা আমি বলতে পারব। মিনুদের পরিবার, রবিদার পরিবার—সব আমার সেই কৈশোরের ১৯৪১-৪২ সালের নিজের পরিবার! মানুষের দুঃখ এই যে, সে নিজের পরিবারের কথা সবচাইতে কম জানে। তাই গুছিয়ে কিছু বলতে বা লিখতে পারে না।

মিনু তো এখনো ওর সংগীতে, সংস্কৃতিতে যথেষ্ট সক্রিয়। আমি তো আশির ঘর পার করে এখন কেবল দিন গুনছি।

১৯৪০ সাল: ২০০৪ থেকে ৬৫ বছরের ব্যবধান। কেমন করে যে আমি একদিকে মিনু, নবাব (কাজী আনোয়ার হোসেন), নুরু (কাজী মাহবুব হোসেন), আব্বা কাজী মোতাহার হোসেন সাহেবের পরিবারের সঙ্গে (কাজী মোতাহার হোসেনকে ‘আব্বা’ ডাকতেন সরদার ফজলুল করিম); এবং আরেক দিকে ১৯৪১-৪২ সাল থেকেই পুরোনো ঢাকার পাতলা খান গলিতে থাকতেন যে রবি গুহ, তাঁর পরিবারের বোনদের সঙ্গে, বড়দির সঙ্গে—তাঁদের গ্রামের বাড়ি বজ্রযোগিনীর পরিবার-পরিজনের কীভাবে যে অভিন্ন হয়ে গেলাম! তার না আছে কোনো বিস্তারিত স্মৃতি, না কোনো লিখিত বিবরণ। অথচ এসবের একটি ঘটনা মনে পড়লেই অপর সব ঘটনা একটির টানে আরেকটি স্মৃতির পটে ভেসে ওঠে।

পূজার সময়ে বজ্রযোগিনীতে গেছি। শুধু দিন নয়, রাতও কাটিয়েছি উঁচু মাটির দেয়াল বাঁধা চৌকি পাতা করে, মুখ ধুয়েছি শানবাঁধানো পুকুরের ঘাটে। আর একদিকে চেয়ে দেখেছি দুর্গাপূজার সকল দেব-দেবীর তৈরি হতে থাকা মনোহর দৃশ্য। রবিদাকে আমি রবিদা বলতাম না, বলতাম রবি: যেন আমরা সমবয়স্ক। অথচ রবিদা আমার যেমন বয়োজ্যেষ্ঠ, তেমনি আমি যখন ম্যাট্রিক পাস করে আইএ পড়তে শুরু করছি, রবিদা তখন নাজমুল করিমের (পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক) সঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে অনার্স পড়ছেন। আমাদের পারস্পরিক সম্বোধন ছিল আপনি বলে, তুমি-আপনি নয়। তবু সে সম্বোধনে যে স্নেহ-প্রীতি-ভালোবাসার প্রকাশ ঘটত, তার কোনো তুলনা হয় না। তাতে থাকত তুমির অধিক স্নেহ-ভালোবাসার প্রকাশ। শিখাদি ছিল রবির ছোট বোন। বড় বোনের নিজের সংসার ছিল ঢাকার দক্ষিণ দিকে, প্রায় সদর ঘাটের কাছে। সে বাড়ির কোনো অনুষ্ঠানে আমাকে বাদ দিয়ে হতে পারত না। দুদিন পরে হলেও পিঠা, নাড়ু এবং অন্যান্য আপ্যায়নের দ্রব্য আমার জন্য রক্ষিত থাকত।

রবিদা ছাত্র আন্দোলন তথা ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমি জড়িয়ে পড়েছিলাম ঢাকার শিল্প-সাহিত্যের সংগঠন তথা প্রগতি লেখকের শিল্প সংগঠনের সঙ্গে। আমি তত সাহিত্যিক ছিলাম না। আমি ছিলাম ভলান্টিয়ার। আমার কাজ ছিল সাপ্তাহিক কিংবা পাক্ষিক সাহিত্য সভার দূর উত্তরের হল থেকে মতিন (আবদুল মতিন), মুনীর (মুনীর চৌধুরী)—এঁদের ডেকে নিয়ে সাহিত্য সভায় যোগ দেওয়ানো। আমার এ স্মৃতি ’৪২ সালের ৮ মার্চের সেই মর্মান্তিক ঘটনার পরের। ৮ মার্চ ’৪২-এ ফ্যাসিস্ট বাহিনীর আক্রমণে নিহত হন অমিত সম্ভাবনাময় সোমেন চন্দ।

সাহিত্য সংগঠনের প্রধান সাহিত্যিক এবং সংগঠক ছিলেন তখন রণেশদা (রণেশ দাশগুপ্ত), কিরণদা (কিরণ শঙ্কর সেনগুপ্ত), সরলানন্দ সেন, অচ্যুৎ গোস্বামী (তিনি কী যে অনবদ্য ভাষায় সভার কার্যবিবরণী লিখে রাখতেন এবং পাঠ করতে পারতেন! তাঁর সেই রচনার পাঠ শুনতে যাওয়া হতো ফজলুল হক হল, ঢাকা হল, জগন্নাথ হল এবং সলিমুল্লাহ হলে)। প্রগতিশীল চিন্তার আবদুল মতিন, সৈয়দ নুরুদ্দিন, মুনীর চৌধুরী—এঁদের সংগ্রহ করে নেওয়ার মূল দায়িত্ব ছিল আমার।

আমি আর রবিদা—দুজনে কেবল যে এক পরিবারের লোক ছিলাম, তা-ই নয়। আমরা দুজনে যেন ছিলাম যমজ সুহৃদ। যেখানে রবি, সেখানেই সরদার। ঢাকা থেকে কোন সে দক্ষিণের বেজওয়াদা, যেখানে সারা ভারত ছাত্র সম্মেলনের অনুষ্ঠান হয়েছিল, তাতে প্রধান অতিথি ভারতের বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা এসএ ডাঙ্গে। সেখানে রবির সঙ্গী আমি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর সে সম্মেলনে একটি বিতর্কও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রবিদার ধমকে আমাকে তাতে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিল। আবার সে আলোচনায় আমি যে তেমন কৃতিত্ব দেখাতে পারিনি, সে জন্য তাঁর ধমক থেকেও রেহাই পাইনি।

বোধ হয় ১৯৪৫ কিংবা ’৪৬ সালের নেত্রকোনার বিশাল মাঠে আয়োজন করা হয় সারা ভারত কৃষক সম্মেলন। প্রধান সংগঠক কমরেড মণি সিংহ। বাংলাদেশের তো বটে, ভারতের নানা অঞ্চল থেকে দল বেঁধে আসছে কৃষক, শ্রমিক, খেতমজুর।

সেখানেও যাবেন রবিদা। আর তাঁর স্থায়ী সঙ্গী সরদার। এমনি ছিল আমাদের দুজনের পারস্পরিক সম্পর্ক। এর শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে, বোধ হয় ১৯৭৩ সালে আমি একবার গিয়েছিলাম কলকাতায়। উঠেছিলাম রবিদার আলিপুরের বাসায়। বউদি নীশা গুহের বাড়িতে। সেই বাসাকে কেন্দ্র করেই বেড়িয়েছি মদন বসাক, জামিল বসাক আর দেবপ্রসাদের বাড়িতে।

কিন্তু সেটিই শেষ স্মৃতি নয়।

রবিদা সপরিবারে বেড়াতে এসেছিলেন ঢাকায়। তাঁর জীবনের প্রিয় ঢাকায়। একুশে ফেব্রুয়ারির মাস। রবিদা কাঁথা-কম্বল নিয়ে বাংলা একাডেমির বটতলায় গিয়ে যেন শুয়ে থাকতেন। খাওয়া নাই দাওয়া নাই।

আমি বলি, ‘রবি খেয়েছেন?’

রবিদা ভয়ার্তভাবে বলেন, ‘এই সরদার, নীশাকে বলবেন না যেন।’

সেবারই পরিবারের সকলকে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজ গ্রাম বজ্রযোগিনীতে। সেই যাওয়াটা ঠিক হয়নি। আমাদের কৈশোরকে কি বার্ধক্যে পাওয়া যায়? যায় না। তবে সেই বিগতের জন্য কেন যে এত আকুলতা? কী লাভ তাতে!

সেবারে এমন দিন যায়নি যে নিজের বাসা থেকে রাজমণি সিনেমা হলের কাছে, ন্যাপের মুজাফ্‌ফর (মুজাফ্‌ফর আহমদ) সাহেবের বাসার কাছের সেই হোটেলে যাইনি।

শেষে একদিন বিদায় নিয়ে গেলেন, কলকাতায়।

আমি সেদিন তাঁদের বিদায় জানাতে এয়ারপোর্টে যাইনি। হোটেলের কাছ থেকেই হয়তো বিদায় দিয়েছিলাম। গাড়িতে উঠে রবিদা একটা খাম আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘সরদার, এই থামটা রাখেন, বাসায় নিয়ে যাওয়ার আগে খুলবেন না।’

তাঁর কথা রেখেছিলাম। বাসায় যাওয়ার আগে খুলিনি। বাসায় গিয়ে খাম খুলে দেখি ১৪ হাজার টাকার একটা বান্ডিল।

নীশা বউদির সেই মর্মান্তিক চিঠির কথা মনে উঠলে এখনো আমার চোখ পানিতে ভরে যায়। বউদি লিখেছিলেন, ‘সরদার ভাই, এখন বুঝতে পারি, ওকে নিয়ে ঢাকায় যাওয়া আমার উচিত হয়নি। এসে অবধি যেন পাগল হয়ে গেছে। যখন-তখন কাঁথা-কম্বল গুছিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হয়। পথ থেকে ফিরিয়ে আনা যে কী কষ্টের, তা কী করে বোঝাই...’।

এই ছিল আমার রবিদা। আর ছিলাম আমি রবিদার সরদার। আসলে আমরা ছিলাম, আমাদের তিনজনেরই শ্রদ্ধেয় এবং প্রিয় রাজ্জাক (জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক) স্যারের ত্রিরত্ন—‘নাজমুল করিম, রবি গুহ আর সরদার।’

মানুষের এই এক অস্তিত্ব: অভিন্ন অস্তিত্ব। আজ রবিদা নেই। আগামীকাল আমিও থাকব না। আমি মৃত্যুতে বিশ্বাস করি না। ঢাকা-কলকাতায় আমাদের আর যাতায়াত না হলেও এই মর্ত্যে এবং ওই মর্ত্যে আমাদের যাতায়াত সেই ৬০ বছর আগের মতোই ঘটবে। তাই আজ এই স্মৃতিটুকু লিখতে আমার নিজের আনন্দ ছাড়া কোনো দুঃখ নেই। কেবল বিস্ময়, আমাদের পরস্পরের সাক্ষাৎ ঘটেছিল! আসলে আমরা ছিলাম এক অভিন্ন পরিবারের সদস্য: কাউকে বাদ দিয়ে কেউ নয়।