‘মুড’। শিল্পী হাবিবুর রহমান
‘মুড’। শিল্পী হাবিবুর রহমান

১৪ শিল্পীর শিল্পকর্ম প্রদর্শনী

‘ফিরে দেখা’: শিল্প ও সময়ের মিলিত রূপ

আমেরিকার ব্ল্যাক আর্টস মুভমেন্টের অন্যতম কবি, নাট্যকার ও সাহিত্যিক আমিরি বারাকা বলেছিলেন, ‘আর্ট ইজ আ ওয়েপন ইন দ্য স্ট্রাগল অব আইডিয়াস, দ্য ক্লাস স্ট্র্যাগল।’ মানবজাতির সভ্য হওয়ার ইতিহাসে চলমান থাকে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, যা সে প্রকাশ করে শিল্পের মধ্য দিয়ে। সভ্যতার উত্থান–পতন থাকলেও মানুষের সংগ্রাম চলতে থাকে। আর এই সংগ্রামই মানবজীবনের বাঁচার আকাঙ্ক্ষাকে জিইয়ে রাখে। জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। শিল্প আর সংগ্রামের সম্পর্ক তাই অবিচ্ছেদ্য। সংগ্রামের ভাষা নির্ধারণ করে শিল্প। কারণ, সংগ্রাম একটি চলমানপ্রক্রিয়া। শিল্পচর্চার মধ্য দিয়ে সমাজে ক্রমাগত যার জানান দিতে হয়। মানব মনকে চলমান সংগ্রাম সম্পর্কে সচেতন রাখে শিল্প।

‘বোরাক’। শিল্পী ঢালী আল মামুন

শিল্পের মধ্য দিয়ে রচিত হয় সংগ্রামের মনস্তাত্ত্বিক ইতিহাস। কারণ, সময়ের অনুভূতিকে একমাত্র ধরে রাখতে পারে শিল্প। ইতিহাস শুধু কালপঞ্জি তৈরি করে আর শিল্প ইতিহাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা মানুষের আনন্দ–বিরহ, সুখ–দুঃখ, বিচ্ছেদ–মিলনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতিকেও করে তোলে কালজয়ী। এসব কারণেই পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা দেখি, চলমান সংগ্রামের মধ্যেই সব সময় রচিত হয়েছে গান, গল্প, কবিতা আর আঁকা হয়েছে হরেক রকমের ছবি।

‘খেলা দেখে যান বাবু’। শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য

এ কারণে সমাজবাস্তবতায় শিল্পীদের প্রাসঙ্গিকতা। কারণ, শিল্পীদের ছাড়া সময় ও ইতিহাসের পুনরায় পরিদর্শন সম্ভব হয় না। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের নানা নিরিখে ইতিহাস বারবার লেখা হতে পারে; কিন্তু শিল্পীর অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে সময়ের যে কাল নির্দিষ্ট অনুভূতি তা সময় ললাটে তিলক হিসেবে রয়ে যায়। যেমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অঙ্কিত চিত্রমালার বা পোস্টারের মধ্যে সেই সময়ে বাঙালির আন্দোলন–সংগ্রামের বাস্তবতা উপস্থাপিত। বিশ্বশিল্পের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা উদাহরণ হিসেবে আনতে পারি পিকাসোর ‘গোয়ের্নিকা’, দেলাক্রোয়ার ‘লিবার্টি লিডিং দ্য পিপল’ বা ফ্রানসিসকো গোইয়ার ‘দ্য থার্ড অব মে’।

বোর্ডে মিশ্র মাধ্যম। শিল্পী ফারেহা জেবা

বাংলাদেশের সত্তর থেকে আশি ও নব্বইয়ের দশকের সময় বাস্তবতাকে সমসাময়িক তরুণ শিল্পীরা কেমনভাবে উপলব্ধি করেছিলেন তার উপস্থাপন চলছে লালমাটিয়া এলাকার ‘কলাকেন্দ্র’ গ্যালারিতে। প্রদর্শনীর নাম ‘ফিরে দেখা’। সত্যিকার অর্থেই সময়ের যেন পুনঃ পরিদর্শন এই প্রদর্শনী। বিশ্ব ও স্থানিক রাজনীতি, সংস্কৃতি, সমাজকে শিল্পে অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে সার্থক প্রকাশ এই প্রদর্শনীর প্রতিটি শিল্পকর্ম। প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হচ্ছে ১৪ শিল্পীর প্রায় ৬০টি শিল্পকর্ম। যার মধ্যে রয়েছে চিত্রকলা, ছাপচিত্র ও ভাস্কর্যধর্মী শিল্পকর্ম।

বোর্ডে মিশ্র মাধ্যম। শিল্পী নিসার হোসেন

শিল্পীরা হলেন কাজী রকিব, দীপা হক, রতন মজুমদার, রুহুল আমিন কাজল, ঢালী আল মামুন, দিলারা বেগম জলি, নিসার হোসেন, শিশির ভট্টাচার্য, সাইদুল হক জুইস, ফারাহ জেবা, হাবিবুর রহমান, লালা রুখ সেলিম, তৌফিকুর রহমান ও ওয়াকিলুর রহমান।

কাঠখোদাই। শিল্পী তৌফিকুর রহমান

শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে রয়েছে মাধ্যম ও শিল্পশৈলীর বৈচিত্র্য। বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের (যেমন জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, এস এম সুলতান) অবয়বধর্মী শিল্পকর্মের যথার্থ উত্তরসূরি এই শিল্পীরা। বর্ণনাধর্মিতা এই প্রদর্শনীর অধিকাংশ শিল্পীর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য।

‘বস সিরিজ’। শিল্পী দিলারা বেগম জলি

এই বর্ণনাধর্মিতার মধ্যে রয়েছে সমসাময়িক জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক সমাজ বাস্তবতার কখনো প্রত্যক্ষ, কখনো পরোক্ষ উপস্থাপন। যেমন শিল্পী কাজী রাকিব, রতন মজুমদার, সাঈদুল হক জুইস অথবা দিলারা বেগম জলির চিত্রপটের মধ্যে রয়েছে জমাটবাঁধা অন্ধকার। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন ক্যানভাস সমসাময়িক সময়ের যে স্পষ্ট উপস্থাপন, তা ছবির টাইটেল দেখলেও বোঝা যায়। যেমন দিলারা বেগম জলির একটি ছবির নাম লালসালু (১৯৮৬) বা রতন মজুমদারের ছবির নাম কালো সময় (১৯৮০)।

‘মোহাচ্ছন্ন সমাজ’। শিল্পী সাইদুল হক জুইস

নব্বইয়ের দশকের বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় শিল্পী শিশির ভট্টাচার্যের বেশ কয়েকটি শিল্পকর্ম রয়েছে এই প্রদর্শনীতে। নব্বইয়ের দশকে তিনি সেই সময় যেভাবে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করেছিলেন ব্যঙ্গচিত্রে, তারই প্রতিফলন এই ছবিগুলো। এই প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সময় পর শিল্পীর বিখ্যাত সিরিজ ‘খেলা দেখে যান বাবু’র ছবি দেখার সুযোগ পাবেন দর্শক। তার এই ‘বাবু’ আসলে সমাজের পর্দার আড়ালে থাকা সেসব কুশীলব, যাঁরা সময়ের মঞ্চে সব কাহিনি মঞ্চস্থ করেন। শিল্পী শিশিরের ছবির চরিত্রগুলোর মধ্যে তার স্বভাবসুলব ব্যঙ্গধর্মিতা লক্ষণীয়। সমাজের এমন চরিত্রগুলো নিয়ে কাছাকাছি উপস্থাপন রুহুল আমিন কাজলের ‘সোসাইটি’ সিরিজের ছবিগুলো। সময়কেই বিষয় করে আরেকজন শিল্পী হাবিবুর রহমানকে ছবি আঁকতে দেখা যায়।

পাটের ক্যানভাসে তেলরং। শিল্পী কাজী রাকিব

কালো অবয়বে ‘সময়ের বিপরীতে’ শিরোনামের ছবিগুলো দীপা হকের ছবিগুলোর সঙ্গেও কোথাও যেন মিলে যায়। এই মিলে যাওয়া আসলে অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ, তারা একই সময়ে একই শহর ঢাকায় বসে শিল্পচর্চা করছিলেন। দীপা হক বাংলাদেশের আশির দশকের এক গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী, যার তুলির আঁচড়ে সমাজ উপস্থাপিত হয়েছে রূঢ়ভাবে। বারবনিতারা বেশির ভাগ সময় তাঁর ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে ধরা দিয়েছে।

‘সমাজ’। শিল্পী রুহুল আমিন কাজল

শিল্পী নিসার হোসেন ও ঢালী আল মামুনের চরিত্রগুলো লোকসংস্কৃতির আবহ থেকে উঠে আসা। ভাস্কর্যে লালা রুখ সেলিম ও তৌফিকুর রহমানের কাজগুলো সমসাময়িক সময়ের প্রথাবিরোধী শিল্পনির্মাণের স্পষ্ট উদাহরণ। এই প্রথাবিরোধী মনোভঙ্গি ফারাহ জেবা ও ওয়াকিলুর রহমানের কাজের মধ্যেও সমানভাবে উপস্থিত।

‘সংলাপ’। শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান

প্রদর্শনীটি কলাকেন্দ্রে শুরু হয়েছে গত ৩১ অক্টোবর, চলবে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত।