‘ওমেন অ্যান্ড সোসাইটি’। শিল্পী: নূর মুনজেরীন রিমঝিম
‘ওমেন অ্যান্ড সোসাইটি’। শিল্পী: নূর মুনজেরীন রিমঝিম

প্রদর্শনী

বহু মাধ্যমে বহু স্বরের শিল্পসংলাপ

বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পচর্চায় তরুণ ও মধ্যপ্রজন্মের শিল্পীদের নতুন উদ্যোগ সব সময়ই দর্শককে চমকে দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত ‘নাইন‍+ওয়ান’ প্রদর্শনী তেমনই একটি উদ্যোগ, যেখানে নয়জন শিল্পীকে একত্র করে ‘এজ আর্ট গ্যালারি’ তৈরি করেছে এক অনন্য শিল্পসংলাপ। যা নতুন ধারার শিল্প ও পরীক্ষামূলক কাজকে সাহস জুগিয়েছে।

আধুনিক শিল্পতত্ত্বে নিকোলাস বুররিওর ‘রিলেশনাল এসথেটিকস’ ধারণা অনুযায়ী, সমকালীন শিল্প একটি সামাজিক ক্ষেত্র তৈরি করে, যেখানে শিল্পকর্ম ও দর্শক মিলে আন্তসম্পর্ক গড়ে তোলে। এ প্রদর্শনীও সেই তত্ত্বের আলোকেই কাজ করেছে—ভিন্ন মাধ্যম, অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি দর্শকের জন্য বহুমাত্রিক চিন্তার ক্ষেত্র উন্মোচন করেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশি শিল্পের প্রেক্ষাপটে এ প্রদর্শনীকে পড়া যায় একটি ‘গ্লোকাল’ শিল্পপ্রবণতা হিসেবে। এখানে শিল্পীরা স্থানীয় অভিজ্ঞতা ও বৈশ্বিক সমকালীন ভাষার মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। প্রদর্শনীতে প্রতে৵ক শিল্পী তাঁর নিজস্ব শৈলী ও চিন্তার মাধ্যমে কাজ প্রদর্শন করেছেন, তবে সব কটি কাজ একত্রে একটি সমন্বিত সংলাপ তৈরি করে।

‘রিফিউজি’। শিল্পী আনিসুল রনি

প্রদর্শনীতে রয়েছে চিত্রকলা, সিরামিক, ভাস্কর্য, প্রিন্ট, ইনস্টলেশন ও নতুন মিডিয়া শিল্প। এগুলো দর্শকের সামনে একসঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন শিল্পভাষার মিথস্ক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

মুক্তি ভৌমিক একজন সমসাময়িক ভাস্কর, যিনি প্রধানত অ্যালুমিনিয়ামে কাজ করেন। তাঁর কাজের বৈশিষ্ট্য হলো রূপ, তন্তু ও অনুভূতির একত্রীকরণ—যেখানে ভাস্কর্যশিল্পে, উপাদান এবং রূপক মিশে যায় একসঙ্গে, একটি রূপের ভাষা উপস্থাপন করে, যা স্মৃতি ও আবেগের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে।

শিল্পী সাদাতউদ্দীন আহমেদ এমিলের শিল্পকর্ম মূলত পরিবর্তনশীল আধুনিকতার ভেতর মানুষের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তাঁর ক্যানভাসে ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষণিক অনুভূতি যেমন স্থান পায়, তেমনি সমাজের সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলোর স্মৃতিও প্রতিফলিত হয়। এভাবে তাঁর কাজ একদিকে ব্যক্তিগত দিনলিপি, অন্যদিকে সমকালীন সময়ের দলিল হয়ে ওঠে।

‘কেইজড ফ্লাইট’। শিল্পী সাদাত উদ্দিন

শিল্পী অসীম হালদার সাগর শিল্পকে একটি সংলাপ এবং পরীক্ষামূলক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখেন, দর্শকদের সংশোধন ও সচেতনতার মধ্যে জড়িত করেন। দৈনন্দিন জিনিসের পুনর্বিন্যাস করে সামাজিক সংকটের প্রতীক তৈরি করেন। এটি শিল্প–সমালোচক ক্লেয়ার বিশপের ‘ইনস্টলেশন আর্ট’ আলোচনার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ, যেখানে দর্শক সক্রিয়ভাবে কাজের অংশ হয়ে ওঠেন।

বাংলাদেশি সিরামিকশিল্পের নবীন কণ্ঠস্বর শিল্পী আনিসুল হক রনি তাঁর কাজে মাটির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গির মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। মাটির স্পর্শ, টেক্সচার ও ভঙ্গুরতা, যা প্রাচীনকাল থেকেই শিল্প ও জীবনের প্রতীক—আনিসুলের হাতে এসে নতুন অর্থ খুঁজে পায়। তাঁর কাজে প্রকৃতি, মানবজীবন ও সমাজের অন্তর্লীন সম্পর্ক প্রতিফলিত হয়। মাটির নান্দনিক ফর্ম ভিন্নধর্মী টেক্সচার তাঁর শিল্পকে এনে দিয়েছে একটি স্বতন্ত্র ভিজ্যুয়াল ভাষা, যা বাংলাদেশি সিরামিক শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক নতুন পথে।

শিল্পী নূর মুনজেরীন রিমঝিমের কলমের অঙ্কন ও যত্নশীল রেখার কাজের মাধ্যমে প্রধানত বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের সৌন্দর্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করে।

‘ক্রিটিক্যাল টাইম’। শিল্পী আনিসুল রনি

শিল্পী তরিকুল ইসলাম হীরকের চিত্রকলার দিকে তাকালে পৌরাণিক কাহিনি, ইতিহাস ও সমকালীন প্রতিফলনকে একত্র করে অসাধারণ, স্তরবদ্ধ কাহিনি উপলব্ধি করা যায় ।

অ্যাক্রিলিক ও মিশ্র মাধ্যমে শিল্পী তুলসী রানী দাস চিত্রকলার মাধ্যমে বস্ত্রের ঐতিহ্যকে নতুনভাবে অলংকারের সীমাবদ্ধতা থেকে বের করে এনে অর্থবহ সাংস্কৃতিক ভাষায় রূপান্তর করেছেন ।

শিল্পী ফাইজুর রহমান ফিরোজের কাঠখোদাই প্রিন্টগুলো দেখায় কীভাবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বৃহত্তর সামাজিক ও পরিবেশগত ব্যবস্থার সঙ্গে প্রতিধ্বনিত হয়।

ভিডিও আর্ট ও ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানবপ্রযুক্তির সম্পর্ককে তুলে ধরেন শিল্পী জিহান করিম। তাঁর কাজ ডিজিটাল যুগের শিল্পভাষার প্রতিফলন।

‘ভেনাস উইপস’। শিল্পী ফাইরুজ রাহমান

শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করে দর্শকের জন্য একটি যাত্রাপথ তৈরি করেছেন কিউরেটর আনমন ও পূজা। তাঁদের কিউরেটরিয়াল দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শনীকে দিয়েছে একটি একক শিল্পকণ্ঠ, যেখানে প্রতিটি কাজ আলাদা হয়েও বৃহত্তর অর্থে একে অপরের সঙ্গে সংলাপে যুক্ত। এই প্রদর্শনী প্রমাণ করেছে যে শিল্পচর্চায় সমষ্টিগত উদ্যোগ কতটা জরুরি। এখানে শিল্পীরা তাঁদের নিজস্ব কণ্ঠ বজায় রেখেও সম্মিলিতভাবে এক নতুন ভিজ্যুয়াল আখ্যান তৈরি করেছেন। ফলে এ প্রদর্শনী হয়ে উঠেছে সমকালীন বাংলাদেশি শিল্পের বহুস্বর ও বৈচিত্র্যের প্রতীক।

‘ওমেন অ্যান্ড সোসাইটি’। শিল্পী: নূর মুনজেরীন রিমঝিম

১২ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া প্রদর্শনীটির শেষ দিন ১৭ অক্টোবর।