দ্বীপ গ্যালারির উদ্যোগে ৪৫ জন শিল্পীর কাজ নিয়ে আয়োজিত ‘স্কেপ বিটুইন স্পেস’ প্রদর্শনী সমকালীন শিল্পচর্চায় এক বিস্তৃত ও বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা হাজির করেছে। এখানে প্রাকৃতিক দৃশ্য শুধু চোখে দেখা কোনো ভিজ্যুয়াল অভিজ্ঞতা নয়—বরং প্রকৃতি ও মানুষের অভ্যন্তরীণ অনুভূতির মাঝে থাকা অদৃশ্য, নীরব অথচ গভীর সংযোগের একটি অনুভবময় মানচিত্র। এই প্রদর্শনীতে শিল্পীরা ল্যান্ডস্কেপকে ব্যবহার করেছেন একটি মধ্যবর্তী ক্ষেত্র হিসেবে—যেখানে প্রকৃতির উপস্থিতি, মানুষের স্মৃতি এবং ব্যক্তিগত মানসিকতার স্তরগুলো একে অপরের সঙ্গে মিশে তৈরি করেছে বহুস্তর অভিজ্ঞতা।
প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি কাজ দর্শককে নিয়ে যায় প্রকৃতির দৃশ্যমান রূপের বাইরে, যা আলো ও ছায়া, শূন্যতা ও পূর্ণতা, স্থিরতা ও গতির সীমান্তরেখা মিলেমিশে নতুন বাস্তব তৈরি করে। পাহাড়, নদী, বন, আকাশ বা মেঘের মতো পরিচিত দৃশ্যশৈলী এখানে রূপ নেয় প্রতীকী ভাষায়, যা প্রশ্ন তোলে অস্তিত্ব, সময়, স্মৃতি এবং মানসিক বোধের নানা স্তর সম্পর্কে।
প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া শিল্পীরা এই ‘অন্তর্লীন প্রকৃতি’কে বিভিন্ন মাধ্যমে উন্মোচন করেছেন— ক্যানভাসে রঙের স্তর, সিরামিক পৃষ্ঠের টেক্সচার, আলোকচিত্রের নীরবতা কিংবা জলরঙের তরল প্রবাহ, সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এমন এক সমন্বিত পরিবেশ, যেখানে দর্শক নিজেকে খুঁজে পান প্রকৃতির ভেতর ও বাইরে উভয় জগতে। কাজগুলোর ভিজ্যুয়াল গহনে লুকিয়ে থাকে কিছু ‘অদৃশ্য স্পেস’, যা দেখতে হলে প্রয়োজন ধীর পর্যবেক্ষণ, নিজের অভ্যন্তরীণ মননে ফিরে দেখা।
প্রদর্শনীর মূল ভাবনা হলো প্রকৃতি শুধু একটি দৃশ্য নয়; এটি মানুষের অনুভূতি, অস্তিত্ববোধ ও স্মৃতির একটি চলমান ভূদৃশ্য। ‘স্কেপ বিটুইন স্পেস’ সেই অনুভূতির দিকেই ইঙ্গিত করে, যেখানে আমরা প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের সম্পর্কটিকে নতুন করে আবিষ্কার করি। জলরঙের স্বচ্ছ প্রবাহ, আলোর খেলা, ছায়ার ভাঁজ—সবকিছু যেন এক নীরব নান্দনিক ভাষা গড়ে তোলে, যা দর্শকের মনকে প্রবাহিত করে এবং তার ভেতরের স্পেসকে সতেজ করে।
এই অনুসন্ধানের গভীরে আছে ফেনোমেনোলজির ফরাসি দার্শনিক মরিস মের্লো–পন্তির ধারণা, যিনি বলেন, ‘আমরা প্রকৃতিকে দেখি না; প্রকৃতিই আমাদের দেখে।’ তাঁর মতে, প্রকৃতি কোনো একপেশে, বাহ্যিক দৃশ্য নয়; বরং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির মধ্যে একটি সক্রিয় পারস্পরিক অভিজ্ঞতা। প্রদর্শনীর প্রতিটি কাজ সেই সংলাপকে দৃশ্যমান করে—যেখানে প্রকৃতি দর্শকের দিকে তাকায়, আর দর্শক প্রকৃতির ভেতরে নিজের অনুভূতিকে আবিষ্কার করে। এই পারস্পরিক দৃষ্টিপথে তৈরি হয় নীরব স্পেস, যা দৃশ্যমানের চেয়ে গভীরতর, সূক্ষ্মতর এবং অন্তর্দৃষ্টিমূলক।
‘স্কেপ বিটুইন স্পেস’ মূলত সেই মধ্যবর্তী স্থানকে অনুসন্ধান করে—যেখানে প্রকৃতির দৃশ্য এবং মানুষের অভ্যন্তরীণ অনুভূতিগুলো একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে নতুন বাস্তবতা ও নান্দনিক অভিজ্ঞতা তৈরি করে। প্রদর্শনীর প্রতিটি কাজ দর্শককে আমন্ত্রণ জানায় কেবল দেখতে নয়; বরং উপলব্ধি করতে, শরীর ও মন দিয়ে সংলাপে প্রবেশ করতে এবং নিজের ভেতরের নীরব স্পেসগুলোকে চিনতে।
প্রদর্শনীর ল্যান্ডস্কেপগুলোও শুধু প্রকৃতির অনুলিপি নয়; বরং রং, টোন এবং বিন্যাসের গভীর মেলবন্ধনে গঠিত একটি নান্দনিক স্তর, যা দর্শকের অন্তর্গত অনুভূতিকে সক্রিয় করে।
এই প্রদর্শনী তাই কেবল ছবি দেখার আয়োজন নয়, বরং প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যবর্তী সেই সূক্ষ্ম, অনির্দিষ্ট, অথচ গভীর অন্তরালের এক নান্দনিক ভ্রমণ। প্রদর্শনীটির উদ্বোধন হয় ১৪ নভেম্বর। শেষ দিন ছিল গতকাল ২৭ নভেম্বর।