
ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান গত ২০ জুলাই ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। মৃত্যুর কিছুদিন আগে, একান্ত এক আলাপচারিতায় নিজের অভিজ্ঞতা, শিল্পচিন্তা এবং জীবন দর্শন নিয়ে কথা বলেন তাঁর দীর্ঘদিনের সহচর, আলোকচিত্রী মোহাম্মদ আসাদ -এর সঙ্গে। দেহগত অনুপস্থিতির পর এই সাক্ষাৎকারটি এখন শিল্পী হামিদুজ্জামানের এক অন্তিম আত্মপ্রকাশ—যেখানে তাঁর অভিজ্ঞতা ও আবেগের বর্ণনাগুলো মৃত্যুর সীমারেখা পেরিয়ে চির যোগাযোগ সক্ষম।
আপনি তো চারুকলায় পড়াশোনা করেছেন ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগে। দক্ষ ছিলেন জলরং ও রেখাচিত্রে। সেখান থেকে ভাস্কর্যে এলেন কীভাবে?
হামিদুজ্জামান খান : আমি গ্রামে বড় হয়েছি। সেখান থেকে ঢাকায় এসে চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে (বর্তমান চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হয়েছি ১৯৬২ সালে। তখন চারুকলা কলেজে বিভাগ ছিল পাঁচটি। ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং, প্রিন্টমেকিং, গ্রাফিক ডিজাইন, ওরিয়েন্টাল ও মৃৎশিল্প বিভাগ। আমি ভর্তি হয়েছি ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগে। গ্রামে থাকতে বা ঢাকায় এসে ভাস্কর্য সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। চারুকলায়ও তখন ভাস্কর্য বিভাগ খোলা হয়নি। এই বিভাগটি রাজ্জাক স্যার (শিল্পী আবদুর রাজ্জাক) শুরু করেন ১৯৬৪ সালে।
ইংল্যান্ড, প্যারিস, ইতালি দেখে আমি দেশে ফিরলাম ১৯৬৮ সালে। সেখানে ছিলাম ছয়-সাত মাস। এই কয় মাসের বিদেশভ্রমণে নিজের পরিবর্তনটা টের পাচ্ছি। পৃথিবীটা দেখেছি, পৃথিবীর উন্নতিটা দেখেছি। আমি একটা অন্য মানুষ হয়ে গেছি। আবেদিন স্যারের সঙ্গে দেখা করলাম। স্যারকে সব বললাম, তিনি বললেন, ভালো করেছ, ইউরোপ ঘুরে সব দেখে এসেছ। বললাম, স্যার আমি ভাস্কর্য করতে চাই। তিনি বললেন, রাজ্জাকের কাছে যাও, আমি বলে দিচ্ছি। রাজ্জাক স্যারের কাছে গিয়ে বললাম, আমি ভাস্কর্য করতে চাই। স্যার খুশি হলেন। তখন ভাস্কর্য কোর্স শুরু হয়নি। সাবসিডিয়ারি হিসেবে পড়ায়। জাহান ভাই (আনোয়ার জাহান) শুধু কাঠ কাটে। কাঠ নিয়ে এসে ধাম ধাম কাঠ কেটে ভাস্কর্য তৈরি করে। পিয়ারু (আনোয়ারুল হক পিয়ারু) ভাইও মাটি দিয়ে মডেলিং করত। পরে জাহান ভাইয়ের চাকরি হলো আমেরিকান স্কুলের আর্ট টিচার হিসেবে। বেতন আড়াই হাজার টাকা। চারুকলায় বেতন ছিল ১৭৫ টাকা। চাকরির পাশাপাশি আবার গুলশানে একটা বাসা ভাড়া নিয়ে ছাত্রদের পেইন্টিং শেখাত। সেখানে তার অনেক টাকা। আমি রাজ্জাক স্যারের সঙ্গে ৯ মাস কাজ করলাম। মাটি দিয়ে রিয়েলিস্টিক কাজ করি। পরে ঢালাই করি সিমেন্টে। সেই সময়ে আমি অনেক অবয়ব করেছি। তখনকার আমার করা একটা অবয়ব জাতীয় জাদুঘরে আছে। খুব সুন্দর হয়েছিল কাজটা। একজন মালির অবয়ব।
একদিন আবেদিন স্যার আমাকে বাসায় ডাকলেন। বললেন, ‘তুমি একটা দরখাস্ত লেখো ভাস্কর্য বিভাগে শিক্ষক হওয়ার জন্য। আমি সাইন করে দিলে তোমার হয়ে যাবে।’ আবেদিন স্যার সাইন দিলে আর কিছু লাগে না। আমি বললাম, স্যার আমি তো ভাস্কর্য সেভাবে পারি না। স্যার বললেন, তোমার ড্রয়িংটা ভালো আছে। ভাস্কর্যে ভালো করবে। তোমার হবে। দরখাস্ত লিখে স্যারের সাইন নিয়ে জমা দিলাম। ডিপিআই অফিস থেকে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়ে গেল। শিক্ষক হিসেবে ভাস্কর্য বিভাগে যোগ দিলাম ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে।
বলছিলেন ইংল্যান্ড, প্যারিস, ইতালি ঘুরে এসেছেন। সে সম্পর্কে একটু জানতে চাই।
হামিদুজ্জামান খান : চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে আমি ১৯৬৭ সালে শেষ বর্ষে পড়ার সময় বড় অ্যাকসিডেন্ট করলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির পাশের রাস্তায় একটা ট্রাক আমাকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। মাথায় বড় আঘাত পেয়েছিলাম। অনেক দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছি। আবেদিন স্যার খুব চেষ্টা করেছিলেন আমাকে ভালো করার জন্য। কিছুটা ভালো হয়ে এসে আমি পরীক্ষা দিলাম। অ্যাকসিডেন্টের কারণে রেজাল্ট খারাপ হলো। অ্যাকসিডেন্ট না হলে আমার ভালো রেজাল্ট হওয়ার কথা ছিল। হয়তো পাস করার পরই পেইন্টিং বিভাগের শিক্ষক হয়ে যেতাম। আমার সব এলোমেলো হয়ে গেল। ডাক্তার আমাকে পরীক্ষা করে বলল, এই চিকিৎসাই তোমার শেষ নয়। তোমার আরও চিকিৎসা করাতে হবে ইংল্যান্ড গিয়ে। প্লাস্টিক সার্জারি করতে হবে। অ্যাকসিডেন্টের কারণে আমার মাথায় বিভিন্ন অংশে স্কাল্প ছিল না। সেই জায়গাগুলো নড়ত। অনেক রিস্কি ছিল। আবেদিন স্যার আমাকে দেশের বাইরে পাঠাতে অনেক চেষ্টা করলেন। ডা. আজহার উদ্দীন (তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন) আমার চিকিৎসা করেছিলেন। উনি বললেন, আমি বলে দিয়েছি তুমি ইংল্যান্ডের এডিনবার্গে যাও। ওখানে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আসো। আবেদিন স্যার আমার একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন চট্টগ্রাম ক্লাবে। চট্টগ্রাম ক্লাবের গ্যালারিতে আমি ছবি নিয়ে টানিয়ে দিলাম। দেখি সব ছবি বিক্রি হয়ে গেছে। স্যার সবাইকে বলে দিয়েছিল ছবিগুলো কিনে নাও, ওর টাকার দরকার। আমি সেখান থেকে অনেক টাকা পেলাম। পারভীন আপা জাহাজের টিকিট করে দিলেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক। আমার বাবা খুলনায় গিয়ে জাহাজে উঠিয়ে দিলেন। খুলনার চালনা বন্দর থেকে জাহাজে করে ইংল্যান্ডের পথে রওনা দিই। পথে পথে জাহাজ নোঙর করেছে। আফ্রিকায় নোঙর করার পর ‘ডাকার’ শহরে নেমেছি। সেখানে প্রথম পরিচয় হয় আফ্রিকান ভাস্কর্যের সঙ্গে। আফ্রিকা বন্দর থেকে একা একাই নেমেছি। হাঁটতে হাঁটতে একটা রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসেছি। তখন ব্যাগ কাঁধে একটা লোক আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমাকে ইংরেজিতে বললেন, তুমি কি কাঠের ভাস্কর্য চাও। ব্যাগের ভেতর থেকে কালো রঙের কাঠের একটা অবয়ব বের করে আমাকে দেখায়। এমন কালো কাঠ আমি আগে কখনো দেখিনি। বললাম, এটার কত দাম। ও একটা দাম বলল, আমি নিয়ে নিলাম। সেই কাজটি এখনো আমার সংগ্রহে আছে। পরে যখন আমেরিকায় গেলাম, নিউইয়র্ক মিউজিয়ামে এই ভাস্কর্য দেখেছি। সেখান থেকে আরও একটা ভাস্কর্য কিনে এনেছি। বিউটিফুল, সুচারুভাবে তৈরি আফ্রিকান ভাস্কর্য। আফ্রিকার ক্রেপটন শহর দেখেছি—অপূর্ব। পাহাড়বেষ্টিত শহর। মেঘ গিয়ে পাহাড়ে লেগে যাচ্ছে। সেখানে মানুষগুলো সাদা আবার কালো। কিছু মানুষ দেখা যায় ধবধবে সাদা, আবার কিছু মানুষ কালো।
আফ্রিকা থেকে দুই দিন পর আমাদের জাহাজটা চলতে লাগল। আমাদের আগেই বলা হয়েছিল সামনে একটা জায়গা সমুদ্র উত্তাল থাকবে। সে জায়গাটা স্পেনের কাছাকাছি। আগে যতটুকু পথ গিয়েছি, দেখেছি শান্ত জলরাশি, সামনে কিছুই চোখে পড়েনি। এখানে এসে দেখি জলরাশি অশান্ত। বিশাল বিশাল ঢেউ আসছে, এক একটা ঢেউ পাহাড়ের সমান উঁচু। ভয়াবহ অবস্থা। জাহাজ দুলছে, আমরা বসে থাকতে পারছি না। কিছু একটা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। খাবারদাবার বন্ধ হয়ে গেছে। সবাই বমি করে অস্থির। সেই জায়গাটুকু পার হতে প্রায় আধা বেলা লেগে যায়। স্পেনের পাশ দিয়ে আমরা গিয়েছি। স্পেন পার হওয়ার পরই কোস্ট দেখা গেছে। অবশেষে গিয়ে পৌঁছালাম ডান্ডি পোর্টে। খুলনা থেকে সেখানে যেতে আমাদের দেড় মাস সময়ে লেগেছে। গিয়ে দেখি সেখানে তীব্র শীত। আমি জাহাজ থেকে বের হতে পারছি না। তাপমাত্রা মাইনাস হয়ে গেছে। সমুদ্রতীরের পানি বরফ হয়েছে। বরফের কারণে জাহাজগুলো নড়তে পারছে না। জাহাজ থেকে বের হয়ে ওখানে একটা ছোট্ট শহর আছে, সেখানে গিয়ে আগে গরম কাপড় কিনেছি। ঢাকা থেকে যা গরম কাপড় নিয়েছিলাম, তা কোনো কাজেই আসেনি। সেখান থেকে মোটা কাপড়ের প্যান্ট-শার্ট, ওভারকোট, চামড়ার জুতা, মোটা মোজা কিনে পরার পর দেখি বের হওয়া যায়। বাইরে গিয়ে লক্ষ করেছি লোকজন দোকান থেকে বের হয়ে দৌড়াদৌড়ি করে। এক দোকান থেকে বের হয়ে দৌড়ে অন্য দোকানে যায়। জিজ্ঞেস করলাম, এরা দৌড়ায় কেন? বলে, শীতের কারণে। সেখানে থেকে জানলাম ট্রেনে করে এডিনবার্গ যেতে পারব। এই প্রথম দেশের বাইরে যাওয়া, তা–ও একা। আমার বয়স তখন ২২–২৩ বছর হবে। আমি ভালো ইংরেজি বলতে পারতাম। ট্রেনে চড়ে এডিনবার্গ গিয়ে নেমেছি। একটা শুটকেসে করে সবকিছু নিয়েছি। তখন তো অত ভালো শুটকেস ছিল না। ট্রেন থেকে নামার পর শুটকেস ধরে নামার পর ছিঁড়ে গেল। আমি দেখলাম মহাবিপদ। একটা মেয়ে এসে আমাকে বলল, তোমাকে সাহায্য করতে পারি? আমি টাই পরা ছিলাম। মেয়েটা বলল, টাইটা খোলো। সেই টাই দিয়ে আমার শুটকেসটা বেঁধে দিল। মেয়েটাকে ধন্যবাদ দিয়ে ট্যাক্সি এডিনবার্গ রওনা দিলাম। ট্রেন থেকে নেমে এডিনবার্গ হাসপাতালে গেলাম। বিরাট হাসপাতাল। সেখানে গিয়ে আমার পরিচয় দিলাম। কাগজপত্র চাইলে আমি বললাম আমার কাছে কাগজ নেই। আবার বলল, কাগজটা লাগবে। আমি বললাম, তোমাদের অফিসে খুঁজে দেখো, এটার কপি আছে। একটু পরে এসে বলল, পেয়েছি এসো। একটা সুন্দর রুম রেডি করা ছিল, সেখানে গিয়ে উঠলাম। সন্ধ্যার সময় ডাক্তার এসে আমার খোঁজখবর নিতে লাগল। কী করে এই অবস্থা হলো। কত দিন এমন ছিল ইত্যাদি। ব্রিটিশরা সময়ের ব্যাপারে খুব সচেতন। যেদিন গিয়ে পৌঁছালাম, সেদিন থেকেই চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছে। আমার স্কাল্প খুলে অপারেশন করতে হয়েছে। আমার সঙ্গে তো কেউ ছিল না। ডা. রশীদ নামে একজন বাঙালি ডাক্তার এসেছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। তিনি বললেন, তোমার অপারেশনের সময় আমি থাকব। আর অপারেশন হওয়ার পর তুমি আমার বাসায় থাকবা।’ পরের দিনই অপারেশন। উনি যাওয়ার সময় আমার দুই হাতে ঝুলে থাকা দুটি আঙুল দেখিয়ে বলেছি এগুলো ঝামেলা মনে করি। এইটুকুই বলেছি। বড় অপারেশন মাথায়। অনেক সময় লেগেছে। পরে দেখি আমার হাত দুটিও ব্যান্ডেজ করা। মাথার অপারেশনের সময় হাতের বাড়তি আঙুল দুটিও অপারেশন করেছে।
রুমে টিভি আছে, সেটা বসে বসে দেখি। বলে দিয়েছে কোনো সমস্যা মনে হলে কলিং বেলের বাটনে আঙুল ধরে রাখলেই নার্স চলে আসবে। একদিন টিভি দেখছি, হঠাৎ করেই মনে হচ্ছে আমার হাত ভেতরে চলে যাচ্ছে। শরীরটা দুমড়েমুচড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। শরীরটা আমার কন্ট্রোলে নেই। কলিং বেলের বাটনে হাত রেখেছি, আর কিছু মনে নাই। জ্ঞান ফেরার পর দেখি বিছানায় শুয়ে আছি। ডাক্তার এসে জিজ্ঞেস করে, তুমি এখন কোথায়? বললাম, হাসপাতালের বিছানায়, এখন ভালো অনুভব করছি। বলল, কী হয়েছিল। একটু ঝাঁকুনি দেখতে পেয়েছি। ডাক্তার জানাল, আমার একটা স্ট্রোক হয়েছিল। আরও বলল, তুমি সহজে ঢাকায় যেতে পারবে না। আমরা তোমাকে ওয়াচে রাখব। ব্রেনের অপারেশন, খুবই ক্রিটিক্যাল। তার ওপর একটা স্ট্রোক হয়েছে। কখন কী হয়ে যায়। ওরা আমাকে এখানে রেখেই ওয়াচ করতে চায়।
হাসপাতালে বিল দিতে গিয়েছি। বলে, তোমার বিল লাগবে না। একটু সুস্থ অনুভব করলে ডাক্তার রশীদ আমাকে বলল, তুমি এক মাস আমাদের কাছে থাকো। পরে এডিনবার্গে এক মাস এবং লন্ডনে চার মাস থাকবা। এই খরচ তোমার আছে। বললাম, আছে। লন্ডনে গিয়ে অসুস্থ হলেও ফ্রি চিকিৎসা করব। আমি যে চিত্রশিল্পী, এটা ওরা ভালো করেই জানত। বলে দিল লন্ডনে গিয়ে মিউজিয়ামগুলো দেখো। ডাক্তার রশীদ আমাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। বাসাটা ছিল হাসপাতাল থেকে অনেক দূরে। নীরব এলাকা, লোকজন নেই। সারা দিন একা একা থাকি, একটা মানুষের চলাচলও দেখি না। দুই দিনেই আমি অস্থির হয়েছি। পরে শহরে বাসা ভাড়া করে দিল। এই এক মাস এডিনবার্গ ভালো করে দেখেছি। সকালে বের হই, হাঁটতে হাঁটতে সব দেখি।
একদিন গেলাম একটা আর্ট কলেজে। একটা গ্যালারি ছিল কাছেই। অ্যান্টিক টাইপের অনেক উপকরণ ছিল সেখানে। বললাম, আমার পেইন্টিং রাখবে? বলল, নিয়ে এসো দেখি। আমি একটা পোর্টফোলিও নিয়ে গেছি। বললাম, এগুলো আমি ঢাকায় নিতে চাই না। তোমরা যদি মনে করো তোমাদের গ্যালারিতে রাখো। বিক্রি হলে আমাকে জানিয়ো। সেই ছবিগুলো পরে ইংল্যান্ড থেকে সম্প্রতি অকশনে চলে এসেছে ঢাকায় গ্যালারি কায়ায়।
এক মাস পর লন্ডনে যাব। আমি সেখানে নতুন। ডাক্তার রশী আমাকে লন্ডনে পৌঁছে দিলেন। শীতের রাত, ট্রেনে করে যাচ্ছি। সিট লম্বা করে শুয়ে আছি। বাইরে শুধু বরফ পড়ে সব ঢেকে আছে। তীব্র শীত। ট্রেন লন্ডনে এসে পৌঁছাল। সেখানে একটা হোটেলে উঠলাম ব্রিটিশ মিউজিয়াম এবং অন্য গ্যালারিগুলোর কাছাকাছি। ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি, প্রোর্ট্রেট গ্যালারি সবই হাঁটাদূরত্বে। খাওয়াদাওয়া করতাম হোটেলে। আমার কাছে অনেক টাকা। কারণ, আমার থেকে চিকিৎসার টাকা নেয়নি। আমি লন্ডনে চার মাসই থাকলাম। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গেছি বহুবার। গিয়ে দেখি বিরাট এক রুম। জানাল এ রকম ৭০টি রুম আছে, তুমি কয়টা দেখবা। প্রতিদিন যেতাম। এই আমার অভিজ্ঞতা হলো। পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় ঘটল। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সবই দেখেছি। ব্রিটিশ ভাস্কর্য, রোমান ভাস্কর্য, মিসরের ভাস্কর্য—সব সেখানে নিয়ে রেখেছে। সেখানে কয়েক শ মমি আছে। ভিক্টোরিয়া আলবার্ট মিউজিয়ামে গিয়েছি। সেখান এশিয়ার সব উপকরণ রাখা আছে। তারপর গেলাম ট্রেড গ্যালারি, সেটা আধুনিক গ্যালারি। কনটেম্পরারি আর্ট সংরক্ষিত আছে সেখানে। যাঁদের নিয়ে আমরা ছাত্রজীবনে পড়েছি, তাঁদের কাজ দেখেছি সেখানে। রোবেলসের ল্যান্ডস্কেপ। একটু এক্সপেরিমেন্টাল। একটা কাজ ছিল পুরো ক্যানভাস ডার্কে, তার মধ্যে সামান্য একটু লাইট। এগুলো দেখেছি। পরে আমি লন্ডনের বাইরেও গিয়েছি। সেক্সপিয়ারের বাড়িতে চলে গিয়েছি বাসে করে। সারা দিন ঘুরে আবার ফিরে এসেছি। লন্ডন শহরের মোড়ে মোড়ে ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য। কাজগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সুন্দর মেটালের ভাস্কর্য বসানো। রাস্তার মোড়ে আশপাশের ভবনের সঙ্গে সংগতি রেখে দীর্ঘস্থায়ী ভাস্কর্য করেছে। অনেক দিন থাকবে সেভাবেই করা হয়েছে। সেখানে আধুনিক ভাস্কর্য দেখিনি। সবই রিয়েলিস্টিক কাজ। লন্ডনে দেখেছি আধুনিক চিত্রকলা।
প্যারিস, ইতালিতে কি সেই সময়ই গিয়েছেন?
হামিদুজ্জামান খান : হ্যাঁ, সেই সময়েই। আধুনিক ভাস্কর্য দেখেছি প্যারিসে। ইংল্যান্ডে আসার আগে শিল্পী রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বললাম, আমি চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যাচ্ছি। তিনি বললেন, তুমি পারলে প্যারিস হয়ে আইসো। আমাকে ফোন নম্বর দিয়েছিলেন। আমার টিকিট ছিল লন্ডন-ঢাকা। ফ্লাইট ছিল ভোর পাঁচটায়। ঘুম থেকে উঠে দেখি ছয়টা বাজে। দ্রুত হিথরো বিমানবন্দরে গেলাম। যাওয়ার আগেই বিমান চলে গেছে। দেশে যাব কীভাবে, মহাবিপদ। এয়ারলাইনসের অফিসে গেলাম। টিকিট দেখানোর পরে বলল, কোনো অসুবিধা নেই। ইন্টারন্যাশনাল রোডে বিমান মিস হলে সমস্যা নেই। অন্য বিমানে নিয়ে যাবে। তোমাকে নতুন টিকিট করে দিচ্ছি। তখন আমি বললাম, আমি প্যারিস হয়ে যেতে পারব? বলল প্যারিসে ব্রেক করতে চাও? বললাম, সম্ভব হলে ইতালিতেও। আমাকে টিকিট করে দিল ১৫ দিন প্যারিসে, ১৫ দিন ইতালিতে। রশীদ চৌধুরীকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, তুমি এয়ারপোর্টে আসো, আমি প্যারিসে নাই। আমার শ্বশুর তোমাকে নিয়ে আসবে। তোমার কোনো চিন্তা করতে হবে না। উনিই তোমার সব ব্যবস্থা করে দেবে। প্যারিস এয়ারপোর্টে নেমে দেখি একজন হামিদুজ্জামান লেখা একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁকে পেয়ে আমার আর কোনো চিন্তা রইল না। কিন্তু সমস্যা হলো ভাষা। ওরা ইংরেজি বোঝে না। ইন্টারন্যাশনাল হলে আমাকে একটা রুম নিয়ে দিল, যেখানে বিদেশিরা এসে থাকে। একটা প্যারিসের গাইড বই দিলেন ইংরেজিতে লেখা। বলে দিলেন তুমি লুভর মিউজিয়ামে যেতে চাও দেখো চিহ্ন দেওয়া আছে। মেট্রোতে উঠবা লুভরের কথা বলবা, সেখানে নেমে যাবা। লুভরে যাওয়ার সময় পথে দেখি একটা প্রদর্শনী। কার—জিয়কোমিতির। বিশাল বিশাল অনেক কাজ। তাঁর লাইফটাইমের কাজ নিয়ে প্রদর্শনী। বড় আয়োজনে প্রদর্শনী। এটা দেখে আমি পাগল হয়ে গেছি। আমি তো তখন পেইন্টিং করি। জিয়াকোমিতির ভাস্কর্যের সঙ্গে পেইন্টিংও আছে। কালো কালো লাইন দিয়ে চমৎকার কাজ। স্পিরিচুয়াল, ফিগারগুলো লম্বা। সব কটি ভাস্কর্য ব্রোঞ্জের তৈরি। এই প্রথম আমি আধুনিক কাজের সঙ্গে পরিচিত হলাম। খুব ভালো লাগল। সেই প্রদর্শনী দেখে আমার খুব উপকার হয়েছিল।
এটা দেখে লুভর মিউজিয়ামে গিয়েছি। সেখানে গিয়ে ভেতরে বড় একটা রুমে বড় একটা ভাস্কর্য। গ্রিক দেবী ভেনাস ডি মেলো। এটা সমুদ্রের নিচ থেকে পাওয়া। লাইফ সাইজ থেকে একটু বড়। একটা স্টোনে খুবই যত্ন করে রাখা হয়েছে। এমন ভাবে রাখা হয়েছে, এটা না দেখে ভেতরে যাওয়া যাবে না। মোনালিসা দেখলাম। নরমাল, সবার সঙ্গে রাখা। আর্টিস্টদের বাড়িতে গিয়েছি। দেখেছি শিল্পীরা কীভাবে স্টুডিওতে কাজ করে।
সেখান থেকে ইতালি গিয়েছি। ইতালিতে নেমে দেখি অনেক ইন্ডিয়ান। আমাদের দেখে এক ইন্ডিয়ান বলে, তুমি কোথায় থেকে এসেছ। আমি ইংরেজিতেই বললাম। বলে, ও স্পিক ইংলিশ, আই এম ফ্রম ইন্ডিয়া। আমার সঙ্গে গল্প করা শুরু করল। যেতে যেতে একটা বারে নিয়ে গেল। আমি বিরক্ত হলাম। উড়ুজাহাজের অফিসে ফোন করে বললাম, আমার যাওয়ার সময়টা একটু এগিয়ে দিতে হবে। তারপরও আমি ঘুরে ঘুরে দেখেছি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিউজিয়াম রোমের সেনপিটারে। সেখানে গিয়েছি দুই দিন। শত শত ভাস্কর্য রাখা আছে সেখানে। সব কটি ভাস্কর্যই মার্বেলের তৈরি। আমি একটা ভাস্কর্যের নাম জানতাম। ‘লিকন অ্যান্ড হিজ সনস’ ভাস্কর্য। সেটার কথা বলতেই আমাকে হাতে ধরে নিয়ে সেটার সামনে দাঁড় করিয়েছে। দিস ইজ দ্য ‘লাওকিন অ্যান্ড হিজ সন্স’ ভাস্কর্য। সাপটাপ পেঁচিয়ে আছে। এটা আমাদের ইতিহাসের ক্লাসে পড়িয়েছে। সেটা দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি। এক আমেরিকানকে বললাম তুমি এখানে কতবার এসেছ। তিনি জবার দিলেন, এইবার নিয়ে ৯ বার। মাইকেলেঞ্জেলো ‘সিস্টিন চ্যাপেল’ দেখেছি। এটা দেখতে দুই–তিন দিন লাগে। বড় বড় বেঞ্চ আছে সেগুলোতে শুয়ে শুয়ে দেখতে হয়। অনেকে গ্যালারিতে গিয়ে শুয়ে থাকে। ওরা যত্নসহকারে এই কাজ স্থায়ীভাবে ধরে রেখেছে।
বাসে যাচ্ছি, দেখি বিল্ডিংয়ের উঁচুতে ভাস্কর্য। ওদের পিলার তো সুন্দর, গথিক নকশায় করা। ওপরে ফ্ল্যাট, ট্রায়াঙ্গেল আছে। সেটার সামনে ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য। তিনটা-চারটা ঘোড়া, ফিগারও আছে। এগুলো আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। পাঁচ–ছয় শ বছরের পুরোনো ভাস্কর্য এখনো টিকে আছে। এটা একটা উদাহরণ যে ভাস্কর্যগুলো বাইরে শত শত বছর টিকে থাকতে পারে।
ভাস্কর নভেরার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল?
হামিদুজ্জামান খান : আমি ঢাকায় এসে চারুকলায় ভর্তি হয়েছি ১৯৬২ সালে। ভাস্কর নভেরা কিন্তু ’৬০ সালে দেশ থেকে চলে গেছেন। ১৯৬০ সালের আগে পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে তাঁর ভাস্কর্য প্রদর্শনী হয়েছিল। সেই সময়ে মধুর ক্যানটিন ছিল পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে। আমাদের ছাত্রাবস্থায় দেখেছি অনেকগুলো ভাস্কর্য সেখানে পড়ে ছিল। কোনো যত্ন ছিল না। এগুলো যে ভাস্কর্য, তখন লোকে বুঝতই না। এগুলো আমরা দেখেছি। পরে যখন নভেরা একুশে পদক পেল, নাম হলো তখন নভেরার ভাস্কর্য খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেল। তাঁর কাজগুলো সিমেন্টে তৈরি করে তার ওপর হোয়াইট সিমেন্ট দিয়ে প্রলেপ দিয়েছে। ভেতরে রড দিয়ে নিয়েছিল। আমি যখন শিক্ষক হলাম তখন আমার ওপর দায়িত্ব পড়ল এগুলো সংরক্ষণের। গিয়ে দেখি অনেক ভাস্কর্য। অনেকগুলো ভেঙে যেতে শুরু করেছে, কিছু ফাটল ধরেছে। ছোট্ট ফাটলে পানি লেগে লেগে বড় হয়। এগুলো দেখে জাতীয় জাদুঘরের ডিজি শামসুজ্জামান খানকে জানালাম। আরও জানালাম, আপনারা রাজি হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এগুলো দিয়ে দেব। একটু ঠিকঠাক করে নিতে হবে। পরে এগুলো জাতীয় জাদুঘর নিয়ে এল। এখান থেকেই জাদুঘরের সংগ্রহ।
পরে পাবলিক লাইব্রেরি সিফট করে চলে এসেছে জাদুঘরের পাশে। তাদের একটা রুমে কাজগুলো ছিল। আমাকে বলেছে আপনি এগুলোকে একটু ঠিকঠাক করে দেন। আমি ২০–২৫টি কাজের বেজ বানিয়ে দিয়েছি। নভেরার একটা কাজ ফার্মগেটের কাছে মনিপুরিপাড়া একটা বাড়িতে ছিল। জাদুঘরের মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান অনেক যত্ন করে সেই কাজটা তুলে জাদুঘরে নিয়ে আসেন। এটা আমার চোখের সামনেই হয়েছে। এটা তো অনেক ভারী। এটা আনতে গিয়ে কিছু ড্যামেজ হয়েছে। জাদুঘরের বাইরে যে ভাস্কর্যটা আছে, সেটা কিন্তু রেপ্লিকা। মূল ভাস্কর্যটা ভাঙা অবস্থায় জাদুঘরেই রক্ষিত আছে।
আপনি ভারতের বরোদায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন ভাস্কর্য নিয়ে?
হামিদুজ্জামান খান : হ্যাঁ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতে স্কলারশিপ শুরুর হলো। আবেদিন স্যার বললেন, স্কলারশিপ নিয়ে ভারত থেকে মাস্টার্স করে আসো। স্কলারশিপের ইন্টারভিউ দিতে গেছি সচিবালয়ে। সেখানে গিয়ে দেখি আবেদিন স্যার চলে যাচ্ছেন। আমি বললাম, স্যার আপনি চলে যাচ্ছেন, ইন্টারভিউ কে নেবে? তিনি বললেন, আমি লিখে দিয়ে এসেছি। যারা যাবে তারা তো আমারই ছাত্র। কে কে যাওয়ার যোগ্য আমি জানি। এই হচ্ছে জয়নুল আবেদিন। তিনি বললেন, আমি যা সাইন করছি, সেটা কেউ কাটতে পারবে না। তুমি গিয়ে শুটকেস রেডি করো। সেখান থেকে মাস্টার্স করে আসবা। আরেকটা কথা বললেন, তুমি ইন্ডিয়া গেলে মীরা মুখার্জির সঙ্গে দেখা করবা। ইন্ডিয়ার নামকরা ভাস্কর। তারপর আমি ইন্ডিয়া গেলাম। বরোদায় দুই বছরের মাস্টার্স সম্পন্ন করলাম ১৯৭৪ সালে। দেশে ফিরে আসলাম। তখন আবেদিন স্যার মারা গেছেন। বরোদা ভারতের উন্নত এলাকা। আধুনিক লাইব্রেরি। বিশাল স্টুডিও। ওয়ার্কশপ লেগেই থাকে। আমাদের প্রথমে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিয়েছে। পরে যার যার পথ বের করে নিতে বলেছে। বরোদায় থাকার সময় বড় একটা ঘটনা ঘটেছে। ওদের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটা প্রদর্শনী হয়। আমি ভাগ্যবান সে প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছি। সেখানে আমার তিনটা কাজ নির্বাচিত হয়। প্রদর্শনীটা হয়েছে মুম্বাইয়ে। আমি যাইনি সেখানে। পরে গ্যালারি থেকে আমাকে ফোন করে বলে, তুমি এসো, মকবুল ফিদা হুসেন তোমার কাজ খুব পছন্দ করেছেন। হুসেন তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান। আমি যাওয়ার পর হুসেনকে খবর দেওয়া হলো। ক্যানটিনে বসে অনেক গল্প করলাম হুসেনের সঙ্গে। আমি বললাম, আমার কাজ আপনার পছন্দ হলো কেন? আমার কাজটা ছিল একটা ফিগার নিচে শুইয়ে দেওয়া। তিনি বললেন, তুমি যে ভাস্কর্য ভূমিতে শুইয়ে দিয়েছ, এটাই ছিল ব্যতিক্রম। এখনো এখানে ভাস্কর্য নিচে ফেলে দেয়নি কেউ। তুমি এই উপমহাদেশের ধারা ভেঙেছ। ভাস্কর্য ভূমিতে ফেলে দেওয়া, এ ধরনের উপস্থাপনা এখানে নতুন। আমার খুব প্রশংসা করলেন। সেই প্রদর্শনী চলাকালে পত্রপত্রিকায় আমার ভাস্কর্য নিয়ে লেখালেখি হয়েছিল। আমার আত্মবিশ্বাস বাড়ল। বরোদায় আমি অনেক কাজ করেছি। এ সময় ভাস্কর্যকে ধারণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। শিক্ষকেরাও উৎসাহ দিতেন।
বহিরাঙ্গন ভাস্কর্য গড়ার কাজ শুরু করলেন কখন?
হামিদুজ্জামান খান : ১৯৮১ সালে আমি একটা বড় কাজ করলাম বহিরাঙ্গনে মেজর আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর আয়োজনে। সিলেট ক্যান্টনমেন্টে সে কাজটি বসানো হয়। ‘হামলা’ নামের এই ভাস্কর্যটি ব্রোঞ্জ কাস্টিংয়ে করা। এই কাজের পরই বঙ্গভবনের কাজটা পাই। বঙ্গভবনের সামনে একটা ঝরনার মধ্যে একটা ভাস্কর্য করতে হবে। বাংলাদেশের কোনো একটা বিষয় হতে পারে। আমি একটা পাখির পরিবার ভাস্কর্যের মডেল দিলাম। বললাম, এটা বক। এটাও ব্রোঞ্জে করা হবে। ব্রোঞ্জের পাইপ-সিট দিয়ে করলাম। এটা অনেক সময় নিয়ে অনেক যত্ন করে করেছি। ইঞ্জিনিয়াররা খুব সহায়তা করেছে। আমি যখন কাজ শেষ করলাম তখন দেখি কেউ পছন্দ করে না। মন্ত্রীরা এসে বলেন, কী বানিয়েছেন এটা। চিফ ইঞ্জিনিয়ার আমাকে বলে, হামিদ ভাই এটা মনে হয় রাখা যাচ্ছে না, কেউ পছন্দ করছে না। আমি রাগে চেক আনতে যাইনি। মন–কষাকষির মধ্যেই ভাস্কর্যটির উদ্বোধন হলো। উদ্বোধনের দিন ঝরনা, লাইট ছাড়া হলো। বিদেশিরাও সেখানে যোগ দিয়েছিলেন। বিদেশিরা বলছিল, এত সুন্দর ভাস্কর্য! আধুনিক ভাস্কর্য। তখন ভাস্কর্যটি ভাঙার হাত থেকে রক্ষা পেল। পরে বঙ্গভবন কর্তৃপক্ষ আমাকে দাওয়াত করে খাইয়ে কাজের খুব প্রশংসা করেছিল। সেদিনই শেষ চেকটি দিয়েছিল।
সংশপ্তক করলেন কত সালে?
হামিদুজ্জামান খান : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশপ্তক ভাস্কর্যটি নির্মাণ করি ১৯৯০ সালে। এখানে আমি দেখেছি মুক্তিযুদ্ধ মানে একটি স্পিরিট, মুক্তিযুদ্ধ মানে শক্তি। অনেক দুর্বল মানুষও দেশের জন্য এই শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বড় কাজ করেছে। শক্তির সিম্বল হচ্ছে গতি। এই গতিই আমাদের অনুপ্রাণিত করে। আমি যখন এই কাজটি করি তখন মানুষের অবয়ব ছাড়া কাজ করা সহজ ছিল না। আমি তাদের বোঝাতে পেরেছি, আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটাই চাই। সেই চেতনাটা একটা গতির মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছি। কেউ বলতে পারে, হাত নাই, পা নাই, এটা কেমন কাজ। আমি বলব এখানে গতিটা আছে। এটা তখন নতুন মিডিয়ায় তৈরি করেছি। ভেতরে এঙ্গেলের স্টাকচার। ওপরে ব্রোঞ্জসিট দিয়ে ওয়েল্ডিং করা। বেজসহ উচ্চতা ২৮ ফুট। তখন তো এত বড় কাজ করার মতো জায়গা ছিল না। চারুকলা ইনস্টিটিউটে কাজটা সম্পন্ন করা হয়েছে। পরে সেটা ক্রেন দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে সেখানে বসাতে হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ভবনের সামনে বসানো হলো। সেই সময় আমি একটা অনুরোধ করেছিলাম, এটাতে যেন পোস্টার না লাগায়। সে ধারা এখনো অব্যাহত রেখেছে। এটা একটা আধা বিমূর্ত কাজ। আমি ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কাজটা করেছি। ভাস্কর্য যুগের পর যুগ টিকে থাকবে। ৫০–১০০ বছর পরও যেন মনে হয় এটা আধুনিক। সে চিন্তা মাথায় রেখে এই কাজটি করা হয়েছিল।
আমেরিকায় গিয়েছিলেন কত সালে?
হামিদুজ্জামান খান : বঙ্গভবনের কাজের অনেক টাকা পেলাম। এই টাকা পেয়ে আমি ভাবলাম আমেরিকায় ঘুরে আসি। মডার্ন কাজ দেখে আসি। ওখানে একটা ওয়ার্কশপ ছিল। তাদের লিখলাম, আমি আসতে চাই। ওরা আমাকে আমন্ত্রণ জানাল। ভিসাও পেয়ে গেলাম। নিউইয়র্কে গিয়ে ভিসা পেয়ে গেলাম চার মাসের। আমি তো অত টাকা নিয়ে যাইনি। ভাবলাম কোনো জায়গায় বসে একটু কাজ করব। একটা দোকানে গেলাম যেখানে ভাস্কর্যের টুলস বিক্রি করে। শুধু ভাস্কর্যের যন্ত্রপাতি। খুব সুন্দর দোকান। প্রায়ই আমি সে দোকানে যেতাম, ভালো লাগত। একদিন আমি বললাম একটা বাটালি কিনব। বাটালি চাইলাম। বলল, তুমি হাতের মাপ দিয়ে যাও, তিন দিন পর এসে বাটালি নিয়ে যেয়ো। তোমার মোটাও চলবে না, আবার চিকন হলেও চলবে না। তোমার হাতের গ্রিপ অনুযায়ী হতে হবে। তা না হলে ভালোমতো কাজ করতে পারবে না। মালিক বলল, তুমি বহন করতে পারো, এমন যন্ত্রপাতি কিনতে হবে। এখানে তোমাকেই সব বহন করতে হবে। আমি বললাম, আমি একটা স্কুল খুঁজতেছি, যেখানে বসে আমি আমি কাজ করতে পারব। স্কাল্পচার সেন্টার নামের একটা স্কুলের ঠিকানা দিয়ে দিল। নিউইয়র্কে এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে বসে কাজ করা যায়। আমি স্কাল্পচার সেন্টার খুঁজে বের করলাম। পুরোনো একটা বিল্ডিং, একটা লোক হাফপ্যান্ট পরা পাইপ হাতে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। আমি নিচে গিয়ে দেখি একটা ভাস্কর্য গ্যালারি। এক মহিলা বসা। তাকে বললাম, আমি জেরির সঙ্গে দেখা করতে চাই। সে বলল, এখন উনি কাজ করছে, তুমি একটু পরে আসো। আমি তোমার কথা বলে রাখব। একটু পরে আবার এলাম। তার রুমে গিয়ে পরিচয় দিলাম, আমি বাংলাদেশ থেকে আসছি। তোমার এখানে বসে কাজ করতে চাই। যখন বলছি আমি শিক্ষক, তখন একটু গুরুত্ব দিল। বলল, তুমি পাঁচটা স্লাইট নিয়ে কালকে আসো। আমি তখন বঙ্গভবনের কাজটাজ করছি। পরের দিন স্লাইড নিয়ে গেলাম। বলল, তুমি সাত দিন পর আসো। সাত দিন পর গিয়ে দেখি একটা চিঠি। হাতে লেখা একটা চিঠি, তোমাকে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হলো। এখানে তোমাকে কিছু কাজ করতে হবে। স্টুডিও দেখাশোনা করতে হবে। স্টুডিও বন্ধ হওয়ার আগপর্যন্ত থাকতে হবে। কে কী করল, তা দেখাশোনা করতে হবে। ফাইনালি তোমাকে স্টুডিও বন্ধ করতে হবে। আমাদের এখানে এক বছরে এক হাজার ডলার লাগে, সেটা তোমাকে দিতে হবে না। আমি অনেক খুশি হলাম। পরের দিন থেকে আসা শুরু করলাম। আমার ভিসা মাত্র চার মাসের।
আমি জানি না কীভাবে টাকা জোগাড় করব। কাজ শুরু করলাম। ১৫ দিনের মধ্যেই এই কাজটা হয়ে গেল। এক দিন এক মহিলা এসে বলে, তুমি হামিদুজ্জামান। আমি বোকা হয়ে গেছি। মহিলা আমার নাম জানে কী করে? বললাম, কোথা থেকে এসেছ তুমি। বলল, আমি ওয়াশিংটন থেকে তোমার কাছে আসছি। আমি আমেরিকায় এসেই এশিয়ান কালচারাল সেন্টারে গিয়ে কিছু ক্যাটালগ দিয়ে এসেছিলাম। বঙ্গভবনের ভাস্কর্যের ক্যাটালগ। ওইটা তার হাতে। বলল, আমরা তোমার কাজ কিনতে চাই বিশ্বব্যাংকের জন্য। জুরিবোর্ড যদি তোমার কাজ পছন্দ করে তবে তোমার কাজ কিনবে। আমি তো বাংলাদেশ থেকে আসছি, এখানে আমার কোনো ভাস্কর্য নেই। আমি কিছু ছবি এঁকেছি, ড্রয়িং করেছি। সেসব নিয়ে যেতে পারো। কালকে এসো দিয়ে দেব। সে বলল, আজকেই চাই। আমি আজকেই চলে যাব, যা দেবে নিয়ে আসো। আমি গিয়ে কিছু নিয়ে এলাম। পাঁচ–ছয়টা ড্রয়িং বেছে নিয়ে গেল। তিন–চার দিন পর আমাকে ফোন দিল, তোমার কাজ নির্বাচিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকে ড্রয়িংগুলো ঝোলাবে। তোমাকে আমরা ডাকব এবং সে সময়ই তোমার চেকটা দেব। বিশ্বব্যাংক থেকে পেয়েছি অনেক ডলার। বিশ্বব্যাংকের চেক দেখে সেখানের ব্যাংক আমাকে অ্যাকাউন্ট খুলে দিল। একদিন বিশ্বব্যাংক আমাকে ডাকল। এম্বাসির সঙ্গে একটা যোগাযোগ হলো। এখানে আমি মেটালে ছোট ছোট কাজ করেছি। আমার অনেক কাজ জমে যাওয়ার পর এম্বাসিকে বললাম, তোমরা আমার ভাস্কর্যের একটা প্রদর্শনী করে দাও। ওয়াশিংটনে এক সপ্তাহের একটা প্রদর্শনী হলো। মেটালের সেসব কাজ বস্তায় ভরে নিউইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটনে নিয়ে গেছি। আমি ১৫ মাস ছিলাম আমেরিকায়। তখন চারুকলায় আমার চাকরি আছে কি নেই, আমি জানি না। আসার পর দেখি চাকরি নেই। দরখাস্ত করলাম। বললাম, আমি তো আমেরিকার স্কাল্পচার সেন্টারে পড়াশোনা করেছি, কাজ করেছি ভাস্কর্যের ওপর। সেখানের সার্টিফিকেট দেখালাম। সেসব দেখে ১৯৮৩ সালে চাকরিটা ফিরে পেলাম।
দীর্ঘ জীবনে কতগুলো ভাস্কর্য করেছেন?
হামিদুজ্জামান খান : এই হিসাব তো বলতে পারব না। অনেক অনেক কাজ করেছি। শত শত ছোট ভাস্কর্য বানিয়েছি, সেগুলো রয়েছে মানুষের ঘরে। তবে বলতে পারি বহিরাঙ্গন ভাস্কর্যই হবে তিন শ–র ওপরে। আমি ব্রোঞ্জ, লোহা, স্টিল, পাথর এবং কোথাও কোথাও সিমেন্ট ব্যবহার করেছি।
শিল্পী ও ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান কাজ করেছেন শিল্পকলার প্রায় সব মাধ্যম নিয়ে। অসামান্য কাজ করেছেন তিনি ভাস্কর্যে। জলরং, তেলরং, অ্যাক্রিলিক, স্কেচ—সব মাধ্যমে কাজ করেছেন সমানতালে। হামিদুজ্জামান খান ১৯৪৬ সালের ১৬ মার্চ বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার সহশ্রাম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সায়েমউদ্দিন খান হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক, মা রাবেয়া খাতুন ছিলেন গৃহিণী। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। হামিদুজ্জামান ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশ কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস (বর্তমান চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে চারুকলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটসে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন শিল্পী হামিদুজ্জামান খান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হামিদ পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রশ্নের সম্মুখীন হলেও ছাড়া পান। ২৭ মার্চ ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায় হামিদুজ্জামান অসংখ্য মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। যুদ্ধের নৃশংসতা এবং বাঙালিদের অভাবনীয় দুর্দশা হামিদকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। তাঁর গড়া ভাস্কর্যের বেশির ভাগই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ভিত্তি করে।
১৯৭৬ সালে বরোদা মহারাজা সায়াজিরাও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। সে বছরই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত প্রথম ‘জাতীয় ভাস্কর্য প্রদর্শনী’-তে শ্রেষ্ঠ ভাস্করের পুরস্কার লাভ করেন। একই বছর শিল্পী ও ভাস্কর আইভি জামানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৮১ সালে বঙ্গভবনে ‘পাখি পরিবার’ শীর্ষক ভাস্কর্য এবং সিলেটের জালালাবাদ সেনানিবাসে ‘হামলা’ শিরোনামে ভাস্কর্য স্থাপন করেন। ১৯৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ গ্যালারিতে প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮২-৮৩ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের স্কাল্পচার সেন্টার স্কুল থেকে মেটাল কাস্টিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৮৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল অলিম্পিক পার্কে স্থায়ীভাবে ‘স্টেপস’ শিরোনামে ভাস্কর্য স্থাপন করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে সার কারখানায় ‘জাগ্রত বাংলা’, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সংশপ্তক’, ঢাকা সেনানিবাসে ‘বিজয়কেতন’, মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন প্রাঙ্গণে ‘ইউনিটি’, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে ‘ফ্রিডম’, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘স্বাধীনতা চিরন্তন’, আগারগাঁওয়ে সরকারি কর্মকমিশন প্রাঙ্গণে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’, মাদারীপুরে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ হামিদুজ্জামান খানের অন্যতম বহিরাঙ্গন ভাস্কর্য। ২০১৮ সালে গাজীপুরের কড্ডায় সামিট পাওয়ারপ্লান্টে হামিদুজ্জামানের কর্মজীবন ও তাঁর শিল্পসাধনার প্রতি সম্মান জানিয়ে ‘হামিদুজ্জামান ভাস্কর্য পার্ক’ নামে একটি ভাস্কর্য উদ্যান প্রতিষ্ঠিত হয়। ১০০টি ভাস্কর্য নিয়ে গড়ে উঠেছে ভাস্কর্য পার্কটি। দিন দিন সেখানের ভাস্কর্যসংখ্যা বেড়েই চলেছে। এরই মধ্যে তিনি একক প্রদর্শনী করেছেন ৪৭টি।
হামিদুজ্জামান বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত প্রথম ‘জাতীয় ভাস্কর্য প্রদর্শনী’তে শ্রেষ্ঠ ভাস্করের পুরস্কার লাভ করেন ১৯৭৬ সালে। তিনি ২০০৬ সালে শিল্পকলায় অবদানের জন্য একুশে পদক লাভ করেন। ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি ফেলো নির্বাচিত হন।