শিল্পী সুনীল কুমারের একক চিত্র প্রদর্শনী ‘বিশ্বপথের মগ্নতা’
শিল্পী সুনীল কুমারের একক চিত্র প্রদর্শনী ‘বিশ্বপথের মগ্নতা’

প্রদর্শনী

‘বিশ্বপথের মগ্নতা’: দুঃখ ও আশার দ্বন্দ্ব

জীবনের পথ কখনোই মসৃণ নয়। অঘটন, বৈষম্য আর প্রতিবন্ধকতার প্রাচীর পেরিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হয়। পথে ফুল বিছানো থাকে না, বরং সংগ্রামের ঘামে ও অশ্রুতে সেই ফুল নিজের হাতে বিছিয়ে নিতে হয়। ঢাকাস্থ ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ‘আর্ট গ্যালারি’তে চলমান শিল্পী সুনীল কুমারের ‘বিশ্বপথের মগ্নতা’ শীর্ষক চিত্র প্রদর্শনী এই জীবনেরই দার্শনিক রূপকথা।

অন্তরালের কাব্য, শিল্পী সুনীল কুমার

তেলরং, জলরং, প্যাস্টেল, কাঠকয়লা, কালি-কলম ও পেনসিলে অঙ্কিত খণ্ডিত দেহরেখা, অসম্পূর্ণ মুখচ্ছবি, ছেঁড়া টেপে জোড়া লাগানো আকার কিংবা নাট-বল্টু-স্ক্রুর প্রতীকী উপস্থিতি সুনীলের শিল্পভাষার স্বকীয়তা নির্মাণ করেছে। তাঁর ক্যানভাসে রং যেমন প্রগাঢ়, তেমনি বিষণ্ন; নেপথ্যের ছায়ামূর্তি যেন অনিশ্চিত বাস্তবতার ভৌতিক ইঙ্গিত। প্রতিটি রেখা ও প্রতীক শিল্পীর ব্যক্তিজীবনের প্রতিকূলতা আর তার বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াইয়ের দলিল। নাট-বল্টু-স্ক্রু তাই শুধু যান্ত্রিক উপাদান নয়, বরং প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধের জোড়াতালি দিয়ে টিকে থাকারও আর্তি।

দেবী দূর্গা, শিল্পী সুনীল কুমার

এই শিল্পভাষায় নারী অবয়ব এসেছে বহুরূপে—কখনো মা, কখনো দেবী, কখনো কন্যা, কখনো আবার প্রেমিকা। সেইসব রূপান্তরিত নারীচিত্র যেন সমাজের বৈষম্য ও সংগ্রামের প্রতীক। ‘মাতৃবৃক্ষ’, ‘মা ও শিশু’, ‘শিকড় থেকে উঠে আসা নারী’ প্রভৃতি ক্যানভাসে ধরা পড়েছে মানবতার বহুমাত্রিক মুখচ্ছবি। আর ‘বিশেষ কারোর জন্য অপেক্ষা’ ছবিতে গর্ভবতী মায়ের নিঃশব্দ প্রতীক্ষা—যেখানে আশার দীপ্তি ও মাতৃত্বের বেদনা পাশাপাশি ভেসে ওঠে।

অন্তরালের উপাখ্যান, শিল্পী সুনীল কুমার

সুনীলের কাজে আধুনিক জীবনের যান্ত্রিক নির্ভরতা প্রতীকী হয়ে ওঠে নাট-বল্টু বা ধাতব উপাদানে। এগুলো কি কেবল প্রযুক্তির রূপক? নাকি জীবনের হঠাৎ অচলাবস্থা ও অদৃশ্য প্রতিবন্ধকের প্রতিচ্ছবি? এই প্রশ্নই ক্যানভাসে জেগে থাকে। গাঢ় রং, বৈপরীত্যপূর্ণ শেড আর অচেনা মুখাবয়বের রহস্যময় দৃষ্টি মিলে তৈরি করে এক গভীর বেদনার সুর। কিন্তু সেই সুরের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে পুনর্গঠনের আশা—অদম্য টিকে থাকার বিশ্বাস।

গফুর ও মহেশ, শিল্পী সুনীল কুমার

সুনীলের চিত্রকর্মে সাহিত্য ও পৌরাণিকতার বয়ানও সৃজনশীলভাবে মিশে গেছে। শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ অবলম্বনে ‘মহেশ ও গফুর’ চিত্রে ধরা পড়েছে দারিদ্র্য ও অবিচারে জর্জরিত গ্রামীণ জীবনের নির্মম অথচ মানবিক সত্য। অন্যদিকে তেলরঙে অঙ্কিত ‘দেবী দুর্গা’ চিত্রে দেবীর হাতে খড়্‌গের পরিবর্তে দেখা যায় তুলি, অস্ত্রের বদলে রঙের প্লেট কিংবা কলম—যেন সমাজের অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শিল্পকেই হাতিয়ার বানানোর অঙ্গীকার।

মায়ের কোলে শিশু, শিল্পী সুনীল কুমার

অশুভ শক্তির সেই ইঙ্গিত আরও স্পষ্ট ‘অন্তরালের কাব্য’ বা ‘অন্তরালের উপাখ্যান’ ছবিতে—যেখানে মুখোশ, কাক, ভয়াল চেহারা আর ঊর্ধ্বমুখী চারা গাছ দর্শককে টেনে নিয়ে যায় বহুস্তরীয় কাহিনির জগতে। যদিও গ্যালারির পরিসরের তুলনায় কাজের আধিক্য দর্শককে খানিকটা ক্লান্ত করতে পারে, আর মুখাবয়বের পুনরাবৃত্তি কখনো শিল্পরসকে ম্লান করে। তবু এই সীমাবদ্ধতা ছাপিয়ে যায় শিল্পীর সৃজনশীলতার আন্তরিকতা।

চাঁদ ও রমণী, শিল্পী সুনীল কুমার

‘বিশ্বপথের মগ্নতা’ তাই কেবল একটি প্রদর্শনী নয়, এক অন্তহীন যাত্রা। যেখানে শিল্পী তাঁর খণ্ডিত অভিজ্ঞতা দর্শকের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন, আর দর্শক সেই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে নিজের জীবনকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পারেন। এখানে যেমন আছে দুঃখের দীর্ঘ অনুরণন, তেমনি জ্বলজ্বলে আশার দীপ্তিও।

গুলশানের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আর্ট গ্যালারিতে ১৮ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী চলবে ১ অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত।