ছবি ও গ্রাফিকস: প্রথম আলো
ছবি ও গ্রাফিকস: প্রথম আলো

প্রদর্শনী

অম্লমধুর শিশির

আকাশ আর পাতাল বোঝানোর জন্য কোনো সীমানা নেই। নিরালম্ব, বায়ুভূত শূন্যে সচল এই সব ইমেজ যেন কোনো জাদুকরি চালে চলমান কিংবা অদৃশ্য শক্তির মায়াজালে বন্দী। শিশির ভট্টাচার্য্যের সৃজন-চৈতন্য এইভাবে ত্রিশঙ্কু অবস্থান থেকে পর্যবেক্ষণ করে মানুষ, প্রকৃতি এবং সর্বোপরি সময়ের নেতির লীলা। কোন বোধ বা রসের বিচারে শিশিরের ছবির বিশ্লেষণ যথার্থ হবে, তা নিশ্চিত হিসেবে বলা সম্ভব নয়, তবে এ কথা দর্শকমাত্রই অনুধাবন করবেন যে শিল্পীর নয়ন-সুখকর ললিত সচল কালো রেখার ইমেজের অন্তরালে রয়েছে এই নেতিবাচক সময়ের সার্কাসি বয়ান। কোথাও পরিপ্রেক্ষিতের ইশারা নেই, নেই আগে-পিছের, ওপরে-নিচের হিসাব। বায়ুভূত কিংবা জলজ হাইড্রার মতো ভাসমান এই সব ইমেজ স্বয়ং চালে স্পেসে আবির্ভূত হয়ে ভয়াল সুন্দর প্রেতায়িত আবেশ তৈরি করে। প্রথমত, আমরা কী সুন্দর বলে বিমোহিত হই। বিমুগ্ধ নয়নে দেখি মানুষের মুখ, নারীর সুনয়ন ও কল্লোলিত চুল, সুডৌল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, দেখি নিসর্গের ডালপালা ও পত্রালির বিচিত্র বিকাশ। কিন্তু কোনো ইমেজই স্থির, সার্বভৌম ও স্বাধীন নয়, একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িয়ে আছে। মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, পল্লবিত নিসর্গের ডালপালা এবং মানুষের ব্যবহৃত তৈজসপত্র, হাতিয়ার ও মারণাস্ত্র নিখুঁত ড্রয়িংয়ের মাহাত্ম্যে পরস্পরিত হয়ে অভূতপূর্ব জৈবিক গড়নে উত্তীর্ণ হয়েছে।

শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্যের রেখাচিত্র

শিশিরের সৃজনী সত্তা উল্লিখিত রূপান্তরশীলতায় বিশেষভাবে আস্থা খুঁজে পেয়েছে। সত্তান্তর, রূপান্তর বা মেটামরফসিস তাঁর চিত্রতলে নিয়ত সচল। তাই মানুষের মুখ ক্রমবিবর্তনশীলতায় মাছের অবয়ব পায়, আবার সেই অবয়ব বৃক্ষের ডালপালার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে থাকে। পরিণামে আর বোঝা যায় না কে কাকে জন্ম দিচ্ছে অর্থাৎ কোন ইমেজকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত হচ্ছে আরেক ইমেজ। বৃক্ষ-মানব, মৎস্যকন্যা এই সব পরিচিত আইডিয়া যে শিল্পীর সৃজনভাবনায় কালের পীড়ন ও পরিহাস ব্যাখ্যা করার জন্য আরও কত বিচিত্রগামী হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত শিশির ভট্টাচার্য্যের শিল্পকর্ম। এই শিল্পী রূপকথায় বা প্রচলিত পৌরাণিক কোনো বিষয়ের রূপায়ণে আকর্ষণ বোধ করেননি। তবু বিভিন্ন প্রাণীর সমবায়ে যেসব নতুন জৈবিক বা অর্গানিক ফরম আমরা শিল্পীর কাজে দেখতে পাই, তা এই কালেরই অভিজ্ঞতার নির্যাস থেকে সৃষ্ট বিশেষ পৌরাণিক প্রতিমা। এসব কালের পুরাণ হিসেবে আখ্যায়িত হতে পারে। কখনো জাদুকরের মতো বিস্ময়কর বিনোদনও শিশিরের প্রিয়। ছিল রুমাল হয়ে গেল কবুতর, ছিল দড়ি হয়ে গেল সাপ, এই সব জাদুকরি ভোজবাজি বা হাতসাফাইয়ের মতো মনোভঙ্গি নিয়েও শিশির ছবি এঁকেছেন। অনেকটা ‘এলিস ইন দ্য ওয়ান্ডারল্যান্ড’ অথবা ‘হযবরল’-র মতো বিষয় রূপায়ণের আহ্লাদও তাঁর কোনো কোনো ছবিতে সরল ভাষ্য পেয়েছে। অনেক সময় শিশির শুধু সৃজনের খেয়ালে আপাতদৃষ্টে পরস্পর সম্পর্কহীন বিষয়কে ঐক্যবদ্ধ করে বিষমীভবনের খেলা খেলেছেন। যেমন মানুষী অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গড়নকে ব্যাখ্যা করেছেন মেশিনের কলকবজার নির্মাণ জ্যামিতিতে।

মানুষ ও প্রাণিকুলের এই চলমানতা আর নিসর্গের বিরামহীন পল্লবগ্রাহিতার মধ্যেই ওত পেতে আছে আততায়ী। তাই শিশিরের ছবিতে পরিবেশিত হয় মানুষের কাটা মুণ্ডু—একটু নিবিষ্ট চোখে তাকালে খুঁজে পাওয়া যায় আততায়ীর ক্ষুর। সেই ক্ষুরে কর্তিত মানুষের অজস্র অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। শিশিরের ছবি গোয়েন্দা-চোখে নিরীক্ষণ করতে হয়। নজরে নিতে হয় সমস্ত আলামত। এভাবে দর্শককে যেন নিতে হয় ময়নাতদন্তের দায়। শিশিরের মানুষি ইমেজগুলো নেতিপীড়িত নৃশংস কালের সাক্ষী। শিকার ও শিকারিকে তিনি ক্যানভাসের সাদা জমিনে কালো রেখার স্পষ্টতায় প্রকাশ করেছেন। সেখানে কোনো কোনো মানুষ অবয়বে রয়েছে বিমূঢ় অভিব্যক্তি। তাই শুধু শিকার ও শিকারি নয়, নিরীহ বেদনাবিদ্ধ দর্শকও শিশিরের নিঠুর তামসিক কালের বয়ানের কুশীলব।

শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্যের রেখাচিত্র

জলাধারের তরঙ্গমুখরতা, বিচিত্র দিকে প্রসারিত নিসর্গ, মানবসৃষ্ট সরঞ্জাম ও মারণাস্ত্র এবং প্রাণিকুল কালো রেখার বিচিত্র গতির প্রয়োগে শনাক্ত করে শিশির ঘটমান বর্তমান কালকে মেধাবী কম্পোজিশনে নির্মাণ করেছেন। তাঁর ছবি নিবিড় পাঠে এই উপলব্ধি হয় যে ইমেজ সৃষ্টিতে সত্তান্তর বা রূপান্তর প্রক্রিয়ার প্রতি তাঁর আসক্তি সবচেয়ে প্রবল। মানুষের ভেতরে পশু আছে, পশুর ভেতরে আছে মানবিকতা—হয়তো এই দ্বিবিধ বোধের আলোড়ন থেকে এই ইমেজের মালা গেঁথেছেন শিল্পী। এ ছাড়া নিসর্গ ও প্রাণিকুলের বিচিত্র গতিপ্রকৃতি নিবিড়ভাবে পাঠ করেছেন শিল্পী। তাঁর ছবি দেখলেই কথা সহজেই বোঝা যায়। বস্তুত মনুষ্য প্রকৃতি অনুধাবনের জন্যই শিল্পীর এই অভিনিবেশ।

শিশিরের ছবির জমিনে চতুর্দিক থেকে ইমেজের আবির্ভাব ঘটে। এই লক্ষণ পটচিত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়। শিশিরের কম্পোজিশনের সঙ্গে লোকশিল্পের সম্পর্ক খুব দূরের নয়। অনেক লোকচিত্রে চতুর্দিক থেকেই ছবি আঁকা হয়। সরাচিত্র, ব্রতচিত্র ও আলপনা আঁকার ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়ে থাকে। লোকচিত্রের সরল প্রবহমান রেখা বিশেষ প্রকৃতি লাভ করেছিল কালীঘাট পটচিত্রে। এই পটচিত্রের রেখা অংশত অবনীন্দ্রনাথ, ব্যাপকভাবে যামিনী রায় ও কামরুল হাসান ব্যবহার করেছেন। এ রেখার বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়েছেন ও নিজের ছবিতেও প্রয়োগ করেছেন নন্দলাল বসু। শিশিরের চিত্রপটে সেই পটরেখা বিশেষ মেধাবী মাত্রা পেয়েছে। এই রেখা শিশিরের প্রয়োজন হয়েছে ইমেজের মেটামরফিক বয়ান তৈরির জন্য।

শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্যের রেখাচিত্র

রেখার গতিশীলতার আশ্রয়ে নিসর্গ, পশুপাখি, মানুষ ও অন্য আরও জড়বস্তুকে অভিন্ন পরিসরে আবাসিত করার জন্য। তবে এই খেলাটা অভূতপূর্ব বিচক্ষণতায় কামরুল হাসান শুরু করেছিলেন। তাঁর ছবিতে হনুমানের লেজ হয়ে গিয়েছিল সাপ এবং এমন আরও অনেক মেটামরফসিস আমরা দেখেছি কামরুলের ছবিতে। এই শিল্পী দুষ্ট শাসকের নিষ্ঠুর কালের দুঃসাহসী সমালোচক এবং শিশিরও তা-ই। কামরুল হাসান ও শিশির ভট্টাচার্য্যের স্বকালসচেতনতা নিয়ে এবং দুই কালের এই দুই শিল্পীর কাজের সঙ্গে লোককলার সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে অভিসন্দর্ভ রচনার তাগিদ সংগত।

প্রদর্শনীর আয়োজন করে লালমাটিয়ার কলাকেন্দ্র গ্যালারি। শেষ হয় ২৭ সেপ্টেম্বর।