
বরেণ্য ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী হামিদুজ্জামান খান ২০ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে নিয়ে এ আয়োজন
যে সম্পর্কের জাল থেকে হঠাৎ মুক্ত হয়ে ভাস্কর ও আঁকিয়ে হামিদুজ্জামান খান ইহলোক ত্যাগ করে চলে গেলেন, সেই বলয়ের মানুষ হিসেবে তাঁর ওপর নিরপেক্ষ দৃষ্টি ফেলা কঠিন। সরাসরি শিক্ষক হিসেবে পরিচয়ের এক সুনির্দিষ্ট মাত্রায় তিনি হাজির ছিলেন। অনেক পরে, শিল্পীজীবনে যখন তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত, তাঁর শিশুসুলভ কোমলতা ও বদান্যতার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে তাঁর গাজীপুরের ভাস্কর্যবাগান পরিদর্শন, তাঁর কাজের ওপর লেখার অভিজ্ঞতা, সর্বোপরি বেঙ্গল গ্যালারিতে তাঁর শেষ প্রদর্শনীসহ কয়েকটি বিশেষ প্রদর্শনীর কিউরেটর হিসেবে কাজ করা—সবই তাঁকে শিল্পী ও মানুষ হিসেবে নতুন করে চিনতে সাহায্য করেছে। আন্তরিকতার যে সমুদ্রের মধ্যে তিনি আমাদের ভাসিয়ে রাখতেন, তা ছিল তুলনাহীন। তথাপি প্রশ্ন হলো—শিল্পী হামিদুজ্জামান গতায়ু হওয়ার পর কোন কোন সূত্রে এই দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত থাকবেন? তিনি ছিলেন বহুপ্রজ এক ভাস্কর ও চিত্রী। সার্বক্ষণিক শিল্প তৈরিতে ব্যস্ত এই মানুষটির ব্যস্ততা থেমে যাওয়ার পর, তাঁর সৃষ্টিশীলতার মূল্যায়নে তাঁর শেষ জীবনের দুটি বড় পরিসর নির্মাণে যে প্রতিভার প্রকাশ প্রত্যক্ষ করা গেছে, তা-ই যথেষ্ট বলে বিবেচনা করা চলে।
গত ৩১ জানুয়ারি বেঙ্গল আর্ট প্রোগ্রামের আওতায় অনুষ্ঠিত হামিদুজ্জামানের সর্বশেষ প্রদর্শনীতে শিল্পীর আকারায়ণের শক্তির নিদর্শনের অভাব ছিল না। রূপের সীমা ছাড়িয়ে আধুনিক ভাস্কর্যে গাঠনিক যে বাস্তবতার প্রজনন সম্ভব, এই শিল্পীর সারা জীবনের অর্জনে সেই স্বাক্ষর মেলে। শৈল্পিক অর্জন যেমনটা সহজেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তাঁর এই বৃহৎ কলেবরের প্রদর্শনীতে, তেমনটা আরও কয়েকটি প্রদর্শনীতে ঘটেছে বারংবার। প্রতিবারই কোনো না কোনো নতুনতর সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার ফসল তিনি দর্শক সমীপে পেশ করতে সক্ষম হয়েছেন।
যে শিল্পী তাঁর প্রথম জীবনে কমিশনধর্মিতার মধ্য দিয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, তাঁর ভাস্কর্যের শক্তিমত্তা বিষয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে সজাগ হয়েছি ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত একক প্রদর্শনীতে অসংখ্য মাকেটসুলভ (ছোট মডেল) ছোট কাজের সমারোহে চোখ রেখে।
‘এন ইন্ডিজেনাস মিনিমালিস্ট’ শিরোনামের এই প্রদর্শনীতে একক দণ্ডায়মান কাজের সঙ্গে একটি বড় টেবিলে রাখা প্রায় একই মাপের ক্ষুদ্র ভাস্কর্যগুলো এক নতুন ডায়ালজিক মাত্রা বা মিথস্ক্রিয়ার জন্ম দেয়। একক মোটিফনির্ভর আধুনিকতার ওপর এটি ছিল নতুন এক মহাজনী।
এর আগে ২০১৬-তে শিল্পী ‘জীবন অন্বেষণ’ শিরোনামে একটি উন্মুক্ত ভাস্কর্য প্রদর্শনী করেন। বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের উন্মুক্ত পরিসরে হামিদুজ্জামান তাঁর ছোট-বড় ধাতব ভাস্কর্যের পাশাপাশি পাথরের ছোট ছোট ভাস্কর্য উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে বিবিধ এমন নজির হাজির করেন, যা তাঁর আপন ভাষার ক্রমবিবর্তনের একরৈখিকতা থেকে আরও অনেক দূর এগিয়ে গিয়ে নব নব আবিষ্কারের আনন্দের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ বলে ঠাহর হয়েছে।
স্পেস ও ম্যাসের ধারণার যে গাণিতিক চরিত্র মইনুদ্দিন খালেদ তাঁর কাজের ব্যাখ্যা দিতে উল্লেখ করেছেন উপরোক্ত প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত পুস্তকে, সেই ইউরোপীয় আধুনিকতার শিক্ষা যেন আরও নানা নির্মাণকুশলতার সূত্রে আকার বা অবয়বের সীমা ছাড়িয়ে অস্তিত্বশীল হয়ে উঠতে চেয়েছে। এ প্রদর্শনী উপলক্ষ করে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর যে উক্তি করেছেন তা ওপরের অভিজ্ঞতার আলোকে জুতসই বলে মেনে নেওয়া যায়। ‘এই (শিল্পীর) আধুনিকতা ভাস্কর্যের সীমা পেরিয়ে যায়।’ উন্মুক্ত উদ্যানে এই প্রদর্শনী ছিল করণ ও দর্শনের ক্ষেত্রকে ক্রমে উন্মুক্ত করে দেওয়ার একটি সোপান।
আধুনিকতা এক সর্বজনীন ভাষা খোঁজে। সুন্দর-অসুন্দরের ভেদরেখার বিলোপ ঘটায়। ফলে শিল্পী বস্তুর বস্তুত্ব স্পষ্ট করে তোলে এবং লৌকিক বাসনা ত্যাগ করে নিরাসক্ত দৃষ্টির চর্চার সূত্রে মাধ্যম ও আকারের সম্পর্ক পুনর্নির্ধারণ করেন। যা সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, তা হলো নিজস্ব পদ্ধতির প্রয়োগে আঙ্গিকগত বা ভাষাগত নিরীক্ষা। আকারায়ণের সূত্রে যেহেতু শিল্পী ভাষার নিশানা ঠিক করেন—এটি দীর্ঘ চর্চার ফসল ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়। আকারায়ণের সূত্রে ভাষা গঠন করে শিল্পী পরিচিত হয়ে ওঠেন। হামিদুজ্জামান আকারে বিশ্বাস এনেছেন, আকৃতির মধ্য দিয়ে একদিকে প্রকৃতির প্রতি আদিম আবেগ, অন্যদিকে আধুনিক মানুষের দেহাতীত, অজৈবিক অর্জন—এই দুই বিপরীতকে তিনি অনায়াসে একত্র করেছেন। এ সূত্রে তিনি ব্র্যাকুসি ও হেনরি মুরের সঙ্গে জড়িত। আলেকজান্ডার ক্যাল্ডারের ধাতব ফর্মের ছায়ায় তাঁর বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছে বলেও দাবি করা যায়। এই তিনের অনুপ্রেরণায় সব আধুনিক ভাস্কর নিজস্ব ভাষা তৈরি করেছেন—হামিদুজ্জামান এর মধ্যে ফর্মের বা আঙ্গিকের হ্রাসকরণের ধরনটি নিজস্ব পথে হাজির করেছেন। সাদৃশ্য তৈরি ও বাস্তববিষয়ক চিন্তা—এই দুই থেকে দূরে থেকে ‘শিল্পের বাস্তবতা’ নির্মাণে তিনি পারদর্শী ছিলেন। হোসে ওর্তেগা গাসেত চিন্তাকে ভার্চুয়াল জগৎ আখ্যা দিয়ে, শিল্পীদের এ জগৎ ও বাস্তব জগতের উপযোগিতার সম্পর্ক থেকে দূরে থাকার পক্ষে একদা তর্ক তুলেছিলেন। যুগধর্ম ও ইচ্ছাবৃত্তি—এ দুই থেকে শিল্পীরা এক অটোনমাস বা স্বতন্ত্র পরিসর তৈরি করে যে প্রক্রিয়ায় ভাষা গড়েন, সেই প্রক্রিয়া মূলত আত্মপরিচয় গড়ার ভিত্তি। আধুনিকতার অদম্য চর্চাকারী হিসেবে তবু হামিদুজ্জামান চোখে দেখা দুনিয়াকে সম্পূর্ণ বাদ না দিয়ে অভিজ্ঞতার ইনটুইটিভ বা সজ্ঞার স্তর থেকে সর্বজনীন ভাষা গড়বার অসিলায় শিল্প গড়ে গেছেন আজীবন। ফলে শিল্পী ইচ্ছাবৃত্তির আওতায় আপন মনোবাসনা বা অন্তরের অধরা বস্তুতে প্রক্ষেপণ না করে, বস্তুর উপস্থিতি গ্রাহ্য করে নানা নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়েছেন। মোটিফ গড়েছেন, যা এক থেকে অধিক হতে চায়, ফর্ম থেকে ডিফরমিটির দিকেও যেতে চায় কখনো কখনো। সর্বোপরি স্পর্শযোগ্য বস্তু হিসেবেই অর্জন করতে চায় কসমিক মাত্রা—এসবই হামিদুজ্জামানের বড়ত্বের তৃষ্ণার পরিচায়ক।
মৃদুভাষী শিল্পী হিসেবে যে অবয়বের বহুত্ব ও বড়ত্ব (শুধু আকারের বিচারে নয়) তিনি অর্জন করেছিলেন, হয়তো তা আরও দূর গড়াত, যদি না মৃত্যু তাঁকে হঠাৎ থামিয়ে দিত।
শিল্পী হামিদুজ্জামান খান অস্তিত্বের চাইতে অস্তিত্বের পরিবর্তনশীলতার ওপর আস্থা রেখে শিল্প গড়ে গেছেন। যে দৃশ্য সারা দিন উপভোগ করা গেল, সন্ধ্যার আলোয় তা আরেক দৃশ্য হিসেবে আমাদের সামনে হাজির হয়, এ মতো দেখার সূত্রেই তিনি বিষয় ও বিষয়ীর অনড় সম্পর্ক থেকে সরে আসেন।
শিল্পী হামিদুজ্জামান খান অস্তিত্বের চাইতে অস্তিত্বের পরিবর্তনশীলতার ওপর আস্থা রেখে শিল্প গড়ে গেছেন। দৈনিক নিউ এজ–এর পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকার নিতে গেলে (২০১৯) শিল্পী তাঁর জীবনের নানা অভিজ্ঞতার পাশাপাশি বস্তুর রূপ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ব্যাখ্যা করেন দৃশ্যবস্তুর পরিবর্তনশীলতা বিষয়ে। যে দৃশ্য সারা দিন উপভোগ করা গেল, সন্ধ্যার আলোয় তা আরেক দৃশ্য হিসেবে আমাদের সামনে হাজির হয়, এ মতো দেখার সূত্রেই তিনি বিষয় ও বিষয়ীর অনড় সম্পর্ক থেকে সরে আসেন; দুনিয়ার বাহ্য বিষয়ের ভেতরেই ফেনোমেনালজিস্টদের মতো সময়, ব্যক্তি ও পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব লক্ষ করেন। এই সূত্রেই তিনি বস্তু—বিশেষ করে প্রাকৃতিক উপাদানে প্রাণ আবিষ্কার করেন। এ সূত্রেই পাথরে গড়া গোল চাকতি কখনো হয়ে ওঠে সূর্য, কখনো ব্রহ্মাণ্ড। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব যে তিনি পাঠ করেছিলেন, পাথরেরও যে প্রাণ আছে, তিনি পাঠের সূত্রে তা জেনেছিলেন, এ বিষয়ে মইনুদ্দিন খালেদ তাঁর পূর্বে উল্লেখিত লেখায় আমাদের জানাচ্ছেন। এ কারণে মূর্তিতে ধ্যান ছিল না তাঁর, ছিল বাহ্য জগতের মৌল সত্তায় মনোযোগ—যা ন্যূনতমের সূত্রে তিনি হাজির করেছেন। ফলে জ্যামিতির ব্যবহারও তাঁর হাতে স্থাপত্যসুলভ কাঠামো ধারণ করেছে।
প্রকৃতি ও কারখানার নির্মাণবিদ্যা—এই বৈপরীত্য ছাড়াও শিল্পীর কাজে আদিম ও ‘সংস্কৃত’ বা শুদ্ধপ্রকাশ পাশাপাশি বিরাজ করেছে। অমসৃণতার পাশে মসৃণতার প্রয়োগে গড়ে উঠেছে ভাস্কর্য। ক্যানভাসের তল বহুদিন পড়ে থাকা লোহার জংধরা পাতের চেহারা পেয়েছে, যার মধ্যগগন থেকে আবার ভেসে উঠছে পুল বা পাতাসুলভ এক চিহ্ন।
ওপরের এই দ্বৈতাদ্বৈতবাদ (ভাবগত ও বস্তুগত উভয় দিক বিচারে) বুঝতে স্মরণে নিতে হবে শিল্পীর ‘আর্থলি ট্রেজার’ শিরোনামের এথেনা গ্যালারির একক প্রদর্শনীটির (২০১৩)। বাড্ডায় আপন বাটির কাছে অবস্থিত এ গ্যালারিতে অমসৃণ পাথরের ওপর আপাত মসৃণ মোটিফ রেখে যে আদিম ভাবাপন্ন ভাস্কর্যের অবতারণা করেন শিল্পী, সে বিষয়ে লেখালেখির খুব একটা উত্পাদন লক্ষণীয় হয়নি। এ প্রদর্শনীতেই শিল্পী প্রথম ক্যানভাস জোড়া দিয়ে অনুভূমিক চিত্র গড়ে তোলাকে উপজীব্য করে ছবি হাজির করেন। এই হাজিরানাই পরে আরও জোরালো হয়ে তাঁর জাতীয় জাদুঘরের রেট্রোস্পেকটিভ প্রদর্শনীকে (২০১৭) নতুন দিশাদানকারী চিত্রী হিসেবে হামিদুজ্জামানকে নতুন করে মূল্যায়নের সুযোগ করে দেয়।
পরিশেষে উদ্ভাবনী শক্তির একটি সুনির্দিষ্ট ক্ষণ স্মরণে আনা জরুরি বলে মনে করি। ১৯৮১ সালে প্রথম এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে যে ভাস্কর্যটি চারুকলার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সাড়া জাগায়, তা ছিল হামিদুজ্জামানের একটি বিশেষ সৃষ্টি। দোকানের ভাঙাচোরা শাটার, তার নিচে এলোমেলো শার্ট-প্যান্ট পরে আছে কোনো এক ব্যক্তির উপস্থিতির স্মারক হিসেবে—এই নির্মাণ বাংলাদেশের শিল্পে প্রথম স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত, যদিও স্থাপনা শব্দটির (অধ্যাপক মঞ্জুরুল ইসলামের সৃষ্টি) প্রচলন তখনো হয়নি। এই কাজ তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক হিসেবে গড়েছিলেন, যার অভিনবত্ব এখনো শিল্পরসিককে ভাবায়।
হামিদুজ্জামানের শুরু ছিল ছোট ছোট মোটিফের মধ্য দিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে ভাস্কর্য গড়ার সংবেদী আয়োজনের সূত্রে। ১৯৬৭ সালে ঢাকা চারুকলা থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করে তিনি ভারতের বরোদায় ১৯৬৭ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করে দীর্ঘদিন কর্মতত্পর থেকেছেন, গড়েছেন অগণিত শিল্পকর্ম, যার কিয়দংশের উল্লেখ করে এখানে তাঁর ভাষার সুলুকসন্ধান করার চেষ্টা করা হলো মাত্র।