একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল গণযুদ্ধ। এই যুদ্ধে গণমানুষের সংগ্রাম ও ত্যাগই ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও আখ্যানে তাদের কথা বেশি আসেনি। এসেছে দল, নেতা, সংগঠনের কথা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার বলা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলিত হয়। আবার দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ, ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার প্রথম নিশানাও হয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়।
স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনী কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের হত্যা করেছে, তার বিবরণ কমবেশি সবার জানা। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ কর্মচারীদের ত্যাগ ও সংগ্রামের বয়ান অনেকটা অজানাই থেকে গেছে।
মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী
সম্পাদক: আশফাক হোসেন ও
কাজী সামিও শীশ
প্রকাশক: উচ্চতর মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র (কারাকাস), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রচ্ছদ: শাওন আকন্দ; মূল্য: ২৫০ টাকা; পৃষ্ঠা: ২৯৪
প্রকাশ: ডিসেম্বর ২০২৪
সেদিন বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ ক্যাম্পাস ছেড়েছিলেন। কিন্তু সাধারণ কর্মচারীরা ভেবেছিলেন, তাঁরা যেহেতু রাজনীতি করেন না, কায়িক পরিশ্রম করে দিন গুজরান করেন, তাঁদের ওপর আক্রমণ হবে না। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী কে শিক্ষক, কে শিক্ষার্থী আর কে কর্মচারী, পার্থক্য করেনি। তারা মায়ের কোল থেকে নিয়ে শিশুসন্তানকে, স্ত্রীর সামনে স্বামীকে হত্যা করেছে। চোখের সামনে স্বজন হত্যার এসব দৃশ্য দেখে কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। তাঁদের কেউ ছিলেন মালি, কেউ অফিস সহকারী, কেউ দারোয়ান, কেউ বাবুর্চি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরা সেই অবরুদ্ধ বাংলাদেশে নিরাপত্তাহীন মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন বার্তা আদান–প্রদান করেছেন। কেউ কেউ গেছেন রণাঙ্গনেও।
মার্চের ২৫-২৬ তারিখে ক্যাম্পাসে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারীদের নির্মম ও বেদনাদায়ক স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণামূলক বইটিতে নিম্নবর্গের এসব মানুষের দুঃসহ স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে, বিভিন্ন গবেষণাগ্রন্থের সহায়তায়।
বইটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অধ্যায় হলো ‘ভয়ংকর এক রাতের কথা: মৃতের স্তূপে প্রাণের আহাজারি’। অন্যান্য অধ্যায়ে আছে, ‘ছাব্বিশে মার্চ সকাল: তবু ভোর হয়’, ‘অবরুদ্ধ থেকে বিজয় পর্ব’ ও ‘কর্মচারীদের অভিজ্ঞতা নিয়ে মৌখিক ইতিহাস’।
মুখবন্ধে শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, ‘বইটি সমষ্টিগত ইতিহাসের অংশ। সমষ্টির পক্ষে ইতিহাস ভুলে যাওয়া এবং ব্যক্তির পক্ষে স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়া একই রকম দুর্ঘটনা।’ ভূমিকায় আশফাক হোসেন যথার্থই বলেছেন, ‘ইতিহাসে নিম্নবর্গের মানুষ বা সাবঅলটার্নদের কথা থাকে না। কর্মচারীরা ছিলেন সেই গোষ্ঠীর মানুষ। যাঁরা প্রায় সবাই এসেছিলেন গ্রাম থেকে। তাঁরা কৃষকের সন্তান।’
বইটি যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন আশফাক হোসেন ও কাজী সামিও শীশ। সহায়তা করেছেন একদল তরুণ গবেষক।
এ ধরনের বই আরও বেশি প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন। এর মাধ্যমে উত্তর প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে।