অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

জন্মদিনে শ্রদ্ধা

ঢাকায় বুদ্ধদেব বসুর শেষ সফর

খ্যাতিমান সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু জন্মেছিলেন পূর্ববাংলায়। তাঁর শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের অনেকটা সময় কেটেছে ঢাকায়। উনিশ শ ত্রিশের দশকের শুরুতে কলকাতায় কর্মজীবন শুরু করার পর ঢাকার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ অত্যন্ত শিথিল হয়ে যায়। ১৯৪৭-এ দেশবিভাগের পর মাত্র একবার ছাড়া আর কোনো দিন ঢাকায় আসেননি। উপনিবেশ–পরবর্তী ঢাকায় বুদ্ধদেব বসুর সেই একমাত্র সফরের বর্ণনা পাওয়া যায় প্রথমা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত লেখক–গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের বই ‘ঢাকার বুদ্ধদেব বসু’–তে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের বৃত্তের বাইরে—তাঁদের সমসাময়িক অথচ অব্যবহিত পরবর্তী—বাংলা সাহিত্যে ‘তিরিশের কবি’ বলে যাঁরা পরিচিত, তাঁদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসুর (১৯০৮-১৯৭৪) স্থান জীবনানন্দ দাশের পরেই এবং তিনি বহুমুখী ও বহুপ্রসূ। বুদ্ধদেবের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টিশীল লেখক আধুনিক বাংলা সাহিত্যে আরও অনেকে আছেন, কিন্তু তাঁর কাজ বিস্তৃত সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়: কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, সাহিত্য-সমালোচনা, সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধ, আত্মজীবনীমূলক রচনা, ভ্রমণকাহিনি, নাটক, কাব্য-নাটক প্রভৃতি। সাহিত্যপত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও তিনি বিশিষ্ট। মডার্নিস্ট বা আধুনিকতাবাদী কবি হিসেবে খ্যাত, তাঁর বোদলেয়ার ও হোয়েল্ডারলিনের কবিতার অনুবাদ প্রশংসিত হয়েছে। তিনি ছিলেন একজন অসামান্য সাহিত্যসংগঠক। বুদ্ধদেব ছিলেন তরুণ লেখক-কবিদের অকৃত্রিম বন্ধু। শেষ জীবনে তিনি আধুনিক তরুণ কবিদের একজন স্নেহশীল অথচ দায়িত্ববান অভিভাবকে পরিণত হন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিনি ছিলেন কলকাতার তরুণ লেখকদের অন্যতম প্রধান প্রেরণাদাতা।

খাঁটি পূর্ব বাংলার অধিবাসী বুদ্ধদেবের জন্ম কুমিল্লায়, পৈতৃক বাড়ি বিক্রমপুরে এবং তাঁর শৈশব কাটে নোয়াখালীতে। কৈশোর ও প্রথম যৌবন ঢাকায় এবং গোটা শিক্ষাজীবন কাটিয়েছেন তিনি ঢাকা শহরেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে ইংরেজিতে এমএ পাস করে উনিশ শ ত্রিশের দশকের শুরুতে কলকাতায় কর্মজীবন শুরু করার পর ঢাকার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ অত্যন্ত শিথিল হয়ে যায়। ১৯৪৭-এ দেশবিভাগের পর মাত্র একবার ছাড়া আর কোনো দিন ঢাকায় আসেননি। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর তাঁর অনুরাগী, বন্ধুস্থানীয় ও গুণগ্রাহীরা তাঁকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানালেও তিনি অজ্ঞাত কারণে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে, তার ভালোমন্দ সম্পর্কে তাঁর তেমন উৎসাহ ছিল না। যে ঢাকায় কাটে তাঁর জীবনের এক অমূল্য সময়, সেই ঢাকা—সেই পুরানা পল্টন—দেখার তাঁর কোনোই আগ্রহ ছিল না। আমরা বুদ্ধদেবের পক্ষ সমর্থন করে বলতে পারি, তাঁর সেই স্মৃতির পুরানা পল্টনের অস্তিত্ব পঞ্চাশ বছর পর আর ছিল না বলেই হয়তো তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বর্তমান পুরানা পল্টনের হতশ্রী অবস্থা দেখতে চাননি। কিন্তু পূর্ব বাংলাকে তিনি কেন ভুলে যেতে চাইলেন এবং ভুলে গেলেনও—সব প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। এর মধ্যে ১৯৭৪-এর ১৮ মার্চ আকস্মিকভাবে হূদেরাগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। মৃত্যুর দুই দিন আগে বুদ্ধদেব বলেছিলেন, ‘রাণুর জন্য আমাকে আরও দশ বছর বাঁচতে হবে।’ রাণু, অর্থাৎ তাঁর স্ত্রী প্রতিভা বসু, কথাশিল্পী, তিনিও ছিলেন ঢাকারই বাসিন্দা।

১৯৭০-এ আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এক কথিকায় বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন:

স্বাধীনতা-লাভের পরের বছর আমি একবার একদিনের জন্য ঢাকায় গিয়েছিলাম, আমার প্রথম যৌবনের বিচরণ-ভূমিতে। তার পরে আর যাওয়া হয়নি। কিন্তু—আমি সাহিত্যিক বলে—পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে কিছুটা যোগাযোগ ছিল আমার; ঢাকার তরুণ কবিরা প্রায়ই লেখা পাঠাতেন ‘কবিতা’ পত্রিকার জন্য, চিঠি লিখতেন; পত্রিকা বেরোতে দেরি হলে গ্রাহকদের আগ্রহ-ভরা চিঠি আসত ঢাকা থেকে; আর মাঝে-মাঝে পেতাম আমার লেখার পক্ষপাতী কোনো পাঠকের প্রীতিপূর্ণ পত্র, তাঁদের মধ্যে অনেকেই পাঠিকা। ‘কবিতা’ এখন আর বেরোয় না, তবু মাঝে-মাঝে আসে চিঠি, কোনো পত্রিকা বা নতুন বই এসে পৌঁছায়; আমি বুঝতে পারি, দুই দেশের মধ্যে বাংলা ভাষা একটি সেতুর মতো কাজ করছে, কিংবা বলা যায় পদ্মার এপারে-ওপারে বয়ে চলেছে একটি অন্তঃশীল স্রোত, তার নাম বাংলা সাহিত্য।

এখানে প্রথম বাক্যটিতে—অসাবধানতাবশত হোক, স্মৃতিভ্রম থেকে থেকে অথবা ইচ্ছাকৃত হোক—তথ্যবিভ্রাট ঘটেছে। ‘স্বাধীনতা-লাভের পরের বছর’ বলতে ১৯৪৮-কেই বোঝায় এবং ‘এক দিনের জন্য’ও নয়, আড়াই দিনের জন্য তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। প্রকৃত ঘটনা হলো, তিনি এসেছিলেন ১৯৫০-এর ১৩ আগস্ট দুপুরে এবং কলকাতায় ফিরে যান ১৫ আগস্ট দুপুরে। সেটাই ছিল তাঁর শেষ ঢাকা সফর। এবং পরবর্তী ২৪ বছরে আর কখনো ঢাকায় আসা না হলেও ঢাকার লেখকদের সঙ্গে তাঁর চিঠিপত্রে ও অন্যান্যভাবে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল আমৃত্যু। বাস্তবিক পক্ষেই বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্য ছিল সেই যোগাযোগের অনন্য সেতু।

বুদ্ধদেব বসু এসেছিলেন ১৯৫০-এর ১৩ আগস্ট দুপুরে এবং কলকাতায় ফিরে যান ১৫ আগস্ট দুপুরে। সেটাই ছিল তাঁর শেষ ঢাকা সফর। এবং পরবর্তী ২৪ বছরে আর কখনো ঢাকায় আসা না হলেও ঢাকার লেখকদের সঙ্গে তাঁর চিঠিপত্রে ও অন্যান্যভাবে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল আমৃত্যু।

সে সময় কলকাতা থেকে আর একজন তরুণ লেখক এসেছিলেন, তিনি শিবনারায়ণ রায়। তিনি এসেছিলেন ট্রেনে, বুদ্ধদেব বিমানে। শিবনারায়ণ তখন ছিলেন প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা এবং পরে নয়া-মানবতাবাদী এম এন রায়ের অনুরাগী। বুদ্ধদেব ও শিবনারায়ণের মধ্যে মিল ছিল এইটুকু যে, তাঁরা উভয়েই ছিলেন অবিচল মার্কিনপন্থী ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির সমর্থক এবং সাবলীলভাবে সমাজতন্ত্রবিরোধী।

বুদ্ধদেব রাজনীতিবিমুখ ছিলেন, বলা চলে অ্যাপলিটিক্যাল, বস্তুত তিনি ছিলেন কমিউনিস্টবিরোধী শিবিরের মানুষ। তবে তিরিশের দশকের শেষ দিকে পরিস্থিতির কারণে তিনি প্রগতি লেখক সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত হন এবং ১৯৪২-এ ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘেরও সদস্য হয়েছিলেন আরও কয়েকজন অ-মার্ক্সবাদী লেখকের মতো। আমেরিকানদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ স্থাপনে অন্যান্যের মধ্যে যে প্রতিষ্ঠানটি সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে, তার নাম ফ্রেন্ডস সার্ভিস ইউনিট—একটি মার্কিন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব ফ্রেন্ডস অ্যাম্বুলেন্স ইউনিট এবং আমেরিকান ফ্রেন্ডস সার্ভিস কমিটি একত্রীকরণের মাধ্যমে ফ্রেন্ডস সার্ভিস ইউনিট গঠিত হয়। আমেরিকার ফিলাডেলফিয়াতে ছিল এটির প্রধান কার্যালয়। কলকাতায় এর অফিস ছিল সাহেবপাড়ায় ১ নম্বর আপার উড স্ট্রিটে এবং ঢাকার অফিস ছিল কায়েতটুলীর ৭ বরোদা গাঙ্গুলি লেনে এক বিরাট বাড়িতে।

সৈয়দ আবুল মকসুদের ‘ঢাকার বুদ্ধদেব বসু’ বইটি অর্ডার করতে ক্লিক করুন

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় থেকে আমেরিকার এই শান্তিবাদী স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। ১৯৪৬-এ কলকাতা ও নোয়াখালীর দাঙ্গা-উপদ্রুত এলাকায় দুর্গতদের মধ্যেও তারা কাজ করে। অবিভক্ত ভারতে রেডক্রসের সঙ্গে তারা কাজ করত—পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তা সম্ভব হয়নি। ব্রিটিশ সরকার যখন ভারতবাসীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দিয়ে ১৯৪৭-এর আগস্টে চলে যায়, তখনো এই সংগঠন পূর্ববঙ্গে ও পশ্চিমবঙ্গে থেকে যায় এবং তখন থেকে শুধু সমাজসেবামূলক কাজ নয়, কমিউনিস্টবিরোধী উদার গণতন্ত্রমনস্ক লেখক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও তারা কাজ করতে থাকে। তখন তাদের প্রধান কাজ হয় সোভিয়েতবিরোধী, বিশেষ করে মার্কিনপন্থী কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা দেওয়া ও পৃষ্ঠপোষকতা করা। কলকাতার পার্শ্ববর্তী সোদপুর খাদি আশ্রমের প্রধান, বিশিষ্ট গান্ধীবাদী নেতা ও সংগঠক সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ ছিল। গান্ধীবাদী সমাজসেবামূলক কাজেও তারা সহযোগিতা দিতে চেয়েছিল। তাদের লোক নোয়াখালী-চাঁদপুরে গান্ধীর সঙ্গে কাজও করেছে। বাংলায় এই সংগঠনের প্রধান গর্ডন এফ মুইরহেড-এর সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে চল্লিশের শেষ দিকে। সেই অন্তরঙ্গতা অক্ষুণ্ন ছিল অনেক দিন। তাঁদেরই আমন্ত্রণে তিনি ১৯৫০ সালের আগস্টে ঢাকায় এসেছিলেন তিন দিনের জন্য: সেটাই তাঁর ঢাকায় শেষ সফর। সাতচল্লিশের পর ফ্রেন্ডস সার্ভিস নিয়মিত ঢাকায় সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে আলোচনার আয়োজন করত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, কবি জসীম উদ্দীন প্রমুখ তাদের আলোচনায় যোগ দিতেন।

ফ্রেন্ডস সার্ভিস ইউনিটের ঢাকা কেন্দ্রের প্রধান টোরেন্স মিউস বুদ্ধদেবকে আমন্ত্রণ জানান ১৯৫০-এর ১৪ আগস্ট—পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের ছুটির দিনে—ঢাকায় তাঁদের অফিসে এক ঘরোয়া সাহিত্য-বৈঠকে বক্তৃতা দিতে। বুদ্ধদেব খুব ব্যস্ত ছিলেন। তবু সম্মত হন, যখন আয়োজকেরা জানান যে এক দিনের বেশি তাঁকে ঢাকায় থাকতে হবে না এবং স্থলপথে নয়, তাঁর যাতায়াতের ব্যবস্থা হবে বিমানে।

এই সংগঠন (আমেরিকান ফ্রেন্ডস সার্ভিস) পূর্ববঙ্গে ও পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টবিরোধী উদার গণতন্ত্রমনস্ক লেখক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কাজ করতে থাকে। তাদের প্রধান কাজ হয় সোভিয়েতবিরোধী, বিশেষ করে মার্কিনপন্থী কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা দেওয়া ও পৃষ্ঠপোষকতা করা।

মিউসের ওই সাহিত্য-আলোচনার বৈঠকে উপস্থিত থাকার জন্য ঢাকার কয়েকজন তরুণ কবি ও লেখককেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আশরাফ সিদ্দিকী, কবি আবদুর রশীদ খান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, ডন-এর সাংবাদিক ও লেখক মাহবুব জামাল জাহেদী, অধ্যাপক অজিত গুহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ। আশরাফ সিদ্দিকী, আবদুর রশীদ খান প্রমুখ তখন ‘নতুন কবিতা’ নামে একটি সংকলন বের করে কবিদের এক গোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন। বুদ্ধদেব ঢাকায় আসবেন শুনে তাঁরা কলকাতায় তাঁকে লেখেন যে ঢাকায় এলে তাঁকে নিয়ে তাঁরাও একটি বৈঠকে বসতে চান। তাঁরা প্রস্তাব করেন, ১৫ আগস্ট সকালে এক প্রাতরাশ বৈঠকে তাঁরা বুদ্ধদেবকে নিয়ে সাহিত্য-আলোচনায় বসবেন। সে আমন্ত্রণের উত্তরে ১০ আগস্ট ১৯৫০ বুদ্ধদেব ‘কবিতা ভবন’ থেকে এক চিঠিতে লেখেন:

কল্যাণীয়েষু,
তোমাদের প্রীতিপূর্ণ নিমন্ত্রণ পেয়ে খুশি হয়েছি। মুশকিল এই যে সোমবার [১৪ আগস্ট] এখানে আমার জরুরি কাজ আছে, তাই সেদিন সকালে ফিরতে হবে। রবিবার ১৩ তারিখ প্রায় পুরো দিনটা তোমাদের সঙ্গে আলাপে-আলোচনায় কাটাতে পারবো, সেই সময়টুকুর সদ্ব্যবহার হলে সাহিত্যের আলোচনার অনবকাশ হবার কথা নয়। এখানে Friends Service Unit-এর প্রতিনিধি আমাকে জানিয়েছেন যে কোনো বড় সভা হবে না—কেন না আমি একেবারেই বক্তা নই—ছোট ছোট ঘরোয়া বৈঠকের ব্যবস্থা হয়েছে, তাতে সাহিত্য বিষয়েই আলোচনা হবে। এ ব্যবস্থা আমার মনোঃপুত এবং এতে তোমাদেরও নিরাশ হবার কারণ নেই। আমি আশা করছি যে রবিবারের মধ্যেই তোমাদের সকলের সঙ্গে দেখাশোনা হতে পারবে, তাই সোমবার সকালে তোমাদের প্রস্তাবিত প্রাতরাশে যদি একান্তই না উপস্থিত হতে পারি তা হলে তোমরা আমাকে মার্জনা করো।

ঢাকার তরুণদের সঙ্গে পরিচয় হবে ভাবতে ভালো লাগছে। তোমাদের সকলকে আমার ধন্যবাদ ও শুভ-কামনা জানাই।

১৩ আগস্ট দুপুরে ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে বুদ্ধদেব কলকাতা থেকে ঢাকায় পৌঁছান। সম্ভবত সেটাই তাঁর প্রথম বিমানভ্রমণ। তেজগাঁও বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান ফ্রেন্ডস সার্ভিস ইউনিটের কর্মকর্তা মার্গারেট ব্রাডলি, ওই সংগঠনের বাঙালি কর্মকর্তা কেরামত আলী তালুকদার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র-শিক্ষক ও তরুণ কবি-সাহিত্যিক। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সাপ্তাহিক সোনার বাংলার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও কবি মনোজ রায়চৌধুরী, আশরাফ সিদ্দিকী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ। কোনো আবাসিক হোটেলের কামরায় নিঃসঙ্গ থাকা তিনি পছন্দ করেননি বলে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল ফ্রেন্ডস সার্ভিসেরই একটি কক্ষে। সেখানে অনুরাগী-পরিবেষ্টিত থাকাতেই তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ অনুভব করেন। কারও বাড়িতে অতিথি হয়ে থাকাতেও ছিল তাঁর আপত্তি।

বিকেলে বুদ্ধদেবের সঙ্গে কায়েতটুলীতে গিয়ে দেখা করেন কবি-লেখক ও অধ্যাপকদের অনেকে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জগন্নাথ কলেজের দর্শনের শিক্ষক রেবতীমোহন চক্রবর্তী, বাংলার শিক্ষক অজিত গুহ, ভবানীচরণ রায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অমিয় চক্রবর্তী, বাংলার মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা প্রমুখ। নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। বুদ্ধদেব ও অজিত গুহ কালিদাসের মেঘদূত নিয়ে কিছু একটা আলোচনা করেন। অন্যেরা তা উপভোগ করেন। বৈঠকে শিবনারায়ণ রায়ও ছিলেন।

১৩ আগস্ট দুপুরে ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে বুদ্ধদেব কলকাতা থেকে ঢাকায় পৌঁছান। সম্ভবত সেটাই তাঁর প্রথম বিমানভ্রমণ। তেজগাঁও বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান ফ্রেন্ডস সার্ভিস ইউনিটের দুজন কর্মকর্তা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র-শিক্ষক ও তরুণ কবি-সাহিত্যিক।

সাহিত্য-আলোচনার চেয়ে অজিত গুহ অধিকতর ব্যস্ত হয়ে পড়েন বুদ্ধদেবের রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে। সে ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন ফ্রেন্ডস সার্ভিসের কর্মকর্তা মিস মার্গারেট ব্রাউলি ও শ্রীমতী বাসন্তী গুহঠাকুরতা।

নির্ধারিত আলোচনা-বৈঠক শুরু হয় ১৪ আগস্ট সকালে। কোনো ভাড়া করা হল-ঘরে বড় সাহিত্য সভা নয়—ঘরোয়া বৈঠকের মতো। বসার ব্যবস্থা হয়েছিল ফ্রেন্ডস সার্ভিসের অফিসের একটি সুপরিসর ঘরের মেঝেতে ফরাশ বিছিয়ে। কোনো মাইকও ছিল না। কলেজে ক্লাস নেওয়ায় অভ্যস্ত বুদ্ধদেব বসুর তাতে অসুবিধা হয়নি।

শ্রোতা ছিলেন জনা পঁচিশ-তিরিশের মতো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে, শ্রোতাদের মধ্যে বুদ্ধদেবের শিক্ষক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও ড. কাজী মোতাহার হোসেনও ছিলেন। অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন আবু জাফর শামসুদ্দীন, ডা. এম এন নন্দী, অজিত গুহ, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, আশরাফ সিদ্দিকী, আবদুর রশীদ খান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, তখনকার প্রতিভাবান তরুণ সাংবাদিক ও কবি মাহবুব জামাল জাহেদী, সৈয়দ আলী আহসান, সৈয়দ আলী আশরাফ, শামসুর রাহমান, কবি মোহাম্মদ মামুন প্রমুখ।

স্বাধীনতা-উত্তরকালের পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের বিভিন্ন ধারা ও গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন বুদ্ধদেব। ঘণ্টা দেড়েক তিনি বক্তৃতা দেন, তারপর জবাব দেন শ্রোতাদের বিভিন্ন প্রশ্নের। পূর্ব বাংলার তরুণ কবি-লেখকদের তিনি পরামর্শ দেন পশ্চিমের, বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকার আধুনিকতম সাহিত্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখার।

সৈয়দ আবুল মকসুদ (২৩ অক্টোবর ১৯৪৬—২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১)

সেদিন তিনি শ্রোতাদের অনুরোধে প্রগতি প্রকাশের উপভোগ্য ইতিবৃত্ত অনেকটা বর্ণনা করেন, যা আগেও তিনি অনেকবার করেছেন। বিভিন্ন উপলক্ষে বলেছেন বা লিখেছেন। আধুনিক সাহিত্য আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য প্রথাবিরোধী সাহিত্যপত্র প্রকাশের ওপরও গুরুত্ব দেন তিনি।

নিজের লেখা কবিতা পাঠ করেন কয়েকজন তরুণ কবি। শামসুর রাহমান সসংকোচে বৈঠকের এক কোণে নীরবে বসে ছিলেন। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার আগ্রহেই শামসুর রাহমান ওই অনুষ্ঠানে যান। গুহঠাকুরতা তাঁকে বিশেষ স্নেহ করতেন।

নিজের লেখকজীবনের যৌবনের দিনগুলো সম্পর্কেও কিছু বলেন বুদ্ধদেব। তরতরিয়ে দ্রুত লিখেছেন তিনি অর্থাৎ ভেবেছেন কম, লিখেছেন বেশি। এজাতীয় লেখার পরিণতি প্রাঞ্জল নয়, তা উপলব্ধি করার ক্ষমতা বুদ্ধদেবের মতো পণ্ডিত-লেখকদের ছিল না, তা নয়। তাঁর গল্প-উপন্যাসগুলো সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে না, তা বোঝার ক্ষমতা তাঁর খুব ভালোই ছিল। হঠাৎ বৈঠকে ড. শহীদুল্লাহ্ জিজ্ঞেস করেন, ‘এ পর্যন্ত তোমার কতগুলো বই হলো?’

শ্রোতা ছিলেন জনা পঁচিশ-তিরিশের মতো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে, শ্রোতাদের মধ্যে বুদ্ধদেবের শিক্ষক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও ড. কাজী মোতাহার হোসেনও ছিলেন। অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন আবু জাফর শামসুদ্দীন, ডা. এম এন নন্দী, অজিত গুহ, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা।

‘প্রায় চল্লিশটির মতো,’ বললেন বুদ্ধদেব, কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত বোধ করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে যোগ করলেন, ‘তবে মোস্ট অব দেম আর স্টিল বর্ন।’ অর্থাৎ বেশির ভাগই জন্মেই মৃত-শিশু। শেষ পর্যন্ত টিকবে না।

সেদিন ঢাকায় নিজের লেখা সম্পর্কে বুদ্ধদেবের ওটি ছিল অতি সত্য অথচ নির্মম স্বীকারোক্তি। বুদ্ধদেবের এই কথাটি সেখানে উপস্থিত ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী মনে রেখেছেন দীর্ঘদিন।

সেদিনের আলোচনায় উপস্থিত শিবনারায়ণ জানান, বুদ্ধদেব তাঁর কবিতার ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন, কিন্তু উপন্যাসগুলোর স্থায়িত্ব নিয়ে তারও সংশয় ছিল।

বিশের দশকে তাঁদের প্রগতির বদ্ধুদের সম্পর্কেও তিনি সরল আলোচনা করেন। শ্রোতারা উপভোগ করেন তাঁর নিজের মুখে ছাত্রজীবনের কথা।

বুদ্ধদেব বসুর প্রসঙ্গে যা বিশেষভাবে উল্লেখ্য, তা হলো, ওই বৈঠকে বেশ কয়েকজন অতি রূপসী ও আধুনিকা রমণীও ছিলেন, যাঁদের উপস্থিতি তিনি উপভোগ করে থাকবেন। ‘স্মার্ট ও স্লিম’ অন্তত দুজনের কথা উল্লেখ করতে হয়, তাঁরা হলেন মিস আমেনা খান পল্লী এবং রোকেয়া রহমান কবির—লেডি ব্রেবোর্নের ছাত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের এমএ এবং ফিরোজ কবিরের পত্নী। তিনি ছিলেন শ্যামলা, চটপটে, দীর্ঘাঙ্গি, স্বাধীনচেতা এবং ভালো বাস্কেটবল প্লেয়ার।

যে বিষয়ে আলোচনার জন্য বুদ্ধদেবকে আমন্ত্রণ করে ঢাকায় আনা হয়েছিল, তা হলো, কীভাবে রাজনৈতিকভাবে পৃথক দুই রাষ্ট্রের, বিশেষ করে দুই বাংলার মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন করা যায় এবং সেই লক্ষ্যে কবি-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীরা কী ভূমিকা পালন করতে পারেন। কিছুদিন আগে হিন্দু-মুসলমানের ভয়াবহ দাঙ্গার পটভূমিতে উপমহাদেশ রাজনৈতিকভাবে ভাগ হয়ে যায়, তখনো দুই দেশের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দগদগ করছিল সেই দাঙ্গার ক্ষত। মাঝেমধ্যেই হচ্ছিল সাম্প্রদায়িক গোলযোগ। ওই অবস্থায় দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় শুধু রাজনীতিবিদেরা নন, সংস্কৃতিজগতের মানুষদেরও উদ্যোগ নিতে হবে, কারণ দুই দেশের মানুষই এক অভিন্ন জাতিসত্তা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। ফ্রেন্ডসের কর্মকর্তারা এই বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়ে মাঝেমধ্যেই ঢাকায় ও কলকাতায় কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবীদের আলোচনায় বসাতেন।

সেদিনের আলোচনা বৈঠকে আবু জাফর শামসুদ্দীনও উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, রাজনৈতিক প্রসঙ্গ এড়িয়ে বুদ্ধদেব দুই বাংলার অভিন্ন সাংস্কৃতিক বন্ধনের ওপর জোর দিয়ে বলেন, বাঙালিরা দুই রাষ্ট্রের নাগরিক হলেও তাদের সাহিত্য এক, হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এক, মধুসূদন-বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে কোনো দিকের বাঙালির পক্ষেই অবহেলা বা অস্বীকার করা সম্ভব হবে না। শুধু অতীতের নয়, ভবিষ্যতেও দুই বাংলায় যে সাহিত্য সৃষ্টি হবে, তার রস দুই দেশের মানুষই উপভোগ করবে। তিনি পূর্ব বাংলার সাহিত্যের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, বিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণেরা যেমন কলকাতাকে চ্যালেঞ্জ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তেমনই ভবিষ্যতে এই বিদ্যাপীঠ থেকে নতুন নতুন সাহিত্যপ্রতিভার আবির্ভাব ঘটবে। এবং দুই বাংলার লেখকদের মধ্যে সম্পর্ক চিরকালই থেকে যাবে।

১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় গুলিস্তান এলাকায় রিজ রেস্তোরাঁয় বুদ্ধদেবের সম্মানে ফ্রেন্ডস সার্ভিস আয়োজন করে এক নৈশভোজের। এটি ছিল কয়েকজন ইহুদির মালিকানায় একটি বনেদি রেস্তোরাঁ, পঞ্চাশের দশকে এর মালিকানা বদল হয় এবং নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় রেক্স। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে রেক্সে ঢাকার আধুনিক তরুণ কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের প্রাত্যহিক আড্ডা বসত। সে আড্ডা চলত অনেক রাত পর্যন্ত।

তখনো দুই দেশের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দগদগ করছিল সেই দাঙ্গার ক্ষত। মাঝেমধ্যেই হচ্ছিল সাম্প্রদায়িক গোলযোগ। ফ্রেন্ডসের কর্মকর্তারা এই বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়ে মাঝেমধ্যেই ঢাকায় ও কলকাতায় কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবীদের আলোচনায় বসাতেন।

রিজের ম্যানেজারের কাউন্টারের পাশেই থাকত একটি প্রাথমিক যুগের আলমারি আকৃতির মস্ত বড় রেফ্রিজারেটর। সেটি ছিল দেখার মতো। তা ছাড়া সে সময় বড় হোটেল-রেস্তোরাঁ-কনফেকশনারি ছাড়া বাড়িঘরে ফ্রিজের প্রচলন হয়নি। বুদ্ধদেব ফ্রিজটি উপভোগ করেন এবং তা নিয়ে রসিকতাও করেন। মিস মার্গারেট তাঁকে জানান যে ওই ফ্রিজের কল্যাণেই টাটকা খাবার, কাবাব ইত্যাদি সকাল থেকে মধ্যরাত অব্দি পাওয়া সম্ভব।

রিজের ভোজে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন জনা-বিশেক কবি-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ। সেখানেও ঢাকা-কলকাতার নতুন সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হয়।

রিজের নৈশভোজে শামসুর রাহমান গিয়েছিলেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার মতো অভাজনকে কে আমন্ত্রণ জানাবে? তবে রিজে আমরা বন্ধুরা নিজেরা খেতাম।’

সেবার বুদ্ধদেবের সঙ্গে শামসুর রাহমানের কোনো কথাবার্তা হয়নি। শামসুর রাহমান জানান, বুদ্ধদেবের সঙ্গে তাঁর প্রথম বাক্যালাপ হয় কলকাতায়, ১৯৫৬-তে, যখন ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে নরেশ গুহ তাঁকে নিয়ে যান। তখনই জীবনানন্দের সঙ্গেও একটুখানি দেখা হয়েছিল।

তখন পূর্ব বাংলায় নতুন লেখকদের মধ্যে দুটি ধারাই ছিল প্রবল: একটি পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শের অনুসারী ইসলামপন্থী ও মুসলমানি ঐতিহ্যের ধারা এবং অন্যটি বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক ধারা। দুই বছর পর দ্বিতীয় ধারাটি বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের পর থেকে আরও শক্তিশালী হয়। প্রথম ধারাটি দুর্বল হতে থাকে। প্রথম ধারার প্রতিভূ কবি ছিলেন ফর্‌রুখ আহমদ, যিনি রিপন কলেজে ছিলেন চল্লিশের শুরুতে বুদ্ধদেবের সরাসরি ছাত্র।

১৪ আগস্টের সকালের বৈঠকে, কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, এমন একজন তরুণ বুদ্ধদেবকে প্রশ্ন করেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন কেমন?

ওই আসরে প্রশ্নটি তাঁর সম্ভবত প্রত্যাশিত ছিল না, তাই তিনি সামান্য বিব্রত হন। যিনি ওই প্রশ্ন করতে পারেন, তিনি কেমন উত্তর প্রত্যাশা করেন, তাও তাঁর অজানা ছিল না। তিনি অপ্রতিভ না হয়ে সংক্ষেপে বলেন, ‘সুকান্ত সম্পর্কে আমি কবিতায় আমার মতামত লিখেছি। পড়ে দেখবেন।’

তার পরও শ্রোতার পীড়াপীড়িতে তিনি যা বলেন, তা কবিতায় প্রকাশিত তাঁর বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি।

নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাস যা-ই হোক, বুদ্ধদেব যে-কারও কবিত্ব শক্তিকে মূল্য দিতেন এবং সুকান্তর মতো রাজনৈতিক মতাদর্শনির্ভর কবিকে—কিশোর কবিকেও—তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন। প্রকাশ করেছেন তাঁর দুটো কবিতা তাঁর কবিতায়। সুকান্তর অকালমৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে কবিতায় বুদ্ধদেব লিখেছিলেন:

পাঁচ বছরে বোধহয় পাঁচবারও সুকান্তকে চোখে দেখিনি আমি। বছরে দু একবার চিঠি লিখতো সে—কিংবা ‘কবিতা’র জন্য কবিতা পাঠাতো—ব্যক্তিগতভাবে এটুকুই ছিল তার সঙ্গে আমার সংযোগ। কিন্তু ব্যক্তিগতর বাইরে অন্য যে জগৎ আছে আমাদের সেখানে সে তো সহযাত্রী, নিত্য সঙ্গী আমাদের।

বুদ্ধদেব বসু (৩০ নভেম্বর ১৯০৮—১৮ মার্চ ১৯৭৪)

জীবনানন্দ দাশ ও বিষ্ণু দে সম্পর্কেও প্রশ্ন করা হয়েছিল। সংক্ষেপে তিনি এর উত্তর দেন। নির্জন স্বভাবের জীবনানন্দকে পাঠকসমাজে প্রতিষ্ঠা করতে বুদ্ধদেবের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। প্রথম থেকেই তিনি তাঁর গুণগ্রাহী। কিন্তু চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি থেকেই জীবনানন্দের বড়ত্ব সম্পর্কে তাঁর সন্দেহের সৃষ্টি হয় এবং তাঁর তখনকার কবিতা সম্পর্কে কিছুটা কঠোর মন্তব্য করতে তিনি দ্বিধা করেননি। কবিতায় মহাপৃথিবীর প্রশংসামূলক সমালোচনা করেননি। ওই কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে বুদ্ধদেব যথার্থই বলেছিলেন যে, জীবনানন্দ তাঁর আগের উৎকৃষ্ট কবিতা থেকে অনবরত ‘পুনরুক্তি করছেন’; এবং মৃদু কঠোর ভাষায়ই বলেন, ‘যা ছিল ভঙ্গি, তা হয়েছে মুদ্রাদোষ’, ‘তিনি অফুরন্তভাবে নিজের পুনরুক্তি করে চলেছেন’। এটা নিঃসন্দেহে একজন বড় কবির খুব বড় দোষ। বুদ্ধদেব আরও বলেন যে জীবনানন্দের অনেক কবিতাই ‘যেন কতগুলো বাঁধাধরা বাক্যের বিচিত্র ও অদ্ভুত সংস্থাপন মাত্র’। বুদ্ধদেব মনে করেন, জীবনানন্দের কবিতা পাঠ করে ‘সবটা মিলিয়ে কিছু পাওয়া যায় না’। জীবনানন্দ ওয়াইড–রেঞ্জিং নন, সংকীর্ণ গন্ডিতে আবদ্ধ, তবে চমৎকার কবি। কথাগুলো অপ্রিয় হলেও তা অসত্য নয়। সেদিনের আলোচনায় তিনি এই কথাগুলোই আরেকটু মৃদু অথচ বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। শ্রোতাদের মধ্য থেকে কোনো ভিন্নমত আসেনি। জীবনানন্দের অপ্রশংসামূলক সমালোচনা শামসুর রাহমানকে সামান্য ‘আহত’ করেছিল। তবে তিনি প্রতিবাদ করেননি। বহু বছর পর শামসুর রাহমানের মনে হয় বুদ্ধদেব ‘বেঠিক’ বলেননি।

তখন পূর্ব বাংলায় নতুন লেখকদের মধ্যে দুটি ধারাই ছিল প্রবল: একটি পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শের অনুসারী ইসলামপন্থী ও মুসলমানি ঐতিহ্যের ধারা এবং অন্যটি বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক ধারা। দুই বছর পর দ্বিতীয় ধারাটি বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের পর থেকে আরও শক্তিশালী হয়। প্রথম ধারাটি দুর্বল হতে থাকে।

সাতচল্লিশের পর পূর্ব বাংলা যখন পাকিস্তানের প্রদেশ হয়, তখন বুদ্ধদেব এখানকার উঠতি কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী হন। তাঁদের তিনি যুগের উপযোগী আধুনিক হয়ে উঠতে সাহায্য-সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিতেও উৎসাহী ছিলেন। তাঁর শরণাপন্ন কেউ হলে, বিশেষ করে তরুণ লেখক হলে, তিনি তাঁকে সাহায্য করতে চাইতেন। তিনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন না বলে মুসলমান তরুণদেরও সস্নেহে উৎসাহ দিতেন। ১৯৫০-এ আশরাফ সিদ্দিকী ও আবদুর রশীদ খানের যৌথ সম্পাদনায় নতুন কবিতা নামে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। ভূমিকায় বলা হয়েছিল, ওই সংকলন নাকি ‘সাহিত্যপথের নতুন যাত্রীদের কাব্য সৃষ্টির খতিয়ান’, বস্তুত তাতে নতুন যাত্রীদের কবিতা ছিল যে ১৩ জন যাত্রীর, দু-তিনজন ছাড়া তাঁদের কেউই আধুনিক ছিলেন না। কোনো নতুন কাব্য-আন্দোলন শুরু করার ক্ষমতা তাঁদের ছিল না। ১৩ জনের মধ্যে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, শামসুর রাহমান ও আলাউদ্দিন আল আজাদও ছিলেন; কিন্তু অধিকাংশই ছিলেন, যেমন হাবীবুর রহমান, মনোজ রায়চৌধুরী, মুফাখখারুল ইসলাম, চৌধুরী ওসমান, আশরাফ সিদ্দিকী, আবদুর রশীদ খান, মযহারুল ইসলাম, মোহাম্মদ মামুন প্রমুখ প্রথাগত কবি, আধুনিকতা সম্পর্কে যাঁদের বিশেষ ধারণা ছিল না। এমনকি আধুনিক পাশ্চাত্য কবিতার পাঠক যে তাঁরা ছিলেন, সে প্রমাণও নেই। তাঁরা নিজেরা ভেবে আত্মতৃপ্তি পেতেন যে তাঁরা আধুনিক। অল্পকাল পরই তাঁরা নিষ্প্রভ হতে হতে একসময় নিঃশেষ হয়ে যান। ওই ১৩ জনের মধ্যে বাংলা কবিতায় শেষ পর্যন্ত টিকে থাকলেন শুধু শামসুর রাহমান—শুধু টিকেই থাকলেন না, তাঁর সমকালের সবার ওপরে উঠে গেলেন, এমনকি তাঁর গুরুপ্রতিম বুদ্ধদেবকেও ছাড়িয়ে গেলেন অন্তত কবিতার ক্ষেত্রে।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে কাগমারীতে ‘পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ভারতের খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। হুমায়ুন কবিরের নেতৃত্বে ভারতের একটি বড় লেখক প্রতিনিধিদল যোগ দেয়। যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধকুমার সান্যাল, নরেন্দ্র দেব, রাধারানী দেবী প্রমুখ। ওই সম্মেলনে যোগদানের জন্য বুদ্ধদেব বসুও আমন্ত্রিত হন। ভাসানীর পক্ষে আবু জাফর শামসুদ্দীন বুদ্ধদেবকে চিঠি লিখেছিলেন। ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও তাঁকে কাগমারী আসার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি আসবেন না বলে সবিনয়ে জানিয়ে দেন। ওই সম্মেলন যে কমিউনিস্ট-প্রভাবিত ‘রাজনৈতিক’ অনুষ্ঠান, তা তিনি জানতেন। সম্ভবত সে কারণেই তিনি আসতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

[লেখাটি ২০১০ সালে প্রথমা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বই সৈয়দ আবুল মকসুদ–এর ‘ঢাকার বুদ্ধদেব বসু’র একাধিক অধ্যায় থেকে সংকলিত ও সম্পাদিত]