
পূর্ববঙ্গ থেকে মৈমনসিংহ গীতিকার পালাগুলো সংগ্রহ করেছিলেন নেত্রকোনার চন্দ্রকুমার দে (১৮৮৯-১৯৪৬)। আর এই সংগ্রহের কাজে পরামর্শ দিয়ে তাঁকে সহায়তা করেন দীনেশচন্দ্র সেন। ১৯১৯ সালে কলকাতায় তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। এর আগে ১৯১৩ সালে সৌরভ পত্রিকায় চন্দ্রাবতীকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন চন্দ্রকুমার দে। প্রবন্ধটি দীনেশচন্দ্র সেনের নজরে পড়ে। তখন তাঁর কাছে মনে হয়েছিল, এই কাহিনি ‘চৈত-বৈশাখী বাগানের ফুলের গন্ধে ভরপুর’। ফলে নিজের আগ্রহ থেকেই তিনি চন্দ্রকুমার দের খোঁজ করতে থাকেন।
সৌরভ পত্রিকা বের হতো ময়মনসিংহ থেকে, কেদারনাথ মজুমদারের (১৮৭০-১৯২৬) সম্পাদনায়। এই কেদারনাথের সঙ্গে দীনেশচন্দ্রের আগে থেকে পরিচয় ছিল। তাঁর কাছে তিনি চন্দ্রকুমার সম্পর্কে প্রথম জানতে পারেন। চন্দ্রকুমার ছিলেন অতিদরিদ্র। নিজের চেষ্টায় বাংলা লিখতে শিখেছিলেন। সাহিত্যচর্চা করতেন। তবে দীনেশচন্দ্রকে হতাশ হতে হয়, যখন জানতে পারেন, চন্দ্রকুমার মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন।
এরপরও হাল ছাড়েননি দীনেশচন্দ্র। বছর দুয়েক পর হঠাৎ একদিন কেদারবাবুর চিঠি আসে দীনেশচন্দ্রের কাছে। চিঠিতে তিনি জানান, চন্দ্রকুমার দে অনেকটা সুস্থ হয়েছেন। তিনি খুব তাড়াতাড়ি কলকাতায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন। একই সঙ্গে তাঁর চিকিৎসাও যে দরকার, এটাও তিনি উল্লেখ করেন।
চন্দ্রকুমারের স্ত্রীর দু-একটা রুপার অলংকার ছিল। সেগুলো বিক্রি করে ১৯১৯ সালে কলকাতায় যান তিনি। সেখানে গিয়ে দেখা করেন দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে। মৈমনসিংহ গীতিকার ভূমিকায় দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন, ‘রোগে-দুঃখে জীর্ণ, মুখ পাণ্ডুরবর্ণ, অর্ধাশনে-অনশনে বিশীর্ণ’ ত্রিশ বছর বয়সের অল্পভাষী এই যুবক ময়মনসিংহ অঞ্চলের অনাবিষ্কৃত পল্লিগাথার সন্ধান দিলেন।’
ওই সময়ে চন্দ্রকুমার কবিরাজ যামিনীভূষণ রায়ের কাছ থেকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা পান। আর থাকতে পেরেছিলেন বিত্তবান গোপালদাস চৌধুরীর বাড়িতে। কিছুদিন কলকাতায় কাটিয়ে ময়মনসিংহে ফিরে আসেন। পরে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আনুকূল্যে ময়মনসিংহ অঞ্চলের গাথা সংগ্রহ করার কাজে নিযুক্ত হন।
এসব গাথার অধিকাংশই চাষাদের রচনা। এগুলো আগে কখনো লিপিবদ্ধ হয়নি। সেসব গান কৃষকেরা তন্ময় হয়ে শুনত। কিন্তু মানুষের রুচি বদলানোর কারণে এই গানের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমতে শুরু করে আঠারো শতকের শেষ থেকেই। ফলে এগুলো গাওয়ার লোকেরও দেখা পাওয়া যেত না সহজে। একেকটি পালাগান সংগ্রহ করতে চন্দ্রকুমারকে তাই বহু লোকের কাছে ধরনা দিতে হয়েছে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে নানা লোকের কাছে গিয়ে তবেই সম্পূর্ণ পালা উদ্ধার করতে পেরেছেন।
চন্দ্রকুমার দে তিন-চার বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে নানা জায়গা ঘুরে পালাগুলো উদ্ধার করেন। তাঁকে দুঃখ ও দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়েছে। গ্রামের পাঠশালায় সামান্য পড়াশোনা করে এক টাকা মাসিক বেতনে মুদিখানায় কাজ নিয়েছিলেন তিনি। পরে দুই টাকা বেতনে তহশিলদারি বা খাজনা আদায়ের কাজ জোগাড় করেন। এই কাজের সূত্রে গ্রামের চাষাদের সঙ্গে অবাধে মেশার সুযোগ হয় তাঁর। চাষারা যখন এসব পালা গাইত, চন্দ্রকুমার তন্ময় হয়ে শুনতেন। বলা ভালো, এসব পালাগানের অধিকাংশই ময়মনসিংহ অঞ্চলের কোনো না কোনো বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে রচিত।
দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন, চন্দ্রকুমার দে মূলত ময়মনসিংহ জেলার কবিদের লেখা ‘বিশুদ্ধ কাব্য’ সংগ্রহের প্রতি বেশি মনোযোগী ছিলেন। আর গীতিকাগুলো সম্বন্ধে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘এগুলো এত প্রাচীন ও এগুলোর ভাষা এমন পাড়াগেঁয়ে যে শুনলে হাসি পায়। ...পয়ারের শেষে প্রায়ই মিল নেই। এগুলি সংগ্রহ করব কি?’
দীনেশচন্দ্র সেন চিঠি পড়ে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিতে দেরি করেননি।
কীভাবে কোন পালা সংগ্রহ করতে হবে, কোন গাথার ঐতিহাসিক মূল্য কী, কোথায় কোন পালার খোঁজ পাওয়া যেতে পারে ইত্যাদি বিষয় জানিয়ে চন্দ্রকুমারকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন দীনেশচন্দ্র সেন। এগুলো সংগ্রহ হওয়ার পর তিনি গাথায় উল্লেখিত গ্রাম ও নদীগুলোর অবস্থান বের করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু ভূমিজরিপ অফিসের মানচিত্রেও পুরোনো জায়গার নাম পাওয়া যাচ্ছিল না। এমনকি মানচিত্রে অনেক নদী ও হাওরের নামও ছিল না। দীনেশচন্দ্র উদ্যোগী হয়ে মৈমনসিংহ গীতিকার বিভিন্ন স্থাননাম দিয়ে একটি মানচিত্র তৈরি করেন। এ কাজে তাঁকে সহায়তা করেন চন্দ্রকুমার দে।
সংগ্রহের পরে পালাগুলোর কোনো কোনো জায়গায় অসামঞ্জস্য পাওয়া যায়। দীনেশচন্দ্র সেগুলো সম্পাদনা করে ঠিক করেন। গাথাগুলোর টীকা-টিপ্পনী ও ভূমিকাও তিনি লেখেন। এ ছাড়া প্রতিটি পালা ঘটনা-অনুযায়ী কয়েকটি ভাগ করেন। পালায় ব্যবহৃত আঞ্চলিক শব্দগুলোর অর্থ লিখে দেন কিশোরগঞ্জের সুরেশচন্দ্র ধর।