গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

মাহমুদ দারবিশের সাক্ষাৎকার

‘আমি শিখেছি, শিল্প আসে সহজ জিনিস থেকে’

ইসরায়েলি কবি ও সাহিত্য সমালোচক হেলিত ইয়েশুরুন কর্তৃক হিব্রু ভাষায় নেওয়া একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকারটি ১৯৯৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি জর্ডানের আম্মানে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে মাহমুদ দারবিশ রামাল্লায় বসবাসের জন্য ইসরায়েলি অনুমতির অপেক্ষায় ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালের বসন্তে ইসরায়েলি সাংস্কৃতিক জার্নাল ‘হাদারিম’-এ। প্রকাশের পরপরই প্রথমে ফরাসি ও পরে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়। সংক্ষিপ্ত আকারে বাংলায় অনুবাদ করেছেন ঋতো আহমেদ

প্রশ্ন

প্যারিসে ১৩ বছর থাকার পর আপনি আম্মানে চলে এসেছেন। এক নির্বাসন থেকে অন্য নির্বাসনে, কেন?

মাহমুদ দারবিশ: আমি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে গিয়েছিলাম। এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক ঘটনাবলিই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। আমি এখানে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে আসিনি, বরং [আমার বিবেকের কারণে] নতুন গতিশীলতা থেকে এত দূরে থাকা আমার পক্ষে সহজ ছিল না। আমি বলতে পারি না যে আমি এক নির্বাসন থেকে অন্য নির্বাসনে চলে যাচ্ছি। কারণ, আরব বিশ্বে আমি আরও বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।

প্রশ্ন

‘মেমরি ফর ফরগেটফুলনেস’ বইয়ে আপনি লিখেছেন, ‘আমি এমন একজন কবি হয়েছি, যে তার মধ্যে থাকা শিশুটিকে খুঁজছে, যে শিশুটিকে সে কোথাও ফেলে এসে ভুলে গেছে। এখন সেই কবি বড় হয়েছে নিজে, কিন্তু নিজের ভেতরকার সেই ভুলে যাওয়া শিশুটিকে বড় হতে দেয় না কিছুতেই।’

মাহমুদ দারবিশ: আমার ক্ষেত্রে, শৈশবের গল্পের সঙ্গে আমার জন্মভূমির গল্পের কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। আমার ব্যক্তিগত জীবনে যে ভাঙন ঘটেছিল, তা আমার জন্মভূমির ওপরও এসেছিল। আমার কাছ থেকে আমার শৈশবকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, সেই সঙ্গে আমার জন্মভূমিকেও। বিষয়টির করুণ দিকটিতে একটি সমান্তরাল ব্যাপার আর ঐক্য রয়েছে। ১৯৪৮ সালে, যখন আমাদের এই বিরাট ভাঙন ঘটেছিল, তখন আমি শৈশবের বিছানা থেকে নির্বাসনের পথে লাফিয়ে পড়ি। আমার বয়স তখন ছয় বছর। হঠাৎ আমার পুরো পৃথিবী উল্টে গেল। শৈশব স্থির হয়ে গেল। আমার কোনো শৈশব আর রইল না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ছিনিয়ে নেওয়া জমি পুনরুদ্ধার করে কি ছিনিয়ে নেওয়া শৈশব পুনরুদ্ধার করা সম্ভব? এটিই আমার কাব্যিক অনুসন্ধান, আমার কবিতার ছন্দ। যে শিশু মাহমুদ দারবিশ একসময় ছিল, তাকে খুঁজে পাওয়া আজ কেবল কবিতাতেই সম্ভব। জীবনে নয়।

প্রশ্ন

মাশারিফ ৩-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন, ‘যখন আমি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হাইফায় থাকতাম, তখন বুঝতে পারলাম আমি একটা নষ্ট ছেলে। কারণ, আমি অনুপস্থিত ছিলাম, সেরা ছিলাম বলে নয়।’

মাহমুদ দারবিশ: হ্যাঁ। আমি ছোটবেলায় বাড়ি ছেড়ে এসেছিলাম। বাড়িতে সমর্থন ও ভালোবাসা না পাওয়া নিয়ে আমার মধ্যে একটা জটিলতা ছিল। পরিবারে আমি দ্বিতীয় ছেলে। আমার মা সব সময় আমাকে অকারণে মারধর করতেন। তিনি অভিযোগ করতেন, বাড়িতে বা আশপাশে যা কিছু খারাপ ঘটনা ঘটছিল, তার জন্য আমিই দায়ী। ১৯৫৬ সালে (গাজা দখলের বিরুদ্ধে ধর্মঘট আর মিসরের ওপর আক্রমণের কারণে), যখন আমার মা এসে আমাকে চুমু খেতেন এবং কফি আর ফল আনতেন, তখনই আমি আবিষ্কার করি তিনি আমাকে ভালোবাসেন, আমার প্রথম ধারণাটি ভুল। ব্যাপারটি আমার জন্য গভীর আনন্দের ছিল, আমার ভেতরে আলোর মতো আনন্দ। তাঁর ভালোবাসা অনুভব করাটা অমূল্য ছিল। আমি সেখানে একটি কবিতা লিখেছিলাম, ‘মায়ের রুটির জন্য আকুল আমি’। আমি আশা করিনি লাখ লাখ মানুষ এটি গাইবে আর তারা ভাববে, আমার মা হলো আমার জন্মভূমি।

একজন লোক, যার কণ্ঠস্বর ছিল সুন্দর, সে রাতে গ্রামের প্রান্তে প্রতিবেশীদের বাড়িতে আসত, রবাব বাজিয়ে তার গল্প গাইত—কীভাবে সে তার বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল এবং কীভাবে সে সীমান্ত পেরিয়ে গিয়েছিল, কীভাবে সে ফিরে এসেছিল, রাত আর চাঁদের কথা বর্ণনা করত, সে এক হৃদয়বিদারক স্মৃতি। আমি তখন শিখেছি, শিল্প আসে সহজ জিনিস থেকে। আমি এই লোকটিকে অনুকরণ করতে চেয়েছিলাম।
মাহমুদ দারবিশ
প্রশ্ন

আপনি এমন একজন ব্যক্তির কথা বলেছেন এবং লিখেছেন, যে রাতে আসে, গান গায় এবং অদৃশ্য হয়ে যায়। এই লোকটি কে ছিল?

মাহমুদ দারবিশ: ‘অনুপ্রবেশকারী’ লেবেলটা কি আপনার মনে আছে? আমার মনে হয় অনুপ্রবেশকারীদের গল্প এখনো লেখা হয়নি। একজন ফিলিস্তিনি লেখকের এখনো এই গল্প লেখার প্রয়োজন আছে। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময়, যখন তারা একটি আদমশুমারি করেছিল, আমরা লেবাননে তখন শরণার্থী ছিলাম। দুই বছর পর যখন ফিরে আসি, তখন আমরা অনুপ্রবেশকারী হিসেবে প্রবেশ করি। আমরা দেইর আল-আসাদে পৌঁছাই। পুলিশ যতবার আসত, আমরা লুকিয়ে থাকতাম। যখনই সুপারিনটেনডেন্ট স্কুলে আসতেন, শিক্ষকেরা আমাকে লুকিয়ে রাখতেন। কারণ, আমি অবৈধ ছিলাম। আর আপনি কল্পনা করে দেখুন, সাত বছরের ছেলের ওপর এর প্রভাব কত বড় হতে পারে। একটি শাসনব্যবস্থা এবং শৈশবের মধ্যে যে ধরনের মানসিক জটিলতা এবং শত্রুতা বিরাজ করে, সেগুলো নিয়ে ভাবুন। দেইর আল-আসাদের সেই সময় থেকে, আমার মনে আছে একজন লোক, যার কণ্ঠস্বর ছিল সুন্দর, সে রাতে গ্রামের প্রান্তে প্রতিবেশীদের বাড়িতে আসত, রবাব বাজিয়ে তার গল্প গাইত—কীভাবে সে তার বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল এবং কীভাবে সে সীমান্ত পেরিয়ে গিয়েছিল, কীভাবে সে ফিরে এসেছিল, রাত আর চাঁদের কথা বর্ণনা করত, সে এক হৃদয়বিদারক স্মৃতি। আমার অবচেতন মন তার বাজনা শুষে নিত। আমি অনুভব করলাম তার শব্দগুলো কীভাবে বাস্তবতাকে প্রকাশ করছে। আমি তখন শিখেছি, শিল্প আসে সহজ জিনিস থেকে। আমি এই লোকটিকে অনুকরণ করতে চেয়েছিলাম।

ইসরায়েলি কবি ও সাহিত্য সমালোচক হেলিত ইয়েশুরুন
প্রশ্ন

নির্বাসন আপনার কবিতাকে পরিমার্জিত করেছে, সমৃদ্ধ করেছে। দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে আপনি যে কবিতা লিখেছিলেন, তাতে যে রূপান্তরের অভাব ছিল, সেই অভাব পূর্ণ করেছে।

মাহমুদ দারবিশ: এটা সত্য, কিন্তু আমাকে কিছু ধারণা পুনর্বিবেচনা করার অনুমতি দিন। আগে আমি বিশ্বাস করতাম যে কবিতা যুদ্ধের একটি রূপ, কিন্তু আজ আমি মনে করি না, এর তাৎক্ষণিক কোনো কাজ আছে। এর প্রভাব খুবই ধীর এবং ক্রমবর্ধমান। সুরকে পরিমার্জিত করতে যা আমাকে তখন সাহায্য করেছিল তা হচ্ছে দূরত্ব। দূরত্ব আমাকে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে, পেশা, ভূদৃশ্য আর কারাগার পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করেছিল। পবিত্রতার পরিমাপ যোগ করেছিল এবং বাধ্যবাধকতা ছাড়াই সৌন্দর্যের ধর্মে পরিণত হয়েছিল। দূরত্বের মধ্যে অদৃশ্য ব্যাপার হলো মুক্তি। যে আপনাকে যত কম জানবে, আপনি নিজেকে তত বেশি জানবেন। এটি পরিপক্বতারও বিষয়। আমি অনেক পড়েছি, ইউরোপীয় কবিতা শুনেছি। ক্ষমা শিখেছি। কারণ, শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই নির্বাসিত। দখলদার এবং আমি—আমরা উভয়ই নির্বাসনে ভুগছি। সে আমার মধ্যে নির্বাসিত এবং আমি তার নির্বাসনের শিকার। এই সুন্দর গ্রহ পৃথিবীতে আমরা সবাই, আমরা সবাই প্রতিবেশী, আমরা সবাই নির্বাসিত, আমরা সবাই একই মানবিক ভাগ্যে হাঁটছি। আর আমাদের একত্র করছে এই নির্বাসনের গল্প বলার প্রয়োজন।

প্রশ্ন

এটা কি দূরত্বের আদর্শীকরণ নয়? নির্বাসনের কি কোনো মূল্য নেই?

মাহমুদ দারবিশ: নির্বাসনে আকাঙ্ক্ষার একটি ব্যক্তিগত মূল্য আছে। প্রান্তিকতার অনুভূতি। কিন্তু বাস্তবতার সমান্তরাল একটি পৃথিবী তৈরির মাধ্যমে এর ক্ষতিপূরণ আসে। দূরত্বও এ কাজটিই করে। ভৌগোলিক দূরত্ব কবিতার সময়সীমাও তৈরি করে, যার তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

প্রশ্ন

আপনার কবিতার ‘আন্দালুসিয়ার শেষ মুহূর্তের ওপর থাকা এগারোটি নক্ষত্র’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে চাই। আরবি কবিতায় আন্দালুস মানে কী? আপনার কাছে এর মানে কী?

মাহমুদ দারবিশ: আরবি ঐতিহ্যে আন্দালুস হচ্ছে হারানো স্বর্গের প্রতি সম্মিলিত বিলাপ। অতীতের প্রতি নাটকীয় আকর্ষণ। জাহেলিয়াত-পূর্ব ইসলামিক কবিতার অনুরূপ, যেখানে কেউ স্থানের জন্য, হারিয়ে যাওয়া বাড়ির জন্য কাঁদে। এটাই ঐতিহ্য—কবিতাটি শুরু হয় হারিয়ে যাওয়া পাথর আর তাঁবুর জন্য বিলাপ দিয়ে। যাযাবরদের কবিতা, যারা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করেছিল। কবি এগিয়ে যান আর পাথর খুঁজে পান—লায়লা এখানে ছিলেন, লুবনা এখানে ছিলেন। সেসব প্রিয়জন আর নেই। এরপর [কবি] ঘোড়া বা উটের বর্ণনা দিতে দিতে এগিয়ে যান এবং সেখান থেকে আধিভৌতিক প্রশ্নগুলোতে পৌঁছান। আন্দালুস ছিল এক হারানো জায়গা। পরে প্যালেস্টাইন আন্দালুসে পরিণত হয়। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে প্যালেস্টাইন সম্পর্কে লেখা জনপ্রিয় কবিতায় আছে: ‘আমরা আন্দালুসকে যেমন করে হারিয়েছিলাম ঠিক তেমনি প্যালেস্টাইনকেও হারিয়েছিলাম।’ এটা আমার মতামত নয়। আমি সব সময় বলেছি, আন্দালুস ফিরে আসতে পারে। স্পেন থেকে বিতাড়ন আর কলম্বাসের আমেরিকা আগমনের ৫০০তম বার্ষিকী উদ্‌যাপনের জন্য আমি ‘এগারো প্ল্যানেটস’ লিখেছিলাম। আপনি জানেন যে তিনি দুর্ঘটনাক্রমে সেখানে পৌঁছেছিলেন। আমার কবিতাগুলো এই মহান ঐতিহাসিক বিকাশের ভেতর একজন আরব কবির আহ্বান ছিল। আমার দৃষ্টিভঙ্গি এই নয় যে আন্দালুস আমার এবং আমার দৃষ্টিভঙ্গি এই নয় যে প্যালেস্টাইন সেই হারিয়ে যাওয়া আন্দালুস। আমি কেবল পৃথিবীতে নির্বাসিতদের মধ্যে সংলাপ তৈরি করার চেষ্টা করেছি। আন্দালুসের ওপর কোনো অধিকার দাবি করিনি। কিন্তু আমি সেই আরবের বেদনা এবং কান্না বুঝতে পারি, যারা ৭০০ বছর ধরে একটি জায়গায় বাস করেছে, যার অন্য কোনো জায়গা নেই, যার অন্য কোনো মিলনস্থল নেই এবং যাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার দৃষ্টি ঔপনিবেশিক ছিল না। আমি সর্বত্র মানুষের ভিন্নতা অনুসন্ধান করেছিলাম। এভাবে আন্দালুস এখানে বা সেখানে, যেকোনো জায়গায় থাকতে পারে। আমার জন্য আন্দালুস ছিল মানব সংস্কৃতি নির্মাণের প্রকল্পে অপরিচিতদের মিলনস্থল।

এটা কেবল ইহুদি আর মুসলমানদের সহাবস্থানেই বিরাজমান ছিল না, বরং তাদের ভাগ্যও একই ছিল। তারা একসঙ্গে চলে গিয়েছিল। স্পেন সরকার ইসরায়েলিদের কাছে ক্ষমা চেয়েছিল; কিন্তু তারা আরবদের কাছে ক্ষমা চায়নি। এটাই ক্ষমতার ভারসাম্য, যার সঙ্গে মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। আমার কাছে আন্দালুস হলো কবিতার স্বপ্নের বাস্তবায়ন। মানবতাবাদী ও সাংস্কৃতিক স্বর্ণযুগ।

স্বদেশ, বিপ্লব আর দেশপ্রেমের বিস্তৃত অর্থ ভঙ্গুর উপাদান দিয়ে গঠিত। স্বদেশ একটি বিস্তৃত ধারণা। কিন্তু যখন আমরা স্বদেশে যাই তখন একটি নির্দিষ্ট গাছ, একটি নির্দিষ্ট পাথর, একটি জানালা খুঁজি। এ উপাদানগুলো খুব ঘনিষ্ঠ এবং এটি কোনো পতাকা বা সংগীত নয়। আমি এসব ছোট জিনিসগুলোর জন্য আকুল।
মাহমুদ দারবিশ
প্রশ্ন

‘মেমরি ফর ফরগেটফুলনেস’ বইটিতে আপনি লিখেছেন, ‘আমরা কী কামনা করি, তা জানা আমাদের কর্তব্য। এটা কি জমির জন্য নাকি জমির ভেতরের জমির জন্য আমাদের যে আকাঙ্ক্ষা সেটার প্রতিচ্ছবির জন্য?’

মাহমুদ দারবিশ: স্বদেশ, বিপ্লব আর দেশপ্রেমের বিস্তৃত অর্থ ভঙ্গুর উপাদান দিয়ে গঠিত। স্বদেশ একটি বিস্তৃত ধারণা। কিন্তু যখন আমরা স্বদেশে যাই তখন একটি নির্দিষ্ট গাছ, একটি নির্দিষ্ট পাথর, একটি জানালা খুঁজি। এ উপাদানগুলো খুব ঘনিষ্ঠ এবং এটি কোনো পতাকা বা সংগীত নয়। আমি এসব ছোট জিনিসগুলোর জন্য আকুল।

প্রশ্ন

আপনি কি স্বপ্ন হারানোর বিষয়ে চিন্তিত?

মাহমুদ দারবিশ: এটি আমার কবিতায় একটি জীবন্ত মিথ। স্বপ্ন ভাঙার ভয় সব সময় থাকে। আমার শেষ বইয়ে আমি বলেছিলাম, ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে: স্বপ্ন খুঁজে বের করা।’ স্বপ্ন হচ্ছে আকাশের টুকরা, যা প্রত্যেকের মধ্যে পাওয়া যায়। আমরা সীমাহীন বাস্তববাদী বা প্রায়োগিক হতে পারি না। আমাদের আকাশ প্রয়োজন। সত্য আর কাল্পনিকতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। স্বপ্ন হচ্ছে কবিতার প্রদেশ।

প্রশ্ন

বৈরুত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এটা কি শহর নাকি মুখোশ? নির্বাসন নাকি কবিতা?’ বৈরুত কি কবিতার রূপক হয়ে উঠেছে?

মাহমুদ দারবিশ: খুব অল্প সময়ের জন্য। আমরা লেবাননকে চিনতাম না। আমরা বৈরুতে নিজেদের জন্য তৈরি একটি ঘেটোর ভেতরে থাকতাম। আমরা সবাই ভাবতাম বৈরুত কী। লেবানিজরাও তা জানে না। প্রকৃত লেবানিজরা পাহাড়ে বাস করে। বৈরুত ম্যানহাটানের মতো, একটি মিশ্র শহর। আমরা কেবল বৈরুতে নিজেদের দেখেছি। সেখানকার প্রতিটি রাস্তাই নিজের কাছে একটি শহর। বিশেষ করে যুদ্ধের সময়। ঘটনার দ্বন্দ্বগুলোকে জোর দেওয়ার জন্য আমি এমনটা ব্যবহার করেছি। বৈরুত ছিল একটি ঘটনা। সেই সময়ের আমার লেখা নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই আমি। যুদ্ধ ইতিমধ্যে ১৯৭৫ সালে শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমি এর দুই বছর আগে সেখানে পৌঁছেছিলাম। আমি ‘বৈরুতের জন্য একটি কবিতা’ লিখেছিলাম। লেবানিজদের সেটা ভালো লাগেনি। তারা বলেছিল, ‘এটি আপনার শহর নয়।’ তারা বলেছিল, আমি একজন বিদেশি। তাই আমি সেখানে ক্ষণস্থায়ী বোধ করতাম। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়যুক্ত যে কেউ অনুভব করেছিল, বৈরুতে ফিলিস্তিনি সত্তা বেশি দিন টিকে থাকবে না। [একদিকে] লেবানিজ, [অন্যদিকে] ফিলিস্তিনি ও সিরিয়ানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী সংবেদনশীলতা দেখা দিতে শুরু করে। সেখানে আমাদের উপস্থিতি তাদের জন্য অস্বস্তিকর ছিল। ফিলিস্তিনি প্রশ্নের বোঝা তারা বহন করতে পারছিল না। আমি তাদের বুঝতে পারি।

এটা আমার জীবনের একটা অধ্যায়। বৈরুত কোনো কবিতা ছিল না। এটা ছিল একটা মুখোশ।

যদি একজন জাতীয় কবি প্রতিনিধি হন, তাহলে বলব আমি কারও প্রতিনিধিত্ব করি না। আমার জন্য স্বাধীন বোধ করাটাই গুরুত্বপূর্ণ। কবিতার জন্য প্রত্যাশা থাকাটা আমাকে বিরক্ত করে, কিন্তু আমি এর কাছে আত্মসমর্পণ করি না। তারা বলে, আমার প্রতিটি প্রেমের কবিতাই ভূমি–সম্পর্কিত। এগারো প্ল্যানেটসের সেই ‘রিতা’ হচ্ছে ফিলিস্তিন। ‘রিতা’ একটি কামোত্তেজক কবিতা, কিন্তু কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে না।
মাহমুদ দারবিশ
প্রশ্ন

বেশ কিছুদিন ধরেই আপনাকে ফিলিস্তিনিদের জাতীয় কবি হিসেবে ভাবা হচ্ছে এবং আপনি তাদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এই মর্যাদা কি কবি হিসেবে আপনার বিকাশের পথে হুমকি নয়? আপনার কি মনে হয় না, আপনি এর ভেতরে বন্দী হয়ে গেছেন?

মাহমুদ দারবিশ: এটা নির্ভর করে ‘জাতীয়’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে তার ওপর। যদি একজন জাতীয় কবি প্রতিনিধি হন, তাহলে বলব আমি কারও প্রতিনিধিত্ব করি না। আমার লেখাগুলো কীভাবে পড়া হয়, তার জন্য আমি দায়ী নই। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত কণ্ঠস্বরের মধ্যেই সম্মিলিত কণ্ঠস্বর বিদ্যমান, আমি চাই বা না চাই। যখন আমি প্যারিসে শীতের এক বিষণ্ন সন্ধ্যার কথা বলি, ভালো বা খারাপ, তখন প্রত্যেক ফিলিস্তিনি মনে করে যে আমি তার প্রতিনিধিত্ব করছি। এ ব্যাপারে আমার কিছুই করার নেই। কিন্তু যদি বোঝানো হয় যে জাতীয় কবি হলেন তিনি, যিনি জনগণের চেতনা প্রকাশ করেন, তাহলে আমি তা মেনে নিই, সেটা সুন্দর। বিশ্বের প্রত্যেক কবি স্বপ্ন দেখেন যে তাঁর কণ্ঠস্বরও অন্যদের কণ্ঠস্বর হবে। দুঃখের বিষয়, সমালোচকেরা আমাকে এই তকমা দিয়েছেন, যাতে তাঁরা বলতে পারেন যে আমি একটি সম্প্রদায়ের কবি এবং যাতে তাঁরা লেখাটিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু আমাদের জীবনে রাজনীতি রাজনৈতিক দল নিয়ে গঠিত নয়, এটি ভাগ্যের একটি নাম। আমি মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি, আমার অবস্থান জনসাধারণের কণ্ঠস্বর আর ব্যক্তিগত কণ্ঠস্বরের সীমানায়। কিন্তু আসলে এটা আমার কাছে কোনো ব্যাপার না। হয়তো আমার এ ধরনের জনপ্রিয়তা আছে বলেই আমি নিজেকে খুশি করতে পারি এবং বলতে পারি যে আমি এটা চাই না। যদি তারা আমাকে ভুলে যায়, তাহলে আমিও সেটা চাই। আমার জন্য স্বাধীন বোধ করাটাই গুরুত্বপূর্ণ। কবিতার জন্য প্রত্যাশা থাকাটা আমাকে বিরক্ত করে, কিন্তু আমি এর কাছে আত্মসমর্পণ করি না। তারা বলে, আমার প্রতিটি প্রেমের কবিতাই ভূমি–সম্পর্কিত। এগারো প্ল্যানেটসের সেই ‘রিতা’ হচ্ছে ফিলিস্তিন। ‘রিতা’ একটি কামোত্তেজক কবিতা, কিন্তু কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে না।

প্রশ্ন

রিতা কে?

মাহমুদ দারবিশ: রিতা একটি ছদ্মনাম। কিন্তু এই নাম একজন নির্দিষ্ট নারীর প্রতি ইঙ্গিত করে। নামটির মধ্যে তীব্র আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি শক্তি, দুর্বলতা আর দূরত্ব রয়েছে।

প্রশ্ন

তবু, ‘রিতার দীর্ঘ শীত’ কবিতায় আপনি লিখেছেন, ‘একটা দেহে দুই দেহের কোনো জায়গা নেই, আর এই ছোট ঘরগুলোতে নির্বাসনের কোনো নির্বাসন নেই...বৃথাই আমরা দুই অতলগহ্বরের মাঝে গান গাই।’ এ কবিতায় রিতাই কথা বলছে; আর সে কথাগুলো রাজনৈতিক উক্তির মতো শোনাচ্ছে।

মাহমুদ দারবিশ: কেন মানবতাবাদী বা দুঃখজনক উক্তি নয় সেগুলো? যদি আমি আপনাকে বলি যে রিতা একজন ইহুদি নারী, তবু কি এটা রাজনৈতিক শোনাবে? সম্ভবত এটি একটি দ্বন্দ্বের প্রকাশ, যখন জাতীয় পার্থক্য শরীরকে প্রেম করতে বা প্রেমের গল্প চালিয়ে যেতে বাধা দেয়। আমার কবিতায় রিতা একজন ইহুদি নারী।

প্রশ্ন

আপনি আপনার কবিতায় অনেক খ্রিষ্টীয় প্রতীক স্থাপন করেছেন। ক্রুশবিদ্ধ যিশু ফিলিস্তিনের রূপকার হিসেবে আবির্ভূত হন। খ্রিষ্টধর্মের প্রতি আপনার ভালোবাসার উৎস কী?

মাহমুদ দারবিশ: আমার কাজের প্রতীক স্থির নয়, চূড়ান্তও নয়। নমনীয়। কবিতার চাহিদা অনুসারে অর্থ পরিবর্তিত হয়। একজন ভালো ফিলিস্তিনি হিসেবে, আমার মধ্যে সব ধর্মই পাওয়া যায়। আমি এমন একজন মানুষ, যে পৃথিবী, ভূদৃশ্য, সংস্কৃতি এবং ইতিহাস উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি। আমি এই স্থানের সন্তান হতে পেরে খুবই খুশি, যার সম্পর্কে কিংবদন্তি লেখা হয়েছে। আমি প্রতীকের স্বর্গে বাস করি। তাই আমি একজন খ্রিষ্টান হিসেবে দ্বিধা ছাড়াই কথা বলি এবং দ্বিধা ছাড়াই আমি ইহুদি পুরাণ ও ঐতিহ্য ব্যবহার করি। কিন্তু খ্রিষ্টের একটি অতিরিক্ত মাত্রা রয়েছে—কষ্ট। এবং তিনি ফিলিস্তিনের বাসিন্দা। তাই আমার কাছে তিনি সহ্য করার এবং ক্ষমা করার একটি উৎকৃষ্ট মডেল। অন্যদের প্রতি ভালোবাসা ও সহনশীলতার বই কীভাবে প্রকাশ করবেন। কবিতায় আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে: তিনি মারা গেলেন, আবার পুনরুত্থিত হলেন। প্রতিবছর তিনি মারা যান এবং জেগে ওঠেন। জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে আমাদের সমগ্র জীবন একটি বিকল্প। প্রতিবার আপনি একটি কবিতায় মারা গেলে, আপনি আবার নতুন করে জন্মগ্রহণ করেন। খ্রিষ্ট একটি প্রাকৃতিক প্রতীক—তিনি সময় ও স্থানের দৃষ্টিকোণ থেকে ফিলিস্তিনি এবং আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বজনীন।

প্রশ্ন

আর উৎপত্তির দৃষ্টিকোণ থেকে ইহুদি।

মাহমুদ দারবিশ: এটা আমাকে বিরক্ত করে না। ধর্মের মধ্যে যুদ্ধ রাজনৈতিক। যদি আমরা আকাশের রং নিয়ে লড়াই করতাম, তাহলে আমরা একটি কাব্যিক যুদ্ধে লিপ্ত হতাম। খ্রিষ্টানরা খ্রিষ্টের প্রতি আমার বন্ধুত্বের জন্য আমাকে বিচার করে না। কারণ, গির্জা ও রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। যখন আমি মুসলিম প্রতীক ব্যবহার করি, তখন আমি আরও সতর্ক থাকি, খুব সতর্ক থাকি। সরকারি ইসলাম খুবই গোঁড়ামিপূর্ণ। ইসলামে নবীদের সঙ্গে কোনো স্বাধীন সম্পর্ক নেই। যা কিছু লেখা আছে তা নির্ধারক; তারা ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য করে না এবং ধর্মের প্রতি সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে না। খ্রিষ্টানরা সে ক্ষেত্রে আরও নমনীয়। তাই খ্রিষ্টধর্মের সঙ্গে আমার সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমি অনেকটাই স্বাধীন।

গাজার দেয়ালে কবি মাহমুদ দারবিশের গ্রাফিতি
প্রশ্ন

আপনাকে খ্রিষ্টধর্মের কোন ব্যাপারটা আকর্ষণ করে?

মাহমুদ দারবিশ: দুঃখ। আমি দুঃখকষ্ট শব্দটি পছন্দ করি। খ্রিষ্ট অনেক বেশি কাব্যিক। কারণ, তিনি ছিলেন এবং ছিলেন না। তিনি আত্মা থেকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মা আছেন, কিন্তু পিতা নেই। তিনি অন্য নবীদের তুলনায় পুরাণের কাছাকাছি এবং আরও বেশি মানুষ। তিনি ওয়াইন পছন্দ করতেন। আমিও ওয়াইন পছন্দ করি। শৈশবে আমরা একজন খ্রিষ্টান আর একজন মুসলিমের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পেতাম না। আমার দাদুর সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিলেন গ্রামের পুরোহিত। আমি ইস্টার ভালোবাসি, গির্জার মিছিল। প্রেমিক-প্রেমিকাদের মিলনের মতো।

প্রশ্ন

যখন আপনি বলেন যে আপনি ট্রয়ের কবি হতে চান, তখন কি তাতে পরাজয়ের আকাঙ্ক্ষা থাকে না?

মাহমুদ দারবিশ: না। সেখানে যা গুরুত্বপূর্ণ, তা খুঁজে পাই। সেখানে আমি অব্যক্ত কথা বলতে পারি, যা বলা হয়নি তা বলতে পারি। কবিতা সর্বদা এমন জিনিসের সন্ধান করে, যা এখনো বলা হয়নি। আমি হোমারের সঙ্গে কিছু যোগ করতে পারি না, তবে আমার ভেতরের মানবিক শূন্যতা, যা ট্রয়, আমি তার ওপর ভিত্তি করে গড়ে তুলতে পারি। পরাজয় হলো মানুষের ভাগ্য পর্যবেক্ষণের একটি চাবিকাঠি, বিজয়ীর পক্ষে অসম্ভব একটি পর্যবেক্ষণ। হতাশা কবিকে ঈশ্বরের কাছাকাছি নিয়ে আসে, তাকে লেখার উৎপত্তিতে, প্রথম শব্দে ফিরিয়ে আনে। বিজয়ীর ধ্বংসের শক্তিকে প্রতিহত করে। কারণ, হতাশার ভাষা আশার ভাষার চেয়ে শক্তিশালী। ট্রয়ের কথা এখনো বলা হয়নি এবং কবিতা হচ্ছে বক্তৃতার শুরু।

প্রশ্ন

আপনি অন্যের কথা বলেন, আসলে সেই অন্য বলতে বেশির ভাগই ফিলিস্তিনি। আজ কি আপনার ভেতরে অন্য একজন ইহুদি, ইসরায়েলি, এমন কারও জন্য কোনো জায়গা আছে?

মাহমুদ দারবিশ: আমার পরিচয়ে ইসরায়েলিরা যে স্থান দখল করে আছে তা এড়িয়ে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি তাকে যা–ই ভাবি না কেন, সে বিদ্যমান। আমার জন্য সে একটি শারীরিক ও মানসিক সত্য। ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের বদলে দিয়েছে এবং তা বিপরীতভাবে। ইসরায়েলিরা সেই একই মানুষ নয়, যারা এসেছিল আগে এবং ফিলিস্তিনিরা সেই একই মানুষ নয়, তারা যা আগে ছিল। একটার সঙ্গে আরেকটা আছে। যদি ইসরায়েলিরা আমার পরিচয় ছেড়ে দেয়, তাহলে কি এটি ভেঙে যাবে? আমার মনে হয়, এটাই ছিল আপনার প্রশ্ন। আমি এ ধরনের প্রশ্নের মধ্যে যেতে চাই না। সর্বোপরি, আমি আরব সংস্কৃতির সন্তান। যদি আমি এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত থেকে অনুপস্থিত থাকতাম, তাহলে আমি নিজেকে মরক্কো বা ইয়েমেনে খুঁজে পেতাম। তাই আপনার জানা উচিত যে গতকালের ইসরায়েলি বা নতুন ইসরায়েলি কারোরই আমাকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা নেই। কারণ, আমার একটি বিশাল পরিচয়পত্র আছে এবং এটি আটলান্টিক মহাসাগর থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃত।

প্রশ্ন

আপনার কাছে হিব্রু কী?

মাহমুদ দারবিশ: ১০ বা ১২ বছর বয়সে আমি প্রথম বিদেশি ভাষা শিখেছিলাম হিব্রু। আমি এই ভাষায় অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে, পুলিশ অফিসার, সামরিক গভর্নর, শিক্ষক, কারারক্ষী ও প্রেমিকার সঙ্গেও কথা বলেছিলাম। তাই হিব্রু আমার কাছে বিজয়ীর ভাষা বোঝায় না। কারণ, আমি এতে ভালোবাসার কথা বলেছি। হিব্রু আমার বন্ধুদের ভাষাও। এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক বিশুদ্ধ। আমার জন্য ইউরোপীয় সাহিত্যের দরজা খুলে দিয়েছে এই ভাষা। আমি হিব্রুতে লোরকা পড়ি, সেই সঙ্গে নাজিম হিকমেতও, যাকে বামপন্থী শিবিরে পড়তে বাধ্য করা হতো। আমি প্রথম হিব্রুতেই গ্রিক ট্র্যাজেডি পড়ি। হিব্রু আমার শৈশবের স্মৃতির ভাষাও। যখন আমি হিব্রু পড়ি, তখন আমার মনে পড়ে যায় জায়গাটির কথা। সঙ্গে প্রাকৃতিক দৃশ্যও চলে আসে। ইউরোপে আমার অনেক বন্ধু ঈর্ষান্বিত হয় আমাকে মূল ভাষায় বাইবেল পড়তে দেখে। আমি হিব্রু পড়া বন্ধ করিনি, এমনকি ইসরায়েলি সংবাদপত্রও বন্ধ করিনি। আমি হিব্রু সাহিত্যে আগ্রহী, বিশেষ করে কবিতায়। আমি আশা করি, আমি ভাষাটি আবারও তৈরি করতে সক্ষম হব। এটা নিয়ে আমার মধ্যে কোনো জটিলতা নেই।

প্রশ্ন

নির্বাসন কি মুখোশ হয়ে গেছে?

মাহমুদ দারবিশ: না। এখন আমার পরীক্ষা চলছে: বহিরাগত নির্বাসন কিংবা অভ্যন্তরীণ, বহিরাগত না অভ্যন্তরীণ স্বদেশ—আমি জানি না আমি কী চাই। নির্বাসন আমার ভেতরে এত শক্তিশালী যে আমি তা ভূমিতে নামিয়ে আনতে পারি।