Thank you for trying Sticky AMP!!

জীবনানন্দ দাশ (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯-২২ অক্টোবর ১৯৫৪)

প্রফেসরদের ‘মাইনে’ নিয়ে ৭৬ বছর আগে কী বলেছিলেন জীবনানন্দ

আজ ১৭ ফেব্রুয়ারি। কবি জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন। ‘রূপসী বাংলা’র এই কবি চাকরিজীবনে বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন, কিন্তু কোথাও জমিয়ে বসা বা থিতু হওয়া বলতে যা বোঝায়, তা হয়নি তাঁর ক্ষেত্রে। নিজের চাকরি, বেতন-ভাতা নিয়ে কমবেশি সব সময়ই তিনি অস্থিরতার মধ্যে ছিলেন। প্রফেসরদের ‘মাইনে’ নিয়ে কী বলেছিলেন তিনি?

বাংলা ১৩৫৫ সালের কার্তিক মাসে মাসিক ‘বসুমতী’ পত্রিকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ লিখেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। খ্রিষ্টীয় বছর হিসেবে সেটা ছিল ১৯৪৮ সাল। এই প্রবন্ধ যখন বের হয়, তখন জীবনানন্দের বয়স ৪৯ বছর।

আমরা অনেকেই জানি, রূপসী বাংলার কবি চাকরিজীবনে তৎকালীন পূর্ব বাংলা, পশ্চিম বাংলা ও দিল্লি মিলিয়ে বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন, কিন্তু কোথাও জমিয়ে বসা বা থিতু হওয়া বলতে যা বোঝায়, তা হয়নি তাঁর ক্ষেত্রে। নিজের চাকরি, বেতন-ভাতা নিয়ে কমবেশি সব সময়ই তিনি অস্থিরতার মধ্যে ছিলেন। বিরক্ত ছিলেন। তবে শিক্ষকতা পেশার প্রতি তাঁর একধরনের প্রচ্ছন্ন ভালো লাগা ছিল, যদিও বেশির ভাগ সময় তিনি তা স্বীকারই করতে চাননি।

জীবনানন্দ দাশের বাবা সত্যানন্দ দাশ সেই আমলে স্নাতক ছিলেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ তিনি লিখেছিলেন। ছিলেন ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত প্রতিষ্ঠিত বরিশালের ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন এই সত্যানন্দ। আর মা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন একজন কবি। ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’, বহুশ্রুত ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতার তিনি রচয়িতা। মা-বাবার জ্যেষ্ঠ সন্তান জীবনানন্দের ডাকনাম ছিল মিলু।

‘প্রফেসররা কী খাচ্ছে তাহলে?

আমরা ‘বসুমতী’র প্রবন্ধে ফিরে আসি। এই প্রবন্ধের শিরোনাম ‘শিক্ষা-দীক্ষা-শিক্ষকতা’।

জীবনানন্দ দাশ কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। এমএ পাস করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, দ্বিতীয় শ্রেণিতে। পরীক্ষার আগে তিনি ‘ব্যাসিলারি ডিসেন্ট্রি’ রোগে অসুস্থ ছিলেন। তাই কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করতে পারেননি।

লেখাপড়া শেষ করার পর বেশি দিন তাঁকে বসে থাকতে হয়নি। চাকরি পেয়ে গেলেন কলকাতার বেসরকারি সিটি কলেজের ইংরেজি বিভাগে টিউটর পদে, ‘খুব কম মাইনেতে’। তাঁর ভাষায়, তখনকার দিনে সরকারি অফিসের দপ্তরিরা যা পান, তার চেয়ে কম পারিশ্রমিকে। তখন ১৯২২ সাল, জীবনানন্দ ২৩ বছরের যুবক। তিনি লিখছেন, ‘বাংলাদেশের অধিকাংশ বেসরকারি কলেজের বেশির ভাগ অধ্যাপকেরাই যা মাইনে পায়, তাতে মনে হয় আমাদের দেশের পরিচালকদের কোনো আস্থা বা শ্রদ্ধা নেই শিক্ষার ও শিক্ষকদের ওপর। অনেক বেসরকারি কলেজের প্রফেসররা মোটামুটি গভর্নমেন্ট অফিসের লোয়ার ডিভিশনের কেরানিদের মতো মাইনে পায় কিংবা তার চেয়েও কম। তবে গভর্নমেন্টের কেরানিদের মাইনের একটা গ্রেড বা হার ঠিক করা আছে, প্রমোশনের পথ আছে, চাকরির নিশ্চয়তা আছে, পেনসন আছে; প্রায় কোনো প্রাইভেট কলেজের প্রফেসরদেরই এসব কোনো সুবিধা নেই।’

১৯৪৮ সালে জীবনানন্দ দাশ যখন এ প্রবন্ধ লিখছেন, তখন চালের মণ ৩০ থেকে ৪০ টাকা। আর তাঁর চাকরি শুরুর (১৯২২) জীবনে চালের মণ ছিল ৪-৫ টাকা। এক জোড়া জুতার দাম ছিল ৪-৫ টাকা, ২-৩ টাকায় এক জোড়া ধুতি পাওয়া যেত। ‘তখনই সত্তর-আশি থেকে শুরু করে প্রফেসরদের মাইনের একটা উচ্চতম বৃদ্ধি—দেড়শ, একশ ৭৫ টাকা অত্যন্ত নিদারুণভাবে আপত্তিজনক ছিল।’ জীবনানন্দ লিখছেন, ‘এত বছর পরে এসেও সেই প্রাইভেট কলেজের শিক্ষকদের মাইনের কোনো উনিশ-বিশ নেই। ওদিকে চালের মণ হয়ে গেছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা।’ কবির প্রশ্ন, ‘প্রফেসররা কী খাচ্ছে তাহলে? কী পরছে?’

কলেজ যাঁরা চালান, সেই গভর্নিং বডির সদস্যদের বিবেক নিয়ে প্রশ্ন তোলেন জীবনানন্দ। তাঁর ক্ষোভ, গভর্নিং বডির উকিলেরা যেখানে মাসে হাজার-বারোশ কামাচ্ছেন, সেখানে কলেজের প্রফেসরের বেতন যেন ১০০ টাকার বেশি দেওয়া যেতেই পারে না। এমনকি চুল সাদা হয়ে গেলে মরবার আগে ১৭৫ কি বড়জোর দুইশ।

অধ্যাপক নিয়োগে বিভিন্ন কলেজের বিজ্ঞপ্তির ধরন নিয়ে এই নিবন্ধে প্রশ্ন তুলেছেন কবি। একটি কলেজের এ রকম একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে অর্থনীতির প্রফেসর চাওয়া হয়েছে, যেখানে প্রার্থীকে ফার্স্ট ক্লাস হতে হবে। আবার কিছু অভিজ্ঞতাও চাওয়া হয়েছে, অথচ বেতন মোটে ১০০ টাকা। জীবনানন্দ এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘এ রকম প্রলোভনে ইকোনোমিকসের কোনো ফার্স্ট ক্লাস এমএ ভুলবে বলে মনে হয় না।’

১৯৪৮ সালে জীবনানন্দ দাশ যখন এ প্রবন্ধ লিখছেন, তখন চালের মণ ৩০ থেকে ৪০ টাকা। আর তাঁর চাকরি শুরুর (১৯২২) জীবনে চালের মণ ছিল ৪-৫ টাকা। এক জোড়া জুতার দাম ছিল ৪-৫ টাকা, ২-৩ টাকায় এক জোড়া ধুতি পাওয়া যেত।

বেসরকারি কিছু কলেজে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বেতন উল্লেখ থাকে না, আবেদনকারীকেই জানিয়ে দিতে হয় ন্যূনতম কত কম নিতে তিনি রাজি আছেন, কিছু কলেজের কর্তৃপক্ষের এ ধরনের প্রবণতা নিয়ে নিবন্ধে প্রশ্ন তুলেছেন জীবনানন্দ দাশ। তিনি লিখেছেন, ‘মাছের বাজারে তো সের চার টাকা, সাড়ে চার টাকা বেঁধে দেওয়া আছে, কোনো উকিল বা জাস্টিস তো সেটাকে ন্যূনতম করতে পারেননি।’

সেকালে ফার্স্ট ক্লাস এমএ ছাড়া কোনো কলেজে চাকরি পাওয়া কঠিন ছিল। যদিবা কোনো ভাগ্যবান সেকেন্ড ক্লাস এমএ চাকরি পেতেন, তবে তাঁর বেতন হতো ৭০ থেকে ৮০ টাকা, যা ফার্স্ট ক্লাসের চেয়ে অনেক কম। ফার্স্ট ক্লাস এমএ হলেই যে সেকেন্ড ক্লাসের চেয়ে বেশি বিদ্বান ও কুশলী হতে পারেন, তাতে জীবনানন্দের বিশ্বাস ছিল না। তিনি নিজেও অবশ্য এমএ সেকেন্ড ক্লাস। জীবনানন্দ লিখেছেন, ‘ফার্স্ট ক্লাসের চেয়ে ভালো পড়াতে পারলেও সেটা স্বীকৃত হতে চায় না, বেশি অভিজ্ঞতা থাকলেও তাকে ডিঙিয়ে নতুন ফার্স্ট ক্লাসকে উঁচু পদ ও বেশি মাইনে দেওয়া হয়, কলকাতার চেয়ে এ জিনিস মফস্বলেই হয়তো বেশি চলে। এ ছাড়া উপায়ও নেই হয়তো!’

‘টাকা ছাড়া এ দেশে সম্মান পাওয়া যায় না’

এখনো আমাদের শিক্ষকেরা, অধ্যাপকেরা বেতন-ভাতা বাড়ানো বা চাকরি স্থায়ী করার দাবিতে দিনের পর দিন অনশন করেন, মিছিল-সভা করেন। তবু যেন কোনো ফল হয় না। সে যুগে চিত্রটা যে বিশেষ সুখকর ছিল, অন্তত এই প্রবন্ধ পড়ে তা মনে হচ্ছে না। জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, ‘পনেরো-কুড়ি বছর আগে তাঁরা মাইনের জন্য ততটা গ্রাহ্য করতেন না, কলেজে কাজ পেলেই হতো। কিন্তু মাইনে নিয়ে যে অবিচার হচ্ছে মাঝে মাঝে সেটা হৃদয়ঙ্গম হলেও সে সম্বন্ধে কোনো ভালো ব্যবস্থার আশা ও চেষ্টা করা ভারতকে স্বাধীন করার চেয়েও কঠিন মনে হতো।’

প্রবন্ধে বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের এই দশার জন্য তিনি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আঙুল তুলেছেন, কারণ ‘এরা কোনো প্রাইভেট কলেজের প্রফেসরদের দিকে ফিরেও তাকায়নি।..ফলে অধ্যাপকরা টাকাও পাননি, সম্মানও পাননি।’ এ প্রসঙ্গে কবির স্পষ্ট মন্তব্য, ‘টাকা ছাড়া এ দেশে সম্মান পাওয়া যায় না।’

আজ থেকে ৭৬ বছর আগে কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর যে উপলব্ধির কথা লিখে গেছেন, তা কি এখনো প্রাসঙ্গিক আছে, নাকি বাসি হয়ে গেছে? কী মনে হয় আপনার, প্রিয় পাঠক?