আষাঢ় মাসে কত কী না–ঘটে, আষাঢ়ে অফার সর্বনেশেও বটে

কারও আষাঢ় মাস, কারও সর্বনাশ

অলংকরণ: রাকিবুর রহমান
অলংকরণ: রাকিবুর রহমান

বৃষ্টির সঙ্গে রোমান্টিকতার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতার কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। কলকাতা শহরের কোনো এক ভঙ্গুর রাস্তার গর্তে পড়ে গিয়েছিল রিকশার চাকা। বাইরে অঝোর বৃষ্টি। পর্দায় ঢাকা হুড তোলা রিকশার ভেতর কম্পমান প্রেমিক-প্রেমিকা। বৃদ্ধ রিকশাওয়ালার বেশ সময় লেগেছিল চাকা তুলতে।

‘রিকশার পর্দা টাঙানো বাসরঘরে’ অবিস্মরণীয় সময় কাটিয়েছিল প্রেমিকযুগল। ঢাকার রিকশাওয়ালা কিন্তু কলকাতার রিকশাওয়ালার মতো বেরসিক নয়। বৃষ্টিস্নাত রিকশার যাত্রী প্রেমিক-প্রেমিকা। হঠাৎ রিকশার গতি কমে গেল। প্রেমিক জিজ্ঞাসা করল, ‘আস্তে চালাচ্ছেন কেন?’ রিকশাওয়ালার জবাব, ‘আফা যে কইলো আস্তে...আস্তে।’

এক বর্ষার বিকেলে পাত্রপক্ষ কনে দেখতে গেছে। সুসজ্জিতা পাত্রীকে দেখে পাত্রপক্ষ মুগ্ধ। আলাপচারিতা ও আপ্যায়নের পর পাত্র-পাত্রী একান্তে কথা বলছেন বারান্দায়। হঠাৎ পাত্র কিছুটা সংকোচ নিয়ে পাত্রীকে বললেন, ‘আমরা কি কিছুক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজতে পারি?’ লাজুক হেসে পাত্রী বললেন, ‘আপনি দেখছি খুব রোমান্টিক।’ পাত্র বললেন, ‘ঠিক তা নয়, বৃষ্টিতে ভিজলে আপনার আসল সৌন্দর্য বুঝতে পারতাম।’

বিজ্ঞানের যুগ ছাড়িয়ে আমরা এখন অফারের যুগে বসবাস করছি। ক্রেতামাত্রই আজকাল অফারসন্ধানী। ব্যবসায়ীরা বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরে তাঁদের বিক্রীত পণ্যের ওপর বিচিত্র অফার দিয়ে ক্রেতাদের প্রলুব্ধ করছেন। আষাঢ় মাসও অফার দিচ্ছে।

মাত্র ২০ মিনিট বৃষ্টির পানিতে ভিজলে পাওয়া যাচ্ছে ৩ দিনের জ্বর, ৫ দিনের সর্দি, ৬ দিনের কাশিসহ ৭ দিন বিছানায় শুয়ে থাকার অপূর্ব সুযোগ! মহামারি করোনার কারণে ঘরে শুয়ে–বসে থেকে যাঁরা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, তাঁরা নিজেদের বলছেন, ‘ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।’ তাঁরা সহজেই আষাঢ়ের অফারটি গ্রহণ করে ঘরে শুয়ে–বসে সময় কাটাতে পারেন।

ঘনঘোর বর্ষায় ছাতা খুব প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। গৃহকর্তা তাঁর মালিকে ডেকে বললেন, ‘বাগানের ফুলগাছগুলোয় পানি দিয়ে এসো।’ মালি বললেন, ‘হুজুর, এখন তো বৃষ্টি পড়ছে।’ গৃহকর্তার জবাব, ‘তাহলে ছাতা নিয়ে যাও।’ ছাতা সম্পর্কে স্মরণীয় উক্তি রয়েছে মার্ক টোয়েনের। তিনি বলেছিলেন, একজন ব্যাংকার হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে আপনাকে ছাতা ধার দেয়, আর বৃষ্টি নামামাত্র সেটি ফেরত চায়।

অর্থাৎ আষাঢ় মাস কারও কারও জন্য সুখের বার্তাবাহক হলেও অনেকের জন্যই সর্বনাশের নামান্তর। আষাঢ় মাসে ঘরে ঘরে যে জ্বর, সর্দি, কাশির হানা, তাতে কারও কারও লাভ ষোলো আনা। চিকিৎসক ও ওষুধ ব্যবসায়ীদের তখন পোয়াবারো। রিকশাওয়ালার অবস্থাটা ভাবুন।

বৃষ্টির অজুহাতে ইচ্ছেমতো ভাড়া চাইবে। কেউ কেউ আবার চোয়ালবদ্ধ হয়ে থাকে যে যাবেই না। তবে আষাঢ় মাস সবচেয়ে ‘সৌভাগ্য’ বয়ে আনে ঠিকাদারদের জন্য। এ সময় ‘এই পথ খোঁড়া যদি না শেষ হয়...’ হয়ে ওঠে তাদের জাতীয় সংগীত। বর্ষা মানেই রাস্তায় খননযজ্ঞ। আর সর্বনাশ হয় সাধারণ পথচারী ও যাত্রীদের। ট্রাফিক জ্যামে জর্জরিত রাস্তার জ্যাম বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এটিও আষাঢ়ে অফার।

বিদ্যালয়বিমুখ শিক্ষার্থীদের জন্যও আষাঢ় সুখের মাস। অনেক ছাত্রছাত্রী ক্লাস ফাঁকি দেয় বৃষ্টির অজুহাতে। টানা কয়েক দিন ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার পর এক ছাত্র ক্লাসে গেল। শিক্ষক সেদিন সবাইকে ‘একটি ক্রিকেট ম্যাচ’ রচনা লিখতে দিয়েছেন। সবার আগে সেই ছাত্র রচনা লিখে খাতা জমা দিল। শিক্ষক বিস্মিত চোখে দেখলেন খাতায় লেখা, বৃষ্টির কারণে ম্যাচ পরিত্যক্ত। আরেক শিক্ষক ট্রান্সলেশন করতে দিলেন, ক্লাসে বৃষ্টি পড়ছে। এক ছাত্রের সপ্রতিভ জবাব, বৃষ্টি ইজ রিডিং। এই ছাত্রের ভুল ধরার সাধ্য কার!

মেঘলা দিনে ভোজনরসিকদের আগ্রহ বেড়ে যায় খিচুড়ি-ইলিশের প্রতি। খেতে খেতে তাঁদের কেউ কেউ গুনগুন করেন, ‘এমন দিনে তারে খাওয়া যায়’। বেচারা ইলিশের কী দুর্দশা তখন! এভাবেই কারও আষাঢ় মাস, অন্য কারও সর্বনাশ হয়। ক্ষেত্রবিশেষে একই ব্যক্তি কখনো আষাঢ় মাস, কখনো সর্বনাশ মনে করেন বৃষ্টিকে। যেমন নাসিরুদ্দিন হোজ্জা।

এক বৃষ্টির দিনে নাসিরুদ্দিন হোজ্জা জানালার পাশে বসে ছিলেন। তিনি এক ব্যক্তিকে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দ্রুত দৌড়ে যেতে দেখলেন। হোজ্জা তাঁকে থামিয়ে বললেন, বৃষ্টি ওপরওয়ালার আশীর্বাদ। সেই আশীর্বাদ এভাবে এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়।

হোজ্জার কথা শুনে লোকটি লজ্জিত হয়ে বৃষ্টিতে ভিজে গন্তব্যে রওনা হলেন। এর কয়েক দিন পর আবার বৃষ্টি নামল। এবার বিপরীত চিত্র। লোকটি জানালা দিয়ে দেখলেন, হোজ্জা বৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে দৌড়ে যাচ্ছেন।

লোকটি হোজ্জাকে ডেকে বললেন, ‘তুমিই তো সেদিন বললে, বৃষ্টি ওপরওয়ালার আশীর্বাদ। আজ সেই আশীর্বাদ ফেলে তুমিই পালিয়ে যাচ্ছ?’ হোজ্জা লোকটির কথায় থামলেন না। বরং দৌড়াতে দৌড়াতে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি এখনো তা–ই বলছি। ওপরওয়ালার সেই আশীর্বাদ কি পা দিয়ে মাড়ানো উচিত? এ জন্যই তো দ্রুত বাড়ি যাচ্ছি।’