দশ দিগন্ত

কীভাবে এল ‘নভেম্বর রেইন’

একঘেয়ে অস্বস্তিকর ঢাকা শহরে বহুদিন পর বৃষ্টি হলো। বৃষ্টিটাও একঘেয়ে—সারা দিন টিপ টিপ টিপ টিপ করে ঝরল। মাসটা যেহেতু নভেম্বর, তাই অবধারিতভাবে এই সময়ে বৃষ্টি এলে ‘নভেম্বর রেইন’ শব্দটা মনে পড়বেই। আর যাঁরা নব্বইয়ের প্রজন্ম, তাঁদের তো রীতিমতো নস্টালজিক করে তোলে ‘নভেম্বর রেইন’ শব্দযুগল। বর্তমানে সাহিত্যের মধ্যেও স্থান করে নিয়েছে শব্দটি।

‘নভেম্বর রেইন’ শুধুই কি এক মামুলি শব্দ? মোটেও নয়। এ এক ইতিহাস। পৃথিবীর রক সংগীতের ইতিহাসে সোনার কালিতে ইতিমধ্যেই লেখা হয়ে গেছে গেছে এই গান। আধুনিক সংগীতের ইতিহাস ‘নভেম্বর রেইন’কে বাদ রেখে লেখার সাধ্য হবে না কারও।

কারণ কী? কী আছে এই গানে? আর দশটি গানে যা থাকে, এই গানেও তা আছে। লিরিক, সুর, বাদ্যযন্ত্র, গায়কি, মিউজিক ভিডিও—এসবই। তবু এই গান লক্ষকোটি গানের ভেতর থেকে জীবনানন্দের কবিতার মতো ‘নিজেরই মুদ্রাদোষে আমি একা হতেছি আলাদা’ বলে আলাদা হয়ে গেছে।

নভেম্বর রেইন আলাদা হয়েছে এর অসামান্য লিরিকের কারণে, অনন্যসাধারণ সুরের কারণে, অসাধারণ যন্ত্রানুষঙ্গের কারণে, অনিন্দ্যসুন্দর মিউজিক ভিডিওর কারণে। যাঁরা গানটি শুনেছেন, তাঁরা জানেন, পুরো গানটি যেন এক গল্প। নব্বইয়ের লাজুক প্রেমের গল্প ধরা আছে এই গানে। দ্বিধা-ভয়-সংকোচে ভরা নব্বইয়ের প্রেম গুমরে কাঁদার আকুতি আছে গানটির ভাঁজে ভাঁজে। এক যুবা-প্রেমিক দেখছে তার চোখের সামনে একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে তার প্রেমিকা, যেন আগের সুরে বাজছে না প্রেমটা, চেনা প্রেমিকা একটু একটু করে অচেনা হয়ে যাচ্ছে, ধীরে মুছে যাচ্ছে প্রেম।

এই ক্রমশ অচেনা হয়ে ওঠা প্রেম একদিন আবারও চেনারূপে ফিরে আসবে, চেনা সুরে গেয়ে উঠবে প্রেমের পাখিটা—এমন এক আশাবাদ তবু অন্তরে লালন করছে বিরহী প্রেমিক। সে বিউগলের মতো করুণ কান্নার সুরে সুরে গাইছে:

নেভার মাইন্ড দ্য ডার্কনেস

উই স্টিল ক্যান ফাইন্ড আ ওয়ে

কজ নাথিং লাস্টস ফরএভার

ইভেন কোল্ড নভেম্বর রেইন।

এ অংশের বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়—

ঘোর তমসায় ভয় নেই, নেই ভয়

পাবই পাব পথ খুঁজে নিশ্চয়

কেননা কিছুই নয় অক্ষয় সৃষ্টি

এমনকি নয় নভেম্বরের বৃষ্টি।

অর্থাৎ কোনো কিছুই অক্ষয় বা চিরস্থায়ী নয়, এমনকি নভেম্বর রেইনের মতো জটিল সময়ও একসময় শেষ হয়। প্রেমিক সেই দিনের অপেক্ষায় আছে।

● ‘নভেম্বর রেইন’-এর মিউজিক ভিডিও ছিল সেই সময়ের সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল প্রোডাকশন। দেড় মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তৈরি করা হয় এটি। ● প্রায় ১০ বছর ধরে এই গানের লিরিক লিখেছেন এক্সেল রস। ● মিউজিক ভিডিও তৈরি করা হয় ডেল জেমসের ছোটগল্প ‘উইদাউট ইউ’ অবলম্বনে। ডেল জেমস ছিলেন এক্সেলের বন্ধু। ● মিউজিক ভিডিওটি ১৯৯২ সালে এমটিভি পুরস্কার পায়। ● স্ল্যাশ এই গানে দুটি গিটার বাজিয়েছিলেন।

চিরচেনা এই প্রেম সবার হৃদয় ছুঁয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। ছুঁয়েছেও। ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই গানটি ইউটিউবে এক বিলিয়ন ভিউয়ের মাইলফলক স্পর্শ করেছে। ইউটিউবে কোনো গানের এটিই ছিল সর্বোচ্চ ভিউ। এখন তা বাড়তে বাড়তে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে কে জানে! অথচ এই গানই কিনা অ্যালবামে রাখতে চাননি গানস এন রোজেস ব্যান্ডের রোজ, স্লাস ও অন্য সদস্যরা!

সালটা ১৯৯১। গানস এন রোজেস ব্যান্ড থেকে ‘ইউজ ইয়োর ইলিউশন ওয়ান’ নামে একটি অ্যালবাম বের হবে। গান প্রস্তুত করা হলো ১০টি। সেখানে স্থান পেল না ‘নভেম্বর রেইন’ নামের গান। এত ম্যাড়মেড়ে গান, এত নাকি কান্নার প্রেম এই অ্যালবামে রাখার কোনো মানে হয় না। শেষে অ্যালবাম মার খাবে। এই ছিল যুক্তি।

ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল ব্যান্ডটির প্রধান গায়ক এক্সেল রসের। ১৯৮৩ সাল থেকে গানটি লিখছেন তিনি। প্রায় ১০ বছর খেটেখুটে সুর বসিয়ে তৈরি করেছেন গানটি। রাতদিন খেটেখুটে করেছেন মিউজিক কম্পোজ। আর এখন কিনা সেই গানেরই জায়গা হচ্ছে না অ্যালবামে!

গোঁ ধরলেন এক্সেল, গানটা রাখতেই হবে। না হলে কোনো গানই তিনি গাইবেন না। শেষে এক্সেলের জেদের কাছে হার মানেন গানস এন রোজেস ব্যান্ডের অন্য সদস্যরা। ‘ঠিক আছে, অ্যালবামের দশ নম্বর গান হিসেবে “নভেম্বর রেইন” রাখা যায়। কিন্তু এত লম্বা গান রাখা কি ঠিক হবে? একটু ছোট করলে ভালো হয় না?’

এক্সেল বললেন, ঠিক আছে। ছোট করা হবে।

‘নভেম্বর রেইন’ ছিল ২৫ মিনিটের লম্বা এক গান। সেটা কেটেকুটে ৮ মিনিট ৫৯ সেকেন্ডে আনা হলো। এরপর এত দরদ দিয়ে গাইলেন এক্সেল, এত নিষ্ঠা নিয়ে গিটার বাজালেন স্লাস, এত দক্ষতার সঙ্গে কি-বোর্ড বাজালেন ডিজি, এত উন্মাতালভাবে ড্রাম বাজালেন সোরাম যে অ্যালবাম প্রকাশের পরপরই সারা দুনিয়ায় সাড়া পড়ে গেল। যে গান অ্যালবামে রাখতেই চাননি কেউ, সেই গানই কিনা মন ছুঁয়ে গেল হাজার হাজার মানুষের!

১৯৯১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মুক্তি পায় ‘ইউজ ইয়োর ইলিউশন ওয়ান’। এরপর ইতিহাস হয়ে যায় ‘নভেম্বর রেইন’। যুক্তরাষ্ট্রের বিলবোর্ড চার্টে ৩ নম্বরে উঠে আসে, যুক্তরাজ্যের হিট গানের তালিকায় ৪ নম্বরে এবং অস্ট্রেলিয়ায় টানা ২২ সপ্তাহ টপ টেন তালিকায় ছিল এই গান। ওই বছরই ‘নভেম্বর রেইন’ পায় এমটিভি পুরস্কার।

এর মিউজিক ভিডিও যেভাবে তৈরি হলো, তা-ও এক ঘটনা বটে। যখন গানটির মিউজিক ভিডিওর দরকার হলো, এগিয়ে এলেন পরিচালক এন্ডি মোরাহান। তিনি মাইকেল জ্যাকসনের গানের মিউজিক ভিডিও তৈরি করে তখনই বিখ্যাত হয়ে গেছেন। বললেন, বাজেট বেশি পড়বে। গানস এন রোজেস বাহিনী বলল, সমস্যা নেই। শেষে দেড় মিলিয়ন ডলার (১৫ লাখ) ব্যয়ে নির্মিত হলো ‘নভেম্বর রেইন’-এর মিউজিক ভিডিও।

মিউজিক ভিডিওর গল্পটা নেওয়া হলো মার্কিন লেখক ডেল জেমসের ছোটগল্প ‘উইদাউট ইউ’ থেকে। এতে অভিনয় করলেন গানস এন রোজেসের শিল্পীরাই আর এক্সেলের প্রেমিকা সেমুর।

গির্জার বাইরে খোলা প্রান্তরে পা ছড়িয়ে গিটারে ঝড় তুলছেন স্লাশ, পিয়ানোতে কান্নার করুণ সুর তুলছেন এক্সেল, সঙ্গে অপূর্ব গায়কি—ক্রেন শটে ধরা এই দৃশ্য কোটি কোটি সংগীতপিপাসুকে আজও মুগ্ধ করে। এমন এক মিউজিক ভিডিও কেন ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবে না, বলুন?

সূত্র: সং ফ্যাক্টস, আই লাভ ক্ল্যাসিক রক, ইউ ডিসকোভার মিউজিক ও এমটিভি।