অলংকরণ
অলংকরণ

শরৎ ঋতুর কথকতা

এখন শরৎ নিয়ে মাতামাতির শেষ নেই। শরতের নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে যান অনেকেই, এ ঋতুতে হয় উৎসবও। কিন্তু বাংলায় কীভাবে এল শারদোৎসব?

ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। কথাটা কবে থেকে যে চলে আসছে, জানি না। ‘ঋতু’ শব্দটি প্রথম পাই ধারাপাত–এর পাতায় নামতা পড়তে গিয়ে। যত দূর মনে পড়ে, ধারাপাত–এর সঙ্গে প্রথম পরিচয় ক্লাস টু-তে ওঠার পর। আমার ক্লাস ওয়ান শুরু গ্রামের ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে—১৯৫১ সালে। সে বছর ছিল শুধু বর্ণপরিচয়ধারাপাত–এর পাঠ শুরু শতকিয়া দিয়ে। ধারাপাত–এ তখন নানা ধরনের কিয়া—কড়াকিয়া, বুড়িকিয়া, পণকিয়া, কাঠাকিয়া ইত্যাদি ছিল। আর নামতা ছিল—প্রথম নামতা, দ্বিতীয় নামতা ও তৃতীয় নামতা। এসব বিচিত্র বিষয় ও শব্দ এখন ইতিহাস। এগুলোর পরিচয় কোথায় পাওয়া যেতে পারে, তা আমার জানা নেই। আর এসব জানার আদৌ কারও প্রয়োজন পড়বে বলে মনে হয় না।

ধারাপাত–এর সবকিছুই পড়তে হতো সমস্বরে সুর করে। প্রথম প্রথম শিক্ষক বলতেন আর আমরা ধুয়ো ধরতাম। পরে দায়িত্বটা পড়ে ক্লাসের বয়স্ক ছাত্রের ওপর। শতকিয়া পড়তে হতো এক-এ চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ, তিনে নেত্র, চারে বেদ, পাঁচে পঞ্চবাণ, ছয়ে ঋতু—এইভাবে দশ শেষ হয়ে গেলে—একের পিঠে এক এগারো, একের পিঠে দুই বারো ইত্যাদি কায়দায়। কয়েক বছর পর শতকিয়া পড়া শুরু হয়—এক-এ আল্লাহ, দুইয়ে জাহান, তিনে জামানা ইত্যাদি দিয়ে।

আমাদের ধারাপাত শিক্ষা যাঁর কাছে, তিনি ক্লাস এইট পাস। গ্রামের স্কুলে তখন ব্যাপারটা এই রকমই ছিল। যিনি হেডমাস্টার তিনিই কেবল ম্যাট্রিক পাস। তো, এইট পাস হলেও আমাদের সেই শিক্ষক ছিলেন বেশ হাসিখুশি মানুষ। খবরের কাগজ পড়তেন। তাঁর প্রিয় কাজ ছিল আমাদের গল্প শোনানো। আমরা বুঝি কি না বুঝি, সে খেয়াল তাঁর থাকত না। শতকিয়া চেঁচানো ছয়ে ঋতু যে আসলে কী—তার ব্যাখ্যা এবং সেই সঙ্গে ছয় ঋতুর নামগুলো তাঁর মুখেই প্রথম শুনি। তবে, ওই শোনা পর্যন্তই। ঋতুচরিত্রের কোনো কিছুই মরমে পশেনি।

বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্যের বিষয়টি নিয়ে গড়পড়তা সাধারণ বাঙালির তেমন কোনো ধারণা আছে বলে মনে হয় না। ষড় শব্দটির সঙ্গে অনেকেরই পরিচয় নেই। অনেকে আবার ঋতু বলতে বোঝেন অন্য কিছু। ঋতু বিষয়ে জানতে চাইলে মুখ ঘুরিয়ে নেন। বুঝিয়ে বলতে গেলে দুকথা শুনিয়ে দেন—শীতকাল, বর্ষাকাল—এই হলো আপনাদের ঋতু? বেশির ভাগ মানুষের কাছেই শীতকাল, বর্ষাকাল আর গরমের কাল—এই তিনটিই হলো বাংলাদেশের ঋতু। পল্লিগীতির কল্যাণে অনেকে আবার বসন্তকালের কথাও বলেন। কিন্তু শরৎ, হেমন্ত নয়।

অনেককাল আগে থেকেই বাঙালিমনে জায়গা নিয়ে আছে বাংলা মাস। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য, মুসলমান কবিদের রোমান্টিক কাব্য ও লৌকিক মৈমনসিংহ গীতিকায় বারোমাস্যা বা বারোমাসির ছড়াছড়ি। পুরুষের রচিত হলেও এগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে আছে বাঙালি নারীর সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার কথা। এগুলো বলা হয়েছে মাস ধরে ধরে—ঋতু নিয়ে নয়।

সংস্কৃত ভাষার কবি কালিদাস—যিনি ‘মহাকবি কালিদাস’ নামে সমধিক পরিচিত। তাঁর এক বিখ্যাত খণ্ডকাব্যের নাম ঋতুসংহার। কাব্যটির নাম শুনলে যেকোনো বাঙালিরই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে এই কাব্যে কালিদাস ষড়ঋতু নিয়ে বুঝি মর্মান্তিক তামাশা করেছেন, কিন্তু ব্যাপারটি তা নয়। এটি মূলত ঋতুস্তুতি ও ঋতুবন্দনার কাব্য। কাব্যটিতে অবশ্য আদিরসের আধিক্য অধিক।

কালিদাসকে নিয়ে বিচিত্র সব গল্প–কাহিনি ও কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। তাঁর জন্মস্থান, জীবৎকাল ইত্যাদি বিষয় নিয়েও রয়েছে প্রচুর বিতর্ক। কোনোটিরই তর্কাতীত মীমাংসা হয়নি। তাই ঋতুসংহার খণ্ডকাব্যে বিধৃত যে প্রকৃতি ও পরিবেশ—তা ভারতবর্ষের কোন এলাকার, তা নিয়েও নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই।

কালিদাস সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ অজ্ঞ। এই অতিসাধারণ রচনায় কালিদাস এসেছেন তাঁর ওই ঋতুসংহার কাব্যের জন্য। এ সম্পর্কে তথ্যসূত্রের উৎস হলো বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতদের লেখা সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস–সম্পর্কিত বিভিন্ন বই।

আমাদের ষড় বা ছয় ঋতু কীভাবে, কোন কালে যে বিভাজিত হলো, তার কোনো হদিস পাওয়া যায় না। সাধারণ যেসব সংস্কৃত অভিধান, সেগুলোর মধ্যে ঋতুর যে বিভাজন—তার সঙ্গে কিন্তু বাংলা সনের ঋতু মেলে না। ঋতুর ক্রমও নয়।

সংস্কৃত অভিধানে বর্ণিত ঋতুর নাম ও ক্রম হলো—অগ্রহায়ণ-পৌষ নিয়ে ‘হিম’; মাঘ-ফাল্গুন নিয়ে ‘শিশির’; শ্রাবণ-ভাদ্র নিয়ে ‘বর্ষা’ এবং আশ্বিন-কার্তিক নিয়ে ‘শরদ’ বা ‘শরৎ’।

এই ঋতুক্রম ও ঋতুনাম যে সনের, সেই সন যে অগ্রহায়ণ দিয়ে শুরু হতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অভিধানে দেখেছি, ‘হায়ন’ বা বছরের অগ্র বা আরম্ভ হলো—অগ্রহায়ণ। এককালে—তবে তা কোন কালে বা কার আমলে প্রবর্তিত সন—অগ্রহায়ণ দিয়ে শুরু হতো, জানি না। আর সংস্কৃত অভিধানের ঋতু-বিভাজন ও ক্রমের ওপর কালিদাসের ঋতুসংহার কাব্যের প্রভাব আদৌ আছে কি না কিংবা থাকলে কতখানি আছে, তার কিছুই বলতে পারব না। আমি বিশেষজ্ঞ নই, নিতান্তই অজ্ঞ মানুষ।

সংস্কৃত অভিধানের শরৎকাল যে আশ্বিন-কার্তিক নিয়ে, সেটা ভাবতে বেশ ভালো লাগে। আমাদের ঋতুচক্রের শরতের মধ্যে ‘পচা ভাদ্র’ কীভাবে যে এসে জুটল, তা মাথায় ঢোকে না। মনে হয়, ভাদ্রের অভদ্র ভ্যাপসা গরমের জন্যই গ্রামের মানুষের কাছে সে পচা ভাদ্র। ভাদ্রের গরমের ভদ্র অন্য এক নাম হলো তালপাকা গরম। তাল অবশ্য ভাদ্র মাসেই বেশি পাকে।

গ্রামের মহিলারা ভাদ্রের জন্য অপেক্ষাও করত গরম কাপড় রোদে দেওয়ার জন্য। ভাদ্রের শেষ দিকে আমরা অর্থাৎ ছোটরা অপেক্ষায় থাকতাম রামধনু বা রংধনু দেখার জন্য। গ্রামের প্রকৃতি ও পরিবেশ তখনো অনেক বেশি প্রাকৃতিক। আকাশের রংধনু দেখতে কোনো বাধা তৈরি হতো না।

আশ্বিনে দেখতাম নির্মল আকাশ। জায়গায় জায়গায় সাদা মেঘ। আশ্বিনের আকাশের নীল ছোট থেকেই আমার ভীষণ প্রিয়। সেই নীল সেই ছোটবেলাতেই ফেলে এসেছি। এখনো সেই নীল দেখার ইচ্ছা জাগে। আকাশ তো এখনো নীল। কিন্তু সেই নীল চোখে পড়ে না। আর ভালো লাগত আশ্বিনের হালকা শিশিরভেজা শিউলি ফুল—শিউলিতলায় ছড়িয়ে পড়ে থাকতে দেখে। ওভাবে পড়ে থাকা শিউলি ফুল কতকাল যে দেখিনি, মনে পড়ে না।

শরতের আকাশের নীলের প্রসঙ্গে বরেণ্য চিত্রশিল্পী সফিউদ্দীন আহমদের কথা মনে পড়ে যায়। ১৯৮৪ সালে অফিসের কাজে একবার তাঁর বাড়িতে যেতে হয়েছিল। বারান্দা থেকে শুরু করে বসার ঘর পর্যন্ত শুধু ছবি আর ছবি। আর প্রতিটি ছবিতেই নীলের ছোঁয়া।

চিত্রকলা সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ মূর্খ। মূর্খ লোকের অসুবিধা-সুবিধা—দুটোই রয়েছে। সুবিধার দিকটা হলো বড় মাপের মানুষকেও বেমক্কা প্রশ্ন করা যায়। বললাম, ‘আপনার প্রিয় রং বুঝি নীল?’দেশের টিভি চ্যানেল ও ফেসবুকের বাসিন্দারা। বাঁশি এখন সেগুলোতেই বাজে।

আমার মতো মূর্খের সামনে অত বড় শিল্পী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন, ‘সেই কত দিন ধরে শরতের আকাশের নীলকে ক্যানভাসে নামানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিছুতেই পারছি না।’

বাংলার ঋতু সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত না করলেও প্রভাব পড়েছিল কবিদের ওপর। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও একসময় কবিতা লিখতেন। সম্ভবত ঋতুসংহার তাঁকে ঋতুপ্রেমী করে তোলে। তাঁর লেখা কবিতায় ঋতুবর্ণনা বেশ গাঢ়।

বাংলার শরৎকাল জীবন্ত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতায়। সমালোচকদের মতে, তাঁর প্রিয় ঋতু বর্ষা। তারপর বসন্ত ও শরৎ। তবে শীত-গ্রীষ্ম-হেমন্তও উপেক্ষিত হয়নি। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসাকে তিনি প্রকৃতি নিয়ে উৎসবে পরিণত করেছিলেন। উৎসবকে ভরিয়ে তুলেছিলেন গানে ও কবিতায়। গানেই বেশি, নৃত্যেও কম নয়।

এখন প্রশ্ন জাগে, প্রকৃতি নিয়ে উৎসবের কথা কীভাবে রবীন্দ্রনাথের মাথায় ঢুকেছিল। শুধুই কি প্রকৃতিপ্রেম নাকি আর কোনো কারণ ছিল?

আমি পণ্ডিত নই, রবীন্দ্রগবেষকও নই। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোনো কথা বলা আমার পক্ষে ধৃষ্টতা। তবু রবীন্দ্রনাথের ঋতু-উৎসব নিয়ে অনেক প্রশ্ন জাগে। নিজে নিজে উত্তরও খুঁজি।

রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্মের প্রকৃত প্রবর্তক। ব্রাহ্মসভায় প্রথম দিকে শুধু ধর্মালোচনা হতো। নীরস–গম্ভীর এ আলোচনায় সবাই আকর্ষণ বোধ করতেন না। ব্রাহ্মরা সবাই হিন্দু ছিলেন। বাঙালি হিন্দুদের তো বারো মাসে তেরো পার্বণ। ব্রাহ্ম হলেও তাঁদের অবচেতন মনে উৎসবের ভাবনা ছিল।

দেবেন্দ্রনাথ মহর্ষি হলেও তীক্ষ্ণ বৈষয়িক বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। ব্যাপারটা সম্ভবত তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। তারই ফলে জোড়াসাঁকোতে বাংলা নববর্ষের উৎসব প্রথম প্রবর্তন করেন, পরে আসে মাঘোৎসব। পৌষ মেলার প্রবর্তকও তিনি।

আবার শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যখন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরও কিছু নতুন উৎসব চালু করে দিলেন তিনি। সেগুলোর মধ্যে গান, নৃত্য ইত্যাদিও যুক্ত হলো।

শরতের কাশফুল নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের এখন যে মাতামাতি, তার মূলে কিন্তু রয়েছে এই ফুলের প্রতি রবীন্দ্রনাথের অতি প্রেম। কাশফুল শুধু নদীর দুই তীরেই দেখা যায় না, গ্রামের বাড়ির চৌহদ্দির বেড়াতেও দেখা যায়। মূলত কাশফুলকে জাতে তুলে দিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। কাশফুল ও শরৎ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের যেসব গান, তার মধ্যে ভাদ্র নেই বলে মনে হয়। তিনি মগ্ন ছিলেন আশ্বিন নিয়ে। কখনো কখনো মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের শারদোৎসব কি আশ্বিনের দুর্গোৎসবের বিকল্প? ব্রাহ্মধর্মে পূজাও নেই, মূর্তিও নেই। নতুন উৎসব নিয়ে আশ্রমিকদের ব্যস্ত রাখার জন্যই কি শারদোৎসব? উত্তর আমার জানা নেই।

শরতের এক গানে রবীন্দ্রনাথের প্রশ্ন ছিল—‘বাঁশি, তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে?’ সে বাঁশি এখন হাতে নিয়েছেন বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল ও ফেসবুকের বাসিন্দারা। বাঁশি এখন সেগুলোতেই বাজে।