পাঠকের প্রতিক্রিয়া

নতুন সময়ে শিল্প–সাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতার বিচার

আমি সুমন রহমানের লেখার অনুরাগী একজন পাঠক। তিনি অনেক সময়ই এমন কিছু ভাবনা উসকে দেন, যা নিয়ে নিজের সঙ্গে তর্ক করার অবকাশ পাওয়া যায়। কিন্তু ৮ আগস্ট প্রথম আলোর অন্য আলো বিভাগে ‘নতুন সময়ে প্রাসঙ্গিক থাকবেন কীভাবে’ শিরোনামের লেখায় তিনি এমন কিছু মন্তব্য করেছেন, যা তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাশা করিনি। কারণ, মন্তব্যগুলো চটজলদি ও সিদ্ধান্তমূলক।

লেখাটিতে এমন অনেক প্রসঙ্গ এসেছে, যা নিয়ে বিশদ তর্ক করা চলে। আমি মোটাদাগে দুয়েকটি প্রসঙ্গের কথাই বলব। তিনি বলেছেন, দেশে জাতীয়তাবাদ হারানোর আগেই জাতীয়তাবাদের কবি শামসুর রাহমান হারিয়ে গেছেন। তিনি উদাহরণ টেনেছেন রুশ বিপ্লবের। দুটি বিপরীত উদাহরণ টেনে বলেছেন, সামন্ততন্ত্রের প্রতিনিধি হয়েও লিও তলস্তয়ের শিল্পের মহিমা বিপ্লব–পরবর্তী সময়ে মোটেই ক্ষুণ্ন হয়নি, অথচ বিপ্লবের সামনের সারিতে থাকা কবি ভ্লাদিমির মায়াকভস্কি ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছেন।

শামসুর রাহমান একেবারে হারিয়েই গেছেন? তাই? শিল্প–সাহিত্য নিয়ে এত চটজলদি এত বড় সিদ্ধান্তের কথা বলা যায়? প্রশ্ন হলো, কোন জরিপের ভিত্তিতে সুমন এমন একটা উপসংহারে পৌঁছালেন?

এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই, ১৯৫০–৬০–এর দশকে আমাদের এখানে একটা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল, যা মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি বিপুল ঐতিহাসিক মোহনায় এসে পৌঁছায়। আমরা জানি, জাতীয়তাবাদের মতো পরিচয়বাদী আদর্শের বিপদ নিয়ে পরবর্তী সময়ে দেশে–বিদেশে বহু তাত্ত্বিক বিতর্ক হয়েছে। আগেও যে হয়নি, তা নয়। এসব বিতর্ক সত্ত্বেও ভুলে গেলে চলবে না যে লেনিনসহ বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক তাত্ত্বিকেরাও একসময় উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের আদর্শবাদী অস্ত্র হিসেবে জাতীয়তাবাদের বিকল্প খুঁজে পাননি। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ উপনিবেশের আন্দোলনগুলো যেভাবে একসময় ধর্মকে ঘিরে দানা বেঁধেছিল। কারণ, ধর্মই তখন ছিল অবলম্বন।

স্বাধীনতার আগে যে পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক লড়াইয়ের মূলধারাটি জাতীয়তাবাদকে আঁকড়ে ধরেছিল, তার বাস্তব পটভূমি আমাদের বুঝে দেখার দরকার আছে। কবি হিসেবে শামসুর রাহমানের উন্মেষ ও বিস্তার সেই সময়ে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, কোনো কবির গায়ে আমরা এভাবে ‘জাতীয়তাবাদী’ তকমার ছাপ মেরে দিতে পারি কি না। আমাদের সাহিত্য–সমালোচনা যে প্রায়ই ‘বিশ্বকবি’, ‘বিদ্রোহী কবি’, ‘পল্লিকবি’—এসব তকমার মধ্যে সৃষ্টিশীল মানুষগুলোকে বন্দী করে ফেলে এবং এর ফলে তাঁদের অন্য সম্ভাবনা যে আমরা আর বের করতে পারি না, এটা এক বড় বিপদ। এটা হয়তো আলাদাভাবে আমাদের আত্মপর্যালোচনারও বিষয়। কথা হলো, সেই সময়ের আবেগ শামসুর রাহমানের কবিতায় উপচে পড়েছিল। ফলে জাতীয়তাবাদী আবেগের স্ফূরণ তাঁর কবিতায় আমরা দেখতে পাব না, তা–ও নয়। কিন্তু তাঁর কবিতা কেবল জাতীয়তাবাদেরই পরাকাষ্ঠা, এটা বললে প্রচণ্ড অবিচার করা হয়। তাঁর কবিতার অন্যান্য দিক তাতে ঢাকা পড়ে যায়।

একটা সময়ের ইতিহাসের আবেগ শামসুর রাহমানের কবিতায় আছে এবং সেই ইতিহাস আমাদেরই হয়ে ওঠার ইতিহাস। সেই সময়কে আমাদের বারবার বুঝতে হবে এবং বুঝতে হলে শামসুর রাহমানের কবিতাও অবশ্য–বিচার্য হবে।

কথা তবু এখানেই শেষ নয়। শামসুর রাহমান যে প্রায় চার–পাঁচটি দশক বাংলা কবিতায় রাজত্ব করলেন, সেটা কি কেবল তাঁর ‘জাতীয়তাবাদী’ পরিচয়েরই কারণে? নিশ্চয়ই নয়। জনপ্রিয়তা তো তিনি ব্যক্তিগত জনসংযোগ করে আদায় করেননি। তাঁর জনসংযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল কবিতা। কোথাও না কোথাও তিনি নিশ্চয়ই শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির আবেগকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিলেন। এক দিন–দুই দিন নয়, দীর্ঘ সময় ধরে। সেটা কেন, কীভাবে—তার অনুসন্ধানও নিজেদের বোঝার জন্য আমাদের করে দেখা দরকার।

কবিতা নতুন পথের সন্ধান করবে। রবীন্দ্রনাথের পর নজরুল বা জীবনানন্দ আসবেন, তারপর শামসুর রাহমান–আল মাহমুদ। পরবর্তীরা আবার তাঁদের পথ ছাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। এটা একটা নিরন্তর প্রক্রিয়া। এর মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ আসছে কোত্থেকে! সন্ধ্যাবেলায় ঠান্ডা হাওয়া দিয়ে ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি এলে কেউ কি এখন একলা উদাস হয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতার পাতা খুলে বসেন? অবশ্যই না। তাই বলে কি বলা যাবে, মধুসূদন হারিয়ে গেছেন? এসব উত্তর এত সরল নয়। শিল্পী–সাহিত্যিকদের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে বের করা আদতে তার ভাষাভাষী সম্প্রদায়েরই দায়।

ঠিক এই সূত্র ধরেই বলছি, সুমন যত সহজে বললেন মায়াকভস্কি ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছেন, ঘটনা তত সহজ নয়। মায়াকভস্কির যে জীবনী আমার নিজের সংগ্রহে আছে, সেটি বেংট ইয়াংফেল্টের লেখা মায়াকভস্কি: আ বায়োগ্রাফি। শিকাগো ইউনিভার্সিটি প্রেস ২০১৪ সালে বইটি প্রকাশ করেছে। কতটা বাতিল হলে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপুল পতনের এতগুলো বছর পরও পুঁজিবাদের পীঠস্থান যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপ্লবের বরপুত্র মায়াকভস্কির বই বের করার দরকার পড়ে?

শিল্পী ও সাহিত্যিকদের দেখার ব্যাপারে আমাদের দেখার চোখ বদলানো দরকার। এই দায় তাঁদের নয়, আমাদের।

আসিফ আহমেদ
কলাবাগান, ঢাকা