গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

প্রদর্শনী

সুলতানের শিল্পীজীবনের প্রতিচ্ছবি

সাধক চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান কথা বলছেন, আমি শুনছি, তাঁকে দেখছি। বলছি, কামরুল হাসান প্রদর্শনশালার একটি অন্ধকার কক্ষে চলমান তথ্যচিত্র দেখার অনুভূতির কথা। এ তথ্যচিত্র ধারণ করা হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। সুলতানের সঙ্গে নাসির আলী মামুনের বাঁশি নিয়ে একান্তে কথোপকথনের ধারণকৃত রেকর্ড ও ভিডিও চিত্রের কথাগুলো মরমে গিয়ে লাগল; বস্তুজগতের বাইরে এক আধ্যাত্মিক উপলব্ধিতে স্নাত হয়ে গেলাম।

নাসির আলী মামুনের প্রশ্ন ছিল, ‘দুঃখ মোচন করার জন্য কি যন্ত্রসংগীতের আশ্রয় নিতে হয়?’ সুলতানের বয়ানে উঠে এসেছে—তাঁর বাঁশি সে উদ্দেশ্যে নয়; বাঁশি নিজেই কথা বলে। সুর কেবল সাংসারিক দুঃখ-বেদনার কনসোলেশন নয়, বরং সুখ-দুঃখের সীমা অতিক্রম করে এক আধ্যাত্মিক স্তরে পৌঁছে যায়। মানুষের প্রেম বা বিরহ বাঁশির লক্ষ্য নয়; বরং প্রকৃতির পশুপাখিই এই সুরে আকৃষ্ট হয়। তিনি বলেন, বাঁশি এমন এক ভাষা বহন করে, যার সঙ্গে বস্তুজগতের সম্পর্ক নেই। এর সুর কোনো ‘ওয়ার্ডস’ দেয় না, কিন্তু অনুভূতির অবস্থান নির্ধারণ করে। বাঁশির প্রাণ নিহিত থাকে বাজিয়ের শ্বাসপ্রশ্বাসে; যদি তা বিশুদ্ধ না হয়, সুরও বিকৃত হয়।

অন্ধকার কক্ষ থেকে বের হয়ে প্রদর্শনীর দেয়ালে ঝোলানো সুলতানের প্রতিকৃতি দেখতে দেখতে হাঁটছিলাম। তথ্যচিত্রে দেখা সেই সুলতান—তাঁর বাঁশির সুর, গভীর ভাষ্য; আর দেয়ালে সাজানো প্রতিকৃতি, অ্যালবামধর্মী অনেকগুলো ছবি, হাতে লেখা চিঠি—সব মিলেমিশে যেন এক অনির্বচনীয় চৈতন্যে ভেসে গেলাম। শিল্পী ও শিল্পীজীবনের এই নিবিড় উপস্থাপনে মুহূর্তের মধ্যেই সুলতানের উপস্থিতি মর্মে উপলব্ধ হলো কবিতার মতোই। এ জন্যই হয়তো নাসির আলী মামুনকে বলা হয় ক্যামেরার কবি।

নাসির আলী মামুনের ক্যামেরায় এস এম সুলতান

মামুন মূলত সুলতানের জীবন, দর্শন, শিল্পকর্ম—সবকিছু বোঝাপড়ায় নিয়ে আলোছায়ার খেলায় ধরেছেন। আলোছায়ার বিশেষ প্রক্ষেপণই নাসির আলী মামুনের ছবির বিশেষ জাদু; যে জাদু কথা বলে, জীবন্ত হয়।

বাঁশির সুরালাপের ফাঁকে ফাঁকে সুলতান যে জীবের কথা বলেছেন, সেসব জীবজন্তু তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল, তা আলোকচিত্রে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। প্রকাশ পেয়েছে মানুষ, বৃক্ষ ও জীবজন্তুর প্রতি ভালোবাসা। অর্থাৎ নাসির আলী মামুনের ক্যামেরায় ধরা পড়েছে শিল্পী সুলতানের জীবনের নানা অন্তরঙ্গ মুহূর্ত—যেন আলোছায়ার ভেতর দিয়ে ফুটে ওঠা এক সাধকের দৈনন্দিন কাব্য।

কোনো ছবিতে দেখা যায় ভোরের আলোয় মাটির মেঝেতে বসে সুলতান রঙের ছোঁয়ায় আঁকছেন নিজের কল্পলোক। পাশে নিশ্চুপ বসে আছে একটি বিড়াল—তীক্ষ্ণ চোখে যেন শিল্পীর সেই সৃষ্টিক্ষণ অবলোকন করছে। পশুপাখির সঙ্গে তাঁর সহজাত সখ্য এসব ছবিতে অমর হয়ে আছে। কখনো বিড়ালটি তাঁর বুকে চাদরের আড়ালে আশ্রয় নিচ্ছে—মুহূর্তেই ধরা পড়ছে আদরের পরম কোমলতা; আবার কখনো ভাতের থালার চারপাশে সজাগ অপেক্ষা—প্রসাদ ভাগ পাওয়ার আশায়। কোথাও দেখা যায় টিয়া পাখির ঠোঁটের কাছে ঠোঁট মিলিয়ে সুলতানের মৃদু কথোপকথন—মানুষ ও প্রাণিজগতের ভেদরেখা যেন সেখানে লুপ্ত হয়ে গেছে। এসব ক্ষুদ্র ঘটনায় উন্মোচিত হয় শিল্পীর অন্য এক চরিত্র—প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় আত্মীয়তার।

শুধু ঘরোয়া মুহূর্ত নয়—আলোকচিত্রে ধরা আছে নদীর ধারে সুলতানের একাকী বসে থাকা, বাজারের ভিড়ে মিশে যাওয়া, শিশুদের সঙ্গে হাসিখুশি সময় কাটানো কিংবা গভীর মননমগ্নতা। এসব খণ্ডচিত্র মিলিয়ে যেন রচিত হয়েছে শিল্পীর জীবনকাব্য, যেখানে তিনি কেবল ক্যানভাসের চিত্রকর নন, বরং মানুষ, প্রাণী ও প্রকৃতির অন্তরঙ্গ সঙ্গী।

নাসির আলী মামুনের ক্যামেরায় এস এম সুলতান

এ প্রদর্শনীতে এসে মনে হলো আলোকচিত্রী যেন রঙিন পৃথিবীকে সাদাকালোর নিবিড় ধ্যানমগ্নতায় রূপান্তর করেছেন, আর সেই রূপান্তরে বিষয়রূপের অন্তর্লীন আত্মা উদ্ভাসিত হয়েছে। লোকরূপের আড়াল ছেড়ে শিল্পরূপে প্রতিভাত এ উপস্থাপনায় রূপ-রস-গন্ধের স্বল্পতা একেবারেই অনুভূত হয় না; বরং ধ্যানযোগী দৃষ্টিতে বস্তুর সারসত্তা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। এ অভিজ্ঞতাই মনে করিয়ে দেয় নাসির আলী মামুনের ‘শিল্পী এস এম সুলতান’ সিরিজ, যেখানে ১৯৭২ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত সময়ের ভেতর সুলতানের জীবন, সাধনা ও শিল্পদর্শনের এক অনন্য দলিল রচিত হয়েছে আলোকচিত্রের মাধ্যমে।

মামুনের প্রতিকৃতি আসলে কেবল চেহারার ছবি নয়; এগুলো ব্যক্তিত্বের একেকটি জীবন্ত ডকুমেন্টারি। সুলতানের শিল্পচর্চা ও প্রাত্যহিক জীবনযাপনকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করে, তাঁর শিল্পদর্শনের ছাপ আলো-অন্ধকারের ভেতর ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। কখনো আলোর ঝিলিক, কখনো ছায়ার ঘনত্ব—এ দ্বন্দ্বেই ধরা পড়েছে সুলতানের সহজ অথচ মহিমান্বিত ব্যক্তিত্ব। সেখানে ভেসে ওঠে শিল্পীর প্রাণিজগতের সান্নিধ্যে কাটানো দিনযাপনের আনন্দ, আবার প্রকাশিত হয় দারিদ্র্যের ভেতরে থাকা ঐশ্বর্যের দীপ্তি।

ভারতবর্ষ ও ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতার পর সুলতান যখন বাংলাদেশের আত্মপরিচয় খুঁজে পান তাঁর চিত্রকলায়—লোকায়ত সংস্কৃতি, কৃষকের সংগ্রাম, প্রকৃতির সঙ্গে অবিরাম দ্বন্দ্ব ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে টিকে থাকার সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করেন—মামুন তখন তাঁর ক্যামেরায় এই শিল্পী-ব্যক্তিত্বকে অমর করে তোলেন। আশ্চর্য লাগে—কখনো সাধারণ বক্স ক্যামেরা, কখনো হারিকেনের আলো—এই সামান্য উপকরণ দিয়েই তিনি গড়ে তুলেছেন এক বিস্ময়কর নান্দনিক জগৎ।

শিল্পী এস এম সুলতান ও আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন

স্টুডিওর মেকি সৌন্দর্যের বদলে মানুষ ও শিল্পীর গভীর অন্তর্জগৎকে উদ্ভাসিত করাই মামুনের লক্ষ্য। ‘সুলতান’ সিরিজের অনেক আলোকচিত্রে দেখা যায় তাঁর হারিয়ে যাওয়া চিত্রকর্মেরও তথ্যচিহ্ন, যা গবেষকদের জন্য এক অমূল্য ভান্ডার। তাই তাঁকে নিঃসন্দেহে বলা যায়—আলোকচিত্রের জগতে এক সাধক, যিনি আলোছায়ার ভেতর দিয়ে মানবাত্মার আসল প্রতিকৃতি আঁকেন।

প্রদর্শনীটি যেমন নাসির আলী মামুনের প্রতিকৃতি আলোকচিত্রণের অনন্যতা স্মরণ করিয়ে দেয়, তেমনি সুলতানের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের একক উদ্যোগেরও স্মারক। ‘শতবর্ষের সুলতান’ শিরোনামের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত ‘সিটিং দ্য সোল’ বা ‘আত্মার বপন’ শীর্ষক একটি বইও প্রকাশ করা হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে সুলতাকে নতুনভাবে জানার সুযোগ তৈরি হলো। সুলতানের জন্মশতবর্ষকে কেন্দ্র করে নাসির আলী মামুন ইতিমধ্যে অনেকগুলো সম্পাদিত গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন, যা আলোকচিত্রের মতোই সুলতানকে জানতে সহায়ক হবে।

‘শতবর্ষের সুলতান’ শিরোনামের সাধক আলোকচিত্রশিল্পী নাসির আলী মামুনের ৬৫তম একক আলোকচিত্র প্রদর্শনীটি ধানমন্ডির বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের কামরুল হাসান প্রদর্শনশালায় গত ২২ আগস্ট শুরু হয়েচলে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।