সৌমনা দাশগুপ্তের দীর্ঘ কবিতা

‘হৃদয়ঘড়ির কাঁটার শব্দে অ্যালার্ম, বাজছে; জাগে ফসফরাস, ক্ষত’—এই দীর্ঘ কবিতার ছত্রে ছত্রে আছে সময়ের উত্তাপ, ক্ষত, হৃদয়ের ক্ষরণ আর দহন।

মৌতালি, ওই নদীর পাড়ে পাড়ে

আমার অপেক্ষা থাকে শুধু

আরও লম্বা চুল

বিদ্যুতের ভাষা

তুমি ঢালো রাত্রি অগাধ

চূর্ণ রথে পড়ে আছে ধুলো

নিষ্ক ভিক্ষা নিয়ে এই লেখা

পারানির আশায় আশায়

কী অখিল বেদনা বিছানো

পথ তবু হাঁটে

জোছনা তরবারি

রুবাইয়াৎ মিশে আছে জলে

হাওয়া হয়...খুব খুব

অতুল এ হাওয়া-কোলাহলে

একলা দুপুর শুয়ে থাকে

আকাশ-সম্ভবা যত ধ্বনি

পথিমধ্যে ঘরকে দিল ডাক

আমি তবে চাঁদকে খুলে দেখি

ঘরের ভেতর অন্য কোনো ঘর

যতই তুমি কপাট বন্ধ করো

আমি শুধু চাঁদকে ধরে রাখি

পূর্ণিমা-চোর অক্ষরেরা জানে

আমি ও চাঁদ জল-সইতে যাই

ঘাটে তখন দারুণ অবরোধ

পদ্মটিও নড়ে বসছে না

দুপুরবেলা রাত্রি হলো তবে

ঢালো তোমার আকাল-বৈশাখী

ব্রহ্মা জানেন জলশব্দকথা

চায়ের কাপে দারুণ চামচ নাড়া

মৌমাছি তার গুটিয়ে নিচ্ছে ডানা

ফুলের কাছে ঘুমের কাছে

বেপাড়ার সে রঙিন পালক

কারওর কাছে ঋণ ছিল না কোনো

এ ভুলভাল কমল-দল খোলা

আঠার ভারে নুয়ে পড়ছে জমিন

একেই বলছ জ্বরের কাতরতা

শব্দ এবং কথার জ্বরে ভুগে

নৌকা আমার সূর্যে গিয়ে ঠেকে

তর্ক থেকে পিছল পায়ে হেঁটে

চোখ ফেরালাম অনেক কাছে-দূরে

খাগের কলম তালপাতার পুথি

আমিও লিখি কূটতন্ত্রকথা

শঙ্খে তখন কাঁটা লাগার ছল

কুণ্ডলিনী আড় ভাঙছেন সবে

বাঁশের বনে ভূতের ভোজবাজি

তুমিও সেদিন জিব ঢেলেছ নুনে

হঠাৎ এসে বললে: জল দাও

আমার তো এ ছোট্ট গাগরি

জল ঢালব সাধ্য তেমন কই

আমার দুপুর একলা পড়ে থাকে

জোয়ার দিনে বিষ ছিল কি

হয়তো ছিল শামুকপোড়া চুন

তোমার হাতে গ্রহণলাগা শাঁখ

আমি তখন হাত রেখেছি তারে

তীব্র নিষাদ কড়ি-মধ্যম ছুঁয়ে

মীড় বেজেছে মেঘ বেজেছে

এইভাবে কি সাপটি কথা বলে

কলোসিয়াম; প্রতিস্পর্ধী দুজন

রক্ত এবং নুনের কথা বলে

সারেঙ্গিতে পাথর ভাঙার গান

খুন হব এই শপথ নিয়ে আসি

এ খঞ্জরে ইচ্ছে ঠাসা ছিল

আমি শুধু যজ্ঞবেদিমূলে

খুলছি ধীরে অলীক স্বপ্নঝুলি

ঘুমের ছলে তারার গল্প শুনে

আকাশ সেদিন বাগান হয়ে ওঠে

জল ঢেলেছি মোমের শামাদানে

নিজেই বলি, হতচ্ছাড়ি যা

এমন করে ভ্রমর নিয়ে হাতে

অন্ধ চোখে জলের দিকে হাঁটে

নিজেই এমন জমিয়ে তুলছি কাদা

এখন তো এই খাঁচামাত্র সার

পাখি আদৌ ডানা নাড়ছে না

আদৌ পাখি ছিল কি এই ঘরে

ঠোঁটের থেকে গল্পদানা নিয়ে

ছিটোচ্ছি এই সফেদ ক্যানভাসে

কাগজ কোথায়, হাওয়ায় লেখা খাতা

শূন্য এই গোলাঘরের ভেতর

গহিন দেশে স্বপ্ন পড়ে থাকে

লেপ-তোশকের অনেক অনেক নিচে

লুকিয়ে রাখা তামাদি সিম্ফনি

কাঁথার ফোঁড়ে এসব লেখাজোখা

গল্প বলো ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী

গাছের থেকে লাফিয়ে নামছে হাওয়া

আলখাল্লা দিঘল তার গায়ে

বলো তবে ফকির কথা বলো

কেমন করে গড়িয়ে যাচ্ছে বালি

কেমন করে এই মরুঝড় ভাঙে

কেমন করে করছ মনের আবাদ

আউলা-ঝাউলা কান্নাভাষাতলে

এসব খবর বাউদিয়ারা জানে

আমি তো স্রেফ সরল অনুবাদক

ফটক আঁটা চা-বাগানের ভেতর

হঠাৎ কোনো শেড-ট্রি এসে দাঁড়ায়

সেই কি কোনো তারার লোকগাথা

এ অঘ্রানে মাস-পয়লার দিনে

আমিও কেমন ধান কুড়ালাম দ্যাখো

ধান্য থেকে ঝরিয়ে ফেলছি খোসা

ভাত ফুটছে আকাশহাঁড়ির ভাপে

সেদিন শুধু বৃষ্টি-ভাষায় লেখা

সেগুনপাতায় অযথা ফুলঝুরি

তরঙ্গ তার খুলে ধরছে পাখা

মরুক তবে মরুক ইচ্ছেপোকা

আমার যত ঝিনুকফাটা রাত

মুক্তো কোথায়; উলিরাজের বাড়ি

দিচ্ছে উঁকি অনেক বাচ্চা উই

ভল্ল ছুড়ে খুন করেছ ময়ূর

তবুও মেঘ মেঘের মতো আসে

কা’সিদ আসে গূঢ় খবর নিয়ে

কোন মহুয়ায় মৃত্যু লেখা ছিল

আকাশ থেকে গড়িয়ে নামছে অ্যাসিড

তাকেই তুমি বৃষ্টি বলো তবে

এ ক্ষুৎকাতর রৌদ্রচাপা দিনে

খেলনাবাড়ির রাতের খাঁজে ভাঁজে

সে ছিল এক লুকোনো তক্ষক

হৃদয়ঘড়ির কাঁটার শব্দে অ্যালার্ম

বাজছে; জাগে ফসফরাস, ক্ষত

ক্ষত তো নয়; সরলগাছের ঘাম

গন্ধক আর অম্লরসের স্বাদ

রিংমাস্টার চাবুক চালান সপাং

বাগ-এ এরাম; পারিজাতের দিন

বৃষ্টি-তিরে ব্রহ্মকমল কাঁপে

আয়না ভাঙা। দুপুর। লৌহফেনা

কী অপরূপ হারাকিরির দেশ

জার্সিবদল; কপট হাড়ের পাশা

তুমিও এমন চাল দিয়েছ অমোঘ

কারবালাতে খড়্গ শানায় সিমার

করাতকলে চেরাই চলছে চেরাই

এ কোন ইঁদুর স্নায়ুতন্ত্রে বসে

কাটছে আমার ইড়া ও পিঙ্গলা

মৌতালি ওই নদীর অন্য পাড়ে

এখনো কি জ্বালিয়ে রাখব শিখা

রাতমশালে পুড়ছে আকাশ, তারা

অরন্ধনের মন্ত্র বলো এবার

মৌতালি, ওই নদীর পাড়ে পাড়ে

অহোরাত্র ভেকের কলরব

অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com