শিল্পী আফজাল হোসেনের ড্রয়িং অবলম্বনে, গ্রাফিকস: প্রথম আলো
শিল্পী আফজাল হোসেনের ড্রয়িং অবলম্বনে, গ্রাফিকস: প্রথম আলো

সাজ্জাদ শরিফের সংগ্রহ ও ভূমিকা

শামসুর রাহমানের অগ্রন্থিত কবিতা

ভূমিকা

১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই কবি আহসান হাবীব মারা গেলেন। কবির মৃত্যুর কিছু দিন পর তাঁর ছেলে মঈনুল আহসান সাবের বাবার অগ্রন্থিত লেখা উদ্ধারের উদ্যোগ নেন। আমার কাছে লেখা উদ্ধার কাজটির প্রস্তাব আসে। আমি তখন ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে নিদারুণ অর্থকষ্টে আছি। প্রস্তাব পাওয়ামাত্র কাজটি লুফে নিই।

      কিন্তু অর্থকড়ি ছাপিয়ে কাজটি নানাভাবে ধীরে ধীরে অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। কাজটি আমি করছিলাম মূলত বাংলা একাডেমির লাইব্রেরিতে বসে। আহসান হাবীবের অসংকলিত কবিতা, অনুবাদ, গল্প ও অন্যান্য লেখার খোঁজে দিনের পর দিন আমি ১৯৪০-এর দশক থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত বাংলা ভাষায় প্রকাশিত যাবতীয় পত্রপত্রিকা উল্টে যেতে থাকি। স্পেনের কবি হুয়ান রামোন হিমেনেথের ‘প্লাতেরো ও আমি’ কাব্যগ্রন্থ আর শাহেদ সোহ্‌রাওয়াদীর কবিতার অনুবাদ ছাড়াও আহসান হাবীবের বিচিত্র লেখার সন্ধান পেতে থাকি। কিন্তু পূর্ব বাংলার সমাজের এক লুপ্ত সময়ের অবয়ব চোখের সামনে যেভাবে স্পষ্ট এক আকার নিতে থাকে, তা আমার নেশা ধরিয়ে দেয়।

      সেসবেরই মধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় ছড়িয়ে থাকা কবি শামসুর রাহমানের বহু কবিতার সন্ধান পাই। বোঝাই যায়, এই কবিতাগুলো কবি হিসেবে শামসুর রাহমানের গড়ে ওঠার সময়পর্বে রচিত। কারণ, কবিতাগুলো তিনি তাঁর কোনো বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করেননি। কবিতাগুলোর গুরুত্ব তাই বলে কোনোভাবেই কমে যায় না। কারণ, এসব কবিতায় পাওয়া যাচ্ছে একজন কবির তৈরি হয়ে ওঠার পথরেখা। শুধু কি তা-ই? এসব কবিতায় এমন কিছু লক্ষণ দেখা যাবে—যেমন নিখুঁত ছন্দের প্রতি তাঁর ঝোঁক, পাশ্চাত্য পুরাণের অবাধ ব্যবহার, ব্যক্তির শূন্যবোধের আধুনিকতাবাদী প্রবণতা ইত্যাদি—পরবর্তী সময়ে যা তাঁর কবিতার একান্ত মুদ্রা হয়ে উঠবে।

    কোন কবিতা কোন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, বয়সের চপলতায় সে সময় তার তথ্য সংগ্রহ করে রাখা হয়নি। এই অপূর্ণতা থেকেই গেল। তবু এত দিন পরে যে কবিতাগুলো আলোর মুখ দেখল, তার আনন্দই-বা কম কী!

সাজ্জাদ শরিফ

...... ...... ......

শামসুর রাহমানের কবিতা

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯—১৭ আগস্ট ২০০৬)

তোমার জন্যে

তোমার কুন্তল-মেঘ    নামে আজও হৃদয়ের
        ঘনিষ্ঠ চূড়ায়:
বিদ্যুৎ আভায় জ্বলে    দ্বৈতপর্ব, অনুপল—
        সময় ফুরায়।
যে আছে তোমার মনে          ভোরের সুহাস দূর
        আকাশের মতো
শত প্রজন্মের পরে     আজও তবু বেদনার
        তিমিরে জাগ্রত,
বৃথা আর কেন তাকে বারবার অপরাধে
        ম্লান হতে দাও?
যে রাত্রি তোমাকে নিয়ে সহজেই হতে পারে
        অতলে উধাও,
সে রাতের তারাফুল   মণিকার মালা ছিঁড়ে
        কোথাও যেয়ো না—
যদি যাও সেই ভুল     মুছে দিতে পারবে না
        তুমি না সে-ও না;
তুমিই বাগান জানি    কালের মালীর প্রাণে,
        বলো পাব কবে
তোমার বসন্ত ছুঁতে    অপেক্ষায় তীক্ষ্ণ হয়ে
        অভ্রান্ত গৌরবে?
কতটুকু নেব আর      উচ্ছল মেঘের জল
        বিহ্বল আঁজল ভরে!
বৃষ্টি হয়ে গেলে পর    আকাশের শতদলে
        একটি ভ্রমর ওড়ে:
যদি এ ভ্রমর এই সন্ধ্যার রাত্রির আর
        প্রভাতের কেউ,
তবে বলি সে ভ্রমর    আমার আসঙ্গে গান
        এবং প্রাণের ঢেউ।। 

দিনলিপি

বটের ছায়ার মতো সময়ের প্রীতি
কখন জানাবে সম্ভাষণ?
আকাশে নিশ্বাস মেশে মাঝে মাঝে, তবু
নীলিমা দেয় না সাড়া। কার হাতে তবে
ঢাকব আতুর মুখ, কার বুকে বিশ্বজয়ী জ্যোৎস্না উন্মোচিত?

শূন্যতার বিলাপে অস্থির মন। অবশেষে যাকে আজীবন
প্রাণের পরম মিত্র জেনে
                      উন্মীলিত গোপন অনল
                      দিয়েছি অকুণ্ঠ উপহার—
তারও হাত
নিস্পৃহ শীতল শুধু নির্বিকার রেখা।

বীরোচিত প্রাণে
জীবিকার জীর্ণ সে তক্তায় ভেসে ভেসে
কীর্তির উজ্জ্বল অহংকারে
মেতে উঠে মাঝে মাঝে যখনই তাকাই
ঊর্ধ্বলোকে, দেখি নিজে স্বজনবর্জিত দেশে নিঃসঙ্গ এবং
                      আশার ধনুক-ভঙ্গ ইতস্তত রণে।
মাছির ডানার ক্ষীণ শব্দের মতন
কথার অস্পষ্ট ঢেউ নড়ে যেন হৃদয়ের ক্লান্ত লোকালয়ে।

এমন মুহূর্ত নেই প্রশান্তির—স্পর্শ যার ভিড়াক্রান্ত মনে
তন্দ্রার নরম আভা জ্বেলে দিয়ে দুর্লভ মাধুর্যটুকু আনে।
জপেছি মুক্তির মন্ত্র, রাত্রিদিন যন্ত্রণার নিরসন চেয়ে
জ্বরতপ্ত পৃথিবীর কাছে
চেয়েছি প্রশান্ত হতে বিধাতার দয়ার মতন।
ব্যাকুল সাধের ষোলোকলা পূর্ণ হলে দুরাশার ব্যাধ
ঘুরবে একাকী তবু অজ্ঞাত সন্ধানে।

নন্দিত সুখের চারা আছে যেই নিবিড় উঠোনে
সেখানে আমার দাবি কতটুকু—কে দেবে উত্তর?
অন্য কিছু নয়,—
জাগে শুধু আকাঙ্ক্ষার একলা প্রহরী,
প্রাণের জটিল দুর্গে নারকী চেতনা।
হয়তো এখনো
জ্বরতপ্ত পৃথিবীর ধূসর কবল হতে সত্তাকে ছিনিয়ে
অন্তত আঁজলা ভরে নিরিবিলি কিছু জল তুলে নিতে পারি
                           কখনো আবার
চুলের প্রপাত আর তোমার মুখের রেখা, স্তনের পূর্ণিমা
জ্যোৎস্না হয়ে ঝরে যেতে পারে।
আমার তৃষ্ণার এই শ্রান্ত উপকূলে।

যদিও তোমার মুখ সারাক্ষণ ভাবনার আয়নায় নামে না,
তুমিই নিস্তার জানি ব্যাপ্ত এই প্রলয়ের মত্ত কোলাহলে।।

যাবার ক্ষণ

যাবার ক্ষণ এলে পরে—গোধূলি কি ভোরবেলায়—
পারব কি সব ফেলে যেতে ঘোর হেলায়?

বিশ্ব ছিল সর্বনাশা দ্বেষে তিক্ত, প্রেমে মদির;
ছিটেফোঁটা আক্রমণে হৃদয় আর নয় অধীর।
জীর্ণ পুঁথি চেখে চেখে একলা আলোয় চরাচরে
চিরদিন যৌবনেরও নুন খেয়েছি অকাতরে।
কেটে যাবে অনেক দিন কত লগ্নে চেনা ঘরে
মগ্ন আলোয় বন্দী হয়ে পদ্য লিখে প্রাণ ভরে।
কোন অলক্ষ্য সূত্রে আমি যুক্ত আছি, জানব নাকো;
সুতোটুকু ছিঁড়লে শুধুই অগাধ জল, লুপ্ত সাঁকো!

অতল সেই লগ্ন এলে চেনা গলা, ঝাপসা চোখ,
কান্না পাওয়া দেহ ছেড়ে দেখতে পাব কোন সে লোক
হয়তো সেই লগ্ন এলে চুলের ঢেউয়ে (আঁকাবাঁকা
কার সে চুল) স্তব্ধ বুকের কাতরতা পড়বে ঢাকা।

যখন এই ভোরের ডালে জ্বলবে ফিরে রোদ্দুর,
শব্দ থেকে গন্ধ থেকে ততক্ষণ কদ্দূর?

দৃষ্টি থেকে লুপ্ত হলে নানা মুনির বিরুদ্ধতা,
তারপরেই অন্তহীন, হৃদয়হীন নির্জনতা।।

অথচ উজ্জ্বল গর্বে

অথচ উজ্জ্বল গর্বে স্ফীতবক্ষ আমি, নিরন্তর
                  অরণ্যের মশালের মতো
অন্ধকার আত্মার গভীরে জ্বলি—উন্নিদ্র, বিশাল।
                  দ্বৈরথে অকুতোভয়, তাই
অজস্র তারার মতো নিজেকে ছিটিয়ে বৈরিতার
                  ক্রুর পাঁকে উন্মীলিত আমি।
যৌবনের তাপে হাত সেঁকে আমিও মাতাল হই
                  তীব্র কোনো ঘ্রাণের নেশায়,
দুর্বিনীত চুম্বনে মথিত করি হিংস্র লাস্যময়ী
                  সময়ের কম্প্র জানুরেখা।

আত্মার খনির ঘন অন্ধকার নিয়ে অনুতাপে
                  কখনো ঢাকি না হাতে মুখ,
চকিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি মায়ালোকে মোহাবিষ্ট, একা;
                 ঝড়ের ঝাপটে নত তবু
হইনি তো কোনো দিন বরং উদ্ধত নিষ্কষিত
                 তরুণ গাছের মতো বেগে
নির্ভয়ে নিশ্চিহ্ন করি আধিপত্য বর্বর হাওয়ার।
                 এবং বিভ্রান্ত নই কোনো
সর্বনাশা প্রলয়ের কুটিল সঙ্গমে, এমনকি
                 অকস্মাৎ গড়াইনি ভুলে
জ্যোতির্ময় দেবতার সুদুর্লভ পদতলে আজও;
                কেননা অমর্ত্য দেবতাকে
দীপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বী জেনে আজীবন লোকালয়ে আছি,
                গর্বোজ্জ্বল স্ফীতবক্ষ আমি।

যখন তোমাকে দেখি, বিলাসিনী সত্যের মতোই
                অবিকল নগ্ন, উন্মোচিত
জ্বলন্ত শয্যায় আর তোমার মোহিনী তনুভারে
                ডুবে যায় তিমির যখন
সকল সংশয়, দ্বিধা, গড়ে ওঠে মৃত্যু সমুজ্জ্বল,
                যখন তোমার দেহ ক্রমে
পুরানো কবরে লব্ধ দর্পণের মতো হয়ে যায়
                সুরভিত, ঝলসিত আরও
তখন নিশ্চিত জানি, মানি অলক্ষিতে লুপ্ত হয়
                আমার সে গর্বের মুকুট।

কোনো একজনের উক্তি

তোমার নিভৃততম মুক্তো ছিঁড়ে নিতে হৃদয়ের
আমার উদ্যম, ইচ্ছা সবই
স্বর্ণ-ঈগলের মতো পাহাড়ের নীলে
অপেক্ষায় তীক্ষ্ণ রাত্রিদিন।
অবশ্য অন্তিমে জানি ফিরে যেতে হবে
তোমার আশ্বিন হতে কোনো
বেদনার নিঃসীম আষাঢ়ে।
কেননা প্রবল জনরব:
ঐশ্বর্যের অপরূপ স্বর্গীয় উদ্যানে
বরাহের অধিকার কেবলই গুজব।
সারসত্য অন্য কিছু বটে
সাবেকি কিংখাবে মোড়া, ভীষণ উজ্জ্বল।
তবু অন্ধ রাত্রির নিঃসঙ্গ ঊর্ণনাভ
গোপনে হৃদয়ে নেমে আসে
পূর্ণিমার আকাঙ্ক্ষায় জ্বলে
দুর্নিবার। তোমার দুর্লভ স্পর্শে যদি
অমরতা নদী হয়ে, তরল জ্যোৎস্নার ঝরনা হয়ে
হাওয়া হয়ে ঝরে
আমার সত্তায়, তাই
তোমার সান্নিধ্য খুঁজি, বিরূপ কাঁটায়
ফুটিয়ে রক্তের ফুল আসি এ উদ্যানে,
প্রত্যাখ্যাত, দুর্বিনীত কুকুর যেমন
বারবার আসে ঘুরে ঘুরে
উৎসবের বিপুল আলোকে।
নিজেরই যে মিত্র নয়, উপরন্তু সংশয়ের বিষ
সঞ্চারিত যার মনে দুদিকে পুড়িয়ে মোম হেলায় যে ভাবে
প্রলয়ের মন্ত্রণা মধুর,
তাকে কেউ দেয় কি ঘেঁষতে ত্রিসীমায়?
অতএব তোমার স্পর্ধিত নিষেধের
হিংস্র তমসায় নেই ক্ষোভ।
নন্দিত স্বপ্নের মাঠে যে বৃক্ষ স্পন্দিত, সারাক্ষণ
আছেন দাঁড়িয়ে, তার পাতা
ধ্বনি হোক, সবুজ নক্ষত্র হোক তারা
হৃদয়ে আমার বিশ্বে প্রজ্বলন্ত, অফুরন্ত—চেয়ে দেখি শুধু।
প্রতিপল-অনুপল যে তীর্থের অভিসারী আমি
হয়তো সে তীর্থ নেই সময়ের নীলাভ সীমায়।
অথচ আমার যাত্রা আজও
বসন্তের সজীব ফুলের মতো দীপ্ত, উন্মোচিত
                      অন্তহীন রৌদ্রের তৃষ্ণায়।
কিন্তু তবু মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে, এবং গভীর
কৃষ্ণ গোলাপের মতো অন্ধকারে তুমি সঞ্চারিণী
দৃশ্যের বৈভবে আর সমস্ত চৈতন্যে যেন তোমার চোখের
                      অপরূপ মহানিশা কাঁপে।।

তার বিষয়ে

যথারীতি ভাসিয়ে সংসার বেনো জলে অবশেষে
অতর্কিতে দিতে হলো পাড়ি নিরুদ্দেশে।

অবশ্য লোকটার চক্ষুলজ্জা ছিল না মোটেই কোনো দিন,
প্রাণের দেয়ালে বহু নিবিড় নক্ষত্র গেঁথে গচ্ছিত রেখেছে শুধু ঋণ
মাছির মতন কিছু প্রাণীর মাথার ’পরে। প্রথাকে দেখিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলি
মায়াবী হাওয়ায় ভরে বুক বুলিয়েছে ইচ্ছার তুলি
সরাসরি পৃথিবীর মুখে। এবং দুর্গম কত সমুদ্রের কাদা সেঁচে
এনেছে যা তার জ্যোতি আর দুর্লভ স্বপ্নকে দিয়েছে সে বেচে
রজতনির্ভর জীব সেজে। দিনযাপনের ফাঁকে
ক্রোচে তাকে
দিলেন নেপথ্যে, ওহে, যে মন্ত্রণা কানে গুঁজে তা-ও
মলিন গলির চক্রে সহসা উধাও।
একদা আকাঙ্ক্ষা তাকে সুড়সুড়ি দিয়ে অনাবিল
হাস্যরোলে মাতিয়েছে কত দিন; ফলত ভাগ্যের পেটে খিল
ধরে গেছে আগেভাগে। এবং সেদিন সে-ও লিবিডোর মাঠে
বেপরোয়া হৃদয়কে ছুটিয়েছে রেসের ঘোড়ার মতো। আর শূন্য খাটে
শুয়ে শুয়ে (তখনো ছেঁড়েনি ভাগ্যে ভার্যারূপ অপরূপ শিকে)
ভেবেছে সমস্ত রাত যার মুখ সে তো বিচ্ছেদের প্যাসেফিকে
লোনা হয়ে অন্তিমে নিয়েছে তুলে নীল ঠোঁটে বণিকের মশকের জল।

সে নিজে, ‘কীর্তির রথ পৃথিবীতে যদি না আঁকে উজ্জ্বল চিহ্ন তবে কী-বা ফল
মানবজন্মের বলো’—এই সব আতশবাজির মতো কথা
ভজিয়ে আপন মনে, নিজেকে সোচ্চার ফাঁকি দিয়ে তোফা সফলতা
খুঁজেছে শব্দের ব্যূহে। এদিকে সংসার কী বাড়ন্ত পরগাছা।

মাঝে মাঝে বোতলের ঠামে মজে বুঝেছে সে কাকে বলে বাঁচা।
তবু তাকে অতর্কিতে দিতে হলো পাড়ি নিরুদ্দেশে
অথচ গৃহিণী আজও সংসারে শ্যাওলার মতো ভেসে—
লোকে বলে—দুবেলা নিপুণ হাতে
        রাঁধেন-বাড়েন। ভুলচুক
                   ভোলে তো ভুলুক
                           চতুরালি
আর শুনি কালেভদ্রে নিরুদ্দেশ যাত্রী সে-ই পায় করতালি।।

দুই সিংহ

পরাক্রান্ত এরেবস নাগপাশে আমাকে কেবলই
জড়ায় নিপুণ ছলে; আমি বলি উদ্ধত, নিকষ
যূপকাষ্ঠে। আমার জীবন এ জীবন্ত অন্ধকারে
দুঃস্বপ্নে শিউরে ওঠে, যেমন গোলাপ শবাধারে
কৃমির পিচ্ছিল স্পর্শে। আর আমি অবলীলাক্রমে
নামি, নামি ধাতুর সুতীব্র গন্ধে অতল পাতালে।

অতীত আমার মাঝে অন্তর্লীন বিষাদ-সংগীত,
বর্তমান ঝড়ের মুখের পাখি, ভবিষ্যৎ সে-ও
বিলাসিনী সুন্দরীর কটাক্ষের মতো অগণিত
ছলনা ও চাতুরীর অভ্যস্ত শোভায় মণিময়।

আকণ্ঠ বিতৃষ্ণা করে পান, নেতির নরকে জ্বলে
আজন্ম আমার সুহৃদেরা পরাস্ত অসাড় যুদ্ধে।
স্মৃতির বিকারে মনে পড়ে যে পথে হেক্টর আর
অ্যাগামেমনন কিংবা অ্যাকিলিস রথচক্রে কত
রূপসীর গোলাপের মতো স্ফুট, রক্তাক্ত হৃদয়
দিয়েছে গুঁড়িয়ে অকাতরে, যে পথে দা ভিঞ্চি, দান্তে
ভ্যান গঘ অথবা সেজান শাশ্বতীরে অফুরান
দিয়েছে ছড়িয়ে শুধু বিশ্বের আনন্দে, বেদনায়,
যে পথে চাঁদের নিচে উলঙ্গ গাধার পিঠে চড়ে
মধ্যরাতে একজন বাজায় বেহালা। সে সুর করুণ কিংবা
উচ্ছল চটুল—তা-ও বোঝা দায়। কাল নিরুপায়।

পিছনে তাকিয়ে দেখি রাজহাঁস-বাসনা আমার
শীতের শৈবালে বন্দী, কর্দমাক্ত তুষার-সফেদ
পাখা; উপরন্তু নীরক্ত চাঁদের মতো বুক নষ্টশক্তি, শুধু
আমরণ সাধের নীড়ের ধ্যানে দারুণ উদ্বেগে
কাটে তার বেলা।

                 অথচ আমিও আজীবন
সোনালি সিংহের মতো ভেবেছি নিজেকে। কতদিন
প্রদীপ্ত পায়ের নিচে গেছে ঝরে তাতানো বালির
রেণু, আর সংগত গর্বের হীরা জ্বলেছে দুচোখে।
সতত করেছি খেলা ভীষণের সাথে, এমনকি
সূর্যের নির্মম তাপও পারেনি গলাতে হেলাভরে
পৌরুষের সোনা। এবং সমুদ্রতীরে সূর্যাস্তে কি
সূর্যোদয়ে নির্বাসিত নৃপতির মতো একা আমি
ভেবেছি, বৈভব আর ভূতপূর্ব মৃগয়ার কথা।

কিন্তু আজ কী অবাক কাণ্ড দ্যাখো, এমনকি এই
একরত্তি চতুর শেয়াল সে-ও হুবহু আমাকে
নিমেষে ঠাউরে নেয় ঘনিষ্ঠ সেঙাত। অর্বাচীন
রবে তার নোয়াই উদ্ধত মাথা, কেবলই নিজেকে
মনে হয় হতশ্রী পটের ছবি, শিশুর সাধের
খেলার সামগ্রী যেন—নির্দোষ, নকল সিংহ এক:
গলিত সুতীক্ষ্ণ নখ, নিষ্প্রভ পাথর-চোখ আর
কুৎসিত কেশর। পথে গাধার করোটি হেসে ওঠে।

যদি ইচ্ছে হয়

যদি ইচ্ছে হয় যেতে পারি আদিম অরণ্যে,
যেখানে অন্ধকারে মূল্যবান রত্নের মতো জ্বলে
পাশব চোখ, আর ভালুকের কশ বেয়ে
গড়িয়ে পড়ে টাটকা মধুর ধারা।

যদি ইচ্ছে হয় যেতে পারি ভয়াল জঙ্গলে,
যেখানে আগুন রঙের বাঘের মুখে
নরম হরিণ ক্লান্ত হয়ে আস্তে আস্তে,
ক্রমাগত ক্লান্ত হয়ে চলে যায়
সময়ের সীমার বাইরে।
অথবা যেতে পারি সেই ঢেউ-বিক্ষুব্ধ
প্রবাল দ্বীপে, যেখানে দুঃসাহসী নাবিকের
হাড় শোনে স্তব্ধ আকাশের নক্ষত্রের গান।

বালিহাঁসের ছায়া-মসৃণ ঢেউ মেখে নিতে পারি
বুকে, কিংবা কোনো সাঁওতালি পথের বাঁকে
মহুয়া-মাতাল অপরাহ্ণে
পাহাড়ি ঝরনার কাচ-স্বচ্ছ, নুড়ি-গড়ানো জল
তুলে নিতে পারি আঁজলা ভরে,
যদি ইচ্ছে হয়।

আলস্যের মদে বুঁদ হয়ে অনেকক্ষণ
শুয়ে থাকতে পারি কোনো শান্ত উপত্যকায়,
যেখানে অনেক পাখি এসে নামবে,
যেমন নদীর তীরে স্নানার্থিনী
মেয়েরা ভিড় জমায়, মুখর হয় গল্পে।
ওরা ভয় পাবে না আমাকে দেখে,
আমার আশেপাশেই চলাফেরা করবে
অনায়াস ছন্দে, জীবনের লাবণ্যে মসৃণ।

তারপর যদি নির্মল চাঁদ ওঠে সেখানে
নির্মেঘ আকাশে, আমার মনে পড়বে
কোনো প্রাচীন কবিতার কথা, যা ঠিক স্মরণে
নেই, অথচ গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে
রোমাঞ্চিত ধমনিতে।

কিন্তু আমি যাইনে সেখানে, থাকি শহরে,
আমার শহরে।
ঊর্ধ্বশ্বাস ট্রাফিকের ব্যস্ততায়
বিজ্ঞাপনের মতো ঝলমলিয়ে ওঠা হাসি
শিরায় আনে আশ্চর্য শিহরণ,
মনে হয় যেন ঢক করে গিলে ফেলেছি
এক ঢোঁক ঝাঁজালো মদ।
আর প্রহরে প্রহরে অজস্র ধাতব শব্দ
স্মরণ করিয়ে দেয় ভ্রমরের গুঞ্জন।

আমার ছোট খুপরিতে ভোর আসে
ব্যালেরিনার মতো নিপুণ বিন্যাসে।
চড়ুইটা জানালা থেকে নেমে আসে
টেবিলে, যেখানটায় চৌকো রোদ স্থির,
তারপর ঠোকরাতে শুরু করে বাসি রুটির টুকরো
কিংবা ফলের খোসা।
আমি মৃত কবিদের প্রাণবন্ত অক্ষরে
ডুবে থাকি, বেলা গড়িয়ে
                         গড়িয়ে
                               গড়িয়ে
অবেলায় এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

রাতে খড়খড়িটা খুলে দেখি
বুড়ো রাজমিস্ত্রির চোখের মতো ছানি-পড়া
আকাশে জ্যামিতিক চাঁদ শোনে
তারার কথকতা। সেই মুহূর্তে
রহমত ব্যাপারীর রক্ষিতা হয়তো তার
ক্লান্ত যৌবনটাকে কুঁচকে-যাওয়া পোশাকের মতো
এলিয়ে দিয়েছে রাত্রির আলনায়।

কখনো দেখি,
রাত্রির ফুটপাতের ধারে এসে জমে
সারি সারি উজ্জ্বল-মসৃণ মোটর,
যেমন গাঢ় সবুজ ডালে ভিড় করে
পাখির ঝাঁক সহজ অভ্যাসে—তৈরি হয়
আমার ভালো লাগা মুহূর্ত।

স্বপ্ন দেখি এই শহর, আমার শহর
অমূল্য ধাতুর এক উজ্জ্বল আধারে প্রোথিত:
এমনকি সবুজ পাতার গাছ—সে-ও
অপ্রাপনীয় ধাতুর স্পর্শে রূপান্তরিত।
আমার সত্তার নদী মেলাই সে আধারে,
গোলাপের মতো পূর্ণতায় এ শহর
প্রস্ফুটিত হয় হৃদয়ে আমার।

নিরাশার নিরুদ্ধ অন্ধকারে
আশার উল্কির মতো জ্বলে
শহর,
        আমার শহর,
               প্রদীপ্ত শহর।।

পাশব গান

কখনো রাখেনি চোখ অজস্র তারার প্রস্রবণে,
নিঃসীম নীলের কান্তি অথবা স্বর্গের মধু, অশরীরী গান,
বসন্তের ঘ্রাণ, কোনো দিন আকণ্ঠ করেনি পান।
                           পরিচিত পৃথিবীকে তার
একটি মায়াবী ফল কিংবা কোনো রঙিন ফানুস
—কিছুই হয়নি মনে। গ্যালিলের পাহাড়ে একদা
যে আলো জ্বলেছে প্রেমে, ত্রাণের তন্ময় ধ্যানে, প্রাণে
                   শোনেনি সে তার
                             মহিমার লোকোত্তর গান।

সাধারণে অপবিত্র, পিচ্ছিল কাদার সুখী এবং মোহিনী
সঙ্গিনীর মত্ত কামে নিত্য সে অধীর
বিজয়ী অপেক্ষমাণ; জান্তবস্বভাবে
অন্ধকারে জননের উল্লাসে বিহ্বল।

নিষ্পন্দ ডোবার ওই নিরানন্দ জলে
জ্বলল চাঁদের ছায়া, অবলীলাক্রমে
নিঃশব্দে রইল শুয়ে সে-ও
                  সংহত, নিঃশঙ্ক, নগ্ন,
হৃতস্মৃতি, স্বপ্নহীন, অনায়াস ঘুমে অভিভূত।

ইতিমধ্যে অতর্কিতে পানোন্মত্ত কয়েকটি ধাঙড়ের উদ্যত বল্লম
বিঁধে নিল ঘুমের প্রশান্তি তার। আর সেই কর্দমবিলাসী
রাজ্যহীন বিতাড়িত সম্রাটের মতো রিক্ত, ভীত—
সুদূর অপার নীলে মেলে দিল অসহায়, অচেতন চোখ
এবং একটু নড়েচড়ে অবশেষে কাদায় রইল পড়ে
        বিরাট ফলের মতো স্তব্ধ, সমাহিত।

তারপর তাকে ঘিরে ধাঙড়ের উৎসবরাত্রির উজ্জ্বলতা,
আর সেই রাত্রির বিশাল
হৃৎপিণ্ডে তাদের নৃত্য জীবনের মতো নির্লজ্জ সুন্দর।
শুধু সে রইল পড়ে
অগ্নিকুণ্ডে ফুলের তোড়ার মতো নিরুদ্বেগ, একা।।