
সম্প্রতি মারা গেছেন সার্ব-মার্কিন কবি চার্লস সিমিচ। তাঁর কয়েকটি কবিতার অনুবাদ
বাংলাদেশের কবিতানুরাগী পাঠকদের কাছে খুব বেশি পরিচিত ব্যক্তিত্ব নন চার্লস সিমিচ। জাতিগত পরিচয়ের দিক থেকে তিনি ছিলেন সার্ব বংশোদ্ভূত। জন্ম বেলগ্রেডে ১৯৩৮ সালে ইউরোপের এক দুর্যোগপূর্ণ সময়ে।
১৫ বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান চার্লস সিমিচ। তবে মাতৃভূমিতে তাঁর আর কখনো ফিরে যাওয়া হয়নি। তিনি কবিতা লিখেছেন ইংরেজি ভাষায়। মার্কিন কবি হিসেবে পেয়েছেন স্বীকৃতি। তাঁর রচিত অধিকাংশ কবিতা হচ্ছে কথা বলা কিংবা দৃশ্য অথবা প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে যাওয়ার মতো, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে মমতাভরা কাব্যিক সৌন্দর্য। সিমিচের অনেক কবিতা ও অন্যান্য রচনায় উঠে এসেছে সার্বিয়ার বিংশ শতাব্দীর মর্মান্তিক ইতিহাসের নানা রকম বর্ণনা।
সম্প্রতি জানুয়ারি মাসের শুরুতে ৮৪ বছর বয়সে মারা গেছেন নানা পুরস্কারে ভূষিত এই সার্ব-মার্কিন কবি।
শহরে আমাদের বন্ধুদের দেখা পেতে
কিছু সময় লেগে যাবে,
কিছুটা দেরি হবে গভীর রাতে
একে অন্যের নাম ধরে চিৎকার করে
শহরের পথে হেঁটে যেতে,
চমৎকার কিংবা ভয়াবহ
কিছু দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে
দ্রুত সেগুলোর নামকরণ করে নিতে।
গ্রামের বাড়িতে আমি আছি,
ঘুম থেকে জেগে উঠি খুব ভোরে
শুনি পাখির গান
স্বাগত জানাই আলোর আবির্ভাবকে,
আর এর সবটা একসময় নীরব হয়ে এলে
বাতাসে শুনি পাতার শব্দ
এখানে যাদের ভিড় এতটাই
ঠিক যেমন শহরে ভিড় করে থাকে মানুষ।
আজকের চেয়ে সুন্দর কোনো দিন তৈরি করেননি ঈশ্বর,
বলছিলেন প্রতিবেশী একজন।
তিনি চলে গেলে গাছের ছায়ায় বসি আমি
আরও একবার ভেবে নিই সেই দৃশ্য,
একটি ব্যাঙ যখন
লাফিয়ে উঠে আসে ঘাসের ভেতর থেকে
আর আমি যে ক্ষতিকর নই, তা দেখে নিয়ে
পায়ের ওপর দিয়ে ডিঙিয়ে চলে যায় পুকুরের দিকে।
(পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধের পাপ নিয়ে প্রথম যে ব্যক্তি আমাকে বলেছিলেন, তিনি ছিলেন আমার পিতামহী। ১৯৪৮ সালে তাঁর মৃত্যু হলেও তাঁর স্মৃতি আমার পরিষ্কার মনে আছে, কেননা আমার মা কাজে থাকার সময় আমার আর ভাইয়ের দেখাশোনা তিনি করতেন। অসহায় সেই রমণীর বিচার-বুদ্ধি ছিল অধিকাংশ মানুষের চেয়ে বেশি। বেশ কয়েকটি ভাষা তাঁর জানা থাকায় রেডিওতে হিটলার, স্তালিন ও অন্য উন্মাদদের বক্তব্য তিনি শুনতেন। তাঁরা যা বলছেন, সেটা যে কতটা অর্থহীন, তা তিনি অনুধাবন করতে পারতেন। যা তাঁকে তাঁদের সেসব কুৎসিত বক্তব্যের চেয়ে আরও বেশি হতাশ করেছিল, তা হলো, তাঁদের পেছনে হাততালি দিয়ে যাওয়া অনুসারীরা। আমি তখন তা বুঝতে পারিনি, তবে যে একটি শিক্ষা তিনি আমাকে দিয়েছিলেন, আমার মনে তা এখনো গেঁথে আছে—‘সেই সব তথাকথিত মহান নেতা আর যে সম্মিলিত আনন্দ তাঁরা জাগিয়ে তোলেন, সে বিষয়ে সাবধান থেকো।’ অনেক বছর পর তাঁকে নিয়ে এই কবিতা আমি লিখেছিলাম।)
পিতামহী আমার সমাপ্তির ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন
তোমাদের সেই সাম্রাজ্যের, হে বোকার দল!
ইস্তিরি করছিলেন তিনি। রেডিওটা ছিল চালু।
আমাদের পায়ের নিচে কাঁপছিল পৃথিবী।
তাদেরই একজন বীর দিচ্ছিল ভাষণ।
‘দানব’; এই নামে ডেকেছিলেন তিনি তাঁকে।
দানবের জন্য চলছিল হর্ষধ্বনি আর কামানের অভিবাদন।
‘আমার এই খালি হাত দিয়ে আমি তাঁকে মেরে ফেলতে পারি,’
এই ঘোষণা তিনি শুনিয়েছিলেন আমাকে।
এর অবশ্য প্রয়োজন নেই কোনো। সবাই এরা
যেকোনো সময় চলে যাবে শয়তানের ডেরায়।
‘এটা নিয়ে কারও কাছে বরাই করতে যেয়ো না তুমি,’
সাবধান করে দিয়েছিলেন আমাকে তিনি।
আর আমি যেন বুঝতে পারি, তা নিশ্চিত করে নিতে মলে দিয়েছিলেন আমার কান।
বিশেষ কোনো পরিবারে কেউ একজন দেখে নেন এর চিহ্ন
ভবিষ্যৎ যেন হচ্ছে রেস্তোরাঁর অবন্ধুসুলভ ওয়েটার
যে থাকে তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে ডিনারের আদেশ নিতে
সে রকম এক মেনু থেকে যা তারা পড়ে নিতে অক্ষম।
না বুঝে তাকিয়ে থাকতে তারা ছিল অভ্যস্ত
টেলিভিশনের দোকানে বিক্রেতা তখন
একক একটি দৃশ্যে চোখ আটকে রাখা কঠিন করে দিয়ে
চ্যানেল বদল করে যায় দ্রুত।
কবরখানায় সদ্য গেঁথে রাখা ছোট পতাকা
আগাম গ্রীষ্মের বাতাসে
হতোদ্যম হয়ে ঝুলতে থাকা অবস্থায় বলছে না কিছুই,
অথবা এমন কিছু নয়, যা কারও নজরে পড়ে।
দৃষ্টিতে চলে আসা শহরে সূর্যাস্ত ছিল যেন
পাগলাগারদের ভোজন উৎসব
সবাই যেখানে আনন্দে লাগাচ্ছিল আগুন
আমাদের ট্রেন ঠিক যখন ঢুকে যায় টানেলে।
বৃদ্ধ এক কুকুর নিজের ছায়া নিয়ে শঙ্কিত
দক্ষিণের কোনো এক শহরে।
দৃষ্টি হারাতে যাওয়া এক মহিলা এই গল্প আমাকে বলেছিলেন
গ্রীষ্মের সুন্দর এক সন্ধ্যায়।
ছায়া যখন চুপিসারে উঠে আসছিল
নিউ হ্যাম্পশায়ারের বনের ভেতর থেকে,
দীর্ঘ এক পথ ছিল কেবল চিন্তিত এক কুকুরকে সাথে নিয়ে
আরও ছিল ধুলামলিন এক জোড়া মুরগির ছানা,
সূর্যালোকের আঘাত লাগা
নামহীন সেই দক্ষিণের শহরে।
এটা আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল ১৯৪৪ সালে
আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে জার্মানদের মার্চ করে এগিয়ে যাওয়া।
পথের পাশের পায়ে হাঁটার জায়গায় জড়ো হয়ে
চোখের কোণ দিয়ে সবাই দেখে নেয় এদের,
কাঁপছে পৃথিবী, ঘটে চলেছে মৃত্যু…
ছোট্ট একটি সাদা কুকুর দৌড়ে যায় পথে
আর আটকা পড়ে যায় সৈনিকের পায়ে।
একটি লাথি সেটাকে উড়িয়ে নেয়, মনে হয় যেন পাখা ছিল তার।
এটা সেই দৃশ্য, যা আমি দেখে যাই।
রাত্রি এগিয়ে আসে ধীরে। ডানাধারী এক কুকুর।