
তোমার অন্তরে কিছু আভা খেলা করে দিনরাত,
বুঝি তাই সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের সাধনায় ব্রতী
করেছে তোমাকে, আনোয়ার। এই ব্রতে
আজীবন মগ্ন থেকো, শিল্পের সৃজনে পেয়ো সাফল্যের মালা।
এখনো তরুণ তুমি, সেলুলয়েডের নীরবতা
যিনি করেছেন ঢের চিত্রল, বাঙ্ময়, খ্যাতি যাঁর জ্বলজ্বলে
বিশ্বজুড়ে, তাঁর উদ্দেশ্যেই
আপন অঞ্জলি ভরে নানা পুষ্প করেছ অর্পণ।
জেনেছি অনেক আগে, বলছি তোমাকে আজ গোধূলিবেলায়
পৌঁছে, জেনো, আনোয়ার, যিনি নিজে গুণী
তিনিই পারেন ছুঁতে প্রকৃত জ্ঞানীর পদযুগ, তাঁর বাণী
এবং সৃষ্টির বার্তা পৌঁছে দিতে দিগ্বিদিক কল্যাণের টানে।
ধন্য তুমি আনোয়ার, সেই ঢের স্বেদক্ষয়ী ব্রত
এ কৃপণ কালে স্বার্থহীনতায় করেছ গ্রহণ।
চলচ্চিত্রশিল্পের মহান শিল্পী সত্যজিৎ রায়ের প্রতিভা
তাঁর সৃষ্টি উদ্দীপিত করুক তোমাকে
নিয়ত আপনকার সৃজনের অভিলাষে, ধনী করো
স্বদেশের সংস্কৃতির বহমান ধারা।
৮ অক্টোবর ২০১১, ঢাকা
কখন, কীভাবে যে আমি সব্যসাচী সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টির প্রেমে পড়েছিলাম, আজ আর তা বলতে পারব না। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল বিশ্ববরেণ্য এই শিল্পীর চিরবিদায়ের পর প্রায় ১০ বছর ধরে নানা লেখা ও বিচিত্র তথ্য–উপাত্ত জোগাড় করে ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয় আমার সম্পাদিত ৫০০ পৃষ্ঠার বই সত্যজিতের রবীন্দ্রনাথ। সে সময় ডাকযোগে প্রায় ২০০ সৌজন্য কপি পাঠিয়েছিলাম বাংলাদেশ ও কলকাতার বিশিষ্টজনদের কাছে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আজ প্রয়াত।
বরেণ্য কবি শামসুর রাহমানও ছিলেন তাঁদের একজন। মাসখানেক পর থেকে শুরু হলো তাঁর প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আমার অভিলাষ। চিঠি বা ল্যান্ডফোনই ছিল সে সময় যোগাযোগ বা আলাপের একমাত্র বাহন।
কেন জানি আমার মনে এমন প্রত্যাশা জেগে উঠল যে শামসুর রাহমানের দু-কলম লেখা বা পাঠপ্রতিক্রিয়া যদি পেতাম! তত দিনে পত্রিকাসূত্রে জেনেছি, বার্ধক্যের রোষানলে পড়ে তিনি অসুস্থ। তারপরও আমার মন নাছোড়। ভাবখানা এমন, সুস্থতা-অসুস্থতা বুঝি না, তাঁর লেখা বা অভিমত আমি শুনবই শুনব। তাই কিছুদিন পরপর ফোন করে অনুরোধের আর্তি প্রকাশ করে চলি, কিন্তু একবারও কবি জানতে দেননি তাঁর অসুস্থতার খবর। প্রতিবারই বলে গেছেন, ‘আনোয়ার, আমি লিখব, বইটা আমার মন কেড়েছে, আশাহত হয়ো না।’ তাঁকে আমি চিনতাম কবিতাসূত্রে। চাক্ষুষ দেখিনি কোনো দিন। আলাপ–পরিচয় তো দূরের কথা।
এর দিন পনেরো পর দ্বিধাদ্বন্দ্বের লাজ ভুলে আবার ফোন করলাম কবিকে। তবে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এটাই আমার শেষ অনুরোধ। ফোনে বেশ কিছুক্ষণ রিংটোনের পর অবশেষে ওপাশে শুনতে পেলাম তাঁর কণ্ঠ। কুশল বিনিময়ের আগেই তিনি বললেন, ‘আনোয়ার, তোমার সত্যজিতের রবীন্দ্রনাথ এবং তোমাকে নিয়ে ছোট্ট একটা লেখা লিখেছি। কাগজ–কলম নিয়ে বসো। আমি পড়ছি তুমি লেখো।’ প্রথমে লিখলাম লেখার শিরোনাম, ‘পূর্বসূরি ও উত্তরসাধক’। শুরু হলো তাঁর বলা এবং আমার লেখা। লেখার শেষে বুঝলাম, তিনি সত্যজিৎ রায়ের প্রতি আমার অনুরাগে মুগ্ধ হয়ে আমাকে নিয়ে ১৮ পঙ্ক্তির একটি কবিতা লিখেছেন! মনে মনে আমি তখন খুশিতে আটখানা।
এর মাসখানেক পর ঢাকার এক কবিবন্ধুর সূত্রে হাতে পেলাম শামসুর রাহমানের কাটাকুটিসমেত সেই কবিতার খসড়া।
আমার জানামতে, ২০০২ সালের অক্টোবরে লেখা শামসুর রাহমানের এ কবিতা শুধু আমার কাছেই আছে। এটি আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি। কবিতাটিতে মেলে কবির সেই চিরচেনা স্বভাবসুলভ অনায়াস বলে যাওয়ার ভঙ্গি, মনে হয়, শামসুর রাহমান যেন আমার সামনে বসে কথা বলছেন!