রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে আমেরিকার সংবাদপত্রের মন্তব্য
আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস। কবিগুরুর মৃত্যুর পর আমেরিকার সংবাদপত্রগুলো তাঁর সম্পর্কে বিচিত্র মন্তব্য করেছিল।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঁচবার আমেরিকা ভ্রমণ করেন এবং মোট ১৭ মাস অবস্থান করেন। ১৯১২ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত বিদেশে ইংল্যান্ডের পর আমেরিকাতেই তিনি সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছিলেন। তাঁর ভ্রমণের কোনো কোনোটি ছিল তাঁর জীবনের সংকটকালে, কোনো কোনোটি ছিল পৃথিবী ও ভারতের ঐতিহাসিক মুহূর্তে। এ ছাড়া তাঁর ভ্রমণের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি।
আমেরিকা ও আমেরিকানদের প্রতি কবির একধরনের আসক্তি ছিল, যা তাঁকে বারবার আমেরিকায় নিয়ে এসেছে। আর এ কারণেই হয়তো যখন উচ্চশিক্ষার্থে সবাই বিলেত যায় তখন পুত্র রথীন্দ্রনাথকে কৃষিবিষয়ক উচ্চশিক্ষার্থে তিনি আমেরিকাতে পাঠিয়েছিলেন। এমনকি কোনো কোনো ভ্রমণে তাঁর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে, তবু তিনি আবার আমেরিকায় এসেছেন।
আমেরিকায় তিনি পেয়েছিলেন অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু, একই সঙ্গে পেয়েছিলেন কিছু সমালোচকও। আমেরিকার পত্রিকাগুলো বেশির ভাগ সময় তাঁর প্রশংসা করেছে। তবে কখনো কখনো তাঁর সমালোচনায়ও মুখর হয়েছে এসব পত্রপত্রিকা। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ যখন পশ্চিমা যান্ত্রিক সভ্যতার বিরোধিতা করে আমেরিকায় একাধিক বক্তৃতা করেছেন। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট, বাংলা ১৩৪৮ সালের ২২ শ্রাবণ তাঁর মৃত্যুতে সারা আমেরিকার মানুষ যাঁরা তাঁর কবিতা ও বাগ্মিতা স্মরণ রেখেছিলেন; এবং আরও অসংখ্য মানুষ যাঁরা তাঁকে দেখেননি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এই দার্শনিক কবির লেখনীর মাধ্যমে পরিচিত হয়েছিলেন, সবাই-ই মর্মাহত হন।
সংবাদপত্রগুলো তাঁকে স্মরণ করে, শ্রদ্ধা জানিয়ে সংবাদ ও লেখা প্রকাশ করে। কোনো কোনো পত্রিকা সম্পাদকীয় লেখে। তাঁর মৃত্যুতে কিছু সংবাদপত্রের শিরোনাম ছিল: ‘ভারতের সবচেয়ে বড় লেখক’, ‘বাংলার আত্মা’, ‘মহান পণ্ডিত ও শিক্ষাবিদ’, ‘পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে বন্ধুত্বের দূত’। এ সময় পত্রিকাগুলো রবীন্দ্রনাথের আমেরিকায় ভ্রমণের স্মৃতিও চারণ করে। পাশাপাশি পশ্চিমের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি যেভাবে নিন্দা জানিয়েছেন এবং বিশ্বের মানুষের পক্ষে তাঁর প্রচেষ্টার কথাও এখানে উল্লিখিত হয়।
‘ফিলাডেলফিয়া ইনকয়ারার’ লেখে, ‘রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ জীবনে সুন্দর স্বপ্নের শেষ ছিল না।’ তারা স্মরণ করে রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমা যান্ত্রিক সভ্যতার কঠোর সমালোচক ছিলেন, তারপরও ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই একই বিশ্বের অনেক বড় স্বপ্ন এবং সুন্দর শব্দের মানুষ ছিলেন।’
‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘ঠাকুর বিশ্বাস করতেন, পূর্ব ও পশ্চিম মানব মনের প্রতিনিধিত্বমূলক অগ্রণীবাদী এবং অপরিবর্তনীয় মনোভাব নয় বরং তারা একে অপরের পরিপূরক। যেহেতু ঠাকুরের নিজস্ব কাজ ও চিন্তাভাবনা পূর্ব ও পশ্চিমের মিশ্রণকে উপস্থাপন করে তাই পরবর্তী প্রজন্মের হাতেই তাঁর কবিতা ও নাটকের ভাগ্য...এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে হাজার বছরের যে সমুদ্রসমান পার্থক্য তাতে কোনো সেতু রচিত হয় কি না তা তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে পরীক্ষা হতে পারে।’
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরদিন ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ কিছুটা সমালোচনামূলক প্রতিবেদন ছাপে এবং রবিঠাকুরের সাহিত্যকর্মের স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে ১৮ শতকের বিশিষ্ট ইংরেজ কবি এ ই হাউস্টনের ‘টু অ্যান অ্যাথলেট ডাইং ইয়াং’ নামাঙ্কিত কবিতা থেকে দুটি চরণ উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘মানুষের নাম তাঁর চেয়ে দ্রুত মরে যায়। স্যার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি ৮০ বছর বয়সে সদ্য প্রয়াত হয়েছেন, তাঁর খ্যাতি আশ্চর্যজনকভাবে তাঁর জীবদ্দশাতেই রাহুগ্রস্ত হয়েছিল। ৩০ বছরের কিছু আগে স্যার উইলিয়াম রথেনস্টেন এবং ডব্লিউ বি ইয়েটস যৌথভাবে ভারতীয় কবি রবিঠাকুরের “গীতাঞ্জলি” প্রকাশ করে, যার প্রচ্ছদ কবির প্রতিকৃতি দিয়ে চিত্রিত ছিল। তাঁর খ্যাতির জোয়ারটি কবি নাকি তার প্রকাশক ব্যবহার করেছিল তা প্রশ্নসাপেক্ষ?’
‘তাঁর একটির পর একটি বই প্রকাশ হচ্ছিল। নোবেল পুরস্কার তাঁকে গৌরবের শীর্ষ নিয়ে গিয়েছিল। উপমহাদেশে বিভিন্ন ভাষায় তাঁর কাজের অনুবাদ হয়েছে এবং সেখানে তাঁর জনপ্রিয়তা এখনো দুর্দান্ত। একসময় জার্মানি ও আমেরিকায় তাঁর লেখার প্রশংসনীয় চাহিদা ছিল। তাঁর লেখা কি একধরনের একঘেয়ে শৈলী ও চিত্রকল্প, রূপক অথবা রহস্যময়তার ধারা নাকি অতিরিক্ত উপন্যাস, নাটক বা গানের রচনা, যা তাঁর চাহিদা হ্রাস করেছিল? যেকোনোভাবেই হোক মনে হচ্ছিল যেন তাঁর সূর্যকিরণ গোধূলিতে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। ঠাকুরের অগণিত রচনা খণ্ড থেকে নির্বাচিত অংশ প্রকাশ করে তার খ্যাতি পশ্চিমে কিছুটা হয়তো ফিরিয়ে আনা যেত।’
‘দ্য সানফ্রান্সিসকো ক্রনিকল’ সম্ভবত ঠাকুরের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে কবির চিত্রকল্পের জাদুটিকে সবচেয়ে ভালোভাবে ধারণ করেছিল। অনেক আমেরিকান মনে করে, যা সম্ভবত এমন একজন ব্যক্তির জন্য এপিটাফ হিসেবে কাজ করতে পারে যিনি সর্বোপরি জন্মভূমির প্রেমিক ছিলেন।
‘মেঘ তারাগুলো মুছে ফেলেছে এবং আমরা ভাবছি কখন ভোর শুরু হবে। কারণ আমরা দুর্ভোগে পড়েছি। শক্তির বোঝা আমাদের মুখগুলো আড়াল করেছে এবং অন্ধকারে আমাদের দমবন্ধ। তবে আগামীকালটি আমাদেরই হবে।’
সূত্র: রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সার্ভিস কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তিকা ‘টেগোর অ্যান্ড আমেরিকা’, জেএলডিস, ১৯৬১ ও ‘নিউইয়র্ক টাইমস আরকায়েভ’, আগস্ট ৮, ১৯৪১
অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com