আহমদ ছফা—হুমায়ূন আহমেদের যে লেখাটির কথা নিজের প্রিয় বলে উল্লেখ করতেন, তা হলো হুমায়ূনের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’। মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগে, ১৯৭০ সালে রচিত, এবং যুদ্ধের পর প্রকাশিত। এই উপন্যাস নিয়ে ১৯৭৮ সালে একটি টেলিভিশন চলচ্চিত্র হয়। একটি ক্ষুদ্র মধ্যবিত্ত পরিবারের কাহিনি নিয়ে রচিত এই নাটকে পরিবারের পিতা আবুল হায়াতের একটি সংলাপ আছে—‘গরিব হয়েছি কিন্তু এখনো ছোটলোক হইনি।’ কী দুর্বল, কী নাজুক এক পিতৃতন্ত্র! হুমায়ূনের ভাষা ধার করলে বলা যায়—আহা রে! বড় মায়া লাগে!
সত্তরের মফস্সলি ঢাকার একটি পাতিবুর্জোয়া পরিবার মুক্তিযুদ্ধের আশপাশের সময়ে গরিব ও ছোটলোকের ভেদাভেদের এই হিসাব–নিকাশ করছে। উত্থানকামী অথচ ‘প্রিক্যারিয়াস’ এই মধ্যবিত্তই ছিল হুমায়ূনের প্রধান পরিপ্রেক্ষিত। সলিমুল্লাহ খান লিখেছেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ যাহাদের জন্য লিখিতেন তাহাদের মাপেই তিনি গড়িয়া উঠিয়াছিলেন।’ খানের মতে তারা ছিলেন এ দেশের ‘নিম্ন–মধ্যবিত্ত’।
হুমায়ূন আহমেদের নন্দিত নরক মূলত সত্তর থেকে নব্বই দশকজুড়ে বিকশিত নিম্ন থেকে মধ্যবিত্ত সমাজের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো। পরিবার ও রাজনৈতিক পরিসরে সেই কাঠামোর বিস্তার। লেখক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের স্বাতন্ত্র্য ও শক্তির হদ্দি এই ‘নন্দিত নরক’ নামক আয়তনের ভেতর অনেকটা ধরা আছে। হুমায়ূন বিস্তর উপন্যাস লিখেছেন বটে, তবে সেগুলোকে আলাদা আলাদা পূর্ণাঙ্গ কাহিনি বলে বিবেচনা না করে যদি একটা বিরাট ক্যানভাসে সমাজের এই পরিসরের গল্প বলে ভাবা যায়, তাহলে তাঁর মৌলিক গরজগুলো হয়তো আমরা চিনতে পারব।
এই লেখায় আমি হুমায়ূনের কাহিনি-সাহিত্যের সামাজিক কূটনীতি বিবেচনা করতে চাই। নিম্ন–মধ্যবিত্ত শ্রেণি কীভাবে গঠিত হলো—হুমায়ূনের গরজ সেটা ছিল না। বরং এই শ্রেণির অবমুক্ত বাসনার কূটনীতিকার ছিলেন হুমায়ূন। তাঁর অজস্র কাহিনি-সাহিত্যে এই ভদ্রলোক পরিসরের নৈতিক বিন্যাসের অর্থভেদ করেছেন। সাহিত্যের মৃদু সহিংসতার দ্বারা পুরোনো পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর বিনির্মাণ এবং মধ্যবিত্ত মানসের বাসনা ও কল্পনাকে গণ্ডিছাড়া করেছেন।
উনিশ শতকে ব্রিটিশ উপনিবেশের অধীনে কলকাতাকেন্দ্রিক যে মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে ওঠে, সেই মধ্যবিত্তের একটি অপেক্ষাকৃত বিলম্বিত ও দুর্বল অনুরণন আকারে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান ও বাংলাদেশের গঠনের মধ্য দিয়ে একটি বাঙালি মুসলমানপ্রধান মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠে। এই মধ্যবিত্ত সমাজের জীবনে কঠোর বিধিবদ্ধতা, পারিবারিক-সামাজিক শৃঙ্খলা আদবকায়দা নিয়মানুবর্তিতার নানা আদর্শ ছিল, তবে বাস্তবতা ততটা ছিল না। এই সব আদর্শের বুলিতে তারা শিশু-কিশোরদের বড় করত—পারতপক্ষে কেরানি হওয়ার জন্য। পিতৃতান্ত্রিক পরিবার এবং বিদ্যালয়-বিচারালয়-পত্রপত্রিকা-শাসনযন্ত্রসহ রাষ্ট্রীয় পরিসর ছিল এই আধুনিক মধ্যবিত্তর নৈতিক বিন্যাসের মূল কারখানা।
এই শ্রেণির আদব-শৃঙ্খলার আদর্শকে দস্তুরমতো ভিক্টোরীয় বলা যাবে না, বরং কলোনিয়াল আদলে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র-পরিসরে রুজু হওয়ার জন্যই এই সব পরিবার আপাত-ভিক্টোরীয় আদব লেবাস আকারে ধারণ করত। ভেতরে ভেতরে তাদের জীবনে ছিল আরও নানা অলিন্দ ও জানালা।
হুমায়ূন দেখাচ্ছেন, সে আমলের ভদ্রলোক পিতৃপুরুষেরা ছিলেন কড়া। তাঁর আত্মজীবনী ও উপন্যাসে এই কড়া পিতৃপুরুষেরা এসেছেন সারি বেঁধে। চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলের ক্লাস টিচার মুখলেসুর রহমান, যাঁকে ছাত্ররা ডাকত ‘দেড় ব্যাটারি’ নামে এবং যাঁর বিখ্যাত ধমকে ছাত্ররা প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলত। ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল জালালউদ্দিন, যাঁর নিয়মকানুনের ভয়ে নিশ্বাস ফেলা মুশকিল ছিল। জালালউদ্দিনের কলেজে পাট চুকিয়ে হুমায়ূন ভর্তি হতে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইন্টারভিউ নিলেন খোন্দকার মোকাররম হোসেন, কেমিস্ট্রি বিভাগের। ‘তাঁর মুখ হাসি হাসি, তবে সেই হাসি থেকে কেন জানি কোনো ভরসা পাওয়া যায় না, বরং ভয় লাগে।’ মুহসীন হলের গৃহশিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ এমরান, যিনি ‘কারণে–অকারণে অতি দ্রুত রেগে যেতে পারেন।’ এক ছাত্রকে চড় মেরেছিলেন। এভাবে এক অনুশাসনিক পরিসর থেকে আরেক অনুশাসনিক পরিসরে বান্দার পরিক্রমা ঘটত।
গুরুগম্ভীর শিক্ষক, বাসার বড় চাচা বা দাদাজান, গ্রামের মাতব্বর সাহেব—এমন ছিলেন নানা জালালি পিতৃপুরুষ—যারা অল্পবয়সীদের জন্য যমের মতো। ‘শিক্ষকেরা ছিলেন অন্য গ্রহের মানুষ। তাঁরা অনেকখানি দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন।’ এবং ‘ছাত্রদের কোনো সমস্যায় তাঁদের কোনো সহানুভূতি ছিল বলেও মনে হয় না।’ এই হলো পুরাতন পিতৃতান্ত্রিক আদব-কায়দা—ঘরে ও বাইরে।
হুমায়ূনের উপন্যাসের কূটনীতি হলো এই কঠোর পিতৃপুরুষদের যে জালালি বা সাবলাইম ভাব, সেটার বিনির্মাণ করা। তাদের অত্যাচারী ও শোষক আকারে কশাঘাত মেরে উন্মোচিত করা হুমায়ূনের প্রধান মুদ্রা নয়, বরং তাদের কঠোর বাতাবরণের আড়ালে তাদের নাজুকতা খুলে দেখানো অথবা হৃদয়ের দ্রবতা আবিষ্কার করাই তাঁর অভীষ্ট। কেমন সেটা? হুমায়ূন মুহসীন হলে লিফট আছে বলে ভর্তি হতে চান শুনে বদরাগী এমরান স্যার হেসে ফেললেন। ‘হেসে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মনে হলো হাসা ঠিক হয়নি। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, আমার সঙ্গে রসিকতা করার চেষ্টা করবে না।’ বাইরে কঠোর ভেতরে দ্রব। এই হলো সূত্র।
শুধু দ্রবতা নয়, পুরাতন কাঠামোর ফাঁকিটাও দেখিয়েছেন হুমায়ূন। দেখিয়েছেন যে মধ্যবিত্ত পিতৃপুরুষদের পিতৃতন্ত্র আদতে বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো। এনএসএফের গুন্ডারা যখন হলের ভেতর এক নারীকে ধর্ষণ করছিল, তখন ছাত্ররা অ্যাসিস্ট্যান্ট হাউস টিউটরকে জানিয়ে কোনো লাভ হয়নি। হুমায়ূন বাঁকা সুরে লিখেছেন, শিক্ষকেরা যখন বলেন সে সময় ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ছিলেন কঠিন। তখন অনেক কষ্টে আমি হাসি চাপি।’ আদতে হুমায়ূনের বিচারে এই সব পিতৃপুরুষেরা ছিলেন গোপনে গোপনে অক্ষম ও ধ্বজ। ‘নন্দিত নরকে’ কাহিনিতে দেখা যায় পরিবারের বাবার পৌরুষ ক্রমাগত নির্বীর্য [ক্যাস্ট্রেটেড] হয় প্রতিবেশী বড়লোকের বিদেশি জিনিসের গৌরবে, দ্বিতীয় বউয়ের খোঁটায়, আর অবাধ্য পুত্রের বেয়াদবিতে। বড় ভঙ্গুর এই পিতৃপুরুষের আত্মাভিমান। রাবেয়াকে সে রক্ষা করতে পারে না।
আহমদ ছফা সমাজের বিদ্যমানের নিরাকরণের রূপক আকারে বারবার অ্যাসিড বা দাহিকাশক্তির কথা বলতেন। হুমায়ূন আহমদ দাহিকায় নয়, দ্রবণে আগ্রহী ছিলেন। অর্থাৎ সমাজের অচলায়তনকে দাহিকা দিয়ে নিরাকরণ করা নয়; বরং তার ভেতরে-ভেতরে দ্রবীভবন খোঁজাকে হয়তো তিনি শ্রেয় মনে করতেন।
আদতে মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের সমাজের যে প্রবল ডামাডোল, সামাজিক আকাঙ্ক্ষার বিপুল উত্থান ও পরাজয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক বর্গগুলোর রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও বিকাশ—সেটা অক্রিয় দ্রবীভবনের মামলা ছিল না; বরং ভয়াবহ মাত্রায় দ্বান্দ্বিক ছিল। আহমদ ছফা বলেছেন, হুমায়ূন এই সময়ের ‘সোশ্যাল ডিসকোর্সে অংশগ্রহণ করেন নাই’ বরং ‘অ্যাভয়েড’ করেছেন, কারণ তিনি মার্শাল ল জমানার ‘প্রোডাক্ট’। অর্থাৎ সমাজ ও রাষ্ট্রের এপিক দ্বন্দ্বকে তার বিপুলতায় স্পর্শ না করে, হুমায়ূন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন। ফারুক ওয়াসিফ লিখেছেন হুমায়ূনের এই নিবদ্ধতা একটা শ্রেণির অনুগামী। ওয়াসিফের মতে, এই সময়ের মধ্যবিত্ত ‘বড় স্বপ্ন হারিয়ে’ জীবন গোছাচ্ছে, আর তাদের ‘সাংসারিক আর অলীক আকাঙ্ক্ষার বিশ্বাসী জীবনীকার’ হুমায়ূন।
তাই–বা কম কী? ছোট করে দেখলে, হুমায়ূন আহমেদের কাহিনি-সাহিত্যের একটা মূল গরজ ছিল মধ্যবিত্তর জীবনে ‘আদব প্যারাডাইম’ সরে গিয়ে ‘খোলাখেয়ালের প্যারাডাইমে’র প্রতিষ্ঠা। ব্যাপারটা বিপ্লবের নয়; বরং বান্দাগঠনের: অর্থাৎ পরিবার ও সমাজে ব্যক্তির সত্তা, অভ্যাস, সম্পর্ক ও বাসনার গঠনের।
জনপ্রিয় ও বাজারনন্দিত যে হুমায়ূন আহমেদ, তিনি ‘মৃদু মানুষের ঈশ্বর’ ছিলেন না। বরং মৃদু মানুষের জীবনে মুক্ত কল্পনা বা খোলা খেয়ালের প্রতিষ্ঠার দূত ছিলেন। সমাজে প্রতিষ্ঠিত নন্দিত নরকের নেতির জন্য হুমায়ূন কোনো দাহিকা অ্যাসিড বা বিপ্লবের শরণ নেননি। ভেতর থেকে মায়া-মমতা মাখিয়ে দ্রবীভবন করে ওটাকে ঝুরঝুর করে ফেলেছেন তিনি আলতোভাবে। এই মোকদ্দমায় তিনি স্রেফ কিছু সাক্ষী হাজির করেছেন। বিদ্যমান পরিবার ও নানা আদব-পরিসরের ভঙ্গুরতা, হাস্যরসাত্মকতা, ফাঁকিগুলো তিনি তুলে ধরেছেন স্রেফ কিছু প্রতি-দর্শক হাজির করে। এই সব প্রতি-দর্শকের মধ্যে আছে শিশু কিংবা শিশুসুলভ বয়স্ক (যেমন হিমু বা শুভ্র), যুক্তির প্রতি ম্যানিক নিষ্ঠ মিসির আলী, কিংবা নানা বৈদেশি ব্যক্তি ও পাগল। সমাজে চিন্তা ও যাপনের যে অভ্যস্ত সূত্র ও সত্য, তাকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ধরেন এই সব প্রতি-দর্শক। আর তাতেই কেল্লা ফতে হয়ে যায়।
সমাজে প্রতিষ্ঠিত নন্দিত নরকের নেতির জন্য হুমায়ূন কোনো দাহিকা অ্যাসিড বা বিপ্লবের শরণ নেননি। ভেতর থেকে মায়া-মমতা মাখিয়ে দ্রবীভবন করে ওটাকে ঝুরঝুর করে ফেলেছেন তিনি আলতোভাবে। এই মোকদ্দমায় তিনি স্রেফ কিছু সাক্ষী হাজির করেছেন। বিদ্যমান পরিবার ও নানা আদব-পরিসরের ভঙ্গুরতা, হাস্যরসাত্মকতা, ফাঁকিগুলো তিনি তুলে ধরেছেন স্রেফ কিছু প্রতি-দর্শক হাজির করে।
আধুনিক ভদ্রবিত্ত সমাজের বিকাশের সঙ্গে শিশুত্ব, পাগলামি, খোলা কল্পনার সংযোগ আছে। ব্রিটিশ শাসনের অধীনে নতুন যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান হলো, তাদের আমরা ‘বাবু’ বলে জানি। বাবু বলতে একই সঙ্গে ভোগবিলাসী, শিক্ষিত-সংস্কৃতিমান ও শিশু বোঝায়, যাদের মধ্যে উপনিবেশী বাস্তবতায় নতুন কল্পনা ও যাপনের বিকাশ ঘটেছিল। সাহিত্যে জানা গিয়েছিল সেই নতুনের খবর। মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতায় কল্পনার সার্বভৌমত্ব ঘোষিত হয়েছিল: ‘সেই কবি মোর মতে, কল্পনা সুন্দরী/ যার মনঃ—কমলেতে পাতেন আসন’। উপনিবেশী আধুনিকতার গোড়ায় ‘আলালের ঘরের দুলালের’ মতো উপন্যাসে শিশুকে নতুন কলোনিয়াল অব-রাষ্ট্রের বাধ্যগত প্রজা আকারে গড়ে তোলার তাগিদ ছিল। শিশুমানুষির এই কর্তৃত্ববাদী ধারায় বড় ছেদ আসে একশ্রেণির শিশুসাহিত্যিকের হাতে, যাঁদের মধ্যে স্মরণীয় সুকুমার রায়। রবীন্দ্রনাথের নবীন-কাঁচা যেখানে রোমান্টিক আর নজরুলের তরুণ যেখানে বিপ্লবী, সেখানে সুকুমার বললেন খেয়ালখোলা, ভোলা, পাগলার কথা। দাশু থেকে শুরু করে অসংখ্য চরিত্রে শিশু, পাগল ও খোলা কল্পনার অবাধ পরিসরের উন্মোচনের দ্বারা সুকুমার রায় শিশু মানুষ করার প্রশ্নে শৃঙ্খলাবাদ থেকে সরে এসে খোলা-খেয়ালের জারি করলেন।
সুকুমারের ছিল আবোলতাবোল আর হুমায়ূনের এলেবেলে। বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত সমাজ একটা সুনির্দিষ্ট মাত্রায় বিকাশ লাভ করার প্রেক্ষিতে হুমায়ূন আহমেদ ও তাঁর ভাইদের সাহিত্যে শিশু, উন্মাদ, ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে এক নতুন সামাজিক কূটনীতি ফলবান হয়েছে। হিমু যেমন। সে এক বাঁধন-ছাড়া বয়স্ক শিশু-ব্যাটা। হিমালয়ের বাবা তাকে যেভাবে বড় করেছেন, তা তার স্বভাবের আদি কারণ বটে, তবে তার পুরো স্বভাবটি ছেলেমির বেশি নয়। চাকরিবাকরি করে না সে, মহাপুরুষের মতো ভিক্ষাবৃত্তি করে। ছ্যাঁচড়ের মতো আত্মীয়বাড়ি ঘোরে। উটকো হয়ে নানা জায়গায় যায় বা তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। শিশুর মতোই নিজেকে সে অপার ক্ষমতাবান ভাবে।
আদব প্যারাডাইমে শিশুদের সঙ্গে বড়দের আন্তঃপ্রজন্ম সম্পর্কের মূল সারবস্তু ছিল আদবকায়দা শেখানোর, শিক্ষা-সহবতের তথা মুরব্বিয়ানার। এই মুরব্বিয়ানা সম্পর্কের অর্থভেদ করলেন হুমায়ূন। ক্লদ লেভিস্ত্রসীয় তত্ত্ব অনুসারে সমাজে বাপ ও মামা—এই দুই ধরনের মুরব্বির প্রতি মানুষের ভঙ্গি সচরাচর দুই প্রকার। কোনো কোনো সমাজে বাপ শ্রদ্ধেয় ও মামা আহ্লাদের। আর কোনো সমাজে মামা শ্রদ্ধেয় আর বাপ আহ্লাদের। বাংলাদেশে মামা প্রধানত আহ্লাদ ও আবদারের অসম্ভ্রান্ত স্থল। বাপও আহ্লাদ দেন কিন্তু বাপ শাসনও করেন, আর মামাবাড়িতে শুধুই খাতির, আহ্লাদ, উৎপাত, আর দুধভাত—এই রকম একটা আইডিয়াল টাইপ সমাজের গৃহপুরাণে হাজির আছে (অবশ্য বাপের অবর্তমানে খোদ মামা যখন অভিভাবক হন, তখন আলাদা হিসাব)। হুমায়ূনের বাপেরা প্রায়ই বাইরে শাসন করেন কিন্তু পারতপক্ষে ভেতরে-ভেতরে দ্রবীভূত ও অনুমোদনপ্রবণ, আর মামারা তো মামাই। সহনশীল মমতাবান অনুমোদনপ্রবণ মা–বাবা বা আত্মীয়ের বাইরে অন্য সব মুরব্বিকেই উপদ্রব [নয়েজ] আকারে প্রতিষ্ঠা করলেন হুমায়ূন। যে বৃহত্তর মুরব্বিসমাজ মধ্যবিত্তের বাসায় আসতেন, থাকতেন, তাদের বিদঘুটে আচার-আচরণ দেখিয়ে তাদেরকে হাস্যকর উপদ্রব বলে উন্মোচিত করলেন হুমায়ূন। গুরুগম্ভীর শাসনপ্রবণ পিতৃপুরুষদের বিদঘুটে বাতিকগ্রস্ত হিসেবে চিত্রিত করে তাদের এথিক্যাল অথরিটিকে খামখেয়ালি, অযৌক্তিক ও হাস্যস্পদ করলেন।
তবে হুমায়ূন কেবল পরিবার ও মধ্যবিত্তে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। গ্রামজীবন নিয়ে তাঁর অত্যন্ত শক্তিশালী অনেক কাহিনি আছে, যেখানে গ্রামের নানা চরিত্র টাইপের মতো করে হাজির হয় একটা জটিল পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর অংশ হিসেবে। এই কাঠামোতে থানায় মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হতে পারে। গ্রামের মাতব্বরের আদেশে কাউকে নৃশংস শাস্তি দেওয়া হতে পারে। চোর পিটিয়ে মেরে ফেলা হতে পারে। মোহাম্মদ আজম হুমায়ূনের এই বসন্তে উপন্যাসের কাহিনি বিচার করে বলেছেন, সমাজে শ্রেণিসম্পর্ক বা ক্রমবিন্যাসকে হুমায়ূন রাজনৈতিকভাবে না দেখে মনস্তাত্ত্বিকভাবে দেখেন। উচ্চশ্রেণির প্রতি তাঁর যে স্যাটায়ার, সেটা অনেকটা সেই উচ্চশ্রেণির অন্তর্গত মামুলিয়াত ও নিপীড়ক চরিত্রের কারণে। গ্রামের পরিসরে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর নাজুক, ধ্বজ ও হিংস্র রূপ যখন দেখিয়েছেন হুমায়ূন, সেখানে আদব সংস্কৃতি বা পিতৃতান্ত্রিক অচলায়তনের বিরুদ্ধে মৃদু সহিংসতা করার মূল নায়ক হয় কোনো পাগল বা প্রান্তিক ব্যক্তি। এই গ্রাম তাই পিতৃতান্ত্রিক অচলায়তনের এক মস্ত লীলাক্ষেত্র, যা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের আধুনিক শাসন-পরিসরের অপর-পিঠ। দুইটাই কলোনিয়াল ও সামন্তবাদী আদব সংস্কৃতি।
সামন্তবাদী ও কলোনিয়াল আদব সংস্কৃতির বিপরীত চিত্র আকারে তাঁর একটি প্রিয় মেছাল ছিল ‘আমেরিকানদের বিচিত্র কাণ্ডকারখানার গল্প’, যা তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা ‘হোটেল গ্রেভার ইন’ বা ‘মে ফ্লাওয়ার’ থেকে শুরু করে নানা উপন্যাসে ছড়িয়ে আছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ভূগোলে সীমাবদ্ধ ঘটনাবলি নয়, বরং বিশ শতকের দ্বিতীয় অংশজুড়ে মার্কিন সংস্কৃতির যে বিশ্বায়ন মুদ্রিত ও দৃশ্যমাধ্যমের দ্বারা দুনিয়াজুড়ে ঘটে গেছে, হুমায়ূন আহমেদ সেটাকে নিজের মতো কিছু শর্তসাপেক্ষে বরণ করেছেন। না করে উপায় ছিল না। মার্কিন সংস্কৃতিতে মুক্তকচ্ছ আচরণের আপাত অনুমোদনের চল, তার ফলে ব্যক্তির নানা বিচিত্র কাণ্ডকারখানা এবং একই সঙ্গে মেধাতন্ত্র, বৈজ্ঞানিক উন্নতি ও সামাজিক প্রাচুর্যের উপস্থিতি তাঁকে এবং এখানকার ভদ্রলোক সমাজকে আকর্ষণ করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষা এখান থেকে তিনি নিয়েছেন, তা হলো ব্যক্তি কীভাবে নিজের জীবনাচরণের নানা অভ্যাস বা হ্যাবিট নিজের মতো গড়ে তোলে। অভ্যাসের গঠন ও ভাঙন এখানে সাবেকি আদব-কায়দা বা সামাজিক আদর্শের অনুগামী নয়; বরং ব্যক্তিতান্ত্রিক আত্মকেন্দ্রিক বিকাশের অনুগামী।
এই ভাঙন-গড়নের নেতির দিকটা ধারণ করেছে হিমু, এক নিঃসঙ্গ বাঙালি মধ্যবিত্ত হিপ্পি। হিমু নির্লজ্জ ও অসংকোচ। তার ভেতর চেতনা বা রুহানিয়াতের দাহ নেই। মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, বি–উপনিবেশায়ন, উন্নয়ন, আমজনতার শিক্ষিতকরণ ধরনের কোনো তাগিদ নেই। পশ্চিমবঙ্গে চর্চিত ক্রাইসিসে ভোগা বেকার গরিব আদর্শবাদী খ্যাপাটে তরুণও সে নয়। এসব কিছু নিয়ে সে বিব্রতও নয়। হিমুকে অরাজনৈতিক বলাটা খাপসই নয়। বরং নতুন মধ্যবিত্তের যে অরাজনৈতিক রাজনীতি, হিমুরও ছিল তাই। মন্ত্রী-পুলিশ-র্যাব বা দুর্নীতিবাজ খালু-মামুর সঙ্গে নানাবিধ টানাপোড়েনের রগড়ই তার রাজনৈতিকতা। অরাজনৈতিক রাজনৈতিকতা হিমুসহ হুমায়ূনের নায়কদের শক্তির জায়গাও বটে—এই অর্থে যে তা রাজনৈতিকতার তত্ত্বীয় বুলি ও ছকের গণ্ডি মানে না, বরং সমাজে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা মানুষের নানা রকম প্রেক্ষিত ও পিছলা বাসনাকে অধিক গুরুত্ব দেয়। হুমায়ূন প্রগতির কোনো তাত্ত্বিক ছককে গুরুত্ব দেন না, বরং তা সমাজের ভেতর থেকেই ঘটে, আজমের মতে। ঘটনাগুলো ঘটে কাঠামোর শর্তে নয়, বরং পরিস্থিতির গর্ভ থেকে।
হিমু যেমন সমাজের নতুন পরিস্থিতির এক আলামত। হিমু আমজনগণের সামনে ভদ্রলোক তরুণ-তরুণীর দৃশ্যমানতার একটা নতুন এথিকের প্রতিনিধি। জনসমক্ষে খামখেয়ালি ও প্রগল্ভতা করেও কীভাবে নিজের শ্রেণিগোষ্ঠীগত অন্তর্লোককে হারিয়ে খোঁজা যায়, তাই হচ্ছে হিমু-এথিক। এটা ঢাকার সমাজে নতুন শ্রেণিগোষ্ঠী-সম্পর্কের আলামত। হুমায়ূন দু–এক ক্ষেত্রে ব্রাত্য রাইসুর সঙ্গে হিমুর মিল উল্লেখ করেছেন। হিমু অবশ্য রাইসুর প্রকৃত উপস্থাপন নয়। আজকের দিনে হুমায়ূনের সাহিত্য অনেকটা অপস্রিয়মাণ এবং হিমুও ক্রমেই অচল আধুলি। তবে তার পরের জমানার মধ্যবিত্ত বা মিক্লাকে অপ্রতিহতভাবে প্রভাবিত করেছেন রাইসু।
আবার একপতিপত্নীক পরিবারের বিকার ও অবক্ষয় হুমায়ূন দেখিয়েছেন পরিবারের কর্ত্রীর ভূমিকার ব্যবচ্ছেদে। পরিবারে সন্তান উৎপাদন-লালনপালন ও স্বামীর পৌরুষজনিত প্রিভিলেজপ্রাপ্ত যৌনসত্তাকে পারিবারিক গণ্ডিতে আটকে রাখার যে ক্লান্তিকর দায়িত্ব নিউক্লিয়ার পরিবারের মধ্যবিত্ত গৃহবধূদের ঘাড়ে অর্পিত, তার ফলে তাদের ভেতর যে ক্ষোভ ও বাষ্প জমত, সেটার নানা রকম অভিব্যক্তি হুমায়ূনের কাহিনিতে আছে। উপন্যাসের এই গৃহবধূরা হয়তো অন্য নারীকে ‘বেশ্যা’ বা ‘মাগি’ বলে গালি দেন—এটিও সেই ক্লান্তিকর পারিবারিক কর্ত্রীরূপী ভূমিকার মরিয়া অভিব্যক্তি। হিমু প্রায় অযৌন সত্তা। হুমায়ূনের নায়কেরা কেউই আগ্রাসী রিরংসা সচরাচর দেখান না। বরং যৌনতার যে নতুন অবমুক্তকরণ, সেটার কর্তৃত্ব হুমায়ূন দিয়েছেন নারীর হাতে। মধ্যবিত্ত গৃহের অন্যতম দায় ছিল অল্পবয়সী নারীদের পাত্রস্থ করার আগপর্যন্ত তাদের যৌনতাকে আড়াল-নিয়ন্ত্রণ-শাসন। হুমায়ূন অল্পবয়সী নারীদের সংযত লীলাময়তাকে জনপরিসরে সেলিব্রেট করার মাধ্যমে তার আড়াল ভাঙলেন। তরুণী নারী যে গাম্ভীর্যের আড়ালে নিজের যৌনসংরক্ষণশীলতা বা আব্রু-সম্ভ্রমের রক্ষাব্যূহ রচনা করার শিক্ষা লাভ করত, তাকে প্রেমিক যুবকের সঙ্গে নানা দুষ্টুমিমাখা আলাপচারিতার দ্বারা ব্যূহভেদ করে দেখিয়ে হুমায়ূন প্রমাণ করলেন যে আপাত গম্ভীর তরুণীরাও মূলত প্রেমমুখী। নীরব ও আড়ালময়কে সরব ও উন্মোচিত করে, গুরুগম্ভীর নিয়মকানুনের এই অর্থভেদের দ্বারা তরুণ-তরুণীদের মনকে গণ্ডিছাড়া করলেন তিনি ও নতুন গণ্ডিতে নিবদ্ধ করলেন। এর ফলে মধ্যবিত্ত সমাজে রোমান্টিক প্রেমের নতুন প্রকারের স্বাভাবিকীকরণ ঘটল। একদিকে শাসন-পরিসরগুলো শিথিল হচ্ছে, ঢাকার নাগরিক পরিসরের ভদ্রলোকির পুরাতন ধরনগুলো আলগা হয়ে আসছে, বিপুল নগর-গরিবের উপস্থিতি ঘটছে, ভোগের নানা পরিসরের পরিগঠন ঘটছে। এই সবের ভেতর তরুণ-তরুণীর প্রেমের নতুন সংকেত ও সওগাত প্রণয়ন করেছেন হুমায়ূন।
এই সবকিছুর দ্বারা পিতৃতান্ত্রিক পরিবার, যা আধুনিক মধ্যবিত্ত ব্যক্তির এথিক্যাল সাবস্ট্যান্সের কারখানা ছিল সেটাকে গলাতে হাত লাগালেন রসায়নবিদ হুমায়ূন। শাসনের বদলে মমতা, আব্রুর বদলে প্রেম, আর শিক্ষার বদলে আদর—অর্থাৎ পরিবার ও সমাজ, শৃঙ্খলাকেন্দ্রিক বান্দাগঠনী কারখানার বদলে অনুভূতিকেন্দ্রিক একটা পরিসর হয়ে উঠল। পরিবারের মূল কাজ হলো ব্যক্তির স্বার্থগত বাসনার যত্ন ও পালন।
নিজেদের নৈতিক পদার্থের অর্থভেদ হয়ে যাওয়ার পরে মধ্যবিত্ত লিবারালের জীবনের দৃঢ় আদর্শবাদ আর রইল না, বরং রইল লাগামছাড়া বিমূর্ত বহুত্ববাদী লিবারাল হওয়া, আর নইলে জবরদস্তি অথো-লিব টাইপের লিবারাল হওয়া—এই দুই পথ। আগের মতো দৃঢ় আদর্শবাদী হওয়ার গরজ ছিল না ভিক্টোরীয় ইন্টারফেসটা অপসৃত হয়ে যাওয়ায়। বিশ্বায়ন ও আখেরি পুঁজিবাদে বেসরকারি চাকরি, বিদেশ আসা-যাওয়া, আর সবশেষে ডিজিটাল প্রযুক্তির আগমনের ফলে নতুন ধরনের নানা পুলক, কল্পনা, বাসনা ও নিয়মে অভ্যস্ত হতে হলো নয়া জমানার মধ্যবিত্ত যুবক-যুবতীদের। পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ও নানা ভদ্রলোকি শাসন-পরিসরের শাসনশৃঙ্খলার নিয়ম ভেঙে পড়েছে, নিয়ন্ত্রণ ক্রম-শিথিল। এমনকি জাতির কর্তা রাষ্ট্রও সেখানে ক্রমেই মামুলি। ফলে এই তরুণেরা এক আবিশ্ব সম্প্রদায়ের অংশ হলো, যার ভুতুড়ে ও বিমূর্ত এথিক্যাল সাবস্ট্যান্সের থই মেলা ভার। ইউরোপ-অনুকারী আধুনিকতা বলে বান্দাগঠনের কোনো মূর্ত-নির্দিষ্ট আদর্শ বা নীতিপদার্থ এখন আর বিরাজ করে না। বরং উত্তরাধুনিক আত্মার চিন্তা-যাপন-অভ্যাস-কল্পনাকে নিত্য ভাঙচুরের দ্বারা আখেরি পুঁজির বাজার-বাস্তবতার উপযোগী হতে হয়।
এই আখেরি জমানার উত্তরাধুনিকতারই আভাস ধরা পড়েছে হুমায়ূনের সৃষ্টিশীল ধ্বংসাত্মকতায়। কিন্তু তাঁর সাহিত্যের সামাজিক কূটনীতির ভেতরে অন্তর্নিহিত স্ববিরোধ আছে। অর্থাৎ মধ্যবিত্তের বিকাশের যে সামাজিক কূটনীতি তাঁর সাহিত্যে পাওয়া যায়, সেই বিকাশ এক আগ্রাসী উত্ত্রাসী পর্যায়ে পৌঁছানোর পরে হুমায়ূন আর তাকে ধারণ করতে পারেননি। সত্তর আশি নব্বইয়ের যে নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান-বাসনার মৃদু রূপকার ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ, শূন্য দশক থেকে বাংলাদেশের সমাজে যেসব জটিলতা প্রবল হলো, সেটা আর তাঁর লেখায় একই গভীরতায় এল না। ফারুক ওয়াসিফের ভাষায়, ‘কেনাকাটার হাত খোলা, মেলামেশায় শরীরখোলা, যোগাযোগে অজড়িত থাকার এই নতুন পরিবেশে হুমায়ূনের আনিস, সাবেত, পরী, নীলারা এক পাশে সরে যায় তাদের কোমল ইনোসেন্সসহ।’ আখেরি পুঁজিবাদ বাংলাদেশের সমাজে যে প্রবৃদ্ধি ও ভোগের অন্তহীন প্রসারণ-বাসনা নিয়ে এল, মধ্যবিত্তসহ শ্রেণির জীবনে যে চরাচরপ্লাবী ভাঙচুর ঘটাল, তার লক্ষণগুলো হুমায়ূনের চোখ এড়ায়নি, তবে তাকে পরিবার, গ্রাম ও শহরের আখ্যানে একইভাবে আঁটাতে পারেননি তিনি। মাদ্রাসা মাধ্যমে যে বিপুল শিশুকিশোর শিক্ষিত হলো, তাদের জীবন, বান্দা হিসেবে তাদের বেড়ে ওঠা ও রাষ্ট্র ও আধুনিকতার সঙ্গে তাদের মীমাংসাকে হুমায়ূন একইভাবে আঁকেননি।
তবে হুমায়ূনের শূন্য দশকের নানা মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত মানুষের কল্পনা বা খেয়ালের জগৎ নম্র নিউরোসিস ছাপিয়ে কীভাবে বাস্তব ও অবাস্তবের ভেদরেখা মুছে অতল-নিরলম্ব সাইকোসিসে পৌঁছে যাচ্ছে, সেই তাৎপর্য উঠে এসেছে। ‘পুফি’ কিংবা ‘আমি এবং কয়েকটি প্রজাপতি’র মতো মামুলি নানা কাহিনির মূল গুরুত্ব এইখানে। সমাজ-জটিলতার মর্মমূলে না পৌঁছিয়ে তা অনেকটা বিচ্ছিন্ন আঁচড়ের মতো রয়ে গেল।
২০২৫ সালে এসে হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য এক অপস্রিয়মাণ মধ্যবিত্তের নম্র বাসনা ও সমাজবীক্ষার দস্তাবেজের মতো পাঠ করা যায়। এখনো সমাজে তাঁর নন্দনের বিপুল গ্রাহকতার শর্ত হাজির আছে। কিন্তু সমাজে শ্রেণি ও গোষ্ঠীর ওলটপালটে, বাসনার নানা নতুন সমীকরণে সামাজিক কল্পনার দিগন্তে হুমায়ূনীয় সামাজিক কূটনীতির প্রাধান্য আগের মতো আর নেই।