গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

চলচ্চিত্র

সাসপেন্সের কবি আলফ্রেড হিচকক

আমরা যেসব দিন পার করে এগোই, সেসব দিন সব সময় হারিয়ে যায় না। কিছু দিন আমরা হারিয়ে ফেলি বা আমরা হারাতে চাই বলে হারিয়ে যায়। সময়গুলো স্মৃতি হয়ে বিরাজ করে, ইতিহাস হয়ে জ্বলজ্বল করতে থাকে। মানুষ হিসেবে দিনের পর দিন আমাদের বর্তমানের মধ্যেও সেই অতীতকে তাই আমাদের বহন করতে হয়। আসলে যেই দিন আমাদের গেছে, তা একেবারে যায়নি। কিছু না কিছু রয়েই গেছে।

প্রতিনিয়ত কাজ করতে করতে মানুষ যেসব ধারা বা ডিসিপ্লিন দাঁড় করায়, সেসবও মুহূর্তের খেলা নয় কেবল। কালের ধারাবাহিকতায় সেসব ধারা আমাদের পর্যন্ত পৌঁছায়। তার ওপর ভিত্তি করেই নিজেদের সময়ে দাঁড়িয়ে সৃজনশীলতার মাধ্যমে আমরা বর্তমানকে নির্মাণ করে থাকি। যেমন ব্রিটিশ চলচ্চিত্র পরিচালক স্যার আলফ্রেড জোসেফ হিচকক। তিনি চলচ্চিত্র ইতিহাসের প্রথম দিকের নির্মাতা। আমাদের বর্তমান সময়ের চলচ্চিত্রে তিনি কীভাবে বিরাজ করেন? বোঝাই যায় যে কী প্রবলভাবে এখনো তাঁর কাজ আমাদের সময়ে প্রভাব রেখে যাচ্ছে। হিচকক শুধু আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতার সাদা–কালো বা কম রেজল্যুশনের সিনেমাগুলো না কিন্তু! তো বুঝতেই পারছেন, হিচকক আমাদের একজন সেই সব দিন, যেসব দিন সব সময় হারিয়ে যায় না।

হিচকককে ‘মাস্টার অব সাসপেন্স’ বলা হয়ে থাকে। তবে তাঁর সিনেমা কেবলই থ্রিল বা সাসপেন্স তৈরির হাতিয়ার ছিল না। তাঁর সিনেমায় দর্শক অন্য রকম এক মনস্তাত্ত্বিক যাত্রার মধ্যে ঢুকে পড়েন এবং সেই যাত্রার প্রধান সহযাত্রী আলফ্রেড হিচকক স্বয়ং।

আলফ্রেড হিচকক অত্যন্ত প্রভাবশালী ও স্মরণীয় একজন চলচ্চিত্র পরিচালক। ১৮৯৯ সালের ১৩ আগস্ট লন্ডনে তাঁর জন্ম। পরিচালক হিসেবে ৫০ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি ৫৩টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। প্রথম ২৩টি সিনেমা তিনি যুক্তরাজ্যে থেকে বানিয়েছেন, এরপর ১৯৩৯ সালে তিনি হলিউডে চলে যান। সেখানেই তিনি ৩০টি সিনেমা বানান এবং সর্বোচ্চ খ্যাতি অর্জন করেন।

আলফ্রেড হিচকককে ‘মাস্টার অব সাসপেন্স’ বলা হয়ে থাকে। তবে মোটাদাগে এই এক বাক্যে হিচকককে ধরে ফেলা একটু মুশকিলের ব্যাপার। তাঁর সিনেমা কেবলই থ্রিল বা সাসপেন্স তৈরির হাতিয়ার ছিল না। সচেতনভাবে লক্ষ করলে টের পাওয়া যায় যে তাঁর সিনেমায় দর্শক অন্য রকম এক মনস্তাত্ত্বিক যাত্রার মধ্যে ঢুকে পড়েন এবং সেই যাত্রার প্রধান সহযাত্রী আলফ্রেড হিচকক স্বয়ং। নিশ্চয়ই একটা দৃশ্য আপনাদের মনে পড়বে, ‘নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট’–এ (১৯৫৯) একদম শুরুর দিকেই, টাইটেল সিকোয়েন্সে একটা লোক হন্তদন্ত হয়ে বাস ধরতে ছুটে যাচ্ছিলেন। মনে পড়ে, তাঁর মুখের ওপরই বাসের দরজা বন্ধ হয়ে যায়? এই ব্যর্থ বাসযাত্রীটিই আসলে হিচকক, যিনি আমাদের সঙ্গে রয়ে গেলেন তাঁর কাহিনি বলার জন্য; তাঁর সিনেমার দর্শক হিসেবে আমাদের নিজেদের ভয়, অনিশ্চয়তা ও নিয়ন্ত্রণহীনতার অনুভূতির মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্য।

ব্যর্থ বাসযাত্রী হিচককের সেই দৃশ্য

হিচককের নির্মিত প্রায় সব চলচ্চিত্রেই হঠাৎ কোনো এক দৃশ্যে তাঁকে দেখা যায়। ‘দ্য থার্টি নাইন স্টেপস’–এ (১৯৩৫) বাসের সামনে দিয়ে সিগারেট খেতে খেতে হেঁটে যাচ্ছেন, ‘শ্যাডো অব আ ডাউট’–এ (১৯৪৩) ট্রেনে বসে তাস খেলছেন, ‘রেয়ার উইন্ডো’তে (১৯৫৪) মিউজিশিয়ান পিয়ানো বাজাচ্ছেন আর তাঁর পেছনে হিচকক ঘড়ি ঠিক করছেন, ‘সাইকো’তে (১৯৬০) মারিয়নের অফিসের বাইরে টুপি পরে হিচকক দাঁড়িয়ে আছেন, ‘দ্য বার্ডস’–এ (১৯৬৩) দোকান থেকে কুকুর নিয়ে বের হচ্ছেন। এ রকম মজার মজার অনেক উপস্থিতি। এটা তাঁর একরকম ট্রেডমার্ক হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি নিজেও ব্যাপারটা উপভোগ করতেন। বলেছিলেন যে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ক্যামিও রাখেন গল্পের একবারে শুরুতে, যেন দর্শক মাঝপথে এসে তাঁকে খুঁজতে গিয়ে মনোযোগ নষ্ট না করেন! এ জন্যই বললাম যে দর্শকের অনিশ্চয়তার এই যাত্রায় নির্মাতা হিসেবে হিচকক তো আছেনই, তিনি সহযাত্রী হয়েও থেকে গেছেন।

গত শতাব্দীর শুরুর দিকে যখন চলচ্চিত্র মাধ্যমটি একটু একটু করে গড়ে উঠছিল, তখন সেই ভাষায় হিচককের গল্প বলা নিঃসন্দেহে দৃশ্যমান ভাষাকেই সুগঠিত করে তুলছিল। সেই ভাষায় একধরনের নীরব বিপদ, সুপ্ত আতঙ্কের আবহ রেখে তিনি যেভাবে কাহিনি বর্ণনা করেছেন, সেই কাহিনি তৈরি হতো শুধু দৃশ্য দিয়েই নয়, সময়ের টানটান বিন্যাস, ক্যামেরার নড়াচড়া ও সংলাপের মাঝের মৌনতা দিয়েও। এখানে একটি মজার বিষয় উল্লেখ করা যায়। সেটি হচ্ছে, সিনেমায় চরিত্রদের যেসব সংলাপ হয়, তা দিয়ে তো দৃশ্যতই কাহিনি অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু যেহেতু তিনি চৌকস নির্মাতা, তাই নীরবে তাঁর গহিন সংলাপ বা বোঝাপড়া গড়ে ওঠে দর্শকের সঙ্গে। সেটা অনেকটা এ রকম—যদি এমন হয় যে টেবিলের নিচে বোমা রাখা আছে আর টেবিলের সামনের চরিত্র সেটি সম্পর্কে অবগত নয়, এ অবস্থায় দর্শক যদি অবগত থাকেন এই ভয়ানক বস্তুটির বিষয়ে, তাহলে দর্শক নিজে সেই চরিত্রের জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। এভাবেই হিচকক কাহিনি বলতেন এবং টেনশন তৈরি করতেন। কেবলই দৃশ্য নির্মাণ করেননি তিনি, উদ্‌গত করতে চেয়েছেন দর্শকের ভেতর প্রতিধ্বনিত হওয়া একান্ত অভিজ্ঞতাও।

হিচককের গল্প ভাষায় একধরনের নীরব বিপদ, সুপ্ত আতঙ্কের আবহ রেখে তিনি যেভাবে কাহিনি বর্ণনা করেছেন, সেই কাহিনি তৈরি হতো শুধু দৃশ্য দিয়েই নয়, সময়ের টানটান বিন্যাস, ক্যামেরার নড়াচড়া ও সংলাপের মাঝের মৌনতা দিয়েও।

আলফ্রেড হিচককের কাজের কৌশল ও ধরন শুধু যে তাঁর সমকালীন নির্মাতাদের মধ্যেই প্রভাব বিস্তার করেছে, তা নয়; বরং তাঁর পরবর্তী সময়ের চলচ্চিত্র নির্মাতাদেরও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তাঁর ভিজ্যুয়ালের নিখুঁত শৈলী, স্পেস ও টাইম নিয়ে সচেতন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং আধুনিক শিল্পধারায় তাঁর অবদান এমন এক নান্দনিক ধারা তৈরি করেছে, যা বর্তমান সময়ের চলচ্চিত্রের জন্যও প্রেরণার উৎস। বিশেষত ‘ভার্টিগো’ (১৯৫৮) চলচ্চিত্রটি আধুনিক চলচ্চিত্র নির্মাণ ও চর্চায় একটি কাল্ট-টেক্সটে পরিণত হয়েছে। খুব সহজভাবে দেখলেও টের পাওয়া যায় যে ডেভিড লিঞ্চের চলচ্চিত্র ‘লস্ট হাইওয়ে’ (১৯৯৭), ‘মালহল্যান্ড ড্রাইভ’ (২০০১) ও ‘ইনল্যান্ড এম্পায়ার’–এ (২০০৬) হিচককের প্রবণতা রয়েছে। ডেভিড লিঞ্চ নিজেও ‘ভার্টিগো’কে (১৯৫৮) তাঁর প্রিয় চলচ্চিত্র হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ব্রায়ান ডি পালমার নির্মাণেও যদি আমরা লক্ষ করি, ‘সিস্টার্স’ (১৯৭৩), ‘অবসেশন’ (১৯৭৬), ‘ড্রেসড টু কিল’ (১৯৮০), ‘বডি ডাবল’ (১৯৮৪), ‘ব্লো আউট’ (১৯৮৫) ইত্যাদি চলচ্চিত্রে আলফ্রেড হিচককের স্পেস, ভিজ্যুয়াল সাসপেন্স, পরিচয়ের দ্বৈততা ও মনস্তাত্ত্বিক বিভ্রমের প্রভাব প্রতিফলিত হয়।

হিচককের চলচ্চিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আজও চলচ্চিত্র নির্মাতারা নৈতিকভাবে অস্বচ্ছ ও অস্পষ্ট চরিত্র নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল, সাবজেক্টিভ পয়েন্ট অব ভিউ শট এবং ভিজ্যুয়াল মোটিফ সমসাময়িক থ্রিলার ও সাইকোলজিক্যাল ড্রামায় এখনো শক্তিশালী রেফারেন্স হিসেবে কাজ করে। হিচককের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘রেয়ার উইন্ডো’ (১৯৫৪), ‘নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট’ (১৯৫৯), ‘সাইকো’ (১৯৬০), ‘দ্য বার্ডস’ (১৯৬৩) তাঁর অনুসারী ও ভক্ত–নির্মাতাদের জন্য টেক্সট হিসেবেই বিবেচিত হয়। যেখান থেকে তাঁরা ন্যারেটিভ স্টাইল, স্ট্রাকচার, চরিত্র নির্মাণ ও সাসপেন্স তৈরির কৌশল গ্রহণ করেন।

‘ভার্টিগো’ নির্মাণকালে ক্যামেরার পেছনে হিচকক

এবার খানিকটা অন্য দৃষ্টিকোণ থেকেও আমরা দেখতে পারি। হিচকক তো দর্শককে উদ্বিগ্ন করে তোলেন। দার্শনিকভাবে উদ্বিগ্নতা নিয়ে ভাবলে তাঁর চলচ্চিত্রগুলোতে খুব পরিণত ভঙ্গি দেখতে পাওয়া যায়। মার্টিন হাইডেগার ‘বিয়িং অ্যান্ড টাইম’-এ বলেছেন, উদ্বিগ্নতা মানুষকে শূন্যতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। অর্থাৎ উদ্বিগ্ন মানুষ এক অচেনা, শূন্য, সব অর্থ ভেঙে যাওয়া এক স্পেসে গিয়ে দাঁড়ায়। হিচকক প্রায়ই তাঁর চরিত্রকে এমন পরিস্থিতিতে রাখেন, যেখানে শুধু বাহ্যিক ঘটনাই নয়, অন্তর্দৃষ্টিগত অস্তিত্বের সংকটও দর্শকের সামনে উন্মোচিত হয়। যেমন ‘ভার্টিগো’তে (১৯৫৮) স্কটির যে উচ্চতার ভয়, তা তো শুধু শারীরিক ভয় নয়। তার মধ্যে পরিচয়, প্রেম, জীবনের মানে ইত্যাদি নিয়ে এক অদ্ভুত শূন্যতার অভিজ্ঞতাও তৈরি হয়।

হিচককের চলচ্চিত্রের চরিত্ররা প্রায় সময়ই অনিচ্ছা সত্ত্বেও এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায়, যেখানে তাদের স্বাধীনতা সীমিত কিন্তু বাস্তবিক দায় অনেক বেশি। ‘দ্য রংম্যান’–এ (১৯৫৬) নির্দোষ নায়ককে যখন অপরাধী ভেবে ধরা হয়, তখন কিন্তু তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। স্বাধীন সত্তা হিসেবে ভাবতে হয় যে সে লড়াই করবে, নাকি পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ করবে। জ্য পল সার্ত্রে ‘বিয়িং অ্যান্ড নাথিংনেস’-এ বলেছিলেন, ‘আমরা স্বাধীনতার জন্য দণ্ডিত।’ এ স্বাধীনতাই আমাদের প্রতিটি সিদ্ধান্তের পূর্ণ দায় গ্রহণ করতে বাধ্য করে। এখানেই উদ্বিগ্নতার উৎস।

ফলে হিচককের এই যে সাসপেন্স, এর থেকে উৎসারিত যে উদ্বিগ্নতা, তা ভয়ের অনুভূতি ছাড়াও অস্তিত্বের অনিশ্চয়তা, নৈতিক অস্পষ্টতা, নিয়ন্ত্রণহীনতা ও মানবিক সীমাবদ্ধতার প্রতিও ইঙ্গিত করে। সেখান থেকে মানুষের অবস্থার জটিলতা নিয়ে গভীর ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হয়।

এই সব দিন, আলফ্রেড হিচকক যে নিরলসভাবে কাজ করে গেলেন, তা কি কেবল পুরোনো দিনের ঘটনা হিসেবেই বিবেচিত হওয়ার মতো? নিশ্চয়ই না। বরং তাঁর চলচ্চিত্রগুলো আমাদের যেন এই কথা মনে করিয়ে দেয় যে বর্তমানকে নির্মাণ করার জন্য এবং সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য আমাদের সাংস্কৃতিক স্মৃতি খুবই জরুরি। যেই দিন যায়, তার সবই মুছে যায় না।

আলফ্রেড হিচকক সর্বশেষ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন ‘ফ্যামিলি প্লট’ (১৯৭৬)। বরেণ্য এই নির্মাতা ১৯৮০ সালের ২৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসে তাঁর নিজ বাসায় মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি ‘দ্য শর্ট নাইট’ নামে একটি স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করছিলেন। তাঁর অসুস্থতায় ছবিটির নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায়। ১২৬তম জন্মদিনে চলচ্চিত্র ইতিহাসের শক্তিমান নির্মাতা আলফ্রেড হিচককের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।