সত্য কি সত্য নয়? ‘ইজ নট দ্য ট্রুথ ট্রুথ?’ শেক্সপিয়ারের চতুর্থ হেনরি নাটকের প্রথম অংশের দ্বিতীয় অঙ্কের চতুর্থ দৃশ্যে এক সরাইখানায় দুই বন্ধুর একজন ফলস্টাফ মিথ্যাকে ঢাকতে এই বাক্চাতুর্যময় ভাষিক ব্যঙ্গটি করেছেন। এটি মিথ্যার পক্ষে এক ভাঁওতাবাজি যুক্তি। কিন্তু আমরা এর জবাবে বলতে পারি, সত্য সত্য নয় সব সময়। তা নির্ভর করে অবস্থা ও পরিপ্রেক্ষিতের ওপর। সত্যকে বলা যায় এমন কিছু, যা বাস্তবের নির্দিষ্ট কিছু বিষয়কে সঠিকভাবে উপস্থাপন করে। সত্যের ধারণার মূল বিষয় হলো—একটি সর্বজনীন বাস্তব বিদ্যমান। তবে এটা মানতেই হবে যে সত্য আর বাস্তব এক নয়। কারণ, সত্য একটি দিককে দৃষ্ট করে, বাস্তবতার সব দিককে প্রকাশ করতে পারে না। বাস্তবতার রয়েছে অনেক দৃষ্টিকোণ, অনেক রূপরূপান্তর। ফলে বাস্তবতার সবচেয়ে সত্য বর্ণনাও বাস্তবতাকে ধরতে পারে না। বাস্তবের অনেক পরিপ্রেক্ষিতও উপস্থাপনে হারিয়ে যায় বা অধরা থাকে। ফলে সত্য বাস্তবের সরাসরি (ওয়ান-টু-ওয়ান) উপস্থাপন নয়; সত্য হলো এমন কিছু, যা বাস্তবের নির্ধারিত কিছু দিকের প্রতি আমাদের দৃষ্টিকে নতুনভাবে নিবদ্ধ করে।
উপন্যাসের সঙ্গে সত্যের সম্পর্ক কী? উপন্যাসের দায় প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত বাস্তবের কাছে, নিরেট সত্যের কাছে নয়। প্রকাশিত বাস্তব কখনো কখনো অপ্রকাশিত ও অধরা, আবার অপ্রকাশিত বাস্তব তো অদৃশ্য ও রহস্যাবৃতই। সুতরাং উপন্যাসের বাস্তবই উপন্যাসের সত্য: বাস্তবের সত্য। বাস্তবতার মধ্যে বস্তুনিষ্ঠ স্তর থাকে, যা বস্তুনিষ্ঠ সত্যের দ্বারা গঠিত। এটি মানুষের বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল নয়। সত্য আর বাস্তবতা তাই ভিন্ন জিনিস, কারণ একটি বিবরণ যত সত্যনিষ্ঠই হোক না কেন, তা কখনোই বাস্তবতার সব দিককে উপস্থাপন করতে পারে না। তাই সত্য মানে সম্পূর্ণ বাস্তব নয়; বরং তার কিছু দিকের প্রতিষ্ঠিত বয়ান। আর ‘সত্য’ মিথ্যা হয়ে যেতে পারে, কিন্তু ‘বাস্তব’ মিথ্যা হয় না, শুধু রূপের পরিবর্তন ঘটে। সুতরাং সত্য বলতে এমন ব্যাখ্যাকে বোঝায়, যা বাস্তবতার বিশেষ কোনো দিককে দৃশ্যমান করে তোলে।
সত্য কি সত্য নয়? শেক্সপিয়ারের চতুর্থ হেনরি নাটকের প্রথম অংশের দ্বিতীয় অঙ্কের চতুর্থ দৃশ্যে এক সরাইখানায় দুই বন্ধুর একজন ফলস্টাফ মিথ্যাকে ঢাকতে এই বাক্চাতুর্যময় ভাষিক ব্যঙ্গটি করেছেন। এটি মিথ্যার পক্ষে এক ভাঁওতাবাজি যুক্তি। কিন্তু আমরা এর জবাবে বলতে পারি, সত্য সত্য নয় সব সময়।
আমরা যখন বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করতে যাই, তখন আমাদের বিবরণে বাস্তবতার সবটুকু ধরা দেয় না। আবার যতটুকুই ধরা দেয়, তা-ও পরিবর্তিত বাস্তবতা। সে অর্থে বিবরণ সত্যকে ধরতে পারলেও বাস্তবতাকে শতভাগ ধরতে পারে না, কারণ বাস্তবতা একটি বৃহতের ছায়ামাত্র, যাকে অনুসরণ করে তার অবয়বকে ধরা এক অর্থে অসম্ভব। তাই বাস্তব পরিবর্তনশীল আর তা অনেক সত্যকে প্রতিবিম্বিত করে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘লেখকের কথা’য় বলেছেন, যেহেতু কোনো পরম সত্য বলে কিছু নেই, তাই এই সব চিহ্ন আমাদেরকে ভ্রমে ফেলে। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা এসব চিহ্নকে ভাঙতে পারি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা বাস্তবের দেখা পাব না।
উপন্যাসে এভাবেই বাস্তবতার স্তরান্তরিত স্বরূপ নির্ধারিত হয়, যা লেখকের ব্যক্তিসত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে। এ জন্যই উপন্যাস আয়না নয়, বরং দৃষ্টিকোণ, যা দিয়ে জীবন ও সমাজকে বা বাস্তবতার সমগ্রকে বহুমাত্রিকতায় প্রতিফলিত করা হয়। এ ক্ষেত্রে সময় ও স্থান প্রধান ভূমিকা পালন করে, কারণ সময় বাস্তবতাকে পরিবর্তিত করে সমাজ, মানুষ ও তার চিন্তনের পরিবর্তন ঘটায়।
বাস্তবতা বহুস্তরী একটি প্রপঞ্চ, তা এমন সত্যের ওপর নির্ভরশীল, যা মানুষের গতিশীল বিশ্বাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। উপন্যাসের সত্য কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি নয়, অভিজ্ঞতার সত্য, জটিলতার সত্য, দ্বন্দ্বের অভ্যন্তরীণ সত্য। উপন্যাসে যে কল্পনা আসে, তা বাস্তবকে শক্তিশালী করার জন্যই আসে, তার থেকে রক্ষা পাওয়ার বা তাকে উপেক্ষার জন্য নয়। ‘আশ্চর্য’ গভীরভাবে বাস্তবের মধ্যে প্রোথিত, আর এই কারণেই এটি পরাবাস্তবকে ব্যবহার করতে পারে রূপক ও চিত্রকল্প নির্মাণে, যা বাস্তবকে এমনভাবে উপস্থাপন করে, যেন তা বাস্তবতার চেয়েও অধিক বাস্তব হয়, সত্যের চেয়ে অধিক সত্যনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। বাস্তব হলো একটি ধারণা আবার অবাস্তবও ধারণা। কোনো কিছুকে বিশ্বাস না করলে বলা হয় সেটি মিথ্যা বা অবাস্তব। এই যে অবস্থাটি, তার মধ্যকার সীমারেখাটি স্পষ্ট নয়। কিন্তু পাশাপাশি পরাবাস্তবও বাস্তবেরই অংশ; পরাবাস্তবতা হলো জগতের আশ্চর্যকে দৃশ্যমান ও প্রকাশিত করে তোলা।
আবার যাকে বলা হয় হাইপারবোল, তা–ও মিথ্যা নয়। এটি বাস্তবকে দৃঢ়তর করার একটি কৌশলমাত্র বা বাস্তবের বহুস্তরীয় গভীরতাকে উন্মোচনের উপাদানমাত্র। হাইপারবোল এক অতিশয়োক্তি, যা জোর দেওয়া বা প্রভাব বিস্তার করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটা শুধু লেখাতেই নয়, আমাদের বাস্তব জীবনেও ব্যবহৃত হয়, যেমন ‘হাজারবার বলেছি যে এটা করো’, এখানে ‘হাজারবার’ আক্ষরিক অর্থে সত্য নয়, শুধু জোর দেওয়া অর্থে সত্য। কিন্তু হাইপারবোল রূপক নয়। রূপকের উদ্দেশ্য গভীর অর্থকে প্রতিভাসিত করা। কিন্তু হাইপারবোলের কাজ হলো আবেগকে তীব্র করা বা প্রভাব সৃষ্টি করা। মার্কেসের শত বছরের নিঃসঙ্গতা-য় এমন অতিরঞ্জন চোখে পড়ে। ম্যাজিক রিয়ালিজম নামের জনপ্রিয় ঘরানায় যে জাদু শব্দটি রয়েছে, তা আসলে বাস্তবকে অপ্রত্যাশিত ও অনুপমভাবে উপস্থাপনের একটি কৌশলমাত্র। শত বছরের নিঃসঙ্গতা-র একটি বর্ণনা:
‘যখনই হোর্সে আর্কাদিয়ো ঘরের দরজা বন্ধ করল, বন্দুকের গুলির শব্দ পুরো ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল। রক্তের একটি ধারা চৌকাঠের নিচ দিয়ে গড়িয়ে আসে, বসার ঘর পেরিয়ে রাস্তায় গিয়ে নামে, একদম সোজা রেখা ধরে হাঁটে—মেঝে, সিঁড়ি, ফুটপাত পেরিয়ে মোড় নেয় ডান দিকে, আবার বাঁ দিকে, ব্যুয়েন্দিয়া বাড়িতে ঢুকে পড়ে, ড্রয়িংরুম অতিক্রম করে রান্নাঘরে এসে পড়ে, যেখানে উরসুলা ছত্রিশটা ডিম ভাঙতে যাচ্ছিল ব্রেড বানানোর জন্য।
“হে ঈশ্বরী মাতা”, চিৎকার করে উঠল উরসুলা।’
এখানে মনে হবে কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। মৃত মানুষের রক্ত ভ্রমণ করছে ঘর থেকে রাস্তায়, তারপর ঘরে। এই অবস্থাটি আপাতভাবে অসম্ভব মনে হলেও পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য। কারণ, এই রক্ত ছেলের মৃত্যুসংবাদ মায়ের কাছে পৌঁছানোর একটি রূপক। বাস্তব এখানে আরও বেশি গভীরতা পায়। তা ছাড়া ব্রেড বানানোর জন্য ছত্রিশটা ডিম!
উপন্যাস হলো একটি সত্যনিষ্ঠ মানবাভিজ্ঞতার প্রতিবেদন আর লেখককে তা এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে, যাতে পাঠক তাকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। এই ফরমাল রিয়ালিজম একটি বর্ণনাভিত্তিক বাস্তববাদ, তা কোনো সাহিত্যিক মতবাদ নয়। একটি ঘটনার নিখুঁত বর্ণনাই সাহিত্য নয়।
উপন্যাসের একটি প্রাথমিক দায়িত্ব হলো ফরমাল রিয়ালিজম বা আনুষ্ঠানিক বাস্তববাদকে ধরা। এটি হলো লেখার এমন একটি কৌশল, যা বাস্তবকে নিয়ে একটি সত্যিকারের জীবনকে উপস্থাপন করে, যেখানে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, সময়ের ধারাবাহিকতা, দৈনন্দিন বাস্তবতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার মাধ্যমে জীবনের বাস্তব চিত্রকে উপস্থাপন করা হয়। অর্থাৎ উপন্যাস হলো একটি সত্যনিষ্ঠ মানবাভিজ্ঞতার প্রতিবেদন আর লেখককে তা এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে, যাতে পাঠক তাকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। এই ফরমাল রিয়ালিজম একটি বর্ণনাভিত্তিক বাস্তববাদ, তা কোনো সাহিত্যিক মতবাদ নয়, তবে প্রমাণের নিয়মের মতো একটি সাহিত্যিক রীতি, যার মাধ্যমে মানবজীবনের ছবি উপস্থাপিত হয়। এটি অন্য সাহিত্যিক মাধ্যমে দেখা যায় না, কিন্তু উপন্যাসে পুনঃ পুন আসে। এটি উপন্যাসকে স্বাতন্ত্র্য দেয়, ভিন্ন করে অন্য সাহিত্য-মাধ্যম থেকে। চরিত্রের পৃথকত্ব, তার স্থানকালের বিবরণ চরিত্রের উপস্থিতির মাধ্যমে উপস্থাপিত হয় বলে তা অনেকটা রেফারেন্সমুখী ও বাস্তবতানির্দেশী। কিন্তু এ ধারণাটি লেখকের ওপর একধরনের নৈতিক দায় সৃষ্টি করে এভাবে যে লেখককে পাঠকদের বোঝাতে হবে ঘটনাটি সত্যি। কিন্তু বাস্তব জীবনের হুবহু প্রতিলিপিই সাহিত্য নয়, সাধারণ সত্য হলেই সাহিত্য হয় না। একটি ঘটনার নিখুঁত বর্ণনাই সাহিত্য নয়, তার জন্য দরকার ভাষার শিল্প, যা কল্পনাশক্তির হাত ধরে এক ভিন্ন ও গভীর বাস্তবতার জন্ম দেবে।
আমাদের মনে রাখা দরকার, উপন্যাস তার স্থানকালের পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবতার সঙ্গে জড়িত। উপন্যাস বাস্তবতাকে কালিক ও স্থানিক পরিবেশে স্থাপন করে। কিন্তু ফরমাল রিয়ালিজম মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে তার নিজস্ব স্থানকালের মধ্য দিয়ে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করে। আর পাঠকও চরিত্রের অভিজ্ঞতা তাৎক্ষণিক উপলব্ধি করে, যাকে বলা হয় ‘ইমিডিয়েট ইমিটেশন’ বা তাৎক্ষণিক অনুকরণ। এর মাধ্যমে পাঠক গল্পের কেন্দ্র ছেড়ে তার সময় ও স্থানের অভিজ্ঞতায় ঢুকে পড়ে। সুতরাং আমরা বলতে পারি, উপন্যাস বাস্তব জীবনের নিখুঁত প্রতিবেদন দেওয়ার ভান করে, এটাই ফরমাল রিয়ালিজমের প্রধান কৌশল। কিন্তু এটা করতে গিয়ে অনেকে শুধু স্থূল বাস্তবতাকেই নকল করে। প্রকৃতপক্ষে বাস্তবতার অনুকরণ শুধু অবিকল হলে চলবে না, এটাকে হতে হবে স্থানকালের পরিপ্রেক্ষিতে একধরনের প্রতিসরিত বাস্তবতা, যেখানে নতুন বাস্তবতার রূপটি উন্মোচিত হয়। জয়েস ও জোলা তাঁদের রচিত উপন্যাসে এমনটা দেখিয়েছেন। ফরমাল রিয়ালিজমের বিপরীতে আমরা দেখতে পাই ডেসক্রিপটিক বা বর্ণনাত্মক রিয়ালিজম ও প্রেসক্রিপটিক বা নির্দেশাত্মক রিয়ালিজমকে। বর্ণনামূলক রিয়ালিজমে বাস্তবতা যেমন আছে, ঠিক তেমনভাবেই তাকে তুলে আনা হয়, কিন্তু প্রেসক্রিপটিক বা নির্দেশিত রিয়ালিজমে বাস্তবতাকে শুধু দেখানো হয় না, ব্যাখ্যা ও বর্ণনাও করা হয়। তাই এটি আদর্শনির্ভর। আবার আধুনিকবাদে বাস্তবতা একটি অনিশ্চিত ব্যক্তিভিত্তিক ও মনস্তাত্ত্বিক নির্মাণ। ভাষাই বাস্তবতার নির্মাণকারী। আধুনিকবাদে বাস্তবতার প্রধান নির্ধারক হলো চেতনা, যা সময় ও স্মৃতির ভেতর দিয়ে শোধিত হয়ে আসে। মার্সেল প্রুস্তের উপন্যাসে আমরা এ ধরনের বৈশিষ্ট্য পাই। জয়েসের লেখায় নিরবচ্ছিন্ন চেতনাপ্রবাহকে দেখা যায়, যা সৃষ্টি করছে আধুনিক বাস্তবকে। আবার কাফকার লেখায় বাস্তবতা হলো অযৌক্তিক ও অস্তিত্বসংকটে পতিত এক অলীক জগৎ।
উত্তরাধুনিকতায় বাস্তবতা এক নির্মাণ, কোনো একক সত্য বলে কিছু নেই। ভাষা নিজেই বাস্তবতার নির্মাণকারী। সোজা কথায়, আধুনিকবাদে যেখানে বাস্তবতার ভেতরে গভীর অর্থকে অন্বেষণ করা হয়, সেখানে উত্তরাধুনিকতাবাদ খোদ বাস্তবতার অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।