
আজ ১২ ডিসেম্বর, মাওলানা ভাসানীর ১৪৫তম জন্মদিন
৮ মার্চ, ১৯৭৫। ২টা ৫৫ মিনিট। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলের কাগমারী গিয়ে পৌঁছালেন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রথমে তিনি গেলেন মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ প্রাঙ্গণে। পুলিশ বাহিনী তাঁকে গার্ড অব অনার জানাল। গার্ড অব অনারের শেষ মুহূর্তে সেখানে এসে উপস্থিত হলেন জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মাওলানা সাহেবকে দেখেই বঙ্গবন্ধু অভিবাদন মঞ্চ থেকে দ্রুত নেমে এলেন। ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। দুজনের মুখে অনুপম হাসির দীপ্তি। এই দৃশ্য ধারণ করতে সংবাদপত্রের আলোকচিত্রীরা দৌড়ে এলেন। কেউ কেউ এই দৃশ্য ধরতে পারলেন। তবে বেশির ভাগই পারলেন না। একজন বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করলেন, ভাসানীকে আবার জড়িয়ে ধরতে। বঙ্গবন্ধু এবার শিশুর মতো নবতিপর মাওলানার বুকে মাথা রাখলেন। মাওলানা সাহেবও পরম স্নেহে বঙ্গবন্ধুর মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে প্রাণভরে দোয়া করতে লাগলেন। মাওলানার চোখে আনন্দের অশ্রু। এ যেন দীর্ঘকাল অদর্শনের পর পিতা-পুত্রের এক হৃদয়স্পর্শী মিলনদৃশ্য। আলোকচিত্রীরা এই দুর্লভ ও মনোহর মুহূর্তকে ক্যামেরায় ধারণ করে চলছেন। মাওলানার বুকে মাথা রেখে বঙ্গবন্ধু এবার আলোকচিত্রীদের বললেন, ‘তোমরা জানো না, আমি তো হুজুরের বুকেরই মানুষ।’ মাওলানাও বললেন, ‘মজিবুর আমার কত প্রিয়, তোমরা তা জানো না।’
মাওলানা সাহেবকে দেখেই বঙ্গবন্ধু অভিবাদন মঞ্চ থেকে দ্রুত নেমে এলেন। ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। দুজনের মুখে অনুপম হাসির দীপ্তি। এই দৃশ্য ধারণ করতে সংবাদপত্রের আলোকচিত্রীরা দৌড়ে এলেন। কেউ কেউ এই দৃশ্য ধরতে পারলেন। তবে বেশির ভাগই পারলেন না।
এরপর মাওলানা সাহেবকে জড়িয়ে বঙ্গবন্ধু কাগমারী মোহাম্মদ আলী কলেজের শ্বেতপ্রস্তর নির্মিত উদ্বোধনী ফলকের আবরণ উন্মোচনের জন্য অগ্রসর হন। দুজনে একত্রে এই আবরণ উন্মোচন করেন। এই পর্ব শেষ করে এই দুই জননেতা রাষ্ট্রপতির গাড়িতে করে গেলেন সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভাসানী ঘুরে ঘুরে রাষ্ট্রপতিকে দেখান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ। ছায়াঘেরা ক্যাম্পাসের চারদিকে লাল শিমুলের সমারোহ। দুজন পাশাপাশি হাঁটছেন। কথা বলছেন কখনো সহাস্যে; কখনো একান্তে। বঙ্গবন্ধু হঠাৎ ভাসানীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শহীদ সাহেব যে একটা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন, সেটা কোথায়?’ ভাসানী তাঁকে নিয়ে গেলেন সন্তোষ মাতৃসদন ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রের সামনে। বঙ্গবন্ধুকে দেখান একটা নবনির্মিত দোতলা দালান। নিচে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ফলক। তাতে লেখা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নাম। মাওলানা ভাসানীকে বঙ্গবন্ধু অনুরোধ করলেন, ‘পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী’ কথাটি তুলে দিতে।
বঙ্গবন্ধু যখন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘুরে দেখছিলেন, তখন তাঁর সফরসঙ্গীদের কেউ কেউ মাওলানা সাহেবকে বললেন, ‘হুজুর, অনেকের নামেই তো অনেক কিছু করেছেন; আপনার মুজিবের নামে তো কিছু করলেন না।’ এর উত্তর দিলেন বঙ্গবন্ধু নিজেই। বললেন, ‘নামে আবার কী দেখো? সবই তো আমাকে দিয়েছেন। তোমরা জানো না, হুজুর আসলে মনে মনে আমাকে সব উইল করে দিয়ে দিয়েছেন।’ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নার্সারি ও প্রাইমারি সেকশনের ছেলেমেয়েরা বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানিয়ে তাঁর গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে তা খুলে পরিয়ে দেন ভাসানীর গলায়। বললেন, ‘হুজুর, এটা আপনার।’
মাওলানা ভাসানী সেদিন বহু লোকের খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন। খিচুড়ি ঢেলে রাখা হয়েছে দুটি নৌকায়। বঙ্গবন্ধুকে তিনি নিয়ে গেলেন সেখানে। বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘লোকজন সবাই খেয়েছে তো?’ সফরসঙ্গীদের বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘পুরোনো সেই দিনগুলোর কথা আমার খুব মনে পড়ছে।’ এরপর বঙ্গবন্ধু মাওলানা ভাসানীর বাড়িতে গেলেন তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে। বেগম ভাসানীর কাছে যেতেই তিনি বঙ্গবন্ধুর গায়ে-পিঠে আদরের হাত বুলিয়ে দিলেন। বঙ্গবন্ধু মাওলানা সাহেবের নাতি-নাতনিদের কোলে তুলে নিয়ে আদর করলেন। এ সময় মাওলানা সাহেব ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সবাইকে দই বিতরণ করছিলেন। আর বঙ্গবন্ধু এমনভাবে এঘরে–ওঘরে ঘুরছিলেন, যেন তিনি এ ঘরেরই ছেলে।
পরের দিন ৯ মার্চ বিভিন্ন পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে এই দুই নেতার উষ্ণ আলিঙ্গনের ছবিটি ছাপা হয়। এই ঐতিহাসিক ঘটনার অজানা কিছু তথ্য জানা যায় ১৯৯৭ সালের ১৬ অক্টোবর পাক্ষিক অনন্যায় প্রকাশিত ‘অনন্য রশীদ তালুকদার’ শিরোনোমের একটি বিশেষ রচনায়।
ওই দিন এই ঐতিহাসিক ঘটনার ছবি তুলেছিলেন দৈনিক পত্রিকার ৮-১০ জন আলোকচিত্রী। পরের দিন ৯ মার্চ দৈনিক সংবাদ, দৈনিক বাংলা, ইত্তেফাক ও বাংলার বাণীর প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে এই দুই নেতার উষ্ণ আলিঙ্গনের ছবিটি ছাপা হয়। এই ঐতিহাসিক ঘটনার অজানা কিছু তথ্য জানা যায় ১৯৯৭ সালের ১৬ অক্টোবর পাক্ষিক অনন্যায় প্রকাশিত ‘অনন্য রশীদ তালুকদার’ শিরোনোমের একটি বিশেষ রচনায়। পত্রিকাটির ৬৭ নম্বর পৃষ্ঠায় ছাপা হয় এ ঘটনা সম্পর্কে রশীদ তালুকদারের বয়ান। বঙ্গবন্ধুর সন্তোষে সফর উপলক্ষে ফটোসাংবাদিকেরা আগেই মাওলানা ভাসানীর বাড়িতে গিয়ে হাজির হন। ফটোসাংবাদিকদের দেখে মাওলানা সাহেব বললেন, ‘কইরে, আমার মজিবর কই?’ ফটোসাংবাদিকেরা বললেন, ‘হুজুর, এই এসে পড়লেন বলে।’ ভাসানী বললেন, বেশ, তাহলে তোরা তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। মজিবর আসলে তো তোরা ছবি তোলায় লেগে যাবি, খাওয়া জুটবে না।’
এই রচনায় রশীদ তালুকদার একটি মজার গল্পও তুলে ধরেন। অনুষ্ঠান শেষে মাওলানা ভাসানীর বাড়িতে গেলেন বঙ্গবন্ধু। দুজন একটা ঘরে ঢুকে চৌকির ওপর বসে আলাপ করতে লাগলেন। সংবাদচিত্রীরা ইচ্ছেমতো ছবি তুলতে শুরু করলেন। একসময় সংবাদচিত্রীরা দেখলেন, চৌকির নিচে অনেকগুলো দইয়ের হাঁড়ি। তাঁরা পিআইডির মোহাম্মদ আলমকে ঢুকিয়ে দিলেন সেই চৌকির নিচে। আলম একটা একটা করে দইয়ের হাঁড়ি বের করে দিতে লাগলেন ফটোসাংবাদিকদের দিকে। ফটোসাংবাদিকেরা হাতে হাতে হাঁড়িগুলো বাইরে পাঠাতে লাগলেন। হঠাৎ একবার বঙ্গবন্ধুর পায়ের সঙ্গে দইয়ের হাঁড়ি ধাক্কা লাগে। বঙ্গবন্ধু তাকিয়ে দেখেন একটা দইয়ের হাঁড়ি বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা তাঁর বুঝতে দেরি হলো না। তিনি নিজেই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘দে আমার কাছে দে।’ বঙ্গবন্ধু নিচু হয়ে এক হাত দিয়ে হাঁড়ি বাড়িয়ে দিতে লাগলেন ফটোসাংবাদিকদের দিকে। বঙ্গবন্ধু নিচু হয়ে আছেন দেখে মাওলানা সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী মজিবর, তুমি ও রকম করে আছো কেন, তোমার কি পা চুলকাচ্ছে?’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘জি হুজুর।’
মজিবর, বাবার পাশে থাইকো। মা মারা যাওয়ার সময় তুমি কাছে থাকতে পারো নাই; মায়ের মুখে পানি দিতে পারো নাই। যাও, বাবার কাছে থাকো, দরকার হইলে সব প্রোগ্রাম ক্যানসেল কইরা ফেলো। এটা আমার নির্দেশ।বঙ্গবন্ধুকে মাওলানা ভাসানী
সেদিন বঙ্গবন্ধু ও মাওলানা ভাসানী একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেন। বঙ্গবন্ধুর খাবার প্লেটে নিজ হাতে মাছ ও মাংস তুলে দেন মাওলানা ভাসানী—এমন তথ্য জানা যায় প্রথমা থেকে প্রকাশিত সৈয়দ আবুল মকসুদ রচিত ‘ভাসানী চরিত’ [মওলানা ভাসানীর পূর্ণাঙ্গ জীবনী] বইয়ের ৩১৭ নম্বর পৃষ্ঠায়। বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমান অসুস্থ। তিনি আছেন খুলনায় ছোট ছেলে শেখ আবু নাসেরের বাসায়। বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে করে যাবেন বাবাকে দেখতে।
দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক বাংলার রিপোর্টে বলা হয়, বেলা পড়ে গেছে। অসুস্থ বাবাকে দেখতে খুলনার উদ্দেশে হেলিকপ্টারে উঠলেন বঙ্গবন্ধু। মাওলানা মাঠে দাঁড়িয়ে আছেন। ভেতরে গিয়ে ৩০ সেকেন্ড পর আবার কী মনে করে যেন তিনি হেলিকপ্টারের দোরগোড়ায় ফিরে এলেন। ভাসানীকে বললেন, ‘হুজুর, আমি এবার আসি। দোয়া করবেন।’ ভাসানী বললেন, ‘যাও বাবা, দোয়া রইল। তোমার বাবার জন্যও দোয়া করি।’ মায়াজড়ানো কণ্ঠে বললেন, ‘মজিবর, বাবার পাশে থাইকো। মা মারা যাওয়ার সময় তুমি কাছে থাকতে পারো নাই; মায়ের মুখে পানি দিতে পারো নাই। যাও, বাবার কাছে থাকো, দরকার হইলে সব প্রোগ্রাম ক্যানসেল কইরা ফেলো। এটা আমার নির্দেশ।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আচ্ছা হুজুর, এবার আসি।’
বঙ্গবন্ধু শূন্যে ভাসলেন। হেলিকপ্টার চলে গেল দৃষ্টির আড়ালে। মাওলানা ভাসানী তবু তাকিয়ে রইলেন ছায়া নেমে আসা আকাশের দিকে।