গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

সংস্কৃতি

সংগীত ও নৃত্য নিয়ে মুসলিম দার্শনিকদের ভাবনা

জালালউদ্দিন রুমি একদিন বাজার দিয়ে হাঁটছিলেন। হঠাৎ তাঁর কানে এল স্বর্ণকারের হাতুড়ি দিয়ে স্বর্ণ পেটানোর শব্দ। হাতুড়ির প্রতিটি আঘাত ছিল এক নিখুঁত ছন্দের মতো। রুমি শুনতে শুনতে গভীর ধ্যানে চলে যান। ধ্যানের মধ্যে আনন্দ ও প্রেমে আপ্লুত হয়ে বাজারেই ঘূর্ণন শুরু করেন। চারপাশের মানুষ অবাক হয়ে একজন মহান আলেম ও ফকিহকে বাজারের মাঝখানে নাচতে দেখছিলেন। আন্নেমারি শিমেলের ‘দ্য ট্রায়ামফল সান: আ স্টাডি অব ওয়ার্কস অব জালালুদ্দিন রুমি’সহ বেশ কয়েকটি বইয়ে ঘটনাটির উল্লেখ পাওয়া যায়। এ ঘটনাটিকেই সুফিরা রুমির সামা বা মেভলেভি ঘূর্ণন নৃত্যের সূচনা বলে মনে করেন।

আরেক দিনের ঘটনা। রুমি তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে বসা। হঠাৎ এক ব্যক্তি বাঁশি বাজাতে শুরু করল। রুমির চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। তিনি ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করলেন। হারিয়ে গেলেন সুরের ভেতর। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল তাঁর মুখ বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে। এই গভীর অভিজ্ঞতার পরই তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘মসনভি-ই-মানাভি’ গ্রন্থের শুরুতে লিখলেন, ‘বাঁশির আর্তি শোনো, কেমন করে সে বিচ্ছেদের কাহিনি বলে।’

এখানে বাঁশি কেবল বাদ্যযন্ত্র নয়, বরং আত্মার প্রতীক—যে তার আদি উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্যাকুল। রুমির কাছে এই সুর ছিল আদি উৎস তথা ঈশ্বরের দিকে ফিরে যাওয়ার ডাক।

এ ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় শামস আল-দীন আহমদ আফলাকির ‘মানাকিব আল-আরিফিন’ গ্রন্থে। আন্নেমারি শিমেল তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘দ্য ট্রায়ামফল সান’-এ এই প্রতীকটিকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে রুমির কাছে সংগীত ছিল আত্মার গভীরতম আকাঙ্ক্ষার ভাষা।

গোটা দুনিয়ার সুফিরা মনে করেন, নৃত্য ও সংগীত হৃদয়কে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে আনে। সংগীত ও নৃত্যের উৎপত্তি মানুষের প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি থেকে। শব্দ, ছন্দ, তাল—এগুলো ভাষার আগেই মানুষ ব্যবহার করত। প্রাচীন সভ্যতা মিসর, মেসোপটেমিয়া, গ্রিসে সামাজিক ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনের অংশ হিসেবে সংগীত ও নৃত্যকে গ্রহণ করা হয়।

সংগীত ও বাদ্যযন্ত্র কতটা শক্তিশালী, তা রুমির মসনভির আরেকটা কবিতার উদ্ধৃতি দিলে পরিষ্কার হওয়া যাবে। মসনভিতে রুমি বলছেন:

আমরা এমন এক স্থানে এসে পড়েছি, যেখানে সবকিছুই সংগীত।
বাঁশির সুর ও তার বাদ-বাঁশির স্পর্শ আকাশে উঠে যায়,
যদি পুরো বিশ্ব জ্বালিয়ে দেওয়া হয়,
তবুও লুকানো বাদ্যযন্ত্র বাজতে থাকবে।
বাঁশি কয়েকবার ভাঙা হলেও,
তার মধ্যে লুকানো গল্প পুনরায় বলে চলে।

(মসনভি-ই-মানাভি)

সুফি নৃত্য ১

রুমির এই কবিতা যে সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রের আধ্যাত্মিক ও প্রাকৃতিক গুরুত্বকে প্রকাশ করে, তা আর ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন নেই। শুধু রুমি কেন, গোটা দুনিয়ার সুফিরা মনে করেন, নৃত্য ও সংগীত হৃদয়কে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে আনে।

সংগীত ও নৃত্যের উৎপত্তি মানুষের প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি থেকে। শব্দ, ছন্দ, তাল—এগুলো ভাষার আগেই মানুষ ব্যবহার করত। প্রাচীন সভ্যতা মিসর, মেসোপটেমিয়া, গ্রিসে সামাজিক ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনের অংশ হিসেবে সংগীত ও নৃত্যকে গ্রহণ করা হয়।

ঢোল, বাঁশি, তারবাদ্য মূলত প্রকৃতির শব্দ অনুকরণ করেই হয়েছে। এই শব্দগুলো প্রকৃতি থেকে আলাদা কিছু নয়, বরং এগুলোকে বলা যায় প্রকৃতির নির্বাচিত ধ্বনিচিত্র। সংগীত ও নৃত্য শুধু বিনোদন নয়, মানুষকে প্রকৃতি, সমাজ ও আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সংযুক্ত করেছে।

ইসলাম আগমনের আগে আরব সমাজে সংগীত মূলত উৎসব, রাজকীয় দরবার ও আধ্যাত্মিক আচারে ব্যবহৃত হতো। মুসলিম দার্শনিক ইবনে সিনা সংগীতকে কেবল বিনোদন হিসেবে দেখেননি; তিনি এটিকে মানুষের শরীর ও আত্মার ওপর গভীর প্রভাব বিস্তারকারী এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁর দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল-কানুন ফিততিব্ব’ এবং ‘কিতাব আল-শিফা’য় সংগীতের ভূমিকা নিয়ে স্পষ্ট আলোচনা পাওয়া যায়।

ইবনে সিনা সংগীতকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে, সঠিক সুর ও ছন্দ রোগীর বেদনা কমাতে পারে, মানসিক চাপ হ্রাস করতে সাহায্য করে এবং মনকে প্রশান্ত করে। এমনকি ইবনে সিনা বলেন, কিছু রোগীর ক্ষেত্রে কবিতা পাঠ বা সংগীত শোনা তাদের যন্ত্রণা ও দুঃখ দূর করতে কার্যকর হতে পারে।

‘আল-কানুন ফিততিব্ব’ গ্রন্থে তিনি সংগীতকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে, সঠিক সুর ও ছন্দ রোগীর বেদনা কমাতে পারে, মানসিক চাপ হ্রাস করতে সাহায্য করে এবং মনকে প্রশান্ত করে। এমনকি ইবনে সিনা বলেন, কিছু রোগীর ক্ষেত্রে কবিতা পাঠ বা সংগীত শোনা তাদের যন্ত্রণা ও দুঃখ দূর করতে কার্যকর হতে পারে। এ বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, তিনি সংগীতকে মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার একটি সহায়ক উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

অন্যদিকে ‘কিতাব আল-শিফা’ গ্রন্থে ইবনে সিনা সংগীতকে দর্শন ও গণিতের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। তাঁর মতে, সংগীত আসলে আত্মার সুর ও ভারসাম্য বজায় রাখার এক বিশেষ বিজ্ঞান। যেমন গণিতের মাধ্যমে সংখ্যা ও অনুপাতের ভারসাম্য বোঝা যায়, তেমনি সংগীতের সুর ও তাল আত্মার অভ্যন্তরীণ অস্থিরতাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং শান্তি ফিরিয়ে আনে।

ইমাম আল-গাজ্জালি তাঁর ‘এহইয়ায়ে উলুমুদ্দিন’ গ্রন্থে বলেন, ‘মানুষের হৃদয় এমনভাবে সৃষ্টি যে এতে যেন একটি লুকানো আগুন রয়েছে—সংগীত ও সুর-সামঞ্জস্য দ্বারা তা প্রজ্বলিত হয় এবং মানুষকে অনুতপ্ত-উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে দেয়।’

তিনি যুক্তি দেখান, সংগীত ও নৃত্য হৃদয়ের পূর্ববর্তী অনুভূতিকে উদ্দীপিত করে। আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হলে প্রশংসনীয়। জাগতিক বাসনা বা অশ্লীল উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হলে নিন্দনীয়।

আল-গাজ্জালি সংগীতকে শর্তসাপেক্ষে বৈধ ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর ‘এহইয়ায়ে উলুমুদ্দিন’ গ্রন্থে বলেছেন, যদি গান ও সংগীত মানুষকে পাপের দিকে না ঠেলে এবং নৈতিক ক্ষতি না করে, তবে তা বৈধ।

আল ফারাবি সংগীতকে দার্শনিকভাবে বিশ্লেষণ করেছেন এবং বলেছেন সংগীত মানুষের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তিনি তাঁর ‘কিতাব আল-মুসিকা আল-কাবির’–এ বলেন, সঠিক সুর মানুষকে শান্তি, একাগ্রতা এবং আধ্যাত্মিক তৃপ্তি দেয়।

দর্শনের আরেকজন পথিকৃৎ ইবনে খালদুন সংগীতকে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সূচক হিসেবে দেখেছেন। সভ্যতার উত্থান-অবনমনের সঙ্গে সংগীত-নৃত্যের চর্চা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।

সুফি নৃত্য ২

ইবনে খালদুন তাঁর গ্রন্থ ‘আল-মুকাদ্দিমা’য় সংগীতকে কেবল বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে দেখেননি। তাঁর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সংগীত একটি সভ্যতার ‘স্বাস্থ্য পরীক্ষা’ হিসেবে কাজ করে। যখন কোনো সমাজ প্রাথমিক বা দরিদ্র অবস্থায় থাকে, তখন আনন্দ ও বিনোদনের জন্য সংগীতের চর্চা সীমিত থাকে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ অবসর ও বিনোদনের জন্য সংগীতের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে সংগীত ও গানচর্চা একটি সভ্যতার সমৃদ্ধি এবং সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের সূচক হয়ে ওঠে।

তিনি সংগীতের অনুশীলনের ওপর শর্ত আরোপ করেন, যা শ্রোতার উদ্দেশ্য, পরিবেশ ও মনোভাবের সঙ্গে সম্পর্কিত। সঠিক ‘নিয়ত’ ও সুস্থ পরিবেশে সংগীত মানুষের আবেগ, আনন্দ এবং আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণাকে বৃদ্ধি করতে পারে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সংগীত একটি নৈতিক ও শিক্ষামূলক চর্চা হিসেবে দেখা যায়।

ইবনে খালদুন তাঁর গ্রন্থ ‘আল-মুকাদ্দিমা’য় সংগীতকে কেবল বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে দেখেননি। তাঁর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সংগীত একটি সভ্যতার ‘স্বাস্থ্য পরীক্ষা’ হিসেবে কাজ করে। যখন কোনো সমাজ প্রাথমিক বা দরিদ্র অবস্থায় থাকে, তখন আনন্দ ও বিনোদনের জন্য সংগীতের চর্চা সীমিত থাকে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ অবসর ও বিনোদনের জন্য সংগীতের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ইবনে খালদুনের বিশ্লেষণ বর্তমান যুগেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আধুনিক বিশ্বে সংগীত ও বিনোদন প্রায়ই অতিরঞ্জিত, বাণিজ্যিক ও সামাজিক প্রভাবমুক্ত নয়। তাঁর ধারণা অনুযায়ী, সংগীতের প্রভাব তখনই সত্যিই ইতিবাচক হয়, যখন এটি সঠিক উদ্দেশ্য ও নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়। এভাবে সংগীত মানুষকে বিভ্রান্তির বদলে সংস্কৃতি, আনন্দ এবং নৈতিকতার দিকে নিয়ে আসে।

উপরোক্ত দৃষ্টিভঙ্গি মাওলানা রুমি এবং গাজ্জালির চিন্তাধারার সঙ্গে মিলে যায়। যেমন রুমি মনে করতেন, সংগীত হৃদয়ের গভীর অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলতে পারে এবং আধ্যাত্মিক প্রশান্তি ও আল্লাহর প্রেমে নিমজ্জিত করতে পারে। গাজ্জালিও সংজ্ঞায়িত করেছিলেন যে সংগীতের প্রভাব শ্রোতার হৃদয়ের অবস্থার ওপর নির্ভরশীল এবং এটি সৎ হৃদয়ের জন্য প্রশংসনীয়, কিন্তু অনৈতিক প্রবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত হলে বিপজ্জনক।

ইবনে খালদুনের এই সমৃদ্ধ বিশ্লেষণ দেখায় যে সংগীতের যথাযথ ব্যবহার মানুষকে আনন্দ, সমন্বয় ও আধ্যাত্মিকতার পথে পরিচালিত করতে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম সমাজের শিক্ষাব্যবস্থা, আধ্যাত্মিক চর্চা এবং সাংস্কৃতিক উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত করে এক ভারসাম্যপূর্ণ, প্রগতিশীল মনোভাব গড়ে তোলে।

সুফি ধারার আলেমগণ মেভলেভি দরবেশদের রোবিক বা ঘূর্ণায়মান নৃত্যকে বৈধ এবং ইবাদতের অংশ মনে করেন। রুমির কাছে নৃত্য ছিল আধ্যাত্মিক ভ্রমণ, যেখানে শরীরের প্রতিটি ঘূর্ণন আত্মাকে ঈশ্বরের দিকে নিয়ে যায়। তিনি বিশ্বাস করতেন, নৃত্য কেবল বাহ্যিক আনন্দ নয়, বরং ভেতরের পরিশুদ্ধি ও স্রষ্টার সঙ্গে মিলনের এক গভীর অভিজ্ঞতা। তাঁর কবিতায় নৃত্যের এই আধ্যাত্মিক তাৎপর্য স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে:

যখন আমরা নাচি,
আমাদের আত্মা সূর্যের চারপাশে ঘোরে,
আমাদের দেহ কেবল সেই গোপন আনন্দের বাহন।

(মসনভি-ই-মানাভি)

রুমির মতে, নৃত্য মানুষের অহংকে বিলীন করে দেয় এবং হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করে। তিনি বলেন, এই নৃত্য মহাবিশ্বের ছন্দের সঙ্গে মানুষের মিলনের প্রতীক:

ঘোরো, যেমন গ্রহ ঘুরে,
ঘোরো, যেমন প্রেমিক তার প্রিয়কে ঘিরে ঘোরে,
প্রতিটি ঘূর্ণনেই তুমি কাছে যাও,
সেই এক সত্যের, যে তোমার হৃদয়ে লুকানো।

(মসনভি-ই-মানাভি)

প্রখ্যাত সৌদি নৃতাত্ত্বিক তালাল আসাদ ধর্ম ও সংস্কৃতিকে আলাদা সত্তা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আসাদ মনে করেন, ধর্ম শুধু ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা নয়; এটি একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া, যা নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পটভূমিতে গঠিত।

এভাবে রুমি নৃত্যকে দেখেছেন একধরনের প্রার্থনা হিসেবে, যেখানে শরীর, মন ও আত্মা একত্রে স্রষ্টার দিকে ধাবিত হয়। তার জন্য নৃত্য ছিল আধ্যাত্মিক সমর্পণের ভাষা—একটি চলমান জিকির।

এই উপমহাদেশে ইসলামের অন্যতম প্রচারক খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি এবং তাঁর শিষ্যরা সংগীত ও নৃত্যকে আধ্যাত্মিক চর্চার অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা মনে করতেন, কাওয়ালি গান হৃদয়কে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে আনে।

চিশতিয়া তরিকার সুফি কবি ও সংগীতজ্ঞ আমির খসরু কাওয়ালি গান এবং ভারতে সুফি সংগীত প্রথা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। খসরুর কাব্য ও সংগীত আধ্যাত্মিক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তিনি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ও রাগ প্রবর্তন করে ভারতীয় সংগীতের ধারা সমৃদ্ধ করেছেন, বিশেষ করে ভক্তিমূলক ও আধ্যাত্মিক গানচর্চায়।

প্রখ্যাত সৌদি নৃতাত্ত্বিক তালাল আসাদ ধর্ম ও সংস্কৃতিকে আলাদা সত্তা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ দ্য আইডিয়া অব অ্যান অ্যানথ্রোপলজি অব ইসলাম এবং জিনিয়ালজিস অব রিলিজিয়ন-এ বিস্তারিতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। আসাদ মনে করেন, ধর্ম শুধু ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা নয়; এটি একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া, যা নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পটভূমিতে গঠিত। ধর্মের ধারণা পশ্চিমা আধুনিকতা দ্বারা নির্মিত, যেখানে ধর্মকে একটি স্বতন্ত্র ও নির্দিষ্ট ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অন্যদিকে সংস্কৃতি হলো মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, সামাজিক সম্পর্ক ও ঐতিহ্যের সমষ্টি, যা সময় ও স্থান অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়।

সংগীত ও নৃত্য নিয়ে মুসলিম দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গি শেষ পর্যন্ত এক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে এসে দাঁড়ায়। ওপরের বক্তব্যের ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি রুমি এটিকে দেখেছেন ঈশ্বরের সঙ্গে মিলনের এক সেতু হিসেবে। ইবনে সিনার কাছে সংগীত আত্মা ও শরীরের ভারসাম্য রক্ষার এক বিজ্ঞান। আল-গাজ্জালি শর্ত সাপেক্ষে এটিকে বৈধ বলেছেন। আল ফারাবি সংগীতকে আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও মানসিক শুদ্ধির এক মাধ্যম হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। ইবনে খালদুন সংগীতকে সভ্যতার সমৃদ্ধির সূচক হিসেবে দেখেছেন। সংগীত নৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হলে তা আধ্যাত্মিক উন্নয়ন ও সামাজিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে।