অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

নজরুলের লোকায়ত নন্দনতত্ত্ব

পশ্চিমি নন্দনের ছাঁচে উপেক্ষিত নজরুল

নন্দনের পাশ্চাত্য ছাঁচে নজরুলকে কখনোই আঁটানো যায়নি। লোক-ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মধ্যে যে সেতু তিনি রচনা করেছিলেন তা উপেক্ষিতই থেকে গেছে। এ লেখা সেই উপেক্ষার কাহিনি নিয়ে।

ভারতের মালয়ালম কবি ও সমালোচক কে সচ্চিদানন্দন জীবনানন্দ দাশ ও নজরুল সম্পর্কে তুলনা করতে গিয়ে আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে বলেছিলেন, ‘জীবনানন্দ দাশ ও নজরুল ইসলাম; ভারতীয় কবিতার দুটি ধারার প্রতিনিধি: একজন সূক্ষ্ম, পরিবর্তনকারী, স্নায়ুপীড়িত, নিম্নকণ্ঠ, অন্তর্মুখী, নিঃসঙ্গ, একান্ত; অপরজন উচ্চকণ্ঠ, দায়বদ্ধ, বিদ্রোহী, বহির্মুখী, সমবায়িক, প্রকাশ্য। নান্দনিক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা ও কাব্যভাষাকে আধুনিকীকরণের স্তরে নিয়ে যাওয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছেন প্রথমজন। দ্বিতীয়জন প্রতিনিধিত্ব করেছেন বিষয়কেন্দ্রিক ও আঙ্গিকগত গণতান্ত্রিকতার স্তরে আধুনিকীকরণের। এই দুই ধারা, ভারতীয় কবিতার ইতিহাসে, চিরকাল সহাবস্থান করে এসেছে এবং তারা পরস্পরবিরোধী নয়; তারা বরঞ্চ পরস্পরের পরিপূরক এবং আমাদের সামাজিক বিবর্তনের প্রধান মুহূর্তগুলিতে তারা পরস্পরের ওপর ক্রিয়াশীল ছিল এবং একে অন্যকে প্রভাবিত করার ফলে আমাদের কবিতা একই সঙ্গে সামাজিকভাবে গতিশীল ও নান্দনিকভাবে অভিনব হয়ে উঠেছে—যেমনটি ঘটেছে সংগম কাব্যে, ভক্তি কাব্যে, স্বাধীনতা আন্দোলনের কবিতায় এবং এ কালের ভারতীয় কবিতার নতুন কয়েকটি পথিকৃৎ আন্দোলনের ক্ষেত্রে।’ (জন্মশতবর্ষে জীবনানন্দ, সম্পাদনা: ভূমেন্দ্র গুহ, সাহিত্য অকাদেমি, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১৩, পৃ. ১)

লক্ষ করার বিষয় হলো যে জীবনানন্দ দাশকে আজ আমরা বাংলা ভাষার ক্যাননিকাল বা মাননির্দেশক কবি হিসেবে বরণ করে নিয়েছি, সচ্চিদানন্দন তাঁরই সঙ্গে নজরুলের তুলনা করে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন, যা যেকোনো ভাষার প্রধান লেখকের জন্যই আবশ্যকীয়। কিন্তু আমাদের সাহিত্যের প্রধান সমালোচকেরা প্রায়ই এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে উপেক্ষা করেছেন গৌণ কবিদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে। তাঁরা পশ্চিমের উনিশ ও বিশ শতকি নন্দনতাত্ত্বিক ধারণার খণ্ডিত ও একরৈখিক প্রবণতাকে একমাত্র মানদণ্ড ধরে নিয়ে নজরুলকে নীরবতা ও উপেক্ষার কবরে জীবন্ত সমাহিত করে রেখেছেন। তিরিশের কবিদের নন্দনতাত্ত্বিক বিশ্বাসের কাঠামোয় নজরুলের জন্য যেটুকু জায়গা বরাদ্দ ছিল, তা ‘মূঢ়তা প্রমাদ ও কার্পণ্যের’ পঙ্কিলতায় দুষ্ট। তাঁদের সংকীর্ণ মানদণ্ডে আধুনিকতা মানে ‘আত্মসন্ধান, আত্মপরীক্ষা; দুঃখ, রোগ, মত্ততা; ইন্দ্রিয়সমূহের অতীন্দ্রিয় বিনিময়’ (অনুবাদ কাব্যসমগ্র, বুদ্ধদেব বসু, পৃ. ১৮১)। তারা এ–ও মনে করেছিলেন, ‘কবিতাকে এবার স্বগতোক্তি হতে হবে—সামাজিক আলাপ আর নয়—’ কিংবা ‘জগৎটাকে বদলানো যে কবির কাজ নয়’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮১)—সন্দেহ নেই যে এসবই আধুনিক কবিতার ভিন্ন এক রুচির ‘নির্মাণ আর সৃষ্টি’র জন্য অবশ্যই গ্রাহ্য করার মতো, কিন্তু এর বিপরীতে সচ্চিদানন্দ-কথিত ‘উচ্চকণ্ঠ, দায়বদ্ধ, বিদ্রোহী, বহির্মুখী, সমবায়িক, প্রকাশ্য’ তাদের কাছে কাব্যমূল্যে গৌণ হয়ে গিয়েছিল। অথচ তিরিশেরই প্রধান পাণ্ডব জীবনানন্দ কবিতার ক্ষেত্রে বহুত্বের ধারণা নিয়ে যখন বললেন: ‘কবিতা অনেক রকম’, আমরা সেই বৈচিত্র্যের ধারণাকে এক পাশে সরিয়ে রেখে আমাদের আস্থাকে ন্যস্ত করেছি ‘বিষাদ, বিতৃষ্ণা ও নির্বেদ, কামোন্মাদ ও কামদ্রোহ, ইন্দ্রিয়বিলাস ও শয়তানপন্থা, দরিদ্র ও পতিতের জীবন, মৃত্যু ও দূরপ্রয়াণ।’ ( প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯০-১৯১)—এ যেমনটা বুদ্ধদেব বসু বোদলেয়ারের বৈশিষ্ট্য হিসেবে তালিকাবদ্ধ করে দিলেন। বুদ্ধদেব যা বোদলেয়ারের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলেছিলেন, আমরা সেটাকেই এক সামগ্রিক এবং একমাত্র সূত্র হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলাম। তিরিশের সবাই যে এই পথে ক্রম মুক্তি খুঁজেছিলেন, তা নয়, তবে তাঁদের আত্মাকে আধুনিকতার এই স্টিক্স-নদে ভিজিয়ে নিয়েছিলেন কবিতাকে অমরত্ব দানের আশায়। এর ফলে তিরিশের কাব্যদর্শনের নন্দন (তত্ত্বের) কানন ভরে উঠেছিল পশ্চিমের বোদলেয়ার, মালার্মে, রিলকে, হোল্ডারলিন, এলিয়ট, পাউন্ডের মতো পশ্চিমি দেবতাদের উপস্থিতিতে। বাংলা কাব্যে কয়েক শ বছরের ধারাবাহিকতায় স্থানীয় ঐতিহ্যের যে জনমুখী ও জনগ্রাহ্য ধারাটি ছিল, তা ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে গৌণ, অপাঙ্‌ক্তেয় এবং ফলত বিলুপ্ত হতে শুরু করল। অর্থাৎ আমাদের কাব্যাদর্শে পশ্চিমি ভাবনার পরিগ্রহণের ফলে শিল্পের দেশজ প্রকরণ ও কলাকানুনকে সেকেলে বলে মনে করা হলো। মধুসূদন যদি হয়ে থাকেন সেই দেশজ প্রকরণের ধারাবাহিক জড়তা ও পৌনঃপুনিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, তাহলে তাঁর হাত ধরেই আমাদের মনোজগতে পশ্চিমি কাব্যোপনিবেশের মুক্তিদায়ী ভূমিকার সূচনা ঘটেছে এবং তিরিশের হাতে ঘটেছে তার নিরঙ্কুশ প্রতিষ্ঠা। নজরুলের আবির্ভাব যদিও বিশের দশকে, কিন্তু তিরিশের হাতে ওই কাব্যোপনিবেশের পরিপূর্ণ বিকাশের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলমুক্তির তিনিই হয়ে উঠলেন আমাদের প্রথম বিদ্রোহী, যিনি দেশজ ঐতিহ্যকে সৃষ্টিশীল পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে প্রায় এককভাবে সর্বব্যাপী করে তুলেছিলেন। সচ্চিদানন্দের ভাষায় তিনি একে ‘বিষয়কেন্দ্রিক ও আঙ্গিকগত গণতান্ত্রিকতার স্তরে আধুনিকীকরণের’ পথ খুলে দিয়েছিলেন। নজরুলের এই দুঃসাহসী অবদানের কথা আমরা খুব একটা উচ্চারিত হতে শুনি না। কিন্তু লোকায়ত নান্দনিক ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার নিয়ে উদ্বেগের কথা আমরা শুনেছি কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে দেবেশ রায়ের কণ্ঠে, অন্যদিকে কবিতার ক্ষেত্রে শঙ্খ ঘোষের ভাবনায়। দেবেশ রায় ওই দেশজ সাহিত্যিক প্রকরণের বিলুপ্তির প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক অভিমত তুলে ধরেছিলেন এভাবে: ‘কিন্তু যদি আমরা ঐ ইংরেজ-আরোপিত আধুনিকতাকে অখণ্ডক না ভাবি, যদি ধরে নিই ঐ আধুনিকতা আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসের ধারাবাহিকতাকে ধ্বস্ত করেছে আর তার ফলে বিশেষত উনিশ শতকের প্রথম পঞ্চাশ-ষাট বছরে আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে কতকগুলি অনুত্তীর্ণ গভীর খাদ তৈরি হয়ে গেছে, তাহলে সেই নানা ধরনের পরিণতিহীন আরম্ভের ভিতর আমরা হয়তো আমাদের সৃষ্টিশীলতার ভিন্ন এক অসম্পূর্ণতা নতুন করে চিনে নিতে পারব।’ (উপন্যাস নিয়ে, দেবেশ রায়, পৃ. ৭)

পশ্চিমি নন্দনতত্ত্বে নাড়া বাঁধা আমাদের তিরিশের কবিদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু ও জীবনানন্দ দাশ কর্তৃক নজরুল যে অংশত গ্রাহ্য ও শংসিত হয়েছিলেন, সেটা এই দেশজ ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধারে নজরুলের অবদানের জন্য নয়, বরং নজরুলের কবিতায় ও গানে পশ্চিমি কাব্যকলার অনুকরণে ও অনুসরণে যেটুকু তাঁরা দেখতে পেয়েছেন, সেটুকুর জন্য।

এই অসম্পূর্ণতার একটা উদাহরণ আমরা এই প্রসঙ্গে দেবেশ রায়ের আলোচনার অন্য এক জায়গায় দেখতে পাব। আমাদের দেশজ প্রকরণে গড়ে ওঠা উপন্যাসের ভিন্ন রুচি ও ঐশ্বর্যের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘“আলালের ঘরের দুলাল”-এ বক্তা বা বিবরণকার হিসেবে লেখকের কোনো আড়াল নেই। একেই মিখাইল বাখতিন তাঁর “ডায়ালজিক ইমাজিনেশন”-এ উপন্যাসের বিবরণ বলেছেন।’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ৯-১০)

অর্থাৎ পশ্চিম আরোপিত শিল্পরুচির নিড়ানিতে উচ্ছেদ করা হয়েছিল এমন সব চারা গাছ, যা তাদের কাছে নিতান্ত আগাছা বলে মন হয়েছিল। যে নকশাগুলোতে নিজস্ব শিল্পরীতির গুঞ্জন ধ্বনিত হয়েছিল, তাকে অঙ্কুরেই হত্যা করা হয়েছিল পশ্চিমি ধারণার কাস্তে দিয়ে। পশ্চিমে উপন্যাসের জন্ম হয়েছিল রোমান্সের (‘আমাদিস দে গাউলা’, ‘পালমেরিন যে ইংলাতেররা’ ইত্যাদি) গর্ভে, বাংলায় ও রকম স্পষ্ট কোনো ঐতিহ্য আদৌ ছিল কি না সন্দেহ, তারপরেও নকশা জাতীয় সাহিত্যিক জনরা (genre) বা ধারা হিসেবে ‘হুতুমপেঁচার নকশা’ বা ‘আলালের ঘরের দুলাল’ যে সৃষ্টি হয়েছিল, তা আমাদের জন্য ছিল বিস্ময়কর এক সূচনা। কিন্তু আমরা তাকে বিকশিত হওয়ার কোনো সুযোগই দিইনি।

পশ্চিমি নন্দনতাত্ত্বিক উপনিবেশের কারণে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে ঘটেছিল একই রকম দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। এ সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে বছর তিরিশ আগে শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন:

‘দুর্ভাগ্যটা এই দিকে যে সেটি করার ফলে আমাদের কবিতার যে স্থানীয় চেহারা ছিল, সেই চেহারা থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন হতে হলো। মধ্যযুগ, অষ্টাদশ শতক কিংবা ঈশ্বর গুপ্ত পর্যন্ত আমাদের পুরোনো প্রবহমান ধারাটা চলেছে। এরপর যে শিক্ষিত শ্রেণিটি এল তারা ইউরোপীয় মডেলে আরেকটি ধারা গড়ে তুলল। সেই ধারাটিই চলেছে। মধুসূদন, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ এঁরা সবাই খুব বিরাট ব্যক্তিত্ব। কিন্তু সকলেরই এই দূরত্বটা তৈরি হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ সচেতনভাবে অবশ্য ভেবেছিলেন যে এই দুই ধারার দূরত্ব কীভাবে দূর করা যায়। তার জন্য কতগুলো আয়োজন রবীন্দ্রনাথ বাইরে থেকে করেছিলেন।’ (আলাপচারিতা, পাঠক সমাবেশ)।

এটা খানিকটা স্ববিরোধী বলে মনে হতে পারে, যে-তিরিশি নন্দনতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে নজরুলের অবস্থান, সেই তিরিশেরই দুজন প্রধান কবির কাছে কীভাবে নজরুল খণ্ডিতভাবে হলেও সমাদৃত হলেন। ঘটনা হলো পশ্চিমি নন্দনতত্ত্বে নাড়া বাঁধা আমাদের তিরিশের কবিদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু ও জীবনানন্দ দাশ কর্তৃক নজরুল যে অংশত গ্রাহ্য ও শংসিত হয়েছিলেন, সেটা এই দেশজ ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধারে নজরুলের অবদানের জন্য নয়, বরং নজরুলের কবিতায় ও গানে পশ্চিমি কাব্যকলার অনুকরণে ও অনুসরণে যেটুকু তাঁরা দেখতে পেয়েছেন, সেটুকুর জন্য। নিশ্চিতভাবে সেটা খুব বড় কোনো অংশ নয়। কিন্তু নজরুলের কবিতায় দেশজ ঐতিহ্য ও প্রকরণের মিশ্রণ যেখানে ব্যাপকভাবে ঘটেছে, সেই অংশটুকু তাঁদের পশ্চিমি হৃদয়কে তৃপ্ত করতে পারেনি বলে তা উপেক্ষিত ও অবমূল্যায়িত হয়েছে।

রবীন্দ্র–পরবর্তী নজরুলই ছিলেন সেই প্রথম কবি, যাঁর কবিতায় দেশজ ও পশ্চিমি ধারার নান্দনিক বিশ্বাসের মিশ্রণ ঘটেছিল। তবে এ দুইয়ের মধ্যে দেশজ রূপটিই ছিল প্রধান। বুদ্ধদেব এ বিষয়ে কতটা সচেতন ছিলেন জানি না, তবে জীবনানন্দ দাশ জানতেন এবং এ বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট ধারণা যে ছিল, সেটা দেখা যায় নজরুল প্রসঙ্গে এই নিচের উক্তিগুলোয়:

কাজী নজরুল যদি ইউরোপীয় সাহিত্যের রীতির ও পরিণতির নিকট কোনো দিক দিয়ে ঋণী থাকেন, তা হলে তা অনেকটা মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ–এর মধ্যস্থতায়।...নজরুল ইসলাম–এর পক্ষে রবীন্দ্র-পরিস্রুত বিদেশি কাব্যেরও ততটা দরকার ছিল না—আধুনিক বাংলা দেশে তিনি বাংলা’র অন্য কোনো মাটিরই বিশেষ স্বায়ত্ত সন্তান বলে। (সমগ্র প্রবন্ধ, জীবনানন্দ দাশ, প্রতিক্ষণ, পৃ. ২১৩)

নজরুল সম্পর্কে জীবনানন্দ দাশের এই উক্তির মধ্যে স্পষ্টভাবেই এই স্বীকৃতি আমার দেখতে পাই যে নজরুলের মধ্যে দুটি ধারাই ছিল—একটি ইউরোপীয়, যা ক্ষীণতোয়া। অন্যটি এই মাটি থেকে উদ্ভূত (‘বাংলা’র অন্য কোনো মাটিরই বিশেষ স্বায়ত্ত সন্তান’) যা প্রবল। তবে বুদ্ধদেব বসু নজরুলকে প্রশংসার ব্যাপারে কার্পণ্য যদিও করেননি, কিন্তু নজরুলের কেবল সেই অংশটুকুকেই প্রশংসনীয় বলে মনে করেছেন, যেটুকু তার পশ্চিমি হৃদয় অনুমোদন করেছে। অন্যদিকে জীবনানন্দ সততার সঙ্গেই এ কথা বলতে দ্বিধা করেন না যে ‘নজরুল–এর কবিতার এমন অনেক গুণ আছে, যে-সবের সঙ্গে আজকের বাংলা কবিতার একটা প্রধান প্রাণতরঙ্গ মোটেই সমধর্মী নয়।’ (পৃ. ২১১)

কেন সমধর্মী নয়, তার জবাবে তিনি বলেছিলেন: ‘নানা কারণেই ইংলন্ড–এর বিরাট সাহিত্যিক ঐতিহ্য পৃথিবীর সংবেদনাগুলো আজ প্রায় সবচেয়ে বড় লক্ষণীয় জিনিস।’ (পৃ. ২১২)

এ বিষয়ে জীবনানন্দ দাশ আরও সরাসরি ও স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছেন বাংলা কবিতার নতুন অভিমুখটা কোন দিকে ঘোরানো হয়েছে। দেশজ প্রকরণ-ভান্ডারের ‘বিবিধ রতন’ থেকে ঈশ্বর গুপ্ত-পরবর্তী ধারাটি যে তার মুখ ফিরিয়ে এগিয়ে গেছে, প্রতীচ্যের ধনভান্ডারের দিকে তার সাক্ষ্য রয়েছে জীবনানন্দ দাশের এই উক্তিতে:

‘আমরা অনেকেই দান্তের দেশে, শেকসপীয়র–এর রাজ্যে, রোমান্টিকদের অমর্ত্যে, উত্তর-রোমান্টিকদের পাতালে অন্তঃপ্রবেশ লাভ করে ক্রমে-ক্রমে আমাদের শরীর-মনের স্বদেশকে উপলব্ধি করি; আমরা আজকের এই আলোচ্য (নজরুল) কবির চেয়ে অল্প-বিস্তর বেশি প্রতিকূল, অধিকতর গহন, মানস-পরিপ্রেক্ষিতের মুখাপেক্ষী।’ (পৃ. ২১৩)

নজরুল গ্রহণের ব্যাপারে রক্ষণশীল ছিলেন না। এমনকি পশ্চিমের প্রতিও ছিল না তাঁর বিমুখতা; নজরুল অংশত পশ্চিম—যেমনটা জীবনানন্দ দাশ বলেছেন—ও প্রধানত আরবি ফারসি সাহিত্যের সিরাজিতে মাতাল হয়ে অনন্য এক স্ফূর্তি লাভ করেছেন। কিন্তু তার মূল প্রেরণা ছিল মূলত দেশজ প্রকরণ ও ভাবৈশ্বর্যের বিচিত্রপ্রসবী ভান্ডার।

আমি এই উদাহরণ দিয়ে কোনোভাবেই এ কথা বলতে চাইছি না যে পশ্চিমের মুখাপেক্ষী হওয়াটা তিরিশের এক সাহিত্যিক ভ্রম। যেকোনো দেশের সাহিত্যের ইতিহাসেই ভিন্নভাষী সাহিত্যের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে মুক্তি অর্জনের দৃষ্টান্ত দেদার। স্প্যানিশ সাহিত্য ফরাসি সাহিত্য থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে বলীয়ান হয়ে উঠেছে, ইংরেজি সাহিত্য ফরাসি থেকে দুই হাত ভরে নিয়েছে। বাংলা কবিতা যে পশ্চিমি রঙে রঞ্জিত হয়েছিল, তা যেমন অনিবার্য ছিল ভিন্ন এক আরম্ভের জন্য, তেমনি বৈচিত্র্য ও ঐশ্বর্যের স্মারক হিসেবেও তার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ওটাকেই মুক্তির একমাত্র উপায় ও বিচারের মানদণ্ড ধরে নেওয়ার মধ্যে একটা ভ্রান্তিবিলাস তৈরি হয়েছে বলে আমার ধারণা। নজরুল গ্রহণের ব্যাপারে রক্ষণশীল ছিলেন না। এমনকি পশ্চিমের প্রতিও ছিল না তাঁর বিমুখতা; নজরুল অংশত পশ্চিম—যেমনটা জীবনানন্দ দাশ বলেছেন—ও প্রধানত আরবি ফারসি সাহিত্যের সিরাজিতে মাতাল হয়ে অনন্য এক স্ফূর্তি লাভ করেছেন। কিন্তু তার মূল প্রেরণা ছিল মূলত দেশজ প্রকরণ ও ভাবৈশ্বর্যের বিচিত্রপ্রসবী ভান্ডার।

নজরুল ইসলাম কতটা সচেতনভাবে দেশাভিমুখী হয়েছিলেন, তা হয়তো নিশ্চিত করে বলা যাবে না, তবে তাঁর দ্রোহচেতনা, রাজনৈতিক স্বরাজ ও স্বাধিকারের সচেতন শিখাটি যে দেশজ উপকরণ ও প্রকরণ থেকেই তার জ্বালানি সংগ্রহ করবে, তা ছিল অবধারিত। উপরন্তু তিনি যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন, তা ছিল বৃহত্তর নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠীর শিল্প ও বিনোদনের উপাদানে কীর্ণ। আধুনিক কবি লেখকদের মধ্যে বাংলার সংস্কৃতির নিম্নবর্গীয় রূপটি অনেকেই হয়তো ঘনিষ্ঠভাবে জেনেছেন, কিন্তু তা যে নতুন তেজে ও দীপ্তিতে, সূক্ষ্ম শৈল্পিক কুশলতা, প্রগাঢ় কাব্যবোধ ও কল্পনাশক্তির যোজনায় অবির্নিমিত (Deconstruction) রূপে আবির্ভূত হবে—এ ছিল অভাবনীয়। সচ্চিদানন্দন সম্ভবত এই কারণেই নজরুলী শিল্পরূপের প্রকৃতি সম্পর্কে ‘বিষয়কেন্দ্রিক ও আঙ্গিকগত গণতান্ত্রিকতার স্তরে আধুনিকীকরণের’ প্রসঙ্গটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছিলেন।

দেশজ শিল্পরূপের আধুনিকীকরণ

রামায়ণ, মহাভারত, হিন্দু ও লোকপুরাণ, মঙ্গলকাব্য, শাক্ত পদাবলী, পাঁচালি ও পুঁথি, বাউল, চারণ ও লেটোর বহমান যে ঐতিহ্যের মধ্যে গণমুখী স্থানীয় শিল্পরূপ ও নান্দনিক বিশ্বাসের স্বতন্ত্র এক নিম্নবর্গীয় কাব্যরুচি গড়ে উঠেছিল, নজরুল তারই শোধিত ও আধুনিক এক রূপকার। তিনি ভারতচন্দ্রের কাম, ঈশ্বর গুপ্তের বিদ্রূপ ও শ্লেষ, গোবিন্দ্রচন্দ্র দাসের দ্রোহ ও কটাক্ষ, সত্যেন দত্তের মানবিকতা, রমেশ শীল প্রমুখের দ্রোহী অনল, পাঁচালিকারদের আখ্যানধর্মী কাব্যকলা ইত্যাদি দেশজ রূপ ও রসকে তিনি শুষে নিয়ে কয়েক গুণ শক্তি ও সৌকর্যে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বাংলা কবিতার বৃহত্তর ভোক্তার মঞ্চে, যেখানে অভিজাত ও অনভিজাত, নিম্ন ও উচবর্গের সবাই আমন্ত্রিত। নজরুলের দেশজ শিল্পরূপের উৎস এবং নজরুলের হাতে তার বিবর্তন ও আধুনিকীকরণ সম্পর্কে বিনয় সরকারের পর্যবেক্ষণ আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ:

নজরুল বাঙলাদেশের আবেষ্টনকে জনসাধারণের চোখে দেখতে সুপটু। ‘মেঠো’ ভাষায় রচিত চলতি শব্দে পাড়াগেঁয়ে হসন্ত-ধ্বনির সাহায্যে পল্লীদৃশ্যগুলো আঁকবার ক্ষমতা তাঁর জবরদস্ত। লোকটা খাঁটি বাঙালী। মফস্বলের নদী-মাঠ, ফুল-পাখী, আকাশ-বাতাস—এই সবকে মামুলী শব্দে সরস করা তাঁর বাহাদুরির অন্তর্গত। নজরুল অনেকটা ঠিক যেন পশ্চিমবঙ্গের (রাঢ় অঞ্চলের) গ্রাম্য কবি। অতি তাজা ও প্রাকৃত তাঁর বোলচাল ও ভাবভঙ্গী। সেকালের মতি রায়, নীলকণ্ঠ আর রসিক চক্রবর্তীর যাত্রার দল ছিল। জানিস তো? তাঁদের গানের শব্দগুলো যেন নজরুলের রপ্ত হয়ে গেছে।…এমনকি তাঁদেরও পূর্ববর্তী দাশরথি রায়ের পাঁচালিতে মেঠো-মিঠে সোজা শব্দের গাঁথুনি দেখা যায়। তা–ও যেন নজরুলের হাতের পাঁচ। নজরুল ছেলেবেলায় বোধহয় যাত্রা-পাঁচালির গান শুনে থাকবে। শুধু কানে নয়, তার মরমে গিয়ে এই সব খুব গভীর ভাবে বসেছিল মনে হচ্ছে। আমি নজরুলকে এই হিসাবে বাঙালী নরনারীর অতি-ঘরোয়া কবি সমঝিতে অভ্যস্ত। বঙ্গ-সংস্কৃতির সেকেলে ধারা বিংশ শতাব্দীর জনসাধারণের ভেতর নজরুল-মারফৎ নতুন গড়নে ছড়িয়ে পড়েছে। গানের কবি নজরুল ভাষা হিসাবে খানিকটা পাঁচালি-যাত্রাকারদের সন্তান ও উত্তরাধিকারী। (বিনয় সরকারের বৈঠকে, পৃ. ৩৯৪)

বিনয় সরকার তাঁর এই বক্তব্যের পক্ষে কয়েকটি উদাহরণও দিয়েছিলেন, যা পশ্চিমি নান্দনিক আধিপত্যের বাইরে নজরুলের এদেশীয় শিল্পরুচির নির্মাণকে নিশ্চিত করে তুলেছিল। তিনি নীলকণ্ঠের একটি গানের সঙ্গে নজরুলের গানের সম্পর্ক নির্ণয় করতে গিয়ে প্রথম নীলকণ্ঠ ও পরে নজরুল থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরেন:

গত নিশীথে কোন ফুলেতে
                কার সনেতে মজেছিলে?
সত্যভাবে নাম রাখিতে
                 প্রভাতে জ্বালাতে এলে।
তাই বলি হে রসময়
                ব’য়ে গেছে সুসময়;
ক্ষুধার সময় ব’য়ে গেলে
              ভালো লাগে কি সুধা দিলে?
কণ্ঠে বলে প্রভাত কালে
              কোথায় যাও হে চিকন-কালা?
তোমা বিনে নিকুঞ্জ বনে
             কাঁদে যত ব্রজবালা।
শুকালে কমলের মধু
            কমল প’ড়ে রইল শুধু।    
সে ফুল ব’সো গা বঁধু
           মধু আছে ভরা ফুলে।। 

এই গানেরই পরমাত্মীয় স্রোতটি দেখা যাবে নজরুলের সেই বিখ্যাত গানটিতে:

কার নিকুঞ্জে রাত কাটায়ে
              আসলে প্রাতে পুষ্প-চোর?
ডাকছে পাখি বৌ গো জাগো—
             আর ঘুমিয়ে না রাত্র ভোর।

বিনয় সরকারের মতে বুলবুল ‘বইটি আগাগোড়াই ঠিক যেন দাশরায়-নীলকণ্ঠর সুললিত শব্দের আধুনিক ফুলঝুরি।’ ( পৃ. ৩৯৭)

এ ধরনের প্রত্যক্ষ সংযোগ ছাড়াও নজরুলের গানে ও কবিতায় ভারতাত্মা ও বাঙালি রূপ ও রসের পরোক্ষ পাতন ঘটেছে অবিরল ধারায়।

নজরুলে নারী ও নারী-পুরুষের অভিন্ন রূপকল্প

নারীকে তিনি উচ্চতম মর্যাদায় বিবেচনা করেছেন। কিন্তু কখনো কখনো তিনি নারীকে পুরুষ এবং পুরুষ ও নারীকে অভেদাত্মায় কল্পনা করেছেন। যেমন মহাকালের কোলে বসি কৃষ্ণ হলো মহাকালী।

এত সংক্ষেপে, মাত্রই ছয়টি শব্দের সম্মিলনে যে সময় ও চরিত্রদের রূপান্তর ঘটিয়েছেন, তা এককথায় বিস্ময়কর। কৃষ্ণকে মহাকালীতে রূপান্তর কেবল নজরুলের উচ্চতর শৈল্পিক দক্ষতারই পরিচয় দেয় না, একই সঙ্গে তা কালের এক রূপান্তরের ইঙ্গিত হয়ে উঠেছে। নজরুলের এই উক্তি একদিকে কাল, নারী ও পুরুষ—সবচেয়ে মিতভাষ্যে এই তিনের মিশ্রণকে উচ্চতর কাব্যিক দক্ষতায় প্রকাশ করাটা একদিকে যেমন আমাদেরকে বিমোহিত করে, অন্যদিকে বাংলার ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার ও বিনির্মাণকেও তুলে ধরে। রামপ্রসাদ বা কমলাকান্তের কণ্ঠে আমরা আগেও নারী ও পুরুষের অভেদাত্মার কথা শুনেছি।

ঐ যে কালী, কৃষ্ণ, রাম—সকল আমার এলোকেশী

জাতীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তি যেহেতু তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল; উপরন্তু, জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও জাতপাত–নির্বিশেষে গোটা জনগোষ্ঠীই ছিল তাঁর শোতৃবর্গ, ফলে ওই দেশজতার প্রাধান্য ছিল তাঁর জন্য অনিবার্য। নজরুল যে গোটা ভারতবর্ষেই তিরিশ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই জনপ্রিয়তম সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব হতে পেরেছিলেন, তা এই দেশজতার সূত্রেই। কিন্তু শুধুই দেশজতা তাঁর একমাত্র পুঁজি ছিল না, ছিল অসামান্য শিল্পকুশলতা ও প্রগতিশীলতা।

বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের কণ্ঠে তারই এক ভিন্ন রূপ ধ্বনিত হয়ে ওঠে:

কালী কেবল মেয়ে নয়,—
সে যে মেয়েরই বরণ করিয়ে ধারণ
                কখন কখন পুরুষ হয়।

কমলকুমার মজুমদারের মধ্যে রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার অবহেলিত, নিম্নবর্গীয় সংস্কৃতির শীর্ণ ঐহিত্যের নব রূপায়ণের যে গৌরব লক্ষ করেন, নজরুলে তার স্বতঃস্ফূর্ত, সহজ প্রকাশ এতটাই শক্তিশালী রূপে প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও সাহিত্যের গুণবিচারীদের কাছে উপেক্ষিত থেকে গেছে। নজরুলের ওই পঙ্‌ক্তিতে কেবল ঐতিহ্যের বিনির্মাণের জন্যই নয়, একই সঙ্গে তা মহাকালের সঙ্গে যুক্ত করার শিল্পিত রণনেও উল্লেখযোগ্য। পুরুষ শক্তিতে রূপান্তরের ফলে যে নারীরূপ ধারণ করে—বাংলার অনার্য সংস্কৃতির এই উপাদান নতুন নয়। নারী দেবতা চণ্ডী শক্তিরূপিণী হিসেবে বিবেচিত হতেন—এ তো আমরা সবাই জানি। ঐতিহ্যবাহিত নারী ও পুরুষের অভিন্নতা বা পরস্পর-প্রবিষ্ট রূপের ধারণাটাকে নজরুল আরেকটি মাত্রা দিয়েছেন অপূর্ব বিন্যাসের মাধ্যমে।

বিঔপনিবেশিক মনোকাঠামো গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এই সাংস্কৃতিক উপাদান ও নিষ্কাশন তাঁর স্বতন্ত্র কাব্যধারা ও শিল্পরীতির জন্য সহায়ক হয়ে উঠেছিল। আর এই কারণে ঈশ্বর গুপ্ত-পরবর্তী আধুনিক কবিতার তিনিই প্রথম আধুনিক কবি, যিনি কেবল রাজনৈতিক অর্থেই ডিকলোনাইজেশনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেননি, একই সঙ্গে ওই রাজনীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সংগতি রেখে ডিকলোনাইজড/বিঔপনিবেশিক কাব্যবিশ্বাসের জনক হয়ে উঠেছিলেন। পশ্চিমি কাব্যবিশ্বাসের অভিজাত শ্রেণি তাঁকে আধুনিক বলে যে মনে করেননি, তার পেছনে প্রধান কারণ তাঁরা নজরুলের এই বিঔপনিবেশিক মনোভাব ও কাব্যাদর্শ সম্পর্কে সচেতন হলেও তাকে সেকেলে ভেবে পরিত্যাজ্য ভেবেছেন। তাঁরা নজরুলের কাব্যবোধের ও সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছেন বটে, কিন্তু নজরুলের এই অন্য, দেশজ আধুনিকতাকে মোটেই আমলে নেননি, কিংবা বুঝতেই পারেননি। কিন্তু সচ্চিদানন্দন নজরুলের এই বিকল্প কাব্যবিশ্বাসের গুরুত্ব ও অভিনবতা সম্পর্কে ছিলেন পুরোপুরি নির্ভুল।

তিরিশের কবিকুল পশ্চিমের শাওয়ারে স্নান করতে গিয়ে উন্মুক্ত ও প্রাকৃতিক গঙ্গা নদীকে পরিত্যাগ করেছেন পুরোপুরি। নজরুল দেশজ প্রকরণ ও উপাদানকে পুনর্বিন্যাস করেছেন তাঁর কবিতায়। জাতীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তি যেহেতু তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল; উপরন্তু, জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও জাতপাত–নির্বিশেষে গোটা জনগোষ্ঠীই ছিল তাঁর শোতৃবর্গ, ফলে ওই দেশজতার প্রাধান্য ছিল তাঁর জন্য অনিবার্য। নজরুল যে গোটা ভারতবর্ষেই তিরিশ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই জনপ্রিয়তম সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব হতে পেরেছিলেন, তা এই দেশজতার সূত্রেই। কিন্তু শুধুই দেশজতা তাঁর একমাত্র পুঁজি ছিল না, ছিল অসামান্য শিল্পকুশলতা ও প্রগতিশীলতা। বক্তব্যের প্রত্যক্ষতা যেমন ছিল, তেমনি ছিল তাকে শিল্পিত স্বভাবে বয়ানের অসামান্য কৌশল। ধ্বনিগুণ, ওজস্বিতা, কল্পনার বিস্ফার ও স্ফূর্তি, পরিশীলিত ও ঘনীভূত কাব্যবোধের শিল্পিত অভিব্যক্তি তাঁর কবিতাকে কুহকী শক্তিতে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিল। পশ্চিমি কাব্যতত্ত্বের মুখাপেক্ষী বা আকণ্ঠ মগ্ন না হয়েও যে বাংলার ঐশ্বর্যে নির্ভর করে শিল্পিত স্বভাবে জনগণমনজয়ী হয়ে ওঠা সম্ভব এবং একই সঙ্গে কাব্যিক সাফল্যকে নিশ্চিত করা যায়—নজরুল এর প্রথম, প্রবল আর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাতেই এই শৈল্পিক নৈপুণ্য আমাদের চোখে না পড়ে পারে না। যেখানে কল্পনা ও শিল্প একই কররেখায় যুক্ত হয়ে সিদ্ধি-শিখরকে ছুঁয়ে গেছে:

ঝামর তাহার কেশের দোলায় ঝাপটা মেরে গগন দুলায়,
সর্বনাশী জ্বালা-মুখী ধূমকেতু তার চামর চুলায়!
               বিশ্বপাতার বক্ষ-কোলে
              রক্ত তাহার কৃপাণ ঝোলে
                                দোদুল দোলে!

               সপ্ত মহাসিন্ধু দোলে
                                কপোল-তলে!

ঐ সে মহাকাল সারথি রক্ত-তড়িৎ চাবুক হানে,
রণিয়ে ওঠে হ্রেষার কাঁদন বজ্র-গানে ঝড়-তুফানে!
ক্ষুরের দাপট তারায় লেগে উল্কা ছুটায় নীল খিলানে

ইংরেজ রোমান্টিক কবিদের কল্পনার যে আগুন আর অলংকারের যে রত্নচ্ছটা দেখতে পাই, তা নজরুলের কবিতায় এক স্বভাবসিদ্ধ লক্ষণ, কিন্তু তার আত্মা সতত স্পন্দিত দেশজ প্রকরণ ও ঐতিহ্যের উতল প্রভঞ্জনে। অর্থাৎ নজরুলের দেশজ আত্মা পশ্চিম থেকে গ্রহণ করেছে বটে, কিন্তু স্বভাবের মৌল রূপটি সব সময়ই ভারতীয় লক্ষণে দীপিত। অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত নজরুলের এই রূপালংকারিক বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতে গিয়ে বলেছিলেন : ‘তাঁহার কাব্যের অনেক স্থানে একটু রেটরিকের rhetoric আধিক্য লক্ষ করিয়াছি। মনে হইয়াছে ইহা যেন সংস্কৃত অলঙ্কারে কথিত গৌড়ী রীতির নিদর্শন।’ (প্রবন্ধ সংগ্রহ, রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত, এবং মুশায়েরা, ২০১০, পৃ. ৩১৬)

নজরুলের নন্দনতাত্ত্বিক কাঠামোর ভিত্তিমূল আসলে সংস্কৃত ও লোকজ ঐতিহ্যের মিশ্রণ। ফলে নজরুল কাব্যবিচারের ক্ষেত্রে পশ্চিমি মানদণ্ডকে একমাত্র মানদণ্ড ধরে নিয়ে নজরুলের বৈশ্বিক ভারতীয়তা স্পর্শ করা অসম্ভব। সূক্ষ্ম বিচারে নজরুল আসলে মধুসূদন-পূর্ব বাংলা কবিতার গণমুখী আত্মা ও স্বভাবের নির্বাপিত দীপশিখাটিকে প্রজ্জ্বলিত করেছেন সামাজিক ও রাজনৈতিক সত্তার বারুদে ঠাসা প্রজ্জ্বালক উপাদান দিয়ে। ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমলের অবসানের আগেও সমাজের উপেক্ষিত সমষ্টির সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী বাংলা কবিতার যে ধারাবাহিকতা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, নজরুল সেই বিলুপ্ত ধারাবাহিকতাকে কেবল নবায়নই করেননি, সেটিকে এক বিস্ফোরক রূপ দিয়েছিলেন। বড়ু চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, ভারতচন্দ্র, গোবিন্দ দাশ, রমেশ শীল প্রমুখের বিদ্রোহ, প্রেম, প্রতিবাদ, ভক্তি ও আদিরস শুষে নিয়ে নজরুল পরিশীলিত এবং একই সঙ্গে সমষ্টির ও ব্যক্তির এক আলোকিত সমন্বয় হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর কবিতার একটি ধারা সেই সমষ্টির দিকে মুখ ফেরানো ‘দিন যায় যাহাদের অসাধে—অসুখে—’, অন্যটি ব্যক্তির নিঃসরণ যেখানে ‘নিজের হৃদয়কে নিয়ে মৌমাছির মতো নিমগ্ন হয়ে’ থেকেছেন। কখনো কখনো ‘জীবনের বিচ্ছেদের বিষণ্ন লেগুন কেঁদে’ উঠেছে তার গানে ও কবিতায়। নিজেরই কবিতার মতো তাঁর ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাশরী আর হাতে রণতুর্য’; তিনি লোকোৎসারিত সেই অভেদাত্মা যেখানে সমাজের বহুস্বরের এক যৌবনদীপ্ত চিন্ময় মানচিত্র ফুটে উঠেছে। কালের বিচারে তিরিশের প্রতিনিধিত্বশীল কবিদের নিকটবর্তী হয়েও নজরুল ছিলেন তাদের স্বভাবের প্রায় বিপরীত: ‘জনতার জঘন্য মিতালী’তেই ছিল তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাধিকার। যে জনতা তাঁর হৃদয়কে বলয়িত করে রেখেছে, সেখান থেকেই তাঁর কাব্যসত্তা পুষ্টি ও প্রত্যয় লাভ করেছে। অন্তঃপ্রেরণায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রাকৃত, উদ্ভিজ্জ, লতাগুল্মময়। আগ্রাসী ও লেলিহান শিখায় দাবানলের মতো বুনো ও ক্রমবিস্তারী। তিনি ছিলেন আশ্চর্য এক প্রাকৃত ঝরনাধারা, অবিশ্বাস্য তাঁর স্বতঃস্ফূর্ততা! নজরুলের এই অন্তর্লীন স্বভাবের দিকে না তাকিয়ে আমরা তাঁকে হুল্লোড়ের সম্রাট ও কোলাহলের রূপকার হিসেবে তাঁর বহিঃস্থ রূপটিকেই কেবল দেখেছি। এই কারণে তাঁকে সত্যিকারের কবি হিসেবে গ্রহণে বিমুখ ছিলেন তিরিশ ও তিরিশোত্তর প্রধান লেখকদের এক বিরাট অংশ। সম্ভবত নজরুলের কাব্যসত্তার গণমুখিতা, স্পষ্টতা ও প্রত্যক্ষতা তাঁদের দূরাগত রুচির জন্য ছিল প্রতিকূল। তাই তাঁরা নজরুলকে নিয়ে দ্বিধা ও সংশয়ে ভুগেছেন।

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও গবেষক