গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

ইলা মিত্রের জন্মশতবর্ষ

একটি ছবির গল্প

তেভাগা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেত্রী ইলা মিত্রের জন্মশতবার্ষিকী ছিল ১৮ অক্টোবর। এ রচনায় তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে স্মরণ করা হয়েছে।

কিশোরীবেলা থেকে বাবার তোলা একটি ছবি খুঁজে বেড়াচ্ছেন সাউথ পয়েন্ট স্কুলের শিক্ষক লায়লা মোশাররফ তুলি। তিনি যখন ভিকারুননিসা নূন স্কুলে পড়তেন, তখন বাবার কাছে বহুবার বিপ্লবী ইলা মিত্রের ছবি তোলার গল্প শুনেছেন। একদিন তিনি বাবার কাছে জানতে চান, ‘ছবিটা কোথায়?’ বাবা জানালেন, ফটোসাংবাদিকতার মতো অনিশ্চিত জীবনে ছবিটি কেমন করে হারিয়ে গেছে। বাবার সহকর্মী সংবাদচিত্রীদের সঙ্গে দেখা হলে তুলি এই ছবির ব্যাপারে জানতে চান। ছবিটির কথা সবারই জানা। কিন্তু কারও সংগ্রহেই এর কোনো প্রিন্ট নেই। যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী, তখন বিভাগের শিক্ষকদের কাছে ছবিটির ব্যাপারে জানতে চান। তাঁর ক্ষীণ আশা, যদি কারও কাছে ছবিটি থাকে। ছাত্রজীবনে ছবিটি দেখা হলো না তুলির।

২০২২ সালে তাঁর বড় মেয়ে ওয়াহিদা রহমান অসুস্থ হয়ে আগারগাঁওয়ের নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে ভর্তি হয়। মেয়েকে নিয়ে ১০ দিন ছিলেন হাসপাতালে। অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে প্রতিদিন বিকেলে হাসপাতালের বারান্দায় ঘুরতেন। বারান্দার জানালা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরটা দেখা যায়। মেয়ের বায়না, ওই জাদুঘরে যাবে। মা বলতেন, ‘আগে সুস্থ হও, তারপর নিয়ে যাব।’

একদিন মেয়েকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে গেলেন। তৃতীয় তলার এক নম্বর গ্যালারিতে ঢুকতেই দেখেন ইলা মিত্রের সেই ছবি, যা তিনি এত দিন ধরে খুঁজছেন! ছবিটি দেখে তাঁর রক্তের ভেতর এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায়। বন্দী অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে শায়িত ইলা মিত্র।
মোশাররফ হোসেন লাল (৪ জানুয়ারি ১৯২৯—১১ অক্টোবর ২০০৪)

একদিন মেয়েকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে গেলেন। তৃতীয় তলার এক নম্বর গ্যালারিতে ঢুকতেই দেখেন ইলা মিত্রের সেই ছবি, যা তিনি এত দিন ধরে খুঁজছেন! ছবিটি দেখে তাঁর রক্তের ভেতর এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায়। ছবির ক্যাপশনে লেখা, ‘মুসলিম লীগ সরকারের চরম নির্যাতনের শিকার কৃষক নেত্রী ইলা মিত্র হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি জাতির প্রতিরোধ চেতনার প্রতীক। বন্দী অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে শায়িত ইলা মিত্র। তাঁকে ঘিরে আছেন শ্রদ্ধাবনত সেবিকারা।’ দাতা হিসেবে রণেন মিত্রের নাম উল্লেখ রয়েছে।

গ্যালারিতে থাকা একজনের কাছে ছবিটির ব্যাপারে জানতে চান। লোকটি বললেন, ‘জাদুঘরের কিউরেটর আমেনা খাতুনের কাছে যান। তিনি সব বলতে পারবেন।’ অনুমতি নিয়ে মুঠোফোনে ইলা মিত্রের ডিসপ্লে করা ছবিটি তুললেন। আমেনা খাতুনের রুমে গিয়ে বললেন সমস্ত ঘটনা। আমেনা খাতুন জানালেন, এই ছবির মূল নেগেটিভ বা আলোকচিত্র তাঁদের সংগ্রহে নেই। পত্রিকায় যে ছবিটি ছাপা হয়েছিল, তারই একটি স্ক্যান কপি আর কয়েকটি নথি ইলা মিত্রের ছেলে রণেন মিত্রের কাছ থেকে তাঁরা সংগ্রহ করেছেন।’ উত্তেজনায় তুলির আর জাদুঘর ঘুরে দেখা হয় না। দ্রুত চলে আসেন মায়ের কাছে। মাকে ছবিটি দেখান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান মা সাহিদা বেগম বললেন, ‘এটাই সেই ছবি!’ মায়ের কাছে নিশ্চিত হয়ে ছবি খুঁজে পাওয়ার আনন্দে চোখ ভিজে ওঠে তুলির।

ওই সময় তুলি বাবার তোলা ঐতিহাসিক ছবিটা খুঁজে পাওয়ার বিষয়টি আমাকে ফোনে জানান। আমি বলি, আপনার বাবা যেহেতু বাংলাদেশের ফটোসাংবাদিকতার সূচনাপর্বের একজন অগ্রপথিক তাই পুরোনো পত্রপত্রিকা খুঁজে দেখি এ বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায় কি না। ন্যাশনাল আর্কাইভে গিয়ে পুরোনো পত্রিকা ঘাঁটতে শুরু করি। হঠাৎ ২০০০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় তাঁর বাবা ও চাচাকে নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন খুঁজে পাই। এই দুইজন পথিকৃৎ ফটোসাংবাদিকের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে আশীষ-উর–রহমান শুভ ‘কেমন আছেন আলোকচিত্রের দুই জাদুকর-মোজাম্মিল আর লাল ভাই’ শিরোনামে এই প্রতিবেদন লেখেন। আশীষ-উর–রহমান লিখেছেন, ‘মোশাররফ হোসেন লাল ব্যাপক পরিচিত “লাল ভাই” হিসেবে। ষাটের দশকে বহু সাড়া জাগানো ছবি তুলেছেন লাল ভাই। দারুণ সাড়া ফেলেছিল তাঁর ইলা মিত্রের ছবি। কারাগারে বন্দী অবস্থায় নেত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে কড়া প্রহরায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার জন্য আনা হয়েছিল তাঁকে। লাল ভাই ক্যামেরা লুকিয়ে ছদ্মবেশে হাসপাতালে গিয়ে ছবি তুলেছিলেন। এই ছবি ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকাতেও ছাপা হয়েছিল।’

এই প্রতিবেদন পাওয়ার পর আমি তুলির সঙ্গে যোগাযোগ করি। ১১ অক্টোবর মগবাজারের সোনালীবাগে গিয়ে তুলি ও তাঁর বড় বোন সাজিয়া মোশাররফের সাক্ষাৎকার নিই। তাঁদের বয়ানে উঠে আসে নানা অজানা তথ্য। ঢাকা মেডিকেল কলেজের পূর্ব দিকে চাঁনখারপুলে ছিল ‘পাকিস্তান ফটোগ্রাফিক ইম্পোরিয়াম’ নামের একটি স্টুডিও। ১৯৫০ সালে সেই স্টুডিওতে ফটোগ্রাফি শুরু করেন লাল ভাই। স্টুডিওর অবাঙালি মালিক মতিউর রহমানের কাছে ফটোগ্রাফি শেখেন লাল ভাই। ১৯৫৩ সালে তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রকে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ইলা মিত্র তখন ছাত্র-জনতার কাছে অত্যন্ত সম্মানের পাত্র। বিশেষ করে সাঁওতালদের কাছে তিনি ছিলেন মায়ের মতো। সাঁওতালরা তাঁকে ডাকতেন ‘রানিমা’ বলে। এই খবর আসে লাল ভাইয়ের কাছে। ২৪ বছর বয়সী লাল ভাই সিদ্ধান্ত নেন যে করেই হোক এই কিংবদন্তি নেত্রীর ছবি তুলে রাখতে হবে।

কারাগারে বন্দী অবস্থায় নেত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে কড়া প্রহরায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার জন্য আনা হয়েছিল তাঁকে। লাল ভাই ক্যামেরা লুকিয়ে ছদ্মবেশে হাসপাতালে গিয়ে ছবি তুলেছিলেন। এই ছবি ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকাতেও ছাপা হয়েছিল।

জীবনের মায়া তুচ্ছ করে প্রথম দিন ক্যামেরা ছাড়াই হাসপাতালে গেলেন লাল ভাই। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রধান গেটের চওড়া সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠেন। সিঁড়ির বাঁয়ের পূর্ব দিকে দুই সারি মহিলা ওয়ার্ড। দক্ষিণ দিকের ওয়ার্ডের একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের বেডটিতে শায়িত বিপ্লবী ইলা মিত্র। পাতলা গড়ন। হাড্ডিসার ভাঙাচোরা শরীর বিছানার সঙ্গে প্রায় মিশে আছে। বসে যাওয়া চোখের গভীরে ক্লান্তির ছাপ। নিরক্ত ফ্যাকাশে মুখে শান্ত শীতল অভিব্যক্তি। শয্যার পাশে পুলিশের পাহারা। পরিচিত দুই নার্সের কাছে শুনলেন, অধ্যাপক ডা. কে এস আলমের অধীনে তাঁর চিকিৎসা ঠিকঠাকমতো চলছে। ডাক্তার-সিস্টারদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। তবু স্বাস্থ্যের আশানুরূপ অগ্রগতি হচ্ছে না। লাল ভাই নার্সদের কাছে তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য খুলে বললেন। তাঁরা ইলা মিত্রের সঙ্গে কথা বলে ছবি তোলার ব্যাপারে সম্মতি দিলেন।

হাসপাতালে শায়িত ইলা মিত্র, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, নভেম্বর, ১৯৫৩
এই ছবি ছাপা হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তান—দুই দেশে হইচই বেধে গেল। কে তুলেছে এই ছবি—পাকিস্তানি গোয়েন্দারাও এই তথ্য বের করতে পারলেন না। ছবিটি ছাপা হওয়ার পর ইলা মিত্রের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন তৈরি হয়।

নার্সদের কথামতো কয়েক দিন পর লাল ভাই গেলেন ক্যামেরা নিয়ে। নভেম্বর মাসের প্রায় শেষ সময়। শীত তেমন নেই। তবু শার্টের ওপর পরলেন একটি হাতাকাটা সোয়েটার। তার ভেতর লুকানো ক্যামেরা। পুলিশের নজর আড়াল করতে সোয়েটারের ওপর পরলেন কোট। সিস্টারদের সঙ্গে ওয়ার্ডে ঢুকতেই গেটে পুলিশ আটকাল। সিস্টাররা পরিচয় দিলেন, ‘ডাক্তার’। দুজন সিস্টার পুলিশের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। আর চারজন ইলা মিত্রের বেডের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। লাল ভাই সোয়েটার উল্টিয়ে বুকের মধ্যে ক্যামেরা রেখেই কোনোরকমে তিন-চারটি শাটার টিপলেন। এক-দুই মিনিটের মধ্যে ঘটল পুরো ঘটনা। এরপর দুজন সিস্টারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন লাল ভাই। পুলিশ টেরও পেল না।

পরে ছবিটা ভারতের বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক দ্য স্টেটসম্যান–এ ছাপা হলো। এই ছবি ছাপা হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তান—দুই দেশে হইচই বেধে গেল। কে তুলেছে এই ছবি—পাকিস্তানি গোয়েন্দারাও এই তথ্য বের করতে পারলেন না। ছবিটি ছাপা হওয়ার পর ইলা মিত্রের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন তৈরি হয়। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ বিভিন্ন মহল সোচ্চার হয়ে তাঁর পাশে দাঁড়ান। ১৯৫৪ সালে শেরেবাংলার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাসীন হলে প্যারেলে মুক্তি পান ইলা মিত্র।

সাপ্তাহিক চিত্রালী, দৈনিক পূর্বদেশ হয়ে লাল ভাই যোগ দেন দ্য মর্নিং নিউজ পত্রিকায়। ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন তৎকালীন সরকার চারটি পত্রিকা বাদে সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়। লাল ভাই তখন ঘূর্ণিঝড় কাভারে ভোলায় ছিলেন। ওখান থেকে খবর পান মর্নিং নিউজ বন্ধ হয়ে গেছে। দ্রুত ঢাকায় এসে মর্নিং নিউজ কার্যালয়ের তালা খোলার ব্যবস্থা করলেন। ভেতরে ঢুকে দেখেন সমস্ত অফিস ফাঁকা! ক্যাবিনেটে রাখা তাঁর সারা জীবনে তোলা ছবি-নেগেটিভ কিছুই পাওয়া গেল না!

ইলা মিত্রকে নিয়ে এ পর্যন্ত যত বই প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর কোথাও এই ছবির বর্ণনা নেই। ছবিটি কে তুলেছেন, তারও উল্লেখ নেই। উল্লেখ না থাকার অন্যতম কারণ—ছবি তোলা হয়েছিল অত্যন্ত গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে। আলোকচিত্রীর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে স্টেটসম্যান পত্রিকায় ছবিটি ছাপা হয়েছিল বিনা ক্রেডিটে। ৭২ বছর পর মোশাররফ হোসেন লাল ভাইয়ের দুই মেয়ের ভাষ্যে জানা গেল বিপ্লবী ইলা মিত্রের ছবি তোলার এই দুঃসাহসিক গল্প।