অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রবন্ধ

গেরিলা ও মুক্তিযুদ্ধের কবিতা

সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণের জন্য ১৯৭৩ সালে ফরাসি লেখক, দার্শনিক এবং এক সাহসী যোদ্ধা আঁর্দ্রে মালরো এক আমন্ত্রণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের হয়ে যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স ৭০ বছর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর আসা হয়নি। তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘গেরিলা পদ্ধতিতে তোমরা লড়াই করো, প্রথাগত যুদ্ধে একটা পেশাগত বাহিনীর বিরুদ্ধে তোমরা টিকবে না।’ গান্ধী-নেহরুর ভক্ত এই মানবতাবাদী সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লেখক-দার্শনিক বঙ্গবন্ধুকে দেখে মন্তব্য করেছিলেন—‘অশ্বারোহী সেনানায়ক, যিনি ক্রুসেডের কালে অনায়াসে সালাউদ্দিনের সেনাবাহিনীতে স্থান পেতে পারতেন। সেই পুরোনো দিনের সেনানায়কদের মতোই তিনি মর্যাদামণ্ডিত, উদারমনা এবং ভাবপ্রবণ।’ (খান সারওয়ার মুরশিদ, মালরো, মুক্তিযুদ্ধ, মুজিব ও কতিপয় নায়ক)।

আঁদ্রে মালরো (৩ নভেম্বর ১৯০১—২৩ নভেম্বর ১৯৭৬)

বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে একটি যুদ্ধের রণনীতি-রণকৌশলও বাতলে দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর বক্তৃতায় গেরিলা যুদ্ধের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।’ এভাবেই তিনি এ দেশের সাধারণ বেসামরিক জনগণকে শত্রুর মোকাবিলা করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। মুক্তিসেনাদের গেরিলাযুদ্ধের কাহিনি আমাদের শুধু অভিভূতই করে না, এর অসামান্য সাফল্যের কথাও আমাদের অজানা নয়।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যাঁরা কবিতা লিখেছেন, আমরা তাঁদের কবিতাকে যুদ্ধের কবিতা বললেও সেই কবিদের ‘ওয়ার পোয়েটস’ বলব না এ কারণে যে তাঁদের এসব কবিতা একটি বিশেষ সময়ের সৃষ্টিমাত্র। ইউরোপে ওয়ার পোয়েটস বললে যাঁদের কথা আমাদের মনে আসে, তাঁদের কাছে যুদ্ধ ছিল কবিতা লেখার অন্যতম উপাদান। ইউরোপের শতবর্ষের যুদ্ধসহ অনেক যুদ্ধই সেই কবিদের মানসভূমিতে ক্রিয়াশীল ছিল, যা তাঁদের যুদ্ধকে মোটিফ হিসেবে ব্যবহার করে কবিতা লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে। সুতরাং সেই অর্থে আমাদের কবিরা কেউই ওয়ার পোয়েটস নন, যদিও তাঁরা স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে ভালো কবিতাও লিখেছেন। কবিরা তীক্ষ্ণ বোধসম্পন্ন মানুষ। সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও একজন প্রকৃত কবির পক্ষে সম্ভব যুদ্ধের কবিতা লেখা।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যাঁরা কবিতা লিখেছেন, আমরা তাঁদের কবিতাকে যুদ্ধের কবিতা বললেও সেই কবিদের ‘ওয়ার পোয়েটস’ বলব না এ কারণে যে তাঁদের এসব কবিতা একটি বিশেষ সময়ের সৃষ্টিমাত্র। ইউরোপে ওয়ার পোয়েটস বললে যাঁদের কথা আমাদের মনে আসে, তাঁদের কাছে যুদ্ধ ছিল কবিতা লেখার অন্যতম উপাদান।

সরাসরি যুদ্ধের মাঠে না থেকেও শামসুর রাহমানসহ বাংলাদেশের অনেক কবির কবিতায়ই যুদ্ধের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। আবার রফিক আজাদ, মাহবুব সাদিকসহ অনেক কবিই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁরা কবিতা লিখেছেন।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কবিতায় যেমন সামরিক শব্দের নানাবিধ উপস্থিতি কবিতার অবয়বকে উদ্ভাসিত করেছে, তেমনি রণনীতি ও রণকৌশলগত নানাবিধ বিষয়েরও উপস্থিতি লক্ষ করা যায় এসব কবিতায়। আমাদের কবিরা অনেকেই গেরিলা শব্দকে কবিতায় উচ্চকিত করেছেন নানা মাত্রায়। গেরিলা শব্দের সঙ্গে আজ আমরা সবাই পরিচিত। এই শব্দ আমাদের অস্তিত্বের অচ্ছেদ্য অংশ। গেরিলা শব্দ উচ্চারিত হলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই সব বীর মুক্তিযোদ্ধার ছবি, সেই দামাল ছেলেদের মুখচ্ছবি, যাঁরা রহস্যের অন্তরালে শত্রুহননে জীবন বাজি রেখেছেন নির্দ্বিধায়। ছদ্মবেশে, নানা চরিত্রের আপাত পরিচয়ে পাকিস্তানি শক্তিশালী বাহিনীকে পরাজিত করেছেন।

গেরিলা যুদ্ধে আমাদের যোদ্ধারা অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছিলেন। এই রণকৌশল যেমন আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়েছিল বিজয়ের দিকে, তেমনি আমাদের গেরিলারা আমাদের চোখে সর্বৈব মুক্তিত্রাতা হিসেবে চিরকাল গৌরবের পাত্র হয়ে থাকবেন আমাদের চেতনায়, মননে এবং সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের স্রোতধারায়। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও এই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তারামন বিবিসহ অনেক তরুণী-কিশোরী সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁরা গেরিলাযুদ্ধও করেছেন। অনেকে শহীদও হয়েছেন। কিন্তু বড় পরিতাপের বিষয় যে তাঁদের অনেকের নাম-ঠিকানাও আমরা ভুলে গেছি।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কবিতায় যেমন সামরিক শব্দের নানাবিধ উপস্থিতি কবিতার অবয়বকে উদ্ভাসিত করেছে, তেমনি রণনীতি ও রণকৌশলগত নানাবিধ বিষয়েরও উপস্থিতি লক্ষ করা যায় এসব কবিতায়। আমাদের কবিরা অনেকেই গেরিলা শব্দকে কবিতায় উচ্চকিত করেছেন নানা মাত্রায়।

গেরিলা শব্দের উপস্থিতি মুক্তিযুদ্ধের কবিতার অন্যতম গৌরব ও শৈল্পিক দিক। গেরিলারা এমনই এক রহস্যময় আলো-আঁধারের মানুষ, যা আমাদের নান্দিক চেতনায় এক অপূর্ব চিত্রকল্পের অবতারণা করে। গেরিলা আতঙ্ক যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মনোবল ভেঙে দিয়েছিল। গেরিলা নিয়ে তাদের মনে নানা জল্পনা-কল্পনা ও উদ্ভট চিন্তাভাবনারও উন্মেষ ঘটেছিল। তারা রাস্তাঘাটে নানা জায়গায় লোকজনকে জিজ্ঞাসা করেছে, গেরিলারা কোথায় থাকে, দেখতে কেমন এবং গেরিলা সন্দেহে তারা এ দেশের বহু নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে। গেরিলাযুদ্ধে গেরিলারা সফল অপারেশন চালিয়েছেন প্রায় সময়ই। গেরিলার রহস্য ও নানাবিধ পদচারণের কথা এসেছে শামসুর রাহমানের কবিতায়:

দেখতে কেমন তুমি? কী রকম পোশাক–আশাক
পরে কর চলাফেরা? মাথায় আছে কি জটাজাল?
... ... ...
পাজামা কামিজ পরে মগডালে শিস দাও
পাখির মতোই কিংবা চা-খানায় বসো ছায়াচ্ছন্ন?
... ... ...
তোমার সন্ধানে ঘোরে
ঝানু গুপ্তচর, সৈন্য পাড়ায় পাড়ায়। তন্ন তন্ন করে খোঁজে প্রতি ঘর।
তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছ হাত ধরে পরস্পর
সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ তাড়ানিয়া
তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন, সন্তান আমার। 

(গেরিলা: বন্দী শিবির থেকে)

সৈয়দ শামসুল হকের ‘গেরিলা’ কবিতায় গেরিলা বাংলাদেশের ভূগোল পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর নানা দেশের মুক্তিসংগ্রামীর অনন্য ভূমিকায়:

অবিরাম
দক্ষিণ ভিয়েতনাম
কম্বোডিয়া
বাংলাদেশ
অ্যাংগোলায়
মোজাম্বিকে তুমি
যেন তুমি আমাদেরই দ্বিতীয়
শরীর কোনো এক রবীন্দ্রনাথের
গান সমস্ত কিছুর কেন্দ্রেই আছো
এবং ধ্বনিত করছো দুঃখের পাহাড়
আফ্রিকার এশিয়ার। 

শিকদার আমিনুল হকের কবিতায় গেরিলার আত্মবিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকার কথা পাই:

স্বাধীনতা আমি তোমার জন্যে
এই জতুগৃহে ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট আর
খাকিদের প্রকাশ্য দৌরাত্ম্যের নিচে।
গেরিলার আত্মবিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছি। 

(এক এক দগ্ধ দিন)

কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতায় দেখা যায় বুলেটবিদ্ধ গেরিলার মুখ, যাঁর সারা শরীরে ছড়িয়ে আছে সমুদ্রতরঙ্গ:

অস্তমিত সূর্যকন্যা হঠাৎ কঁকাতেই দেখি
বুলেটপ্রবিষ্ট এক গেরিলার মুখ
জন্মের তোরণে এসে যার সাথে দেখা হয়েছিল
সমুদ্রতরঙ্গ ছিল যার সারা গায়।

(একবার পরাজিত হলে)

অসীম সাহার ‘ন্যায়যুদ্ধ’ কবিতায় দেখা যায় গণমানুষের যুদ্ধ প্রস্তুতি:

অস্তমিত সূর্যকন্যা হঠাৎ কঁকাতেই দেখি
বুলেটপ্রবিষ্ট এক গেরিলার মুখ
জন্মের তোরণে এসে যার সাথে দেখা হয়েছিল
সমুদ্রতরঙ্গ ছিল যার সারা গায়।

‘স্মৃতি জাগানিয়া পদ্য’ কবিতায় রুবী রহমান সেই সব গেরিলার কথা বলেছেন, যাঁদের রক্তঋণের কথা ভুলে গেছে মুক্ত স্বদেশ, যাঁদের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতার লাল সূর্য উদিত হয়েছিল, সেই তরুণ বীর যোদ্ধাদের কথা কি স্বাধীনতা ভুলে গেছে? কবি এই প্রশ্ন তুলেছেন এভাবে:

তোমার জন্য লক্ষ তরুণ রক্তের বীজ বুনে রেখে গেছে
স্বাধীনতা তুমি ভুলেছ সে কথা।
একটি যুবক বুকের পাঁজরে স্বপ্নের মতো রেখেছে গ্রেনেড
স্বাধীনতা তুমি ভুলেছ সে কথা।
... ...
অগ্নিসাক্ষী নিজ হাতে শিরা–উপশিরা ছিঁড়ে গাঢ় জল দিল
তোমার শিকড়ে মুগ্ধ গেরিলা।

যুদ্ধকালীন স্বদেশের এক বিরান-শূন্য-থমথমে প্রতিবেশের চিত্র এঁকেছেন রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর ‘হাড়েরও ঘরখানি’ কবিতায়। সেই নৈঃশব্দ্য অন্ধকারে গেরিলাদের তিনি আলোর সঙ্গে তুলনা করেছেন:

গেরামের পর গেরাম উজাড় উঠোনে উঠেছে ঘাস,
হাইতনের পরে মরে পড়ে আছে পালিত বিড়ালছানা,
কেউ নেই, শুধু তেমাথায় একা ব্যথিত কুকুর কাঁদে।
আর রাত্রির কালো মাটি খুঁড়ে আলোর গেরিলা আসে।’ 

কবি ছৈয়দ হায়দারের কবিতায় গেরিলা ও প্রকৃতি মিশে গেছে এক অনন্য রহস্যময়তায়। প্রকৃতির আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে অমিত সাহস ও শক্তির সন্ধান পেয়েছে এই সব যোদ্ধা। প্রকৃতি তাঁদের যেমন রক্ষা করেছে, তেমনি শিখিয়েছে শত্রুহননের কৌশল। তাই এই কবিতায় গেরিলারা প্রকৃতির সন্তান হয়ে উঠেছে:

রাত অন্ধকার মেলে শেখায় গেরিলা কুশলতা
...অরণ্য আশ্রয় দেয়
জোনাকিরা দেখাতে লাগল পথ, শত্রুর আস্তানা
বোনকে নিয়েছে ধরে পাকিস্তানি শয়তান, ‘জানোয়ার’
বলে চিৎকার করে পুকুরের সমবেত হাঁস
গেরিলা যোদ্ধার মাথা ঢেকে রাখে ফুটন্ত শাপলা।

(একত্র নদীরা চলে)।

যুদ্ধদিনের কষ্ট ও স্বপ্নের কথা, গেরিলাদের আক্রমণ, শত্রুদের পালানোর দৃশ্য ভেসে ওঠে খালেদা এদিব চৌধুরীর কবিতায়:

যুদ্ধ হচ্ছে—তীব্র এক যুদ্ধ চলছে গেরিলাদের আক্রমণ
প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছে হানাদারদের দল
... ...
আমরা এখন ঘোড়াশাল সার কারখানার রেস্টহাউসে
কিন্তু এখানেও জ্বলছে আগুন দাউ দাউ জ্বলছে
যেন হিরোশিমা আর এক নাগাসাকি
হয়ে যাচ্ছে জনপদ, ধসে পড়ছে জীবন
বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে কী যে হাহাকার
বুলেটবিদ্ধ লাশ, মানুষের চিৎকার
কবরের স্তব্ধতায় হিম শীতল হয়ে যাচ্ছে সব
হানাদারদের হিংস্র নখর ছিঁড়ে খাচ্ছে জীবন
সব ভেঙেচুরে যাচ্ছে—

(একাত্তরের দিন: স্বপ্ন এবং কষ্ট)।

মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁদের সুস্থ ও সাবলীলভাবে, সগর্বে বেঁচে থাকার সুযোগ দিতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না তাঁদের ত্যাগ ও দেশপ্রেমের সেই অনন্য গাথা। মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকথার মধ্যে উঠে এলে মুক্তিযুদ্ধের পরের প্রজন্ম উপকৃত হবে।