গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

জাপানি আলোকচিত্রী

ইচিনোসে তাইজোর বাংলাদেশ

আজ থেকে প্রায় ২২ বছর আগে ২০০৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত প্রথম আলোর বিশেষ আয়োজনে জাপানি আলোকচিত্রী তাইজো ইচিনোসেকে নিয়ে মনজুরুল হকের এই লেখাটি প্রথম ছাপা হয়েছিল। আমাদের বহু মূল্যবান লেখা শুধু মুদ্রণের পাতায় রয়ে গেছে; তেমনি একটি এই ‘ইচিনোসে তাইজোর বাংলাদেশ’। তবে দীর্ঘদিন কেবল ছাপার পাতায় সীমাবদ্ধ থাকা এই লেখা বিজয়ের মাসে অনলাইনে উঠে এল নতুন পাঠকদের সামনে।

বিজয় দিবস ও মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে অনলাইনপূর্ব যুগে যত লেখা, সাক্ষাৎকার, স্মৃতিচারণ ও কবিতা ছাপা হয়েছিল, বিজয়ের পুরো মাসজুড়ে সেসব ধুলোঝরা পৃষ্ঠা আমরা প্রথমবারের মতো অনলাইনে তুলে আনছি।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ছবি তুলতে ১৯৭২ সালে ঢাকায় আসেন তাইজো ইচিনোসে। ২৫ বছর বয়সী এই জাপানি আলোকচিত্রী পথে পথে ঘুরে ধারণ করেন দুই শতাধিক আলোকচিত্র। কোনোটা রঙিন, কোনোটা সাদাকালো। পরের বছরই কম্বোডিয়ায় রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান তাইজো। তাঁর তোলা সেসব ছবি আড়ালেই থেকে যায়। গত বছর (২০২৪) জুলাই মাসে আলোকচিত্রগুলো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাছে হস্তান্তর করে তাইজো পরিবার। জাদুঘরের গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়েছে সেসব ছবি।

১৯৭৩ সালের নভেম্বর মাসে কম্বোডিয়ার আঙ্করওয়াট থেকে হারিয়ে যায় ২৬ বছরের প্রাণবন্ত জাপানি তরুণ ইচিনোসে তাইজো। সত্তরের দশকের শুরুর দিকের যুদ্ধবিধ্বস্ত এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে মানুষের মর্মন্তুদ ছবি ক্যামেরায় ধরে রাখার অদম্য বাসনা নিয়ে ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া থেকে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন এই আলোকচিত্রী। যুদ্ধের উত্তেজনা আর সংঘাতের ডামাডোলে ব্রেখটের ‘মাদার ক্যারেজ’-এর অসহায় কিছু চরিত্রের মতো বিপর্যস্ত মানুষের বিভিন্ন ছবি ক্যামেরাবন্দী করেছেন তাইজো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকায় ছাপা হয় তাঁর তোলা বেশ কিছু ছবি। সে সুবাদে ওই সময়ে তিনি সাংবাদিকতার জগতে কিছুটা পরিচিতি পেয়ে যান। যুদ্ধের মর্মান্তিক চিত্র তুলে ধরেছে—এ রকম বেশ কিছু ছবির জন্য প্রামাণ্য ফটোগ্রাফির একাধিক পুরস্কার পান তিনি।

১৯৭৩ সালের ১ নভেম্বর ২৬ বছরে পা দেওয়ার মাত্র কয়েক দিন পর কম্বোডিয়ায় এক বন্ধুর কাছে একটি চিরকুট লিখে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন তাইজো। চিরকুটে লেখা ছিল: পেতে রাখা কোনো মাইনের ওপর ভুলক্রমে পা পড়ে গেলে ঘরে ফিরে আসা আর না–ও হতে পারে। সেদিন বিধ্বংসী কোনো মাইনে তাঁর পা পড়েছিল কি না, আজ আর জানার উপায় নেই। কারণ, সেই যাত্রার পর তাইজো আর ফিরে আসেননি। আশ্চর্যজনকভাবে নিজের মর্মান্তিক ভবিষ্যৎ নিয়ে সঠিক পূর্বাভাস রেখে সেই যে গেলেন, তারপর আজ পর্যন্ত তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

ঘটনার প্রায় ১০ বছর পর পুত্রের ভাগ্যে ঠিক কী ঘটেছে, তা জানার জন্য কম্বোডিয়ায় গিয়ে উপস্থিত হন ইচিনোসের মা–বাবা। কম্বোডিয়ার যেসব শহর আর গ্রামে একদিন পদচারণ ছিল তাঁদের সন্তানের, সেসব জায়গা চষে বেড়িয়ে একসময় ঠিকই তাঁরা খুঁজে পান তাইজোর ভাঙা ক্যামেরা। সেই সূত্রে আরও কিছু তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে প্রথমবারের মতো তাঁর মা–বাবা নিশ্চিত হন, ছেলে আর জীবিত নেই। সন্তানের জন্য মা-বাবার অন্তর বিদীর্ণ হয়েছিল সন্দেহ নেই, তবু তাঁরা ভেঙে পড়েননি। বরং মানুষের দুর্দশার যে প্রামাণ্য দলিল ছেলে রেখে গেছেন, তা সংরক্ষণে নিজেদের নিবেদিত করার ব্রত নিয়ে কম্বোডিয়া থেকে জাপানে ফিরে আসেন তাঁরা।

ইচিনোসে তাইজো যে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি জাপানি সাংবাদিক নাওয়াকি উসুইয়ের কাছ থেকে। তবে কখন গিয়েছিলেন এবং কোন ধরনের ছবি তিনি তুলেছেন, সেসব বিস্তারিত তথ্য তখনো অজানা ছিল।

ইচিনোসে তাইজোর বৃদ্ধা মাতা এখন হুইলচেয়ারবন্দী। এখনো গভীর যত্নে তিনি সংরক্ষণ করছেন সন্তানের তোলা সব রকম ছবি। অসংখ্য ছবি তুলেছিলেন ইচিনোস। সেসব ছবি থেকে বাছাই কিছু ছবি, তাঁকে আর বন্ধুদের কাছে লেখা তাইজোর চিঠি মিলিয়ে একটি আত্মজীবনীমূলক বই লিখেছেন তিনি। বইটি কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর ইদানীং জাপানে আবারও আলোচিত হচ্ছেন ১৯৭৩ সালে কম্বোডিয়ায় হারিয়ে যাওয়া জাপানি তরুণ আলোকচিত্রশিল্পী ইচিনোসে তাইজো।

তাইজো ইচিনোসে

ইচিনোসে তাইজো যে একসময় বাংলাদেশে গিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে প্রথম আমি জানতে পারি ১৯৭১ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহে নিয়োজিত জাপানি সাংবাদিক নাওয়াকি উসুইয়ের কাছ থেকে। তবে কখন তিনি বাংলাদেশে গিয়েছিলেন এবং কোন ধরনের ছবি সেখানে তিনি তুলেছেন, সেসব বিস্তারিত তথ্য তখনো অজানা ছিল। কিছুদিন আগে বন্ধ সে দুয়ার খুলে দিয়েছেন তাইজোর বৃদ্ধ মা।

ইচিনোসে তাইজোকে নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছেন জাপানি পরিচালক তাকাকো নাকাজিমা। ছবিটির বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় গত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে টোকিওর বিদেশি সাংবাদিকদের প্রেসক্লাবে। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তাইজোর মাকে। তিনি তাঁর বক্তব্যে তাইজোর বাংলাদেশ ভ্রমণের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। সঙ্গে নিয়ে আসা বই খুলে গভীর মমতায় তিনি আমাকে দেখান বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে তোলা ইচিনোসে তাইজোর কিছু ছবি। বাংলাদেশের মানুষকে ক্ষণিকের দেখায় ভালোবেসেছিলেন তাইজো। এ দেশের মানুষের আনন্দ-বেদনার প্রামাণ্য দলিল রচনায় একসময় নিজেকে নিয়োজিত করেছিল ৩০ বছর আগের নভেম্বরের এক সকালে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া তাঁর পুত্র, সেই বাংলাদেশের এক প্রতিনিধিকে সামনে উপস্থিত দেখে হারানো ছেলেকে তাঁর নিঃসন্দেহে অনেক বেশি করে মনে পড়েছে।

অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তাইজোর মাকে। সঙ্গে নিয়ে আসা বই খুলে গভীর মমতায় তিনি আমাকে দেখান বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে তোলা ইচিনোসে তাইজোর কিছু ছবি।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর তরুণ এই জাপানি আলোকচিত্রী ঠিকই রাখছিলেন। ২৪ বছর বয়সে পেশাদার সংবাদ ফটোগ্রাফিতে হাতেখড়ি তাঁর। এরপর কিছুদিন ভিয়েতনামে কাটিয়ে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, কিন্তু অনুমতি না পাওয়ায় আর যাওয়া হয়নি। পরবর্তীকালে যখন ভারতে যান, তখন যুদ্ধ শেষ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটেছে। সদ্য শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে এসে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আর স্বাধীনতার উত্তাল আনন্দ দুটোই দেখেন তিনি এবং নিষ্ঠার সঙ্গে তার কিছু ছবি ক্যামেরাবন্দী করেন।

ইচিনোসে তাইজোর দেখা সেদিনের সেই বাংলাদেশে একদিকে যেমন দেখা যায় রাজপথে তারুণ্যের বাঁধভাঙা আনন্দের মিছিল, অন্যদিকে চোখে পড়ে রংপুরে হানাদারদের তৈরি বধ্যভূমি খুঁড়ে তুলে আনা মানুষের মাথার খুলি আর হাড় ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় মানুষজন। মনে গভীরভাবে দাগ কাটার মতো একটি ছবি হচ্ছে বিধ্বস্ত ভবনের রান্নাঘরে উনুনে হাঁড়ি চাপিয়ে বসে থাকা একাকী রমণী; ভাঙা জানালা দিয়ে আসা সূর্যের প্রখর আলো যেখানে তৈরি করেছে রহস্যঘেরা মায়াবী পরিবেশ। ছবিটা মনে করিয়ে দেয় অবরুদ্ধ মাতৃভূমিকে নিয়ে লেখা শামসুর রাহমানের অসাধারণ পঙ্‌ক্তি:

এখানে দরজা ছিল, দরজার ওপর মাধবী
লতার একান্ত শোভা। বারান্দায় টব, সাইকেল ছিল
তিন চাকা-অলা, সবুজ কথক একজন,
দাঁড়বন্দী। রান্নঘর থেকে উঠতো রেশমি ধোঁয়া।

তাইজোর মা যত্নের সঙ্গে সংগ্রহ করে রেখেছেন ছেলের তোলা এসব ছবি, যা আমাদের ইতিহাসের কঠিন এক সময়ের প্রামাণ্য দলিল। বাংলাদেশে এসব ছবির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা দরকার। এটা সম্ভব হলে একজন বিদেশি সুহৃদের চোখে ধৃত আমাদের অতীতের গৌরবময় অধ্যায়ের দিকে নতুনভাবে চোখ রাখার সুযোগ পাওয়া যাবে, পাশাপাশি বন্ধুপ্রতিম একটি দেশের অকৃত্রিম কিছু মানুষের পরিচয় দেরিতে হলেও আমাদের সামনে উন্মোচিত হবে। তাঁরা সেই সব দুর্লভ মানুষ, হৃদয়ে জেগে ওঠা উত্তাল তরঙ্গ যাঁদের প্ররোচিত করে মানুষের সুখ-দুঃখের গান গেয়ে বেড়াতে। তাঁরা জানেন, জীবন আর মৃত্যুর ব্যবধান খুব ক্ষীণ, তবু তাঁরা এগিয়ে যান এবং এ–ও জানেন নিশ্চিত, কীর্তি অবিনশ্বর।