
জাদুকর ছিলেন তিনি নিঃসন্দেহে। সে কি কেবলই কথার জাদুকর? শব্দের জাদুকর? নাকি জাদুকর বলতে সাধারণভাবে আমরা যা বুঝি, সেটাও? হ্যাঁ, ম্যাজিশিয়ান ছিলেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে লিখেছেন তাঁর দীর্ঘদিনের সহচর—প্রকাশক ও লেখক মাজহারুল ইসলাম
নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বহুমাত্রিক শিল্পস্রষ্টা। গল্প বলার ভাষা আর ভঙ্গিকে আরও সহজ, আরও জীবন্ত করেছেন তিনি। তাঁর লেখায় সাধারণ মানুষের হাসি-কান্না, স্বপ্ন-বাস্তবতা আর জীবনের টানাপোড়েন এমনভাবে ফুটে উঠেছে যে পাঠক মনে করে—এই গল্পগুলো যেন তাদেরই জীবন থেকে উঠে এসেছে।
হিমু, মিসির আলি, রূপা কিংবা শুভ্র—চরিত্রগুলো এখন কেবল সাহিত্যের পাতায় নয়, আমাদের জীবনেরও অংশ। হুমায়ূন আহমেদের লেখায় একদিকে যেমন আছে হাস্যরস ও প্রাণ, অন্যদিকে জীবনের নিঃসঙ্গতা, ভালোবাসা আর মায়া। তিনি দেখিয়েছেন—সহজভাবে লিখেও কীভাবে গভীরতাকে স্পর্শ করা যায়।
এ তো কেবল জাদুকরের পক্ষেই সম্ভব। মানুষকে এভাবে মোহাবিষ্ট করা। তাঁর হাতে ছিল জাদুর কলম!
শুধু গল্প-উপন্যাসে নয়; নাটক, চলচ্চিত্র কিংবা গান—সব ক্ষেত্রেই তাঁর সৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে মানুষের জীবন, সম্পর্ক আর সৌন্দর্য।
তিনি ছিলেন এমন এক লেখক, যিনি নিঃশব্দে জায়গা করে নিয়েছিলেন পাঠকের হৃদয়ে। সময় পেরিয়ে গেছে, কিন্তু তাঁর গল্পগুলো এখনো আমাদের জীবনের সঙ্গে মিশে আছে—যেন প্রতিদিনের কথোপকথনে, ভেতরের নিঃসঙ্গতায়, বা হঠাৎ কোনো ম্লান সন্ধ্যায় তাঁর শব্দগুলো ফিরে আসে। তাঁর লেখার সহজতা, মায়া আর মানবিক উষ্ণতা আজও আমাদের ছুঁয়ে যায় নিঃশব্দে। হুমায়ূন আহমেদ নিছক একজন লেখক নন—তিনি আমাদের অনুভবের অন্তহীন অনুরণন, যা শুধু হ্যামিলিনের সেই জাদুকর-বংশীবাদকের পক্ষেই সম্ভব।
জাদুকর ছিলেন তিনি নিঃসন্দেহে। সে কি কেবলই কথার জাদুকর? শব্দের জাদুকর? নাকি জাদুকর বলতে সাধারণভাবে আমরা যা বুঝি, সেটাও?
হ্যাঁ, ম্যাজিশিয়ান ছিলেন তিনি।
তাঁর চরিত্রগুলো এখন কেবল সাহিত্যের পাতায় নয়, আমাদের জীবনেরও অংশ। হুমায়ূন আহমেদের লেখায় একদিকে যেমন আছে হাস্যরস ও প্রাণ, অন্যদিকে জীবনের নিঃসঙ্গতা, ভালোবাসা আর মায়া। তিনি দেখিয়েছেন—সহজভাবে লিখেও কীভাবে গভীরতাকে স্পর্শ করা যায়।
শৈশব-কৈশোর থেকেই ম্যাজিকের প্রতি ছিল হুমায়ূন আহমেদের দুর্বলতা। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় থেকেই তিনি জাদুর চর্চা শুরু করেন। প্রায়ই আত্মীয়স্বজন-বন্ধুদের জাদু দেখিয়ে মুগ্ধ করতেন। পরবর্তীকালে, ১৯৬৮ সালে, তিনি তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে প্রথম জাদু দেখান—অর্থাৎ লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগেই তাঁর পরিচিতি তৈরি হয় ‘ম্যাজিশিয়ান হুমায়ূন’ হিসেবে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জাদুশিল্পী জুয়েল আইচকে ভীষণ ভালোবাসতেন হুমায়ূন আহমেদ। একই রকম জুয়েল আইচও ভালোবাসেন তাঁকে। জাদুবিদ্যায় তাঁর হাত পাকানোর পেছনে জুয়েল আইচের অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বিশ্বের বৃহত্তম জাদুশিল্পী সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যাজিশিয়ানস’ (আইবিএম)-এর সম্মানিত সদস্য, আর এই সদস্যপদ প্রাপ্তিতে জুয়েল আইচ তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন।
জুয়েল আইচ প্রায়ই বলতেন, ক্লোজআপ ম্যাজিকের ক্ষেত্রে হুমায়ূন ভাই অসাধারণ পারদর্শী—বিশেষ করে ‘পামিং’য়ে তাঁর দক্ষতা অবিশ্বাস্য।
হুমায়ূন আহমেদ হাতের তালুতে একটি কয়েন রেখে মুহূর্তের মধ্যেই সেটাকে অদৃশ্য করে দিতেন, তারপর সেই কয়েনটি বের করে আনতেন সামনে বসা কারও মাথার চুল বা কানের ভেতর থেকে।
আরেকটি জনপ্রিয় ম্যাজিক ছিল—কেউ একজন হাত মুঠো করে রাখলে, হুমায়ূন আহমেদ সিগারেটের ছাই নিয়ে সেই মুষ্টিবদ্ধ হাতের ওপর রাখতেন এবং আঙুল দিয়ে ঘষে মিলিয়ে দিতেন। তারপর যখন হাত খোলা হতো, দেখা যেত ছাইটি আশ্চর্যভাবে লেগে আছে হাতের তালুতে!
তাসের বিভিন্ন ম্যাজিকেও তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। ঘরোয়া আড্ডায়, প্রিয়জনদের সামনে এসব জাদু দেখিয়ে তিনি মুহূর্তেই তৈরি করতেন এক মোহময় পরিবেশ—যেখানে বাস্তব আর কল্পনা মিলেমিশে যেত এক অপূর্ব মায়ায়।
২০০১ সালে আমরা একসঙ্গে আমেরিকায় যাই—এটাই ছিল আমার প্রথম আমেরিকা ভ্রমণ। পরিকল্পনা ছিল নিউইয়র্ক হয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস যাওয়ার। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ লস অ্যাঞ্জেলেস যাওয়ার আগের দিন হঠাৎ বললেন, তিনি দেশে ফিরে যাবেন। কারণ, তাঁর নতুন আলু দিয়ে রান্না করা দেশি কই মাছের ঝোল খেতে ইচ্ছে করছে! অনেক বোঝানোর পরও কোনোভাবেই তাঁকে আটকানো গেল না। শেষ পর্যন্ত টিকিট পরিবর্তন করে পরদিনই তিনি ঢাকার ফ্লাইটে উঠলেন।
প্রায়ই আত্মীয়স্বজন-বন্ধুদের জাদু দেখিয়ে মুগ্ধ করতেন। পরবর্তীকালে, ১৯৬৮ সালে, তিনি তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে প্রথম জাদু দেখান—অর্থাৎ লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগেই তাঁর পরিচিতি তৈরি হয় ‘ম্যাজিশিয়ান হুমায়ূন’ হিসেবে।
একই দিনে আমি, কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, বন্ধু কমলসহ আরও কয়েকজন লস অ্যাঞ্জেলেসের পথে রওনা হলাম। ফেরার সময় আমি বেশ কিছু জাদু দেখানোর সরঞ্জাম কিনে আনলাম। হুমায়ূন আহমেদ সেসব দেখে দারুণ খুশি হলেন। এরপর থেকে বিদেশে গেলেই জাদুর সরঞ্জাম কিনে আনতাম। উনি নিজেও বিদেশ থেকে জাদু দেখানোর জিনিসপত্র আনতেন। আমি দেশের বাইরে গেলে বলতেন, সস্তার জিনিস আনবে না। ভালো জিনিস আনবে।
একটা স্টিলের ট্রাংকে রাখা হতো হুমায়ূন আহমেদের সব জাদুর সরঞ্জাম। মজা করে হুমায়ূন আহমেদ এবং আমার নামের আদ্যক্ষর মিলিয়ে আমাদের ম্যাজিক কোম্পানির একটা নাম রাখা হলো—‘এইচএম ম্যাজিশিয়ান কোম্পানি’। ‘দখিন হাওয়া’ বা নুহাশপল্লীতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো অতিথি এলেই ‘এইচএম ম্যাজিশিয়ান কোম্পানি’ জাদু দেখাত। অবশ্য জাদু দেখাতেন মূলত তিনিই, আমি থাকতাম তাঁর সহকারী হিসেবে—এক অনন্য আনন্দের অংশ হয়ে।
নতুন কোনো জাদু শিখলেই হুমায়ূন আহমেদ বলতেন, মাজহার, জুয়েল আইচকে খবর দাও।
তিনি জাদু দেখাতেন, আর জুয়েল আইচ দর্শক হিসেবে সেই জাদু দেখে মুগ্ধ হতেন। জুয়েলদা কখনো বুঝতে দিতেন না যে এটা তাঁর কাছে নতুন কিছু নয়—বরং নীরবে উপভোগ করতেন হুমায়ূন আহমেদের আনন্দ। এদিকে হুমায়ূন আহমেদের চোখেমুখে তখন অপার উচ্ছ্বাস—তিনি জুয়েল আইচকে জাদু দেখিয়ে যেন শিশুর মতো খুশি হয়ে যেতেন। এরপর দেখা যেত, একই জাদু জুয়েল আইচ আরও বড় পরিসরে, আরও নিখুঁতভাবে করে হুমায়ূন আহমেদকে অবাক করে দিতেন। এভাবেই চলত তাঁদের জাদুর খেলা—প্রশংসা আর আনন্দের মিশেল। একজন দেখাতেন, আরেকজন মুগ্ধ হতেন।
আমাদের কনিষ্ঠ পুত্র অন্বয়ের প্রথম জন্মদিন ২০০৭ সালের ৫ জুন। আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানানো হলো ‘দখিন হাওয়া’য়। নিজেরাই বেলুন লাগিয়ে সাজসজ্জা করা হচ্ছিল। সব মিলিয়ে অতিথি ছিলেন প্রায় ৫০ জন। দুপুরে হুমায়ূন আহমেদ আমাকে ডেকে বললেন, অন্বয়ের জন্মদিনে তিনি অতিথিদের জন্য জাদু দেখাবেন, আমি যেন প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করি। আনন্দে আমার চোখ ভিজে এল—এ যেন স্বর্ণা আর আমার জন্য এক বিশাল সারপ্রাইজ!
মেকআপম্যান খলিল হুমায়ূন আহমেদের অ্যাপার্টমেন্টে হাজির। অবাক হয়ে এগিয়ে গিয়ে বললাম, আজ তো কোনো নাটকের শুটিং নেই, তাহলে আপনি কেন? কিছুক্ষণের মধ্যেই জানলাম, হুমায়ূন আহমেদ তাঁকে খবর দিয়ে এনেছেন—কারণ তিনি জাদু দেখানোর আগে মেকআপ নেবেন।
সন্ধ্যার কিছু আগে দেখি মেকআপম্যান খলিল হুমায়ূন আহমেদের অ্যাপার্টমেন্টে হাজির। অবাক হয়ে এগিয়ে গিয়ে বললাম, আজ তো কোনো নাটকের শুটিং নেই, তাহলে আপনি কেন?
খলিল ভাই বললেন, স্যার ডেকেছেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জানলাম, হুমায়ূন আহমেদ তাঁকে খবর দিয়ে এনেছেন—কারণ তিনি জাদু দেখানোর আগে মেকআপ নেবেন।
সন্ধ্যার পর একে একে অতিথিরা আসতে শুরু করলেন। হুমায়ূন আহমেদ জাদু দেখাবেন শুনে সবার মধ্যে একধরনের উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ল। সবাই অপেক্ষা করছিলেন, কখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসবে। একপর্যায়ে হুমায়ূন আহমেদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আমি ঘোষণা দিলাম—
‘এখন আপনাদের সামনে জাদু দেখাবেন সুদূর চীন থেকে আগত বিখ্যাত জাদুশিল্পী চ্যাং ম্যাং উন, এবং তাঁকে সহযোগিতা করবেন তাঁর স্ত্রী আন কুন শিং।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই হুমায়ূন আহমেদ হাজির হলেন। মাথায় লম্বা পরচুলা, মুখে মেকআপ, পাকানো গোঁফ, আর গায়ে চাইনিজ রাজাদের মতো নাইটগাউন ধরনের পোশাক। কিছুদিন আগে আমরা বেইজিং গিয়েছিলাম—সেই সফর থেকেই কেনা হয়েছিল এই পোশাকগুলো। হুমায়ূন আহমেদের সহ-জাদুশিল্পী হিসেবে সেদিন ছিলেন মেহের আফরোজ শাওন।
উপস্থিত সবাই করতালির মধ্য দিয়ে স্বাগত জানালেন এই অভিনব অতিথি জাদুশিল্পী দম্পতিকে। শুরু হলো একের পর এক জাদু প্রদর্শন। কেউ বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে আছে, কেউ হেসে উঠছে মুগ্ধতায়। অন্বয়ের জন্মদিন হয়ে উঠল রঙিন। আর যাকে ঘিরে পুরো আয়োজন, সেই ছোট্ট অন্বয় বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে হুমায়ূন আহমেদের দিকে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ভয় পেয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। অবশেষে শেষ হলো চাইনিজ জাদুশিল্পী চ্যাং ম্যাং উন ওরফে হুমায়ূন আহমেদের সেই ম্যাজিক শো—যা আজও আমাদের জন্য এক অনবদ্য, মায়াময় স্মৃতি হয়ে আছে।
হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন এক অসাধারণ প্রাণবন্ত মানুষ—জীবনকে তিনি উপভোগ করতেন গভীর রসবোধে, এক শিশুসুলভ কৌতূহল নিয়ে। মানুষকে মুগ্ধ করতে ভালোবাসতেন, আর সেটা করতেন একেবারে সহজভাবে, যেন কোনো জাদু দেখাচ্ছেন। মুহূর্তের মধ্যেই কাউকে চমকে দিতে পারতেন—তাঁর রসিকতায়, হঠাৎ বলা কোনো গল্পে, কিংবা সেই সহজ সরল আনন্দে, যা ছিল তাঁর স্বভাবেরই অংশ।
তাঁর মধ্যে ছিল এক অপার প্রাণচাঞ্চল্য—একধরনের উচ্ছ্বাস ও হাস্যরস, যা আশপাশের মানুষদেরও আনন্দে ভরিয়ে দিত। তাঁর সঙ্গে সময় কাটানো মানেই ছিল আনন্দময় অভিজ্ঞতা। কখনো নীরব থেকে হঠাৎ এমন কিছু বলতেন, যা পুরো ঘরকে হাসির রোলে ভাসিয়ে দিত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, ‘হুমায়ূনের কথাগুলো লিখে রাখো—এসব একদিন “হুমায়ূন-কথামালা” হয়ে থাকবে।’
প্রকৃতই হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন জাদুশিল্পী। তাঁর সৃষ্টির জাদুতে মোহাবিষ্ট করে রেখেছেন আমাদের; তাঁর লাখো পাঠককে। এই মোহ, এই ঘোর কখনো ম্লান হবে না, বরং বাড়বে দিন-দিনান্তরে।