কিছুই করা হয়নি। বেড়াতাম। এখন বাসায়ই থাকি। লিখতাম। ভাষা খুঁজে পাই না। চাকরি করতাম। হারিয়েছি। রাজনীতি নিয়ে ভাবতাম। ভাবি না। স্বপ্ন দেখতাম। ঘুম হয় না আজকাল।
একা একা থাকি। ভাগ্যিস আব্বাজান চারতলা বাসা রেখে মারা গেছেন। বাসাভাড়া দিয়েই চলে জীবনযাপন।
সারা দিন বাসায় কাটে। সন্ধ্যার পর কোনো কোনো দিন বের হই। উদ্দেশ্যহীন। হাঁটি। মানুষের ভিড়ে।
একদিন দেখা হয় তুলির সঙ্গে। মৌচাক মার্কেটের সামনে।
জানায়, তার লিভারে ক্যানসার। ১১ দফা ইন্ডিয়ায় গিয়ে কেমোথেরাপি দিয়েছে। মাথার চুল ছোট। রং পুড়েছে। বাসার ঠিকানা দিয়ে বলে একদিন বেড়াতে যেতে।
যাই না। এর দু মাস পর আবার দেখা তুলির সঙ্গে। হাইকোর্টের মাজারের সামনে, মানুষের ভিড়ে। আমিই তাকে আগে দেখেছিলাম। দেখে ফুটপাত পাল্টে অন্যদিকে পা বাড়াচ্ছিলাম। ডাকল।
বলল, মরে যাব, বাসায় যেয়ো।
মানুষের মৃত্যু নিয়ে একধরনের রোমান্টিকতা আছে। আমার পছন্দ না। তবু একদিন গেলাম তুলির বাসায়।
অসীম আকাশ এভাবে আস্তে আস্তে আমার সসীম মাথার ভেতর ঢুকতে থাকে। আমি চুলোয় পানি ফোটাতে দিয়েছি, গরম পানি দিয়ে গোসল করব বলে, দেখা গেল, পানি ফুটতে ফুটতে হাওয়া। সেই পানি মেঘ হলো। বৃষ্টি এল, ছাদে লুঙ্গি পরে খালি গায়ে ভিজি। ভাবি, আহা আমার চুলোয় ফোটানো পানি।
মানুষের জীবন আসলে কিছুই না—এ টাইপের কথাই বেশি শোনাল তুলি।
তার তিন মাস পর তুলি মারা গেল। আমার মনের রোগ দেখা দিল এরপরই।
কমোডে বসে ভয়ে ভয়ে দেখি পায়ুপথে আমার রক্ত বেরোচ্ছে কি না, দেখি প্রতিদিন।
একবার নয়, কয়েকবার। কমোডে বসার পরিস্থিতি না হলেও বসে থাকি। আবার বাথরুমে যেতেও ভয় পাই।
মৃত্যু নিয়ে রোমান্টিকতা একদম আমার পছন্দ না। কিন্তু আমি রোমান্টিক হয়ে উঠতে থাকি। মৃত্যুবিষয়ক যেখানে যা পাই পড়ি, গান শুনি।
অসীম আকাশ এভাবে আস্তে আস্তে আমার সসীম মাথার ভেতর ঢুকতে থাকে। আমি চুলোয় পানি ফোটাতে দিয়েছি, গরম পানি দিয়ে গোসল করব বলে, দেখা গেল, পানি ফুটতে ফুটতে হাওয়া। সেই পানি মেঘ হলো। বৃষ্টি এল, ছাদে লুঙ্গি পরে খালি গায়ে ভিজি। ভাবি, আহা আমার চুলোয় ফোটানো পানি।
এক বিকেলে ঘুম ভাঙলে কফির মগ নিয়ে বারান্দায় বসেছি। হঠাৎ মনে হলো, কনকনে হাওয়া টের পাচ্ছি, কিন্তু দেখতে পাই না কেন? রাতে একা বাসায় ভয় পেতে শুরু করলাম।
কমলাপুর স্টেশনে তিন রাত পার করলাম। তারপর গ্রামের বাড়ি থেকে এক বুড়োলোককে আনালাম আমার সঙ্গে থাকার জন্য।
আমারও মনে ঘুরপাক খেতে থাকে সব সময়, তুলির মতো আমিও একদিন মরে যাব। আমি আমার পরিচিত মৃতদের মনে রাখিনি, জীবিতরাও আমায় মনে রাখবে কেন?
আমার মনে পড়তে থাকে বিদিশার মুখ। আমার মেয়ে। লন্ডনে থাকে। পড়তে গিয়ে স্থায়ী হয়েছে সেখানে। আমার মনে পড়তে থাকে রোমেনার মুখ। আমার বউ ছিল। সংসার টেকেনি।
আমার শৈশবের বন্ধুদের কারও কারও মুখ মনে পড়ে। কিন্তু কাউকে মনে পড়ুক, আমি চাই না। শেষমেশ এলিফ্যান্ট রোডে মনোরোগ চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করলাম। মনে পড়ে, রাতে সব রোগী দেখার পর আমায় তাঁর সামনে ডাকা হয়েছিল। রাত ৯টা ২২ মিনিটে। মনে আছে সব। অনেক কিছু জানতে চাইলেন। বললাম। তিনি একা না থাকার এবং যেকোনো কাজে ব্যস্ত থাকার পরামর্শ ও কিছু ওষুধ দিলেন।
একদিন রাতে বসে আছি ফেসবুকের সামনে। কারও ওয়াল দেখছিলাম হয়তোবা। হঠাৎ মনিটরের নিচের দিকে ডান কোণে একটা সবুজ সিগন্যাল জ্বলে উঠতে দেখি, সঙ্গে সঙ্গে একটা ছোট বক্স ভেসে ওঠে। অরিন রহমান নামের একজন বলে, হাই। জবাব দিই, হুম। ‘হুম কী?’ ‘ ঘুম।’
আমি ফুটপাতে, রেলস্টেশনে, পার্কে, নাগরিক জ্যামে মানুষের পাশাপাশি হাঁটি। তারা কী নিয়ে মশগুল বোঝার চেষ্টা করি, তাদের সঙ্গ এভাবে নিতে যাই। দেখি সবই পুরোনো আলাপ। বাজার-সংসার-ক্যারিয়ার সব একাকার। রাত হলে গোলাপি রঙের ল্যাক্সোটানিল। আধো ঘুম আধো জেগে থাকা। এভাবেই যাচ্ছিল দিবারাত্রি।
একদিন আমাকে একজন ফেসবুকের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দিল। আইডি করলাম। প্রোফাইল লিখলাম। কিছু পুরোনো ছবি আপলোড করলাম। কিছু বন্ধু জুটল। ফেসবুকের খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো রপ্ত করতে বেশ কিছুদিন লেগে গেল। এবার একটা স্ট্যাটাস লিখতে হয়, শেয়ার করতে হয়। কী লিখব কিছুই খুঁজে পাই না। বন্ধুদের স্ট্যাটাস পড়ি। কত কিছু নিয়ে যে তারা মেতে থাকে। আহা, আমি যদি তাদের মতো মেতে থাকতে পারতাম।
একদিন রাতে বসে আছি ফেসবুকের সামনে। কারও ওয়াল দেখছিলাম হয়তোবা। হঠাৎ মনিটরের নিচের দিকে ডান কোণে একটা সবুজ সিগন্যাল জ্বলে উঠতে দেখি, সঙ্গে সঙ্গে একটা ছোট বক্স ভেসে ওঠে। অরিন রহমান নামের একজন বলে, হাই।
জবাব দিই, হুম।
হুম কী?
ঘুম।
ঘুম পেয়েছে তোমার?
না।
আমার এখানে এখন ভরদুপুর। তোমার তো বেশ রাত। জেগে আছ যে—
??????
??????
কী, ব্যস্ত?
না।
কী করো তুমি?
আমার হঠাৎ কী মনে হলো, ভাবলাম একটু ভয় দেখাই, উদ্ভট কথা বলি।
টেক্সট পাঠাই—তুমি কি জানো তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ?
কে?
কেউ না।
হিহিহিহি, ওসব পুরোনো স্টাইলে আলাপ মেয়ে পটানোর?
যার সঙ্গে কথা বলছ, তিনি জীবিত অথবা মৃত।
রবীন্দ্রনাথ?
মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা। ইচ্ছা করছে না যেতে। তবু গেলাম। সন্ধেয়। ভিড় বেশি নেই। ডাক্তার জানতে চাইলেন, আমার মধ্যে আত্মহত্যা করার ইচ্ছা জাগে কি না। বললাম, খুব জাগে আজকাল। কিন্তু ওটি কখনোই করব না। ডাক্তার বললেন, ধর্মীয় মূল্যবোধ আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে।
তারপর অফলাইনে চলে গেলাম। অরিন রহমানের ইনফো, প্রোফাইল, অ্যালবাম কিছুই দেখলাম না। আগ্রহ কাজ করল না। শেষ রাত। ঘুমানো দরকার। ঘুমঘুমঘুম। তুলিকে মনে পড়ল। শেষের দিকের অসুস্থ তুলি নয়। সুস্থ তুলির সুন্দর শরীর। অ্যাডাল্ট সাইটে সার্চ দিলাম। তুলিকে খুঁজলাম ওই সব মুখগুলোয়। ডুবসাঁতারের নেশায় পেয়ে বসল। তুলি মারা গেছে। তাতে কি, আমি তুলিকে নিয়েই ডুবসাঁতারে মেতে উঠলাম। এই রোগের কী জানি একটা নাম আছে।
পরদিন তুলিকে নিয়ে রাতের ওই ব্যাপারটা মনে পড়তে একটু অস্বস্তি। ধেৎ, নৈতিকতা। দুপুরের পর দুই ভাড়াটে ভাড়া দিয়ে গেল। মাসের প্রথম উইক।
মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা। ইচ্ছা করছে না যেতে। তবু গেলাম। সন্ধেয়। ভিড় বেশি নেই। ডাক্তার জানতে চাইলেন, আমার মধ্যে আত্মহত্যা করার ইচ্ছা জাগে কি না। বললাম, খুব জাগে আজকাল। কিন্তু ওটি কখনোই করব না।
ডাক্তার বললেন, ধর্মীয় মূল্যবোধ আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে।
না হেসে পারলাম না তাঁর কথায়। হাসার কারণ জানতে চাইলে বললাম, আমার মতো মানুষ আর কয়জন সুইসাইড করে, অন্য রকম মানুষেরাই বেশি করে।
তিনিও এবার হাসলেন। আমি বললাম, আমি সুইসাইড করব না, কারণ আমার কাছে আমার লাইফ মিনিংলেস। সুইসাইড করলে মিনিংফুল হয়ে যাবে।
তিনি এ কথায় কী বুঝলেন তিনিই জানেন, আমাকে দুটো ওষুধ বদলে দিয়ে বিদায় দিলেন।