অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

গল্প

সবুজ চশমা

মধ্য ফাল্গুনের সকালে তিরের ফলাসদৃশ তেরছা রোদ এসে জানালার পাশের বুড়ো অশ্বত্থের নোয়ানো শাখার কচি পাতাদের ওপরে ডানপিটে বালকের মতো লাফাচ্ছে। রোজকার মতোই বিছানা ছেড়ে, প্রাতকৃত্যের পরে, চোখে জল ছিটিয়ে, জিলেটের নতুন রেজরে মুখের ঠেলে ওঠা শিশু ক্যাকটাসের কাঁটার মতো দাড়ি কামিয়ে, স্নান। অতঃপর আগরবাতি প্রজ্বালন। ঘর মরমি গন্ধে ভরে উঠলে একটা নরম সুতার কাপড়ে চশমা মুছতে মুছতে বসার ঘরের জানালার পাশের পুরোনো ডিভানে বসে বয়স্ক কচি পাতা আর রোদের নৃত্যানন্দে বিভোর হয়ে বুড়ো অশ্বত্থের প্রকাণ্ড শরীরের দিকে বড়শির মতো দৃষ্টি বিঁধিয়ে দিয়ে সময়ের অতলান্ত দিঘি থেকে অশ্বত্থের বয়স তুলে আনতে চায় যখন, তখন নিজের বয়সও একটা ধেড়ে কালবাউশ মাছের মতো তার মস্তিষ্কের শান্ত জলে ঘাই মারে—সত্তর পার হলো লেখক দেবরূপ স্যানালের। একসময়ের সমাদৃত রহস্যগল্প লেখক ঠাকুরদা অমিয়নাথ স্যানালের কাছে অনেকবার শোনা—ঠাকুরদার জন্মেরও অনেক আগে রায়গঞ্জ থেকে আনা ঠাকুরদার পিতৃদেব রঘু স্যানালের হাতে প্রোথিত সেই অশ্বত্থ–শিশুই আজকের এই প্রকাণ্ড মহিরুহ।

পাশের বাড়ির কালো মিশমিশে বিড়ালটা মুখে মাছের কাঁটা নিয়ে বাড়ির সীমানাপ্রাচীরের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেবরূপ স্যানালে চোখ বরাবর কিছুটা বিরাম নিল; কাঁটাটা মুখে সযত্নে ধরে রেখেই খুব মিহি স্বরে ম্যাও ডেকে আবার যাত্রামগ্ন হলে, চোখের সীমানা থেকে বিড়ালের ছায়া উধাও হতেই আবারও অশ্বত্থ শাখার কচিপাতার ওপরে রোদের বাহাদুরিই প্রত্যক্ষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দেবরূপ স্যানালের চশমায় যেন হঠাৎ কুয়াশা হাজির। ফাল্গুনের এই সকালে জানালা টপকিয়ে কুয়াশা!—অস্বস্তিতে পড়ে পরনের ফতুয়ার কাপড়ে চশমাটা মুছে চোখে দেওয়ার পরও ভারি আশ্চর্য—কেমন ধোঁয়াশা; যেন ঠাওর হলো—বিড়ালটা অতিকায় হয়ে সীমানাপ্রাচীরের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। চশমাটা আবারও মুছে চোখে তুলতেই এবার কিছুটা পরিষ্কার—একটা বালক, তেরো–চৌদ্দ বছরের বালক সীমানাপ্রাচীরের ওপরে বসে ছোট্ট একটা বস্তুকে কোলে জড়িয়ে মাথা নিচু করে আদর করছে, যেন তার কতকালের পোষা প্রিয় কোনো পাখি। চশমাটা আরও একবার মুছে নিয়ে সুনিশ্চিত হলো—প্রাচীরে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে একটা ছোট্ট কচ্ছপকে খুব আদর করছে বালকটা।

—কে গো তুমি। এতটুকুন কচ্ছপ কোথায় পেলে?

দেবরূপ স্যানালে কথায় খুব একটা কানখাড়া না করে কোলের ছোট্ট কচ্ছপটাকে আদরে চুইয়ে দিচ্ছে বালকটি, তার পেছনে অশ্বত্থের শাখায় কচি পাতা ও রোদ ক্রীড়ামোদী তখনো। আবারও খুব উৎসুক স্বরে জানতে চাইল দেবরূপ স্যানাল—তুমি কে গো? কোথায় বাড়ি?

—বাড়ি তো অনেক দূর। বালিয়াদিঘা।

এবার একটু মাথাটা উঁচু করল বালকটি।

—সে তো অনেক দূর। চার ঘণ্টা ট্রেনের পথ। আমার দাদুবাড়ি। বাবা তখন বালিয়াদিঘা কলেজের দর্শনের অধ্যাপক। আমি তো বালিয়াদিঘা স্কুলেই পড়েছি। তুমি কীভাবে এলে? কার সাথে? তোমার হাতের কচ্ছপের বাচ্চাটা কোথায় পেলে?

—এটা বাচ্চা নয়, মা কচ্ছপ।

—তাই। এতটুকুন! তা আবার মা কচ্ছপ!! তা তুমি কোথা থেকে এলে? এখানে কোথায় আছ?

—তুমি তো শুধু আমাকে ভুলেই যাও। এখন তো তোমার আরও বয়স—সব ভুলে যাচ্ছ। এবার তোমার যে নতুন বই বের হলো, সেখানে ‘সবুজ চশমা’ নামে একটা গল্প থাকার কথা ছিল। অথচ গল্পটা বাদেই বইটা বের হলো। আমিই সেই গল্পের চোখে কম দেখা বালক। একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় বনের ভেতরে নির্জন রেললাইন ধরে হেঁটে বাড়ি ফেরার সময় খেলাচ্ছলে আমার চশমাটা নিয়ে তুমি দ্রুতগতিতে উধাও হয়ে গেলে। তুমি জানতে আমি চোখে কম দেখি। তবু...তুমি তো খুব জেদি ছিলে। আমি কতবার ডাকলাম—দেবরূপ, দাঁড়াও, আমার চশমা দাও, আমাকে নিয়ে যাও, যদি ট্রেন চলে আসে। তোমার কোনো সাড়া পেলাম না আর। আমি অনেকক্ষণ একা হাঁটলাম, হঠাৎ ট্রেনের হুইসেল শুনে দ্রুত রেললাইন থেকে নামতে গিয়ে কিসে যেন পা আটকে পড়ে গেলাম।

—শানু। শান্তনু বিশ্বাস।

—হ্যাঁ শানু। তবে তোমার গল্পে আমার যে নামটা রেখেছ—সেই নামটা আমার বেশি পছন্দ—নোটন।

—নোটন, শানু...

—হ্যাঁ দেখো, কোন নামে এখন ডাকবে তুমি। তুমি ভুলেও অনেক কিছু ভুলে যাওনি। যতটুকু আমাকে বাঁচিয়ে রাখার, তুমিই তো বাঁচিয়ে রেখেছ। আর সবাই ভুলে গেছে।

—নোটন...না...শানু...তুমি কীভাবে জানলে গল্পটা বইয়ে ছাপা হয়নি। আমি নিজে ফাইনাল প্রুফ কেটে দিয়েছি প্রকাশককে। কী আশ্চর্য! বলছ বইয়ে ছাপা হয়নি!

হন্তদন্ত, বিদ্যুৎপদে পড়ার ঘরে গিয়ে বইয়ের তাক থেকে নতুন বইটা নামিয়ে বারকয়েক সূচিপত্রে চোখ বুলিয়ে ‘সবুজ চশমা’ নামের কোনো গল্পেরই সন্ধান না পেয়ে, বইয়ের ভেতরের সমস্ত পাতা খানাতল্লাশি করে বিফল হলে মুঠোফোনটা তুলে প্রকাশককে কল করল—অভীক, আমার ‘সবুজ চশমা’ গল্পটা বইতে ছাপেননি? আমি সারা বই খানাতল্লাশি করে হয়রান।

—এই নামে তো কোনো গল্প আপনার পাঠানো পাণ্ডুলিপিতে ছিল না।

—তাই। আমি তো ফাইনাল প্রুফেও গল্পটাকে সংশোধন করলাম। পাণ্ডুলিপিটার কপি আছে আপনার কাছে?

—এই যা, নেই তো দাদা। আমরা বছর শেষে সব পুরোনো কাগজপত্রের সঙ্গে বই হয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপির কপি বিক্রি করে দিয়েছি।

—পাড়ার মোড়ের একটা দোকান থেকে কম্পোজ করিয়ে আপনাকে পাণ্ডুলিপি মেইল করেছিলাম, দোকানটা উঠে গেছে কিছুদিন আগে। আমাকে একটা সিডি করে দিয়েছিল কম্পোজার ছেলেটা। কিন্তু তা আর খুঁজে পাব না, কোথায় রেখেছি! আপনার মেইলে...

—না, নেই। এত মেইল জমা হয়ে যায় দাদা। ছ’মাসান্তর ডিলিট না করে দিলে হয় না...

ফোন রেখে কেবিনেট, পুরোনো আলমারি, খাটের নিচের ধুলোর স্তূপ থেকে কান টেনে রাশি রাশি ফাইলপত্র বের করে ঘরের মাঝখানে জমা করল দেবরূপ স্যানাল। কত কত দিনের পুরোনো ধুলোমলিন কাগজপত্রের ভেতরে থেকে কিছুতেই ‘সবুজ চশমা’ গল্পটা খুঁজে বের করতে পারল না। সাধারণত দিস্তার নিউজপ্রিন্ট কাগজ ছাড়া গল্প লেখেনি কখনো, তবু ভেতরের ঘরের দেয়ালের তাকের ওপর থেকে রাশিকৃত ডায়েরি ও নোটবুক হর হর করে নামিয়ে গাদা করে, গল্পটার হদিস করতে না পারলেও স্মৃতিকে প্রতারণা করতে সুযোগ দেওয়ার আগেই তার মনে পড়ে যায়—এক প্রবল বৃষ্টির দিনে দোতলার ঘরের বারান্দায় বসে সম্পন্ন হয়েছিল লেখাটি, পঞ্চাশ বছর আগে। হ্যাঁ—গল্পটা শানুকে নিয়েই লেখা। কিন্তু শানু, শানুর কথা তার মনে পড়লেও সেদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় সে কি সত্যিই চশমা খুলে নিয়েছিল শানুর চোখ থেকে—স্মৃতি এখানে প্রতারক। অশীতিপর পা দুটো জড়পদক্ষেপে সিঁড়ি টপকে দোতলার ঘরে টেবিল ও ছোট্ট খাটের ওপরে ডাই করে রাখা কাগজপত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজে আবার নিচে নেমে আসে। শোবার ঘরে খাটের ড্রয়ারে কিছু বিদঘুটে মাস্তান তেলাপোকার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় কেবল। একটা তেলাপোকা আন্তনগর রেলগাড়ির মতো পা বেয়ে শরীর মাড়িয়ে যেন তার মস্তিষ্কে ঢুকে গেছে—বসন্তের বাতাস পেলে কাশবন হয়ে যাওয়া মাথাভরা শুভ্র যেই চুল, তা যেন আগাছার মতো উপড়ে ফেলবে এবার। দরদর করে শরীরের ঘামবিন্দু পায়ের গোড়ালি চুইয়ে বাড়ির পুরোনো মোজাইককে স্বেদাক্ত করে দিচ্ছে। অশেষ ক্লান্তি নিয়ে বসার ঘরে এসে চশমাটা আবার একটু পরনের কাপড়ে মুছে নিয়ে চোখে সেঁটে জানালা গলিয়ে বাইরে তাকালো। বাড়ির সীমানাপ্রাচীরে বসে থাকা বালকটি, মানে শানু, মানে শান্তনু বিশ্বাস, না নোটন নেই—প্রাচীরের ওপরে সেই ছোট্ট কচ্ছপটা রেখে চলে গেছে। মাঝেমধ্যে ছোট্ট কচ্ছপটা তার আশক্ত খোলস থেকে বালকের নুনুর মতো মাথা বের করে পিটপিট করে চোখের তারা জ্বালিয়ে আবার আদিম গুহায় লুকাচ্ছে। কচ্ছপটার পেছনে অশ্বত্থগাছের কচি পাতার ওপর ফাল্গুনের তেরছা রোদ অনেক আগেই তার নিজ চক্রপথে সন্ধ্যার দিকে ধাবিত।

বাড়ির প্রধান দরজা খুলে সীমানাপ্রাচীরের বাইরে এল দেবরূপ স্যানাল। কত দিন পরে ঘরের বাইরে বের হলো—আসন্ন সন্ধ্যার তুহিন অন্ধকারে ঝিল্লির সমবেত সংগীতে বিভোল হলো মন। বাড়ির সামনে বিশাল অজগরের শীতল শরীরের মতো নির্জন পড়ে আছে পুরোনো আবাসিক এলাকার পিচ রাস্তাটি। মনে হলো—একটু হাঁটি, একটু বেড়িয়ে আসি এদিক–সেদিক। কিন্তু লাঠিয়ালের চেয়ে লাঠির প্রকৃত মূল্য বোঝায় বয়স তার। হাতের লাঠিটা ঘরে রেখে বেরিয়েছে। লাঠি ছাড়া বেশি দূর হাঁটার বাস্তবতা তার নেই। বাড়ির বাইরে বের না হতে হতে একটা ভয়ও তার আপন হয়েছে—যদি ঠিকঠাক রাস্তা চিনে বাড়ি না ফিরে আসতে পারে। দিন দিন মস্তিষ্ক ভারি অকেজো হয়ে পড়ছে। সেই সাহস না করে বাড়ির সীমানাপ্রাচীর–ঘেঁষা অশ্বত্থগাছের কাছে এগিয়ে যায়। এখানেই তো কোমরপ্রমাণ উঁচু বাড়ির সীমানাপ্রাচীরে বসে ছিল শানু। প্রাচীরের ওপরে শানুর রেখে যাওয়া কচ্ছপটির কাছে এগিয়ে যেতেই মনে হলো—এ তো নিশ্চল, পোড়ামাটির খেলনা কচ্ছপ। কিন্তু ঘরের জানালা গলিয়ে দেখার সময় তো দিব্বি কচ্ছপটির পিটপিট করা চোখ দেখতে পেল। কচ্ছপটি হাতে তুলে নিতেই তার সমস্ত শরীর কেমন বিড়বিড় করে উঠল। দু’হাতের তালুতে বাঁধা ছোট্ট খাদে কচ্ছপটি যেন জল পেল। সন্ধ্যার আঠালো অন্ধকার আরও ঘন, আরও নিরেট হলে কচ্ছপটি তার হাত বেয়ে ঘাড়ে, ঘাড় টপকে মাথার ভেতরে ঢুকে যেতে উদ্ধত হলে দেবরূপ স্যানালের ঠিক মনে পড়ে যেতে থাকে—স্কুল থেকে ফেরার পথে চড়কের মেলা থেকে কচ্ছপটা কিনেছিল সে। শানু খুব করে কচ্ছপটি চেয়েছিল—দাও না আমাকে দেবরূপ। আমি পুষব। অনেক বড় করব। তারপর কচ্ছপের পিঠে চড়ে জগৎ ঘুরব।

—কেমন বোকা ছেলে গো তুমি। সবাই মোটরসাইকেল, রেলগাড়ি, উড়োজাহাজে জগৎ ঘুরতে চায়। আর তুমি...তা ছাড়া এই খেলনা কচ্ছপ কী করে বড় হবে!

—হ্যাঁ, আমি তো চোখে খুব কম দেখি। আমার জগৎটা খুব ছোট। আমার অত দ্রুতযানের দরকার নেই। কচ্ছপটা অনেক বড় হলে ওর পিঠে চড়ে আমার ছোট জগৎটাতে ঘুরব।

ঠিক মনে আছে—কচ্ছপটা শানুকে দিয়েছিল সেদিন। কিন্তু শানুকে নিয়ে লেখা গল্পটাতে কচ্ছপটার কথা ছিল কি না, ভ্রম হচ্ছে। এটা কি সে কচ্ছপটিই! কচ্ছপটিকে নিয়ে বাড়ির প্রধান দরজা আটকে ঘরে ঢুকে সন্ধ্যাবাতি জ্বালাতেই মনে হলো দক্ষিণের ঘরটার পাশের ছোট লনটাতে রাখা রেবার হুইলচেয়ারটাতে কে যেন বসে আছে। তৃতীয়বার স্ট্রোক করার পরে হুইলচেয়ারটাই রেবার আশ্রয় হয়েছিল। রেবাও গত হওয়ার বছর সাত পার হলো। লনের শীতল নির্জনে হুইলচেয়ারটা সেভাবেই পড়ে আছে এত দিন। কিন্তু আজ অবেলায় কাছে এগিয়ে যেতেই স্পষ্ট হলো—শানু, হুইলচেয়ারে বসে আছে। কিন্তু ওর একটা পা নেই।

—তুমি! কীভাবে এলে? তোমার আরেকটি পা...

—তুমি সেদিন আমার চশমাটা জেদ করে নিয়ে চলে আসার পর, আমি ট্রেনের হুইসেল শুনে দ্রুত রেললাইন থেকে নামতে গিয়ে কিসে যেন বেধে পড়ে গেলাম। ট্রেনটাও তখন দৈত্যের মতে ধেয়ে এল। তারপর কত দিন হসপিটালে থাকলাম। হসপিটালের বিছানায় কচ্ছপটাই আমার সঙ্গী হলো। ওর সঙ্গে খেলতাম। একদিন আমাদের গণিতের স্যার এলেন আমাকে দেখতে। স্যারই বলেছিলেন—আমাদের বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে গেছে। প্রাইমারি শেষ। সবাই অন্যান্য স্কুলে চলে গেছে। তুমিও যে শহরের স্কুলে চলে গেছ, স্যারই বলেছিলেন। আমার আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। এই কচ্ছপটা নিয়েই কেটেছে এত দিন। আর দেখো, তোমার কত বয়স হয়েছে, বৃদ্ধ হয়ে গেছ। আমার একটুও বয়স বাড়েনি। আমার কচ্ছপটিও বড় হয়নি।

—হ্যাঁ, আমার বাবারও তো বদলি হয়ে গেল। শহরে, নিজেদের আদি বাড়িতেই ফিরলাম। আচ্ছা, এটা সেই কচ্ছপ?

—একদম ঠিক ধরেছ। এটা এখন থেকে তোমার কাছেই রাখো।

—তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে শানু। তুমি নিশ্চয় ক্ষুধার্ত।

—ক্ষুধা একটু লেগেছে। কিন্তু তুমি তো একা লোক, অশীতিপর। কষ্ট করতে হবে না। থাক।

—আরে নাহ্‌। কোনো কষ্ট না। হরিদাসী আসে সকালে। রান্না, কাপড় ধোয়া, ঘর গোছগাছ করে। একবার রান্না করে যায়, ওই সারা দিন ওভেনে গরম করে একটু একটু খাই।

ওভেনে খাবার গরম করে টেবিলে রাখল দেবরূপ স্যানাল। কচ্ছপটাকেও রেখেছে খাবার টেবিলের ওপরে। শানু হুইলচেয়ারে চাকা ঘুরিয়ে এগিয়ে খাবার টেবিলের দিকে আসছিল যখন, দেবরূপ স্যানালের মনে হলো—যেন, রেবা এগিয়ে আসছে। কত দিন পরে হুইলচেয়ারটা সচল হলো। শানু ছোট ছোট লোকমায় খাবার তুলে নিচ্ছে মুখে।

—আচ্ছা। তুমি আমার ‘সবুজ চশমা’ গল্পটা পড়লে কোথায়? গল্পটা তো কোনো পত্রিকায় ছাপা হয়নি কখনো।

—হয়েছিল। তুমি বড় লেখক। বয়স হয়েছে। কত কিছুই তো ভুলে যাও। আর গল্পটাতে এই কচ্ছপের কথাটাও লেখোনি তুমি। কিন্তু আমার কথা মানেই তো এই কচ্ছপের কথা।

—লিখিনি!

—না, লেখোনি।

—কোথায় ছাপা হয়েছিল?

—আমাদের স্কুলের দেড় শ বছর পূর্তির ম্যাগাজিনে।

—তোমার কাছে আছে ম্যাগাজিনটা?

—না। তবে এক জায়গাতে নিশ্চয় থাকবে। কিন্তু সে তো চার ঘণ্টার ট্রেনের পথ। বালিয়াদিঘা। আমাদের স্কুলের লাইব্রেরিতে। আমি সেখান থেকেই পড়েছি। বিকেল গড়িয়ে স্কুলটা যখন সন্ধ্যার অন্ধকারে ডুবে যেত, আমি মাঝেমধ্যে যেতাম স্কুলে। সারা স্কুল একা ঘুরতাম। স্যারদের বসার ঘর, লাইব্রেরির জানালা টেনে খুলে লোহার গরাদ গলিয়ে ভেতরে ঢুকতাম। একদিন লাইব্রেরিতে বইপত্র ওল্টাতেই তোমার গল্পটাতে চোখ পড়ল।

—তাই! আমাকে নিয়ে যাবে সেখানে?

—আচ্ছা, সে যাওয়া যাবে। তার আগে তুমি দোতলার রুমটাতে রাতে খুঁজে দেখো আর একবার। কোথাও আছে নিশ্চয়।

বাড়িটাকে রাতের তরল অন্ধকার ক্রমেই ডুবিয়ে দিতে থাকে। কিন্তু আজ দেবরূপ স্যানালের অর্গল খুলেছে বুনো ঝরনার মতো। এত দিন বাদে একজন মানুষ পেয়ে তার সমস্ত জমানো কথাকে যেন মুক্তি দেবে। বসার ঘরের আরামকেদারায় শরীর ডুবিয়ে দিয়ে অজস্র কথা বলে চলেছে হুইলচেয়ারে বসে থাকা শানুর সঙ্গে। রাত আরেকটু গভীর হলে শানুকে আর বালক দেখাচ্ছে না, যেন সে কিশোর। হঠাৎ চোখে পড়ল কচ্ছপটা পুরোনো ডিভানের ওপর। দেবরূপ স্যানালের একবার মনে হলো, কচ্ছপটাকে নিজেই হয়তো এখানে এনে রেখেছে। আবার সংবিৎ ফিরে পেয়ে স্থির ভাবতে চাইল—না, কচ্ছপটাকে তো খাবার টেবিলে রেখেছিল। কিন্তু নিজের প্রতারক স্মৃতিশক্তির কাছে পরাজয় মেনে নিল, সে নিজেই হয়তো এনেছে। ভুলে গেছে।

নতুন প্রকাশিত বইটা বসার ঘরের চা-টেবিলের ওপরেই ছিল। শানু যখন বইটা টেনে নিয়ে পাতা ওল্টাচ্ছিল, তখন তাকে কিশোর নয়, পরিণত যুবকের মতো দেখাচ্ছিল। মুখটা মেধায় উজ্জ্বল। বইটা নাড়তে নাড়তে শানু বলল—ইদানীং তুমি খুব কাল্পনিক কী সব লিখছ। বাস্তবতা বর্জিত। এই জীবনকে অস্বীকার করতে চাও।

—না, তা নয় আসলে। তোমরা যাকে কল্পনা বলছ, আমার কাছে তাই-ই বাস্তব। দেখো, মানুষ বর্তমানে খুব কম সময় থাকতে পারে। হয় ভবিষ্যতে, নয়তো অতীতে। ভবিষ্যতে সে কী করবে বা অতীতের আনন্দ ও বেদনার ছবিটাই বয়ে বেড়ায়। বর্তমান আসলে মাঝনদীতে ভাসা একটা নৌকা। পেছনে ফেলে এসেছে কূল, সামনে নতুন ঠিকানা।

—কিন্তু তোমার চরিত্রগুলো কেমন অবাস্তব। তাদের অতীতও নেই। ভবিষ্যৎও নেই।

—আসলে তারা বয়ে বেড়ায় অতীতের অপ্রাপ্তি আর অসুখ, ভবিষ্যতে সমৃদ্ধির বাসনা নিয়ে বর্তমানকে এত বেশি নৈরাজ্যে ভরে তুলতে চাইছে। ফলে তোমাদের মনে হচ্ছে তাদের অতীতও নেই। ভবিষ্যৎও নেই। প্রযুক্তির পৃথিবীতে প্রতিটি সময় এত দ্রুত মরে যাচ্ছে। আর একটা সুবিধে আছে জানো—আমার নিজের এই কল্পনার জগতে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। কিছু হারানোর নেই। কিছু পাওয়ারও নেই। কোনো রাজনীতি নেই। কোনো ধর্মও নেই। খুব আপসহীন লিখতে পারি।

—রাজনীতি, ধর্ম...এসব ছাড়া মানুষ কি সামাজিকভাবে বাঁচতে পারে।

—এখন যে যত অসামাজিক, সে তত বাঁচবে।

কথার পাহাড় স্ফীত হতে হতে রাত বয়স্ক হলো। একটু জল খেতে হবে। আরামকেদারার ভেতর থেকে শরীরটাকে বের করে দেবরূপ স্যানাল উঠে খাবার টেবিলের দিকে যায়। জগ থেকে গ্লাসে জল ঢালতে গিয়ে দেখতে পায় দিব্বি কচ্ছপটা খাবার টেবিলেই রয়েছে। শূন্য জলের গ্লাস হাতে করেই বসার ঘরে গিয়ে ডিভানের দিকে তাকায়, না নেই। ক্যামেরার মতো চোখ প্যান করে ঘোরাতেই দেখে কচ্ছপটাকে হাতের তালুতে নিয়ে ভীষণ আদর করছে শানু। দেবরূপ স্যানালের হাত থেকে গ্লাসটা খসে পড়ল বাড়ির পুরোনো মোজাইকের মেঝেতে। কিন্তু কী আশ্চর্য...কাচের গ্লাসটা একটুও ভাঙেনি। কচ্ছপটাকে আদর করতে করতে শানু বলল—অবাক হওয়ার কিছু নেই। ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কাচের গ্লাস পড়লে অনেক সময় ভাঙে না।

— তাই! আচ্ছা আমি কচ্ছপটাকে তো খাবার টেবিলে দেখলাম। তার আগে ডিভানে।

—ও, তোমার যা হয়। এত দ্রুত সব ভুলে যাচ্ছ ইদানীং।

দুর্বোধ্য স্বগতকথন করতে করতে মেঝে থেকে গ্লাসটা তুলে খাবার টেবিলের দিকে যায় দেবরূপ স্যানাল। অনেকক্ষণ ধরে সময় নিয়ে জল খায়।—তুমি একটু জল খাবে শানু? এক গ্লাস জল বয়ে নিয়ে এসে দেখে হুইলচেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েছে শানু। আর তার হাতের কচ্ছপটা মেঝেতে। জলের গ্লাসটা চা-টেবিলে রেখে কচ্ছপটাকে তুলতে যায়। হাত বাড়াতেই কচ্ছপটা সরে যাচ্ছে। যতই এগিয়ে যায়, মাটির কচ্ছপটা ততই সরে সরে যাচ্ছে। এ-ঘর ও-ঘর করে আবার এসে শানুর পায়ের কাছে কচ্ছপটা যখন এল, ঘুম ভাঙল শানুর। দেখে—আটাত্তরে অশীতিপর দেবরূপ স্যানাল ক্লান্ত, ঘামে জবজব করছে তার শরীর।

—একি, তোমার এই হাল কেন! বসো, বসো তুমি।

—না, ওই কচ্ছপটা!

—আরে ও তো আমাদের সঙ্গেই আছে। এই দেখো আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। চলো তো ওপরের ঘরে, গল্পটা আবার খোঁজা যাক। তার আগে তুমি একটু জিরিয়ে নাও তো।

কিছু সময় পর দেবরূপ স্যানাল দোতলার ঘরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালে, শানু বলল—আমি তো এক পাওয়ালা, ক্ষীণদৃষ্টির অর্ধেক মানুষ। আমাকে একটু তোমার কাঁধে ভর করে সিঁড়িতে যদি উঠতে সাহায্য করো, খুব ভালো হয়। তুমিও তো বুড়ো মানুষ, অর্ধেক আছ, অর্ধেক নেই। আমিও অর্ধেক, তুমিও অর্ধেক।

—নিশ্চয়।

কতকালের পুরোনো বাড়ি। একচিলতে বারান্দার কোণ দিয়ে দোতলায় ওঠার সরু সিঁড়ি। যেন কোনো সুড়ঙ্গ, পাতাল থেকে ওপরে ওঠার। সিঁড়ির বাতিটা জ্বালিয়ে দিল দেবরূপ স্যানাল। খুবই ক্ষীণ সে বাতির আলো। তার কাঁধে ভর করে একটা একটা সিঁড়ি ভাঙছে। যেন কত শত কাল ধরে লাখ লাখ সিঁড়ি ভেঙে আকাশের গভীর অন্ধকারে ঢুকছে। হঠাৎ মনে হলো—যেন কয়েক মণ ওজনের পাথর তার কাঁধে চেপে বসেছে। নুইয়ে যেতে চাচ্ছে শরীর। পরের সিঁড়িতে পা উঠছে না।—কী হলো দেবরূপ? এই বলে শানু তার কাঁধে দেবরূপ স্যানালকে চাপিয়ে নিল। তখন আর শানুকে বালক নয়, কিশোর নয়, যুবক নয়, ঠিক তারই মতো অশীতিপর এক বৃদ্ধলোকের মতো দেখাচ্ছে। কিন্তু সিঁড়ির অল্প আলোতে শানুর মুখটা কেমন ঝাপসা, খুব একটা ছবি আনতে পারছে না মনে। একবার দেবরূপ স্যানালের মনে হলো—একি শানুর মুখ, নাকি তার নিজের!

শেষতক দোতলার ঘরে উঠে আলো জ্বালাল। আলোতে এবার শানুর মুখটা পরিষ্কার। না তো, তার চেহারার সঙ্গে কোনো মিল নেই। দোতলার ঘরে পুরোনো কাগজপত্র উল্টেপাল্টে গল্পটা খুঁজতে খুঁজতে রাত্রি ভোর। ভোরের নরম আলো লেগেছে পৃথিবীর গায়ে। একটা খোঁড়া শালিকের মতো ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে দোতলার ঘরে একচিলতে ঝুলবারান্দার দিকে এগিয়ে গেল শানু। বারান্দার রেলিং টপকানো দেখে দেবরূপ স্যানাল চিৎকার করে উঠল—কী করো শানু? পড়ে যাবে তো!

বয়স্ক শরীর টেনে নিয়ে বারান্দায় যেতেই মনে হলো একটা কালো বিড়াল ঝুপ করে দোতলার বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়লো নিচে।

—শানু, এই শানু।

—ভয় নেই, আমি ঠিক আছি। গল্পটা তো খুঁজে বের করতে হবে। ওই গল্পটাতেই আমি কেবল বেঁচে আছি। আর আমাকে সবাই ভুলে গেছে। আমি স্টেশনে চলে গেলাম। তুমি এসো। আমরা বালিয়াদিঘা যাব। স্কুলের লাইব্রেরিতে ম্যাগাজিনটা নিশ্চয় পাব আমরা।

ভোরের জনশূন্য রাস্তা ধরে শানু এক পায়ে হাঁটতে হাঁটতে দূরে মিলিয়ে গেল।

ট্রেন বালিয়াদিঘা স্টেশনে থামল। এই স্টেশনেই বাবা পোস্টমাস্টার ছিল। সময় সবকিছু বদল করে ফেলেছে। স্টেশনের পুরোনো দালানটা নেই। স্টেশন মাস্টারের ঘরের কোনার কুর্চিগাছটা নেই। রেললাইনের দুই ধারে দেবদারুগাছগুলো নেই। রেললাইন ধরে হেঁটে স্কুলের দিকে যাওয়ার সময়ও শানুকে নিজের ন্যুব্জ কাঁধে চাপিয়ে নিল দেবরূপ স্যানাল। মাথার ওপরে দুপুরের বাহাদুর সূর্য—হাঁটতে হাঁটতে শানুকে ঠিক তার বয়সি দেখাচ্ছে। রেললাইন ধরে তারা হাঁটছে, দুটো মানুষ। কিন্তু দেবরূপ স্যানাল স্পষ্ট দেখল—দুপুরের উত্তপ্ত রেললাইনের ওপরে কেবল একজন মানুষেরই ছায়া। আর সেই ছায়াকে কামড়ে দিতে পেছন থেকে ট্রেনের হুইসেল নিকটবর্তী হয়ে আসছে।