ছয় বাই আটের এই ঘরটাতে আমি কতক্ষণ আছি বলতে পারব না। চোখ মেলে মনে হলো চোখ না মেললেই বোধ হয় ভালো ছিল। ঘুমঘোরে প্রচ্ছন্ন আলো-আঁধারে স্বপ্ন তবু সহনশীল; কিন্তু চোখ মেলে যে ভয়াবহ অন্ধকারের মুখোমুখি হতে হলো, তা সহ্য করা প্রায় অসম্ভব। তবু আমায় সহ্য করতে হবে। হাহ! এরা কী ভেবেছে? এখানে রাখলেই আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসব? না, কখনোই না। আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন ঘুটঘুটে অন্ধকারে যেখানে নিজেকেই দেখা যায় না, সেখানে আমি কী করে ঘরের মাপ বলে দিচ্ছি। ঘরের মাপ কেন, আমি এই ঘরের অনেক কিছুই বলে দিতে পারি। এই ঘরটা প্রতিমুহূর্তে আমার শরীরের তাপমাত্রা, হৃৎকম্পন, রক্তসঞ্চালন মাত্রাসহ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। আমার দুই হাতে দুটি ডিভাইস লাগানো আছে। ডান হাতের ডিভাইসটি চাপ দেওয়ামাত্র ওরা এসে আমাকে মুক্ত করে দেবে। বাঁ হাতের ডিভাইসটি আমার বর্তমান সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবে। আমাকে সব তথ্য ওরা আগে থেকেই শিখিয়ে–পড়িয়ে দারুণভাবে বুঝিয়ে তবেই এখানে এনেছে। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা আমার।
‘সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি—
এখনো কি ভালোবাসি?
সেটা অবসরে ভাববার কথা,
অবসর তবু নেই;
তবু একদিন হেমন্ত এলে অবকাশ পাওয়া যাবে;’
আচ্ছা সেই অবকাশ পাওয়া হেমন্ত কী এসেছিল লোকেন বোসের জীবনে? কে জানে? এই ঘন কালো পৃথিবীতে বসে আমিও ভাবছি, অবকাশ কি সত্যিই আসে? কী জানি? তবে আমি এবার অবকাশ পেয়েছি। আমি এখানে আসার আগে অন্তত এক যুগ ভেবেছি। শুধু যে ভেবেছি, তা নয়। সময় দিয়েছি বলা যায়। সব সম্প্রদায়কে সময় দিয়েছি। অনেক ভেবেই আমি এক বেণি বাঁধা বিকেলে এসে হাজির হই জুরিখের এই ছোট শহরটাতে। এই একটা শহর অন্তত নিজেদের পারস্পরিক মর্যাদা ও বিশ্বাসের যোগসূত্র তৈরি করে এখনো নিজেদের ধরে রাখতে পেরেছে। এখানে বাতাস ভারী নয়। এখানে পাখিরা স্বাধীন। ক্ষোভ, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, হিংস্রতা কিংবা লোভ এখনো এদের মানবিকতাকে অতটা গ্রাস করতে পারেনি। আমি এসে পৌঁছানোর পর সাত দিন ওরা আমাকে বিরক্ত করেনি। অবশ্য ইনস্ট্রাকশন সেভাবেই দেওয়া ছিল। সাত দিন আমি এই শহরটা ঘুরে বেড়িয়েছি। যদি মত বদলে যায় আমার। এপ্রিলের এই সময়টায় জুরিখের রোদ অলস সময় কাটায়। ইচ্ছা হলে উঠে নইলে বৃষ্টি তো আছেই। সে তার দায়িত্ব যথাযথ পালন করে। আমি প্রায়ই লিমাট নদীর ধারে কোনো পার্কে কিংবা লিমাটের বুকে নৌকায় কাটিয়ে দিই। আমার জখমি শরীর এই বিশুদ্ধ বাতাস আর নির্মল জলের ছোঁয়া পেয়ে কিছুটা চনমনিয়ে ওঠে। তবে এই হাওয়াবদল আমার মন বদলাতে পারে না। প্রকৃতি যেমন অপরিপূর্ণ থাকে না, তেমনি অপ্রয়োজনীয়ও কোনো কিছু রাখে না। সম্ভবত আমি এখন তার সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় অংশ। আমার শরীরের কিছু কিছু অংশে এত পচন ধরেছে যে তা রোধ করার ক্ষমতা চিকিৎসাবিজ্ঞানে আবিষ্কৃত হয়নি। আমার হৃদয়ে অসংখ্য ব্লক, নিশ্বাস নিলেই কার্বন মনোক্সাইড, সালফার, নাইট্রোজেন, সেই সঙ্গে ধুলা, ধোঁয়া, বিষাক্ত ধাতু হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে শ্বাসনালিতে। আর শরীরজুড়ে যত ক্ষত তার বিবরণ দিতে গেলে আরব্য রজনীর হাজার রজনীতেও কুলাবে না। ভাগ্যিস কেউ তেমন করে তাকায় না আমার দিকে। তাকালে খুঁড়িয়ে চলা রক্তাক্ত পচাগলা এই আমাকে দেখে আতঙ্কে দৌড়ে ঘরের খিল এঁটে দিত।
সাত দিন বেশ ঘুরেফিরে কেটে গেল। গ্ল্যাটভ্যালির কাছেই এত সবুজ আর এত নীল যে আমার নিজেরই ধাক্কা লাগছিল। তার মানে এখনো কোথাও আশা জেগে আছে! এখনো ভরসা করা যায়! এই সব আশা–ভরসা মুহূর্তের জন্য ভুলিয়ে দিয়েছিল আমার এখানে আসার কারণ। আমি সব ভুলে বুকভরে নিশ্বাস নিতে শুরু করলাম। ঝরনার জলে ক্ষতস্থান ধুয়ে বনৌষধি খুঁজতে শুরু করলাম। কিন্তু পরমুহূর্তেই আমি বুঝলাম এসব ক্ষণস্থায়ী স্বপ্ন থেকে দূরে সরতে হবে। না, আমি আর পিছু ফিরতে চাই না। আমাকে এসব ভাবালুতা ঘায়েল করতে পারবে না এবার। কিছুতেই না।
গুনে গুনে সাত দিন পর ওদের অফিসে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। খুব গোছানো ছিমছাম একটা রুমে আমাকে বসানো হলো। রুমটার চারদিকে কাচের দেয়াল। দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ড্রাকেনা স্যান্ডেরিয়ানার ঝাড়। কেউ কেউ একে লাকি ব্যাম্বুও বলে। মানুষ বিশ্বাস করে এই গাছ তাদের সমৃদ্ধি বয়ে আনবে। ঝিরঝিরে এক জলের ধারা কাচের গা বেয়ে নেমে আসছে ঝাড়ের পায়ের কাছে। শব্দটায় কান খাড়া করে রাখলে এমন মাদকতা তৈরি হয় যে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নাকি এক ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম, জানি না। তবে সেই ঘোর আমাকে নিয়ে গিয়েছিল এক অপার্থিব জগতে। এক নীলাভ লেকে শুয়ে শুয়ে আমি যেন মাছ ও পাখির আনন্দ কলতান শুনছি। লেকের পার ধরে ফুটে আছে নানা বর্ণের পাহাড়ি ফুল আর তার অল্প দূরে বেরি, বাদাম ও আলপাইনের গাছ। সোনালি শস্যে বিকেলের আলো পড়ে মনে হচ্ছে কেউ তুলি চালিয়ে সোনালি রঙের গাঢ় প্রলেপ এঁকে দিয়েছে। কোত্থেকে এক নীলরঙা পাখি চোখে একরাশ কৌতূহল নিয়ে উড়ে এসে আমার কাঁধে বসল। আমি আবেশে ডুবে যেতে যেতে শুনলাম কেউ খুব দূর থেকে আমার নাম ধরে ডাকছে।
—মাননীয়, ডিগনিটাসের ভুবনে আপনাকে স্বাগত। আপনি কি আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছেন? আপনি কি এখনো আপনার সিদ্ধান্তে অনড়? কথা বলুন মাননীয়—
খুব অনিচ্ছায় চোখ মেলে তাকালাম। আর ঠিক তখনই বুঝলাম আমি এক মায়া কিংবা বিভ্রমের জগতে পা দিয়েছিলাম। আমার সামনে দুজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক। মূলত ওরাই আমাকে ডাকছিল। আমি মেরুদণ্ড সোজা করে বসলাম। পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে ওদের দিকে তাকালাম। ওরা আবার আমাকে প্রশ্ন করল—
—আপনি কি এখনো আপনার সিদ্ধান্তে অটল?
—জি।
—ওকে। আমি গ্যাব্রিয়েল মুলার আর আমার সঙ্গে আছেন ম্যাত্তিও মেয়ার। ডিগনিটাসের সদস্য ফরম পূরণের আগে নিয়মানুযায়ী আমরা দুজন মনোরোগবিশেষজ্ঞ, আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
—বলুন।
—আপনি জানেন আত্মহত্যায় সহায়তা প্রদান বৈধ, যতক্ষণ না এটা কোনো স্বার্থপর উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত না হয়।
—জি, জানি।
—আপনি কি ক্লান্ত? কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে চান?
—না। আপনি বলুন।
—এই যে এত অসহ্য রকম সুন্দরের মধ্যে আপনি ছিলেন এই সৌন্দর্য; কিন্তু আপনারই ভেতরকার সৌন্দর্য। আপনিই সৃষ্টি করেছেন। এসব ছেড়ে আপনি সত্যিই চলে যেতে চান?
—ওহ, এসব তবে আমার তন্দ্রা কিংবা অবচেতনের কোনো অধরা দৃশ্য নয়। খুব সচেতনভাবে আপনারাই এই দৃশ্য দেখিয়েছেন!
—জি। যেন আপনার ইচ্ছাটা রোধ হয়। দেখুন আমরাই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যারা চায় না কেউ তাদের সেবা গ্রহণ করুক। আমরা বিশ্বাস করি মৃত্যুর অধিকার সবারই আছে; কিন্তু সেই সঙ্গে এ–ও বিশ্বাস করি বেঁচে থেকেই কেবল সত্য ও সুন্দরের জন্য লড়াই করা যায়।
—আপনারা কিছু দৃশ্যমান সৌন্দর্য আমাকে দেখালেন বটে; কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর কী জানেন? মানুষের মানবিকতা। অথচ সেই মানুষ একে অপরের প্রতি হিংস্র হয়ে উঠেছে। পশু ক্ষুণ্নবৃত্তির জন্য শিকার করে আর মানুষ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর লোভে পড়ে একে অপরকে শিকার করে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ কেউ রেহাই পায় না ওদের থেকে। ছিন্নভিন্ন শিশুর লাশ সামনে রেখে যে মানব সম্প্রদায় অট্টহাসি হাসতে পারে, দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সামনে রাজকীয় ভোজ সাজিয়ে যারা আহারে বসতে পারে, বিজ্ঞানের আশীর্বাদকে যারা ঘোর পাপাচারে ব্যবহার করতে পারে, সেই সম্প্রদায়ের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। এদেরকে থামানোর কোনো পথ আমি হাজার বছর ধরেও খুঁজে পাইনি। এরা দিন দিন আরও সহিংস ও বিধ্বংসী হয়ে উঠেছে। রাগে–ক্ষোভে ফুঁসেছি। একেকবার মনে হয়েছে এদের ডুবিয়ে মারি কিংবা আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চারদিক ধ্বংস করে দিই। কিন্তু পারিনি জানেন। নিজেই রক্তাক্ত হয়েছি। অদ্ভুত কী জানেন? এরা আমাকে মায়ের আসনে বসায় আবার এরাই আমাকে নগ্ন ও বিকৃত করতে ছাড়ে না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই সব জঘন্য দৃশ্য সহ্য করার চেয়ে মৃত্যুও অনেক বেশি সহনশীল।
—আমরা আপনার মনের অবস্থা পরিষ্কার বুঝতে পারছি। কিন্তু...
আমি হাত উঁচিয়ে ওদের কথা থামিয়ে দিলাম। দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে ওরা প্রশ্ন করল—
—আপনি সম্পূর্ণ ব্যাখ্যাসহযোগে প্রয়োজনীয় রিপোর্ট নিয়ে এসেছেন?
—আমার ক্ষতবিক্ষত আর রক্তাক্ত দেহ কি যথেষ্ট নয়?
—বুঝতে পারছি; কিন্তু আমাদের কিছু নিয়মনীতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
—আপনারা আপনাদের পরবর্তী ধাপে এগোতে পারেন। আমি আমার সিদ্ধান্তের সপক্ষে যা যা বলার সব লিখে এনেছি। আশা করি, এতে কাজ হয়ে যাবে আপনাদের।
—বেশ!
কথাবার্তার এই পর্যায়ে গ্যাব্রিয়েল ম্যাত্তিওকে নিয়ে একটু দূরে সরে খুব নিচু স্বরে কিছু একটা আলাপ করছে। আমি কান তীক্ষ্ণ করলেই শুনতে পেতাম; কিন্তু আমার কোনো ইচ্ছাই কাজ করছে না। যা খুশি করুক কিংবা বলুক। আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসব না।
—মাননীয় আমরা এবং সেই সঙ্গে আপনিও এখন নিশ্চিত যে আমরা আপনার ইচ্ছাকে এগিয়ে নিতে যাচ্ছি। এই পর্যায়ে আপনাকে একটা ফরম ফিলাপ করতে হবে ও আমাদের নিজস্ব ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে হবে। আপনি কি প্রস্তুত?
—ফরমটা দিন। আমি ফিলআপ করে দিচ্ছি। আর হ্যাঁ, আমি সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
—ততক্ষণে আমাদের তরফ থেকে আপনাকে বাদাম ও ফলমিশ্রিত একটি জুস অফার করছি। খেতে খেতে ফরমটা ফিলআপ করুন। তবে শেষ পয়েন্ট আপনি একা পূরণ করতে পারবেন না। আমাদের সহযোগিতা লাগবে। আপনি জুস খেতে খেতে যতক্ষণ ইচ্ছা সময় নিয়ে বাকি পয়েন্টগুলো লিখুন। এখানে একটা বোতাম আছে। বোতাম চাপলেই আমরা তৎক্ষণাৎ হাজির হব।
অদ্ভুত সুন্দর বাদামি চোখের এক মেয়ে এক গ্লাস জুস নিয়ে হাজির হলো। এত মায়া মেয়েটির চোখে! আমি না চাইতেও জিজ্ঞেস করলাম—
—মিষ্টি মেয়ে তোমার নাম জানতে পারি?
মেয়েটি হাসল। সেই হাসিতে কী ছিল জানি না। আমিও মেয়েটির সঙ্গে হাসলাম। না চাইতেও হাসলাম।
—নাম জানতে চাও? কী করবে জেনে? তুমি সিদ্ধান্ত থেকে সরে না এলে আমিও বিলীন হয়ে যাব। আমি বা আমার নাম আর অল্প সময় বেঁচে আছি হয়তো। তোমার সিদ্ধান্ত মানেই আমি বা আমাদের মতো অনেক সত্য ও সুন্দরের মৃত্যু। জানো, ভেবেছিলাম এই ক্রিসমাসের ছুটিতে বাবাকে দেখতে যাব। বাবার জন্য মাফলার আর মোজাও কিনে রেখেছি। আমার আদরের বিড়ালছানাটি কত বড় হয়ে গেছে! কিছুই হবে না হয়তো। তবু তোমার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাই।
আমি স্থানুর মতো বসে রইলাম। কী বলে মেয়েটা! এ কি ভ্রম নাকি সত্যিই মেয়েটা আছে। আমাকে এরা আবার কোন মায়ায় আটকাতে চেষ্টা করছে না তো! আবার এ–ও তো সত্যি, আমার প্রস্থান মানেই সমস্ত বিলোপ। আমি ভাবতে পারছি না আর! কাঁপা হাতে গ্লাস তুলে দিতেই মনে হলো আমার শিরায়–উপশিরায় এক শীতল সমুদ্র ঢেউ খেলে এগিয়ে যাচ্ছে। ধুয়ে দিচ্ছে সব ক্ষত। মনে হচ্ছে দূর থেকে কোনো এক পাহাড়ি ঝরনা ছুটে আসছে সেই সমুদ্রের কাছে। কী এক আকুতি ঝরনার কলতানে! মনে হলো আমি আবার সুস্থ হয়ে উঠছি। এক দুরন্ত পজিটিভ এনার্জি আমার শরীরের যাবতীয় ক্ষত ধুয়ে দিচ্ছে। আমি হাওয়ায় ভাসছি কিংবা উড়ছি। বেশ বেগ পেতে হলো নিজেকে নিজের কাছে ফিরিয়ে আনতে। আমি জানি এসব আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। আমি তো ফিরতে চাই না। বহুবার তো ফিরে গেছি। আর কত? আমি বোতামে চাপ দিলাম। এত দ্রুততার সঙ্গে এল, যেন ওরা আমার ঘাড়ের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমি ওদের দিকে না তাকিয়ে বললাম—
—শেষ পয়েন্টটা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
—নিশ্চয়ই মাননীয়। শেষ পয়েন্ট পূরণের আগে আপনাকে জানতে হবে আপনার আত্মহত্যা নিশ্চিত করার জন্য আমরা আপনাকে কোন পদ্ধতি সরবরাহ করব এবং আপনি তার মধ্য থেকে কোন পদ্ধতি অনুসরণ করবেন।
—আপনাদের পদ্ধতিগুলো জানান।
—জি। আমরা সাধারণত মৃত্যুকে সহায়তা করার জন্য পেন্টোবারবিটালের গুঁড়ো ব্যবহার করি। আপনি এটি পানিতে গুলে খেতে পারেন, গ্যাস্ট্রিক টিউব আকারে খেতে পারেন কিংবা শিরাপথে গ্রহণও করতে পারেন। আপনি এটি যেভাবেই গ্রহণ করেন না কেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই এটি আপনার স্নায়ুতন্ত্রকে শিথিল করে আপনাকে কোমায় নিয়ে যাবে এবং কোমায় থাকাকালীন শ্বাস বন্ধ করে দিয়ে আপনার মৃত্যু নিশ্চিত করবে।
—আর কোন পদ্ধতি?
—জি, কিন্তু এটি খুবই ব্যতিক্রম। আমরা মাত্র তিন–চারটি কেসে এটি ব্যবহার করেছি। এটি হলো হিলিয়াম গ্যাসের ব্যবহার। তবে এটি প্রথমটির তুলনায় রিস্কি ও কষ্টদায়ক। আপনাকে আবারও মনে করিয়ে দিই আপনি এখনো আপনার সিদ্ধান্ত বদল করতে পারেন।
—না, আমাকে সিদ্ধান্তে থাকতে সাহায্য করুন। আর পিছু হটার কথা বারবার শোনাবেন না।
—বেশ। আপনি উত্তেজিত হবেন না মহোদয়। আমরা সর্ব অবস্থায় আপনার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করব। এই যে দেখুন আপনার আত্মহত্যার প্রস্তুতি ও সহায়তা বিল বাবদ জমা করা সাত হাজার সুইস ফ্রাঁর রসিদ আমাদের হাতে। আর মাত্র একটি ধাপ। তারপরই আপনার সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে আর কোনো বাধা নেই।
—আবারও একটি ধাপ!
—জি মহোদয়। এই ধাপে আপনাকে ছয় বাই আট ফিটের একটি নিকষ কালো অন্ধকার ঘরে বাহাত্তর ঘণ্টার জন্য থাকতে হবে। আপনি সেখানে সম্পূর্ণই একা।
আমার ক্লান্ত হওয়ার কথা। কিন্তু আশ্চর্য! ৭২ ঘণ্টা বেশি সময় পেয়ে আমি যেন কিছুটা স্বস্তি বোধ করছি। ওরা আমাকে রুমের যাবতীয় সব বুঝিয়ে দিল। সবশেষে জানতে চাইল আমি হেঁটে সেই ঘরে প্রবেশ করতে চাই নাকি ঘুমন্ত অবস্থায় আমাকে সেখানে রেখে আসা হবে। আমি দ্বিতীয় পন্থাকে ভালো মনে করলাম। অন্তত কিছু সময় ঘুমিয়ে পার হবে ভেবে।
এখন কটা বাজে কে জানে? ৭২ ঘণ্টার কত ঘণ্টা পার হয়েছে? এখন দিন না রাত? আমার হঠাৎ বাদামি চুলের মেয়েটির কথা মনে পড়ল। আচ্ছা, মেয়েটার সঙ্গে ওর বাবার আর দেখা হবে না! নীলরঙা পাখিটা আমাকে কি কিছু বলতে চেয়েছিল? ছুটে চলা ঝরনাটা কি সাগরের দেখা পেয়েছিল? আশ্চর্য! এসব কেন ভাবছি আমি? আমার তো এসব ভাবার কথা নয়। কিন্তু ভাবনা থেকে বেরিয়েও তো আসতে পারছি না। আসলে এই তীব্র অন্ধকার থেকে রেহাই পেতেই আমি বোধ হয় হন্যে হয়ে সুন্দরের খোঁজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাইছি। ওই তো! এক তিল পরিমাণ আলোর রেখা দেখা দিল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। রেখা ধরে এগোতে থাকলাম। একটা দেয়াল। দেয়ালের ওপাশে একটা বিকেল বসে আছে। সেই বিবস বিকেলের আলো কেটে কেটে কানে বাজে বৈকালিক রাগ বাগেশ্রী। কে বাজায় এমন তোলপাড় করা সুর? আরে! ওই তো সেই বাদামি চুলের মেয়েটি, যার পায়ের কাছে বেগুনি ঘাসফুলে একটা গুবরে পোকা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ঘরে ফেরার তাড়া নেই কারোরই। না মেয়েটির, না পোকাটির। নাকি আমার বোঝার ভুল, দেখার ভুল। জানতে ইচ্ছা করছে ওদের কাছে, ‘কারও কি অপেক্ষায় আছ?’ অদূরে নারকেলপাতায় একটা দাঁড়কাক। আচ্ছা, ও কী এ যুগের যক্ষ? মেঘকে ডেকে ডেকে অনুনয় করছে ওর আকুলতা পৌঁছে দিতে! তবে ওর বেশিক্ষণ ডাকতে হয়নি। সঙ্গীটি উড়ে এল খানিক বাদেই। ঠোঁটে ঠোঁটে চলে ওদের প্রেম ও প্রশ্রয়। বিকেলের আলোর গায়ে বর্ষার স্পর্শ লেগেছে। আমি সব ভুলে যাই। সমর্পিত সন্ধ্যায় রক্তের ভেতর বেহাগ কিংবা দরবারি কানাড়া শুনতে পাই। ঘনঘোর বিকেলের বাহু আমাকে পেঁচিয়ে ধরে। যুদ্ধ চলে বর্ষা ও বঞ্চনার, যুদ্ধ চলে রঙে আর রক্তে। এগোতে গিয়ে দেয়ালে ধাক্কা খাই। আমি জানি আমি ডুবছি। অজান্তেই আমার বাঁ হাতের আঙুল চলে যায় ডান হাতের ডিভাইসের কাছে।