আব্বা খুব ভালো শর্টহ্যান্ড পারতেন, বাংলায় যাকে বলে সাঁটলিপি। এটা একধরনের অর্থপূর্ণ সাংকেতিক চিহ্নবিদ্যা। সেই সময় মানে সত্তরের দশকে অফিসগুলোয় স্টেনোগ্রাফার পদে লোকের বেশ চাহিদা ছিল। একটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে আব্বার চাকরি হয়েছিল, প্রতিষ্ঠানপ্রধানের পিএ হিসেবে। উনি বিভিন্ন অফিশিয়াল চিঠি ও ডকুমেন্ট বানানোর জন্য দ্রুতগতিতে ডিকটেশন দিতেন, আব্বার কাজ ছিল শর্টহ্যান্ডে সেগুলো লিখে পরে টাইপ করা। অনেকটা রেকর্ডার মেশিনের মতো। আমাদের বাসায় আব্বার টেবিলে ছোটবেলাতেই ছোট ছোট ইংরেজি অক্ষর আর হিজিবিজি আঁকিবুঁকি কাটা সবুজ মলাটে পিটম্যানের শর্টহ্যান্ড শেখার বইটি দেখেছি মনে পড়ে।
১৯৭৪ সালের দিকে মহাখালীতে ‘আধুনিক কমার্শিয়াল কলেজ’ নামে টাইপরাইটিং শেখার একটা প্রতিষ্ঠান ছিল। আব্বা অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যায় সেই কমার্শিয়াল কলেজে গিয়ে দুই ঘণ্টা ছাত্রদের শর্টহ্যান্ড শেখাতেন। স্বল্প পরিসর একটি ঘরে মশার কামড় খেতে খেতে ছাত্রদের মাথায় শর্টহ্যান্ডের কায়দাকানুন প্রবেশ করানোর জন্য আব্বার যে পরিমাণ খাটুনি হতো আধুনিক কমার্শিয়াল কলেজের স্বত্বাধিকারী কাশেম সাহেব সেই পরিমাণ সম্মানী দিতে রাজি ছিলেন না। মাসকয়েক পড়িয়ে আব্বা ভাবলেন—থাক অল্প কয়টা পয়সার জন্য এত কষ্ট করার দরকার নেই। তার চেয়ে সন্ধ্যাবেলা নিজের পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোই বরং ভালো।
সেসব ভেবে আব্বা তাঁর জমানো টাকা থেকে একটা দামি হারমোনিয়াম কিনলেন। আমাদের পিতা–কন্যার সন্ধ্যাগুলো সংগীতসাধনায় মুখর হয়ে উঠল। আমি তখন মোটে ক্লাস ওয়ানের ছাত্রী। পড়ালেখার তেমন চাপ নেই। আব্বা হারমোনিয়াম বাজান আর আমি চিকন সুরে চিৎকার করে গাই, ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা...’
আব্বা আবার আমার সঙ্গে গলা মেলান, ‘...তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা…’
এদিকে আব্বা শর্টহ্যান্ড শেখানো ছাড়লে কী হবে, কম্বল তাঁকে ছাড়ল না। আধুনিক কমার্শিয়াল কলেজের ছাত্ররা একসন্ধ্যায় আমাদের দুই কামরার টিনশেড বাড়ির দরজায় এসে কড়া নাড়ল। না, তারা আব্বার কাছেই শর্টহ্যান্ড শিখতে চায়।
‘আরে বাবা, আমার পক্ষে আর সম্ভব না, কাশেম সাহেবের সাথে আমার তেমন সদ্ভাব নাই, আমি আর ওখানে ফিরে যাব না।’
আব্বা ছাত্রদের একরকম হাতজোড় করেই বললেন।
‘স্যার, আপনাকে ওখানে ফিরতে বলছি না। আপনি স্যার আপনার বাসায় আমাদের পড়ান।’
আব্বা পড়লেন মহা মুসিবতে। এই দুই কামরার ভাড়া বাড়িতে ছাত্র পড়ানোর জায়গা কোথায়?
‘স্যার, আমাদের জন্য একটা টেবিল আর সামান্য কয়েকটা চেয়ারের বন্দোবস্ত করতে পারবেন না স্যার?’
‘আমরা না হয় আপনার এই উঠানেই বসব!’
শেষ পর্যন্ত অবশ্য উঠান না, বারান্দায় তাদের বসার বন্দোবস্ত করা হলো। চারজন তরুণ ছাত্র সন্ধ্যাবেলা এসে খাতা–পেনসিল নিয়ে আব্বার কাছে শর্টহ্যান্ড চর্চা করতে বসে। ফলে আমাদের পিতা–পুত্রীর সান্ধ্য সংগীত সাধনা একপ্রকার স্থগিতই হয়ে গেল। সেই সময়টা আম্মা ভেতরের ঘরে আমাদের তিন ভাইবোনকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে নিচু ভলিউমে রেডিও শুনতেন অথবা ছোট ভাইবোনদের ঘুম পাড়িয়ে আমাকে হোমওয়ার্ক দেখিয়ে দিতেন।
ঘটনা এখানেই থেমে রইল না। শর্টহ্যান্ড শিক্ষার্থীরা একদিন এসে বিপন্ন কণ্ঠে জানাল, তারা বড় বিপদে পড়ে গেছে! আধুনিক কমার্শিয়ালের মালিক কাশেম সাহেব জেনে গেছেন যে ছাত্ররা আলাদাভাবে আব্বার কাছে শর্টহ্যান্ড শেখে। সুতরাং তিনি রেগে গিয়ে ঘোষণা দিয়েছেন, যারা অন্য জায়গায় শর্টহ্যান্ড শিখবে, তাদের আর আধুনিকে টাইপ শিখতে দেওয়া হবে না। যদি তারা সত্যিই টাইপ শিখতে চায় তবে তাদের আর মোফাজ্জল সাহেবের (মানে আব্বার) কাছে যাওয়া চলবে না। তিনি নতুন ইনস্ট্রাক্টর রেখেছেন, তাঁর কাছেই শর্টহ্যান্ড শিখতে হবে।
‘ঠিক আছে বাপুরা, তোমরা তাহলে আধুনিকেই ফিরে যাও।’
আব্বা এককথায় সমাধান দিয়ে দেন।
‘না স্যার, তা হয় না।’
‘দেখো টাইপরাইটিং শেখা, প্র্যাকটিস করা দুটোই তোমাদের দরকার!’
‘সেই জন্যই তো বলি স্যার, আপনি কয়েকটা টাইপরাইটিং মেশিন কিনে ফেলেন!’
‘বলো কি তোমরা? মাথা খারাপ নাকি? আমি এত টাকা কোথায় পাব?’
‘স্যার নিয়ত করে ফেলেন হয়ে যাবে!’
‘স্যার সেকেন্ড হ্যান্ড অনেক মেশিন বিক্রি হয় স্যার, সস্তায়, একটু খোঁজ লাগালেই পেয়ে যাবেন।’
আব্বার ইতস্তত ভাব দেখে একজন তো মরিয়া হয়ে বলেই বসল,
‘লাগে তো বলেন স্যার, আমরা বাড়ি থেকে টাকা এনে দিই! পরে না হয় ফেরত দিয়ে দেবেন!’
‘আরে কী আশ্চর্য! সেটা কি হয় নাকি!’
ছাত্ররা কিন্তু গোঁ ধরে বসেই রইল। তারা আধুনিকে ফিরে যেতে চায় না। আব্বা পড়লেন মহাসংকটে। এই ছাত্রদের প্রয়োজনটা তিনি বুঝতে পারছিলেন, কিন্তু সমাধানের উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ছাত্রদের শুকনো মুখ ও করুণ চেহারা দেখে আবারও নিজের সামান্য সঞ্চয়ে হাত দিলেন তিনি। পুরান ঢাকা থেকে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড টাইপরাইটার মেশিন কিনে আনলেন। ছাত্রদের আনন্দ দেখে কে? তারা কি-বোর্ডের ওপর পাখির ঠ্যাংয়ের মতো বাঁ হাতের লম্বা লম্বা আঙুল চালিয়ে মুখে মুখে প্র্যাকটিস করে—এ, এস, ডি, এফ, জি । বুড়ো আঙুলে নিচের লম্বা বারটা চাপ দিয়ে বলে স্পেস। ডান হাতের আঙুলে প্র্যাকটিস করে, সেমিকোলন, এল, কে, জে, এইচ।
‘স্যার, আপনে একটা ইনস্টিটিউট খোলেন। আমরা ছাত্র জোগাড় করে দেব। আর দু–একটা মেশিন জোগাড় করে ফেলেন স্যার!’
ছাত্রদের উৎসাহ আব্বাকে একটা ইনস্টিটিউট খুলতে অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু সে জন্য মূলধন সংস্থান কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে আব্বার চিন্তার অন্ত ছিল না। কারও কাছ থেকে ধার নেবেন! কিন্তু কে দেবে ধার? তা ছাড়া, ধারদেনা বিষয়টাকে আব্বা বরাবরই অপছন্দ করেন। কাউকে দেনও না, কারও কাছ থেকে নেনও না। আম্মা প্রস্তাব করল, তার বিয়ের গয়না বিক্রি করার, কিন্তু সেটাতেও আব্বার আপত্তি। স্ত্রীর স্বর্ণে হাত দিলে অমঙ্গল হয়, এমন একটা ধারণা আজীবন পোষণ করতেন তিনি। ফলে সেটাও বাদ।
এক ছুটির দিনে হঠাৎ আব্বার চোখ গেল ঘরের কোনায় অবহেলায় পড়ে থাকা হারমোনিয়ামের দিকে। আমাকে ডাকলেন আব্বা। বললেন, ‘আম্মাজান, হারমোনিয়ামটা তো পড়েই আছে, ওটাকে বিক্রি করে দিই? তুমি কী বলো?’
আমি কিনা একটা শান্ত লক্ষ্মী পুতুলের মতো বাচ্চা। ছয় বছর বয়সে হারমোনিয়ামের মর্ম কী বুঝব? মাথা নেড়ে বললাম, ‘আচ্ছা।’
পরের সপ্তাহেই হারমোনিয়াম বিক্রির টাকায় আরও দুটো টাইপরাইটার মেশিন এল বাড়িতে। এবার এল স্থান সংকুলানের প্রশ্ন। ওইটুক বারান্দায় ঠাসাঠাসি করে তো আর চলছিল না। এবার আব্বা সাহস করে রাস্তার পাশে তিন রুমের একটা বাসা নিয়ে নিলেন। দুই রুমে আমরা থাকব আর রাস্তার পাশের ৩ নম্বর কামরায় চলবে টাইপ ও শর্টহ্যান্ড শেখার ইনস্টিটিউট। এক্ষণে এই প্রতিষ্ঠানের একটি নাম তো থাকা দরকার। আব্বা ধারেকাছে আর কাউকে না পেয়ে তাঁর প্রিয় কন্যার নামে প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করলেন, ‘মুন্নী কমার্শিয়াল কলেজ।’
বলা বাহুল্য, এই নামকরণে মুন্নীর কোনো আপত্তি–অনাপত্তি আছে কি না, সে বিষয়ে আব্বা জিজ্ঞেস করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করলেন না। অবশ্য জিজ্ঞেস করলেই–বা কী হতো? হাবাগোবা মেয়েটি বরাবরের মতোই বাবার ইচ্ছাতেই সায় দিত।
কালোর ওপর হলুদ রঙে ‘মুন্নী কমার্শিয়াল কলেজ’ লেখা টিনের সাইনবোর্ড ঝোলানো হলো এবং কিছুদিনের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটি পুরোদমে চালু হয়ে গেল। আব্বা প্রতি মাসে ছাত্রদের ভর্তি ফি ও মাসিক বেতনের টাকা জমিয়ে একটা একটা করে টাইপরাইটার মেশিন বাড়াতে থাকলেন। ছাত্রছাত্রীও বাড়তে থাকল। গ্রাম থেকে আমার আইএ পাস বেকার মামাকে নিয়ে আসা হলো ইনস্ট্রাক্টর কাম সবকিছু দেখাশোনা করার বিশ্বস্ত মানুষ হিসেবে। স্কুল থেকে ফিরেই আমি দৌড়ে গিয়ে কমার্শিয়াল কলেজের টেবিল–চেয়ারে বসে ফাঁকা টাইপরাইটারে টাইপ প্র্যাকটিস করতাম। ছোট ছোট আঙুলে কি বোর্ডের দিকে না তাকিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে টাইপ করতাম, ‘আ কুইক ব্রাউন ফক্স জাম্প ওভার দ্য লেজি ডগ’। আব্বা বলেছেন, ‘ইংরেজি বর্ণমালার প্রতিটি অক্ষর রয়েছে এই বাক্যে।’ ছাত্রছাত্রীরা আমাকে দেখে খুব মজা পেত। ‘আরে তুমিই মুন্নী? তোমার নামেই কলেজ! তুমিই তাহলে আমাদের স্যার!’ আমি কিছু না বলে মুচকি মুচকি হাসতাম।
আব্বার ছাত্ররা শর্টহ্যান্ড শিখে চাকরি পেয়ে চলে যায়। শুধু বজলুর রহমান নামের একজন ছাত্রের কোনো উন্নতি নাই। তবে অধ্যবসায়ে বজলুর রহমান রবার্ট ব্রুসকেও হার মানায়। আব্বা মাঝে মাঝে গজগজ করেন, ‘গাধা! একটা গাধা আইসা জুটছে!’
গাধার তাতে কোনো উনিশ–বিশ হয় না, বরং আমার মামার সঙ্গে তার বেশ খাতির হয়ে যায়।
একদিন স্কুল থেকে ফিরতেই আমার ছোট বোন উত্তেজিত ভঙ্গিতে ফিসফিস করে বলল, ‘আপুনি, কমার্শিয়াল কলেজে না একটা পরির মতো সুন্দর মহিলা আসছে।’
আমাদের কমার্শিয়াল কলেজ আর বাসা তখন কেবল একটা ভারী পর্দা দিয়ে আড়াল করা ছিল। আমি দেখলাম আম্মাও পর্দা সরিয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন সেই পরির মতো নারীকে দেখার জন্য। ওটা ১৯৭৭–৭৮ সাল হবে। আমি ছুটে গিয়ে দেখতে পেলাম একজন ধবধবে ফরসা, লম্বা, স্বাস্থ্যবান এক নারী আমাদের কমার্শিয়াল কলেজের একটা সাধারণ চেয়ারে বসে আছেন। তার পরনে কালচে লাল রঙের হাঁটু পর্যন্ত লম্বা একটা গাউন। মাথায় ছোট করে কাটা বাদামি চুল এবং তার নেইল পলিশ লাগানো লম্বা নখের আংটি পরা দুই আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। তিনি সবার সামনে বসে টকটকে লাল লিপস্টিক পরা ঠোঁট গোল করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছেন।
মামা ও বজলুর রহমান প্রায় দমবন্ধ করে তার দিকে অপলক তাকিয়ে বসে আছে। আমি যেতেই মামা যেন একটা কথা খুঁজে পেল, আমাকে মহিলার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘এই যে ওই মুন্নী...’
‘ও! প্রিটি গার্ল!’ ভদ্রমহিলা ভ্রু উঁচিয়ে আমাকে দেখলেন। তারপর হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে ব্যাগ থেকে একটা বড়সড় বিদেশি চকলেট বের করে আমার হাতে গুঁজে দিলেন। মামার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এবার তবে কাজের কথায় আসা যাক।’
কাজটা হচ্ছে, ভদ্রমহিলার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় কিছু ডকুমেন্ট টাইপ করতে হবে। সুতরাং তিনি এক রাতের জন্য আমাদের সবচেয়ে উন্নত মানের টাইপরাইটার মেশিনটি উপযুক্ত অর্থ দিয়ে ভাড়া করতে চান। নিজের গাড়ি দিয়ে সেটা তিনি গুলশান নিয়ে যাবেন, পরদিন সকালে আবার লোক দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেবেন। ভদ্রমহিলা মেশিনের ভাড়া হিসেবে যে অঙ্কের টাকা দিতে চাইছিলেন, সেটাও বেশ লোভনীয়। এ রকম প্রস্তাব এর আগে মুন্নী কমার্শিয়াল কলেজে কেউ কখনো দেয়নি। সুতরাং মামা কী করবেন, সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। তখন তো আর মোবাইল বা টেলিফোন সহজলভ্য ছিল না যে আব্বার সঙ্গে যোগাযোগ করে তার মতামত নেওয়া যাবে! মামা পর্দার এপাশে থাকা আম্মার সঙ্গে পরামর্শ করতে এলেন।
তারা দুই ভাইবোন মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, এতগুলো টাকা উপার্জনের সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। এক রাতেরই তো ব্যাপার! সেই ফয়সালা মোতাবেক মাত্র এক মাস আগে কেনা আব্বার অনেক শখের নতুন চকচকে টাইপরাইটার মেশিনটি গাড়িতে চড়ে গুলশানের দিকে রওনা হয়ে গেল।
আব্বা অফিস থেকে ফেরার পর আম্মা বেশ কৃতিত্বপূর্ণ একটা কাজ করা গেছে এমন ভঙ্গিতে আব্বার হাতে সন্ধ্যার চায়ের কাপ তুলে দিয়ে গল্পটা বলতে শুরু করলেন। চা পান করতে করতেই আব্বা একটা বিষম খেলেন। গল্প শেষ হওয়ার আগেই চিৎকার করে বললেন, ‘দিয়ে দিছ? এ্যাঁ, আমার এত দামি মেশিনটা দিয়া দিলা ... হায় হায়...করছ কী তোমরা?’
‘না, ফেরত দেবে...’ আম্মা বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু আব্বা কি আর তা শোনে, তিনি দুই হাতে মাথা ও কপাল চাপড়াতে শুরু করলেন! কত বড় ক্ষতি হয়ে গেল তাঁর! এই দুই বেকুব ভাইবোন মিলে তাঁকে পথে বসানোর পরিকল্পনা করেছে, তাঁর এত পরিশ্রমের টাকা জলে ঢেলে দিচ্ছে, পাঁচ টাকার লোভে পাঁচ শ টাকার জিনিস খুইয়ে ফেলছে…ইত্যকার নানা কটু বাক্যবাণে জর্জরিত করে তিনি আম্মাকে কাঁদিয়ে ফেললেন। সেই রাতেই তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায় প্রায়।
দুই আসামি আমার মামা ও বজলু মামাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে জেরা শুরু হলো। বজলু মামা বললেন, ‘স্যার, চিন্তা করবেন না, আমি ওই মহিলার ঠিকানা শর্টহ্যান্ডে লিখে রেখেছি! এক্ষুনি গিয়ে নিয়ে আসব।’
তাঁরা দুজনে গেলেন মেশিন উদ্ধারে, কিন্তু বজলু মামা সড়ক ও বাড়ির যে নম্বর লিখে রেখেছে, বাস্তবে গিয়ে সেই নম্বরের অস্তিত্বই পাওয়া গেল না। পাওয়া যাবে কীভাবে, কেউ তো জানত না—তিনি শর্টহ্যান্ডে উল্টাপাল্টা নম্বর লিখেছিলেন। ১২৮–কে লিখেছেন ২৮২। ৫৬ নম্বর বাসাকে লিখেছেন ১৬৫ নম্বর। আব্বার ভয়ে আমার মামা সেই রাতের ট্রেনেই গ্রামের বাড়ি রওনা দিয়ে দিলেন। বজলু মামা মধ্যরাতে শুকনা মুখে সেই তথ্য জানিয়ে কেটে পড়লেন। আম্মা সারা রাত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলেন, আব্বা জেগে রইলেন নিদ্রাহীন। আমরা তিন ভাইবোন খালি পেটে আধো ঘুম, দুঃস্বপ্ন আর জাগরণের মধ্যে একটা মহাদুর্যোগপূর্ণ রাত পার করলাম।
পরদিন থমথমে সকালে মুন্নী কমার্শিয়াল কলেজের সামনে একটা গাড়ি এসে থামল। একজন লোক দুই হাতে ধরে আমাদের মূল্যবান টাইপরাইটার মেশিনটা নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।