গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

টি এস এলিয়টের সাক্ষাৎকার

‘কবিতার জন্য কেবল একটি ভাষা বেছে নেওয়া উচিত’

আধুনিক কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি টি এস এলিয়টের জন্মদিন। ১৮৮৮ সালে জন্ম নেওয়া এই কবি, নাট্যকার ও সমালোচক বিশ শতকের ইংরেজি সাহিত্যের ধারা পাল্টে দিয়েছিলেন। ১৯৫৯ সালে মার্কিন কবি ডোনাল্ড হল তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় বসেন। সেই আলাপচারিতায় উঠে আসে এলিয়টের সাহিত্যদর্শন, সৃজনপদ্ধতি ও সময় সম্পর্কে তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। সেই সাক্ষাৎকারের সংক্ষিপ্ত বাংলা অনুবাদ করেছেন ঋতো আহমেদ

প্রশ্ন

আচ্ছা, আপনার কি মনে আছে, কিশোর বয়সে আপনি যখন সেন্ট লুইসে থাকতেন, তখন আসলে কোন পরিস্থিতিতে কেমন করে প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করেন?

টি এস এলিয়ট: মনে আছে। আমার বয়স তখন চৌদ্দ, ফিজগেরাল্ডের অনুবাদে ওমর খৈয়াম পড়ে উৎসাহিত হয়েছিলাম। তখন বিষণ্ন, নান্দনিক ও নিরাশামূলক কিছু চার লাইনের কবিতা লিখি, যেগুলো পরে ছিঁড়ে ফেলি, মানে ওগুলোর অস্তিত্ব আর নেই। কাউকে দেখাইনি কখনো। সেই হিসেবে আমার প্রথম কবিতাটি স্মিথ একাডেমি রেকর্ডে ও পরে ‘হার্ভার্ড অ্যাডভোকেট’–এ প্রকাশিত হয়। বেন জনসনকে অনুসরণ করে লিখেছিলাম আমার ইংরেজি শিক্ষকের জন্য অনুশীলন হিসেবে। তাঁর কাছে মনে হয়েছিল, ১৫–১৬ বছরের ছেলে হিসেবে লেখাটা খুব ভালো হয়েছে। এরপর ‘হার্ভার্ড অ্যাডভোকেট’-এ সম্পাদনা পর্ষদের নির্বাচনে অংশ নিতে কিছু লেখা পাঠাই, যা খুব উপভোগ্য ছিল আমার জন্য। তখন থেকেই পরবর্তী কয়েক বছর বলা চলে আমার লেখালেখির উন্মেষ ঘটে। বোদলেয়ার আর জুলেস লাফোর্গের প্রভাবে আমি আরও উর্বর হয়ে উঠি। তাঁরা ছিলেন হার্ভার্ডের আমার প্রথম কয়েক বছরের আবিষ্কার।

প্রশ্ন

নির্দিষ্টভাবে কেউ কি আছেন যে আপনাকে ফরাসি কবিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন?

টি এস এলিয়ট: হার্ভার্ড ইউনিয়নেই পেয়েছিলাম। তখনকার দিনে হার্ভার্ড ইউনিয়ন মানে একটা সভাস্থান, যেখানে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থীরা যুক্ত হতো। তাদের খুব সুন্দর ছোট একটা পাঠাগার ছিল। যেমনটি এখন হার্ভাডের প্রায় অনেক বাড়িতেই আছে। আর্থারের উদ্ধৃতিগুলো ভালো লাগত এবং আমি একবার বোস্টনের এক বিদেশি বইয়ের দোকানেও গিয়েছিলাম (নাম ভুলে গেছি, আর জানি না এখনো ওটা আছে কি না), যা ফরাসি, জার্মান ও অন্যান্য ভাষার বইয়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। সেখানে লাফোর্গ আর অন্য কবিদের বই পেয়েছিলাম। এখনো ভাবলে অবাক হই, ছোট ওই দোকানে কেনই–বা তারা লাফোর্গের মতো অল্প কিছু লেখকের বই সংগ্রহে রাখত!

প্রশ্ন

আপনি যখন অনার্সে ছিলেন, তখন কি কোনো অগ্রজ কবির প্রভাব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন? এখন যেমন তরুণ কবিরা লিখতে গিয়ে এলিয়ট, পাউন্ড আর স্টিফেনসের প্রভাব অনুভব করেন। আপনার তখনকার চিন্তাচেতনা কেমন ছিল, মনে করতে পারেন? অবাক হব যদি আপনার অবস্থা অতিমাত্রায় আলাদা না হয়ে থাকে।

টি এস এলিয়ট: আমার মনে হয়, তখন ইংল্যান্ড বা আমেরিকায় সে রকম কোনো জীবিত কবির উপস্থিতি না থাকাটা আমাদের জন্য সুবিধাজনক হয়েছিল, যার ওপর কেউ আলাদা কোনো আগ্রহ দেখাতে পারত। আমি জানি না ব্যপারটা কেমন হবে, কিন্তু আমি মনে করি, এতজন কবির প্রভাব, যেমনটি আপনি বললেন, তাহলে তো বিরক্তিকর ক্ষোভের সৃষ্টি হবে। সৌভাগ্য যে আমরা একে অপরকে বিব্রত করিনি।

প্রশ্ন

(এজরা) পাউন্ডের সঙ্গে আপনার প্রথম সাক্ষাৎ কেমন ছিল?

টি এস এলিয়ট: প্রথমে ফোনে যোগাযোগ করে দেখা করতে যাই। কেনসিংটনের ছোট তিন কোনা বসার ঘরে ভালো ছাপ ফেলতে পেরেছিলাম। তিনি বললেন, ‘তোমার কবিতা পাঠিয়ো আমাকে।’ তারপর উত্তরে লেখেন, ‘আমার দেখামতে, এগুলো খুবই ভালো হয়েছে। এসো, একদিন কবিতাগুলো নিয়ে কথা বলব।’ তারপর তিনি ওগুলো হ্যারিয়েট মনরোতে পাঠিয়ে দেন। কিছুদিন পর ছাপা হয়।

কবি ও সমালোচক এজরা পাউন্ড (১৮৮৫-১৯৭২)
প্রশ্ন

আপনার অ্যাডভোকেটের দিনগুলো নিয়ে এইকেন একটি গদ্য লিখেছিলেন, যেটি বই হিসেবে আপনার ৬০তম জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন। এইকেন সেখানে লিখেছেন, প্রথম দিককার ইংল্যান্ড থেকে পাঠানো এক চিঠিতে পাউন্ডের কবিতা সম্পর্কে আপনি লিখেছিলেন, ‘অস্পৃশ্য অখাদ্য।’ আমি অবাক হয়েছি, যখন আপনি আপনার মতামত বদলালেন।

টি এস এলিয়ট: হাহ্‌! ব্যাপারটা খুব বাজে, তাই নয় কি? ‘হার্ভার্ড অ্যাডভোকেট’–এর একজন সম্পাদক প্রথম পাউন্ডের কবিতা দেখান আমাকে। ডব্লিউ জি তিনকম-ফারনান্দেজ আমার ও কনরাড এইকেন এবং সিনেটের অন্য কবিদের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। তিনি বলেন, ‘এই কবিতাগুলো তোমার ধারার, তোমার উচিত এগুলো পছন্দ করা।’ আসলে আমার তেমন ভালো লাগেনি। মনে হয়েছিল, অলংকারে ভারাক্রান্ত, পুরোনো ধাঁচের, রোমান্টিক কবিতা। তেমন খুশি করতে পারেনি আমাকে। এমনকি যখন আমি পাউন্ডের সঙ্গে দেখা করতে যাই, তখন তাঁর লেখার ভক্ত ছিলাম না আমি। যদিও আমি মনে করি, তখন যা ভেবেছিলাম, তা ঠিক ছিল। তবে তাঁর পরবর্তী লেখাতেই মহৎ কাজগুলো পেয়েছি আমরা।

প্রশ্ন

আপনি প্রকাশিত কোনো লেখায় বলেছেন, পাউন্ড আপনার অপেক্ষাকৃত লম্বা ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কেটে বর্তমানের মতো ছোট করেছিলেন। এ রকম কাটাকাটিতে আপনি কি উপকৃত হয়েছিলেন? তিনি কি আর কোনো কবিতা কাটছাঁট করেছেন?

টি এস এলিয়ট: হ্যাঁ, সেই সময় করেছিলেন। সমালোচক হিসেবে তিনি অসাধারণ। কারণ, তিনি চাননি কেউ তাঁর নকল হয়ে উঠুক। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন, আপনি কী করতে চাইছেন।

প্রশ্ন

কখনো কি আপনি কারও কবিতা পুনর্লিখনে সহায়তা করেছেন? এই ধরুন এজরা পাউন্ড?

টি এস এলিয়ট: নির্দিষ্ট করে কিছু মনে পড়ছে না। তবে অবশ্যই গত ২৫ বছরে আমি অনেক তরুণ প্রজন্মের কবিদের পাণ্ডুলিপিতে প্রচুর পরামর্শ দিয়েছি।

চিন্তাভাবনা ছিল ইংরেজি ছেড়ে দেব আর প্যারিসে থিতু হয়ে ধীরে ধীরে ফরাসিতে লিখতে শুরু করব। কিন্তু ওটা ছিল বোকার মতো চিন্তা, যদিও দোভাষী হিসেবে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে আমি খুব ভালো করছিলাম, শুধু এই কারণে যে আমি ভাবিইনি কেউ দোভাষী কবিও হতে পারে।
টি এস এলিয়ট
প্রশ্ন

আপনার মূল, অপরিমার্জিত ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর পাণ্ডুলিপিটি কি এখনো আছে?

টি এস এলিয়ট: জানতে চেয়ো না। অনেক কিছুর মধ্যে এটাও একটা ব্যাপার, যা আমি জানি না। অমীমাংসিত রহস্য। আমি এটি বিক্রি করে দিয়েছিলাম জন কুইনের কাছে। তাকে একটি অপ্রকাশিত কবিতার নোটবুকও দিয়েছিলাম। কারণ, সে বিভিন্ন বিষয়ে আমার সঙ্গে আমায়িক ছিল। এরপর আর ওগুলো দেখিনি। তারপর সে মারা গেলে ওরা আর প্রকাশনায় যায়নি।

প্রশ্ন

‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ থেকে কী কী জিনিস পাউন্ড বাদ দিয়েছিলেন? তিনি কি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অংশ বাদ দিয়েছিলেন?

টি এস এলিয়ট: সম্পূর্ণ অংশ, হ্যাঁ। জাহাজডুবির একটা লম্বা অংশ ছিল। অন্য আরও কিছুর মতো এই অংশ নিয়ে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু মনে হয় কি, আমি ‘ইউলিসিস’-এর জাহান্নামের গান থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। এরপর আরও একটি অংশ যেখানে ধর্ষণের চিত্র ফুটিয়ে তোলা ছিল। পাউন্ড বললেন, ‘কোনো মানে হয় না, যেটা অন্য কেউ লিখে গেছে, সেটা আবার লেখার কোনো অর্থ নেই। চেষ্টা করো নতুন ভিন্ন কিছু লিখতে।’

প্রশ্ন

এই কাটছাঁট কি কবিতার কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোকে বদলে দিয়েছিল?

টি এস এলিয়ট: না। তেমন কিছু না। একই জিনিসের প্রলম্বিত সংস্করণ বলা যায়।

প্রশ্ন

আপনি কি বিগত শতাব্দীর দুই আমেরিকান কবির মতো ফরাসি সিম্বলিস্ট কবি হতে চেয়েছিলেন?

টি এস এলিয়ট: স্টুয়ার্ট মেরিল আর ভিলে-গ্রিফিনের কথা বলছেন? হার্ভার্ডের পর যখন প্যারিসে একটি রোমান্টিক বছর কাটিয়েছি, তখন করেছিলাম। তখনকার চিন্তাভাবনা ছিল ইংরেজি ছেড়ে দেব আর প্যারিসে থিতু হয়ে ধীরে ধীরে ফরাসিতে লিখতে শুরু করব। কিন্তু ওটা ছিল বোকার মতো চিন্তা, যদিও দোভাষী হিসেবে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে আমি খুব ভালো করছিলাম, শুধু এই কারণে যে আমি ভাবিইনি কেউ দোভাষী কবিও হতে পারে। আমার কোনো ধারণাই ছিল না, কেউ একই সঙ্গে দুই ভাষাতেই ভালো কবিতা লিখতে পারে। আমি মনে করি, কবিতার জন্য কেবল একটি ভাষা বেছে নেওয়া উচিত, আর অন্য ভাষাগুলো সব অন্য কোনো বিষয়ের জন্য হতে পারে। ইংরেজি ভাষা ফরাসি ভাষার চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই সমৃদ্ধ। অন্যভাবে বলতে গেলে, সম্ভবত আমি ফরাসির চেয়ে ইংরেজিতেই ভালো করেছি, এমনকি যদি ফরাসিতে ওই দুই কবির চেয়ে স্বচ্ছন্দ হতামও।

প্রশ্ন

আপনার কি অসমাপ্ত কোনো কবিতা আছে, মাঝেমধ্যে খুলে দেখেন?

টি এস এলিয়ট: সে রকম বেশি কিছু নেই। নিয়ম হলো, অসমাপ্ত কিছু থাকলে, সেখান থেকে ভালো অংশ নিয়ে অন্য কোথাও ব্যবহার করে ফেলা। কাগজে লিখে ড্রয়ারে ফেলে রাখার চেয়ে মনের মধ্যে গেঁথে রাখি। যদি কাগজে ফেলে রাখি, তাহলে তা যা তা-ই থেকে যাবে, এর চেয়ে যদি মনের মধ্যে স্মৃতিতে রাখি, তাহলে পরবর্তী সময়ে সেটা বদলে গিয়ে নতুন কিছু হয়ে যেতে পারে। আগে যেমন বলেছি, ‘মার্ডার ইন দ্য ক্যাথেড্রাল’ থেকে বাদ পড়া অংশের সূত্র থেকে ‘বার্ন্ট নরটন’–এর শুরু। ‘মার্ডার ইন দ্য ক্যাথেড্রাল’ থেকে বুঝতে পেরেছি, কবিতা হিসেবে কোনো পঙ্‌ক্তি যতই ভালো হোক না কেন, যৌক্তিকতা না থাকলে ওসবের কোনো প্রয়োজন নেই। যেমন মার্টিন ব্রাউনি তখন প্রয়োজনীয় ছিলেন। তিনি বললেন, ‘এখানে দারুণ সুন্দর কিছু পঙ্‌ক্তি আছে, কিন্তু মঞ্চের ঘটতে যাওয়া ঘটনার সঙ্গে এগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’

প্রশ্ন

আমি শুনেছি, আপনি টাইপরাইটারে লেখালেখি করেছেন।

টি এস এলিয়ট: আংশিকভাবে টাইপরাইটারে। আমার নতুন নাটক ‘দ্য এল্ডার স্টেটসম্যান’-এর বেশির ভাগই পেনসিল দিয়ে কাগজে লিখেছি। পরে প্রথমে নিজেই এটি টাইপ করতাম, তারপর আমার স্ত্রী শুরু করে। নিজে টাইপ করার সময় উল্লেখযোগ্য অনেক কিছুর পরিবর্তনও করি। কিন্তু যেকোনো দৈর্ঘ্যের রচনা আমি নিয়মিত ঘণ্টা ধরে, যেমন ১ থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত লিখি বা টাইপ করি। আমি দেখেছি, দিনে তিন ঘণ্টাই প্রকৃত রচনার জন্য যথেষ্ট। সম্ভবত পরের সময়টুকু পলিশিং করলে ভালো হতো। মাঝেমধ্যে বেশি সময় ধরে কাজ করি, কিন্তু পরের দিন যখন ওই লেখাপত্রের দিকে তাকাই, তখন দেখতে পাই, তিন ঘণ্টা শেষ হওয়ার পর আমি যা লিখেছি, তা সন্তুষ্ট হওয়ার মতো নয়। তাই তিন ঘণ্টার পর লেখা থামিয়ে অন্য কিছু সম্পর্কে চিন্তা করা অনেক ভালো।

নিয়ম হলো, অসমাপ্ত কিছু থাকলে, সেখান থেকে ভালো অংশ নিয়ে অন্য কোথাও ব্যবহার করে ফেলা। যদি কাগজে ফেলে রাখি, তাহলে তা যা তা-ই থেকে যাবে, এর চেয়ে যদি মনের মধ্যে স্মৃতিতে রাখি, তাহলে পরবর্তী সময়ে সেটা বদলে গিয়ে নতুন কিছু হয়ে যেতে পারে।
টি এস এলিয়ট
প্রশ্ন

১৯৩২ সালে আপনি যে কাব্যিক নাটকের স্তরের তত্ত্ব (প্লট, চরিত্র, শব্দচয়ন, ছন্দ, অর্থ) উপস্থাপন করেছিলেন, তা কি এখনো ধরে রেখেছেন?

টি এস এলিয়ট: কাব্যিক নাটক সম্পর্কে আমার নিজস্ব তত্ত্বগুলোতে আমি আর খুব বেশি আগ্রহী নই, বিশেষ করে ১৯৩৪ সালের আগে যেসব তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিলাম। থিয়েটারের জন্য লেখালেখিতে বেশি সময় দেওয়ার পর থেকে আমি তত্ত্বগুলো নিয়ে কম ভাবছি।

প্রশ্ন

নাটক লেখা ও কবিতা লেখার মধ্যে পার্থক্য কী?

টি এস এলিয়ট: তাদের পন্থা বেশ ভিন্ন। নাটক লেখা হয় দর্শকদের জন্য। তাই একটি নাটক লেখা আর একটি কবিতা লেখার মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। কবিতা আপনি মূলত নিজের জন্য লিখছেন, যদিও এটাও স্পষ্ট যে আপনি কবিতাটিতে সন্তুষ্ট হবেন না, যদি পরে অন্যদের কাছে কিছু হলেও অর্থবহ না হয়। কবিতার মাধ্যমে আপনি বলতে পারেন, ‘আমি আমার অনুভূতিকে নিজের জন্য শব্দে রূপান্তরিত করেছি। যা অনুভব করেছি, তার বেশির ভাগ এসব শব্দের সমতুল্য।’ এ ছাড়া কবিতায় আপনি নিজের কণ্ঠস্বরের জন্য লিখছেন, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজের কণ্ঠস্বরের দিক থেকে চিন্তা করছেন। অন্যদিকে শুরু থেকেই একটি নাটকে আপনাকে বুঝতে হবে, আপনি এমন কিছু তৈরি করছেন, যা অন্যদের হাতে যাচ্ছে। অবশ্যই আমি বলব না যে একটি নাটকে এমন কোনো মুহূর্ত নেই, যখন দুটি পদ্ধতি এক না–ও হতে পারে, যা আমার মনে হয় আদর্শভাবে করা উচিত। শেক্‌সপিয়ারে প্রায়ই এমনটি ঘটে, যখন তিনি একটি কবিতা লেখেন এবং থিয়েটার, অভিনেতা ও দর্শকদের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করেন, তখন দুটি ব্যাপারই চালু থাকে। দারুণ লাগে। আমার ক্ষেত্রে এমনটা কেবল অদ্ভুত মুহূর্তেই ঘটে।

প্রশ্ন

আপনি কি আপনার কাব্যনাটকের অভিনেতাদের বক্তব্য নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছেন, যাতে আরও কাব্যিক মনে হয়?

টি এস এলিয়ট: আমি এটা মূলত প্রযোজকের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এমন একজন প্রযোজক থাকা প্রয়োজন, যার মধ্যে কাব্যের অনুভূতি আছে এবং যিনি কবিতাকে কতটা জোরদার করতে হবে, গদ্য থেকে কতটা দূরে যেতে হবে বা কতটা এগিয়ে যেতে হবে, সে সম্পর্কে তাঁদের নির্দেশনা দিতে পারেন। আমি কেবল তখনই অভিনেতাদের নির্দেশনা দিই, যখন তাঁরা আমাকে সরাসরি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। অন্যথায় আমি মনে করি, তাঁদের প্রযোজকের মাধ্যমে পরামর্শ নেওয়া উচিত। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রথমে তাঁর সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছানো এবং তারপর বিষয়টি তাঁর ওপর ছেড়ে দেওয়া।

আমি দেখেছি, বিভিন্ন মানুষের কাজ করার বিভিন্ন উপায় থাকে এবং ব্যাপারগুলো তাঁদের কাছে বিভিন্ন উপায়ে আসে। আপনি কখনোই নিশ্চিত হতে পারেন না যে আপনি এমন একটি বক্তব্য বলছেন, যা সাধারণত সব কবির জন্য প্রযোজ্য, অথবা কখন এটি এমন কিছু, যা কেবল আপনার জন্য প্রযোজ্য।
টি এস এলিয়ট
প্রশ্ন

খুবই সাধারণ একটি প্রশ্ন, আপনি কি একজন তরুণ কবিকে তাঁর শিল্পকলার উন্নতির জন্য কোন ধরনের শৃঙ্খলা বা মনোভাব গড়ে তুলতে পারে, সে সম্পর্কে পরামর্শ দেবেন?

টি এস এলিয়ট: সাধারণত পরামর্শ দেওয়া খুবই বিপজ্জনক। একজন তরুণ কবির জন্য সবচেয়ে ভালো যা করা যেতে পারে, তা হলো তাঁর একটি নির্দিষ্ট কবিতার বিস্তারিত সমালোচনা করা। প্রয়োজনে তাঁর সঙ্গে তর্ক করুন; তাঁকে আপনার মতামত দিন এবং যদি কোনো সাধারণীকরণ করার থাকে, তাহলে তাঁকে নিজেই তা করতে দিন। আমি দেখেছি, বিভিন্ন মানুষের কাজ করার বিভিন্ন উপায় থাকে এবং ব্যাপারগুলো তাঁদের কাছে বিভিন্ন উপায়ে আসে। আপনি কখনোই নিশ্চিত হতে পারেন না যে আপনি এমন একটি বক্তব্য বলছেন, যা সাধারণত সব কবির জন্য প্রযোজ্য, অথবা কখন এটি এমন কিছু, যা কেবল আপনার জন্য প্রযোজ্য। আমি মনে করি, আপনার নিজের ভাবমূর্তির আরেকটি মানুষ গঠনের চেষ্টার চেয়ে খারাপ আর কিছুই হতে পারে না।

টি এস এলিয়ট ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ভেলেরি, ১৯৫৮
প্রশ্ন

আপনার কি মনে হয়, এখনকার সব ভালো কবি, যাঁরা বয়সে আপনার ছোট, তাঁরা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন?

টি এস এলিয়ট: আমি জানি না। আমার মনে হয়, একমাত্র সাধারণীকরণ যা মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা যেতে পারে, তা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তৈরি করা হবে। এ মুহূর্তে আপনি কেবল বলতে পারেন যে বিভিন্ন সময়ে জীবিকা নির্বাহের বিভিন্ন সম্ভাবনা থাকে, অথবা জীবিকা নির্বাহের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা থাকে। স্পষ্টতই একজন কবিকে তাঁর কবিতার বাইরেও জীবিকা নির্বাহের একটি উপায় খুঁজে বের করতে হয়। সর্বোপরি শিল্পীরা শিক্ষকতার ক্ষেত্রে প্রচুর কাজ করেন এবং সংগীতজ্ঞরাও।

প্রশ্ন

আপনি কি মনে করেন যে একজন কবির জন্য সর্বোত্তম হচ্ছে কর্মজীবনে লেখালেখি ও পড়া ছাড়া আর কোনো কাজেই জড়িত না থাকা?

টি এস এলিয়ট: না, আমার মনে হয় না তা। কিন্তু আবার কেউ কেবল নিজের সম্পর্কেই ভালো বলতে পারে। সবার জন্য একটি সর্বোত্তম ক্যারিয়ার তৈরি করা খুবই বিপজ্জনক। তবে আমি নিশ্চিত যে আমি যদি স্বাধীন উপায়ে শুরু করতাম, যদি আমাকে জীবিকা নির্বাহের জন্য চিন্তা করতে না হতো এবং আমার পুরো সময় কবিতায় দিতে পারতাম, তাহলে আমার ওপর এক মারাত্মক প্রভাব পড়ত।

প্রশ্ন

কেন?

টি এস এলিয়ট: আমার মনে হয় ব্যাংকে কাজ করা, এমনকি প্রকাশনার মতো অন্যান্য কাজ করা আমার জন্য খুবই কার্যকর হয়েছে। যতটা সময় চাই, ততটা সময় না পাওয়ার অসুবিধা আমাকে মনোযোগের চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি বলতে চাইছি, এটি আমাকে খুব বেশি লেখা থেকে বিরত রেখেছে। সাধারণত অন্য কিছু করার না থাকার বিপদ হলো কেউ মনোযোগ দিয়ে লেখার চেয়ে, কম পরিমাণে লেখার চেয়ে, বেশি লিখতে পারে। এটাই হতে পারত আমার বিপদ।

প্রশ্ন

আমাদের সময়ে একজন লেখকের জন্য কি অন্য কোনো অনন্য সমস্যা আছে? মানবজাতির ধ্বংসের আশঙ্কা কি কবির ওপর কোনো বিশেষ প্রভাব ফেলে?

টি এস এলিয়ট: আমি বুঝতে পারছি না কেন মানবজাতির ধ্বংসের সম্ভাবনা কবিকে অন্যান্য পেশার মানুষের থেকে আলাদাভাবে প্রভাবিত করবে। একজন মানুষ হিসেবে তাঁকে প্রভাবিত করবে নিঃসন্দেহে তাঁর সংবেদনশীলতার অনুপাতে।

প্রশ্ন

আমি শুনেছি, আপনার মতে আপনার কবিতা আমেরিকান সাহিত্য-ঐতিহ্যের অন্তর্গত। কেন এমন অভিমত আপনার?

টি এস এলিয়ট: আমি বলব যে ইংল্যান্ডে আমার প্রজন্মের লেখা যেকোনো কবিতার চেয়ে আমেরিকায় আমার বিশিষ্ট সমসাময়িকদের সঙ্গে আমার কবিতার মিল স্পষ্টতই বেশি। আমি নিশ্চিত।

প্রশ্ন

আমেরিকান অতীতের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক আছে?

টি এস এলিয়ট: হ্যাঁ, কিন্তু আমি এর চেয়ে স্পষ্ট করে বলতে পারছি না। দেখুন, অন্যভাবে হলেও এটা আসলে যা আছে তা হবে না এবং এর চেয়ে ভালোও হবে না; বিনয়ীভাবে বলতে গেলে, ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করলে তেমনটা হতো না, আর আমেরিকায় বসবাস করলেও হতো না। অনেক কিছুর সংমিশ্রণ বলতে পারেন একে। কিন্তু এর উৎসে, এর আবেগের উৎসে নিঃসন্দেহে আছে আমেরিকা।

প্রশ্ন

শেষ কথা। ১৭ বছর আগে বলেছিলেন, ‘কোনো সৎ কবি কখনোই তাঁর লেখার স্থায়ী মূল্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন না। তাঁর মনে হতে পারে, তিনি হয়তো তাঁর সময় নষ্ট করেছেন, জীবনকে অকারণে নষ্ট করেছেন।’ ৭০ বছর বয়সে এসে এখনো কি একই রকম মনে হয় আপনার?

টি এস এলিয়ট: এমন সৎ কবি হয়তো আছেন, যাঁরা নিশ্চিত বোধ করেন, আমি করি না।