
ফিলিস্তিনের আকরে একটি মধ্যবিত্ত খ্রিষ্টান পরিবারে ১৯২৭ সালে জন্ম সামিরা আজ্জামের। মাত্র ১৬ বছর বয়সে শিক্ষকতা পেশায় আসেন। ‘কোস্টাল গার্ল’ ছদ্মনামে গল্প ও সাহিত্য সমালোচনা লিখতে শুরু করেন ‘ফিলিস্তিন’ পত্রিকায়। শুরুটা এভাবেই।
২১ বছর বয়সে লাখ লাখ ফিলিস্তিনির সঙ্গে নিজ দেশ ছাড়তে বাধ্য হন আজ্জাম। লেবাননে শুরু হয় তার শরণার্থী জীবন। তারপর এই শরণার্থী জীবনযাপনই হয়ে ওঠে তার লেখার প্রধান বিষয়।
‘ব্রেড স্যাক্রিফাইস’ গল্পটির সময় ও প্রেক্ষাপট ১৯৪৭-১৯৪৯ সালের ফিলিস্তিন যুদ্ধ (নাকবা)। হাইফার পতনের পর আকরের বাস্তবতায় রচিত গল্পটিতে সামিরা আজ্জামের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সংমিশ্রণ ঘটেছে।
৫০-এর দশকে সামিরা আজ্জাম যখন সাহিত্যিক খ্যাতির চূড়ায়, তখনই ১৯৬৭ সালে মাত্র ৪০ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
• অনুবাদ: ফরহাদ নাইয়া
ইব্রাহিম যখন তাকে তামাকের কল্কিটা দিচ্ছিল তখন তার মনে হয়েছে, সে যদি একটা ছোট্ট শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদতে পারত! তার চোখ ভিজে আসছিল, মুখ ঘুরিয়ে শার্টের হাতায় চুপি চুপি চোখের পানি মুছে ফেলল। কান্না লুকাতে মাথা উঁচু করে ব্যারিকেডের ওইপাশটা দেখার ভান করল, কিন্তু তার কমরেডদের দিকে তাকাতেই, তাদের শোকার্ত মুখাবয়ব তাকে আবারও অশ্রুসিক্ত করে তুলল।
দূরে মেঘে ঢাকা গুমোট চাঁদ যেন তাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে শোকসঙ্গ করছিল। মনে হচ্ছিল, আসমান–জমিনের সবাই তার কাহিনি জানে। সে খুব করে চাইছিল, নিজেকে একটু আবেগে ভাসিয়ে দিতে, কাঁদতে। কিন্তু পারছিল না। চাইছিল বন্ধুদের ঝাঁকি দিয়ে নিজের শক্ত হয়ে থাকা ভানটা ভেঙে ফেলতে, চাইছিল লজ্জা ছাড়া কাঁদতে; অঝোরে কাঁদতে।
সে আবারও শার্টের হাতায় চোখ মুছল, কিন্তু সেই মোটা উলের জামার খসখসে গা–চুলকানো ছোঁয়া তাকে মনে করিয়ে দিল মেয়েটার দেওয়া কবজটার কথা; যেটা দেওয়ার সময় মেয়েটা বলছিল, ‘এই কবজ আপনাকে প্রতিটা বিশ্বাসঘাতক বুলেটের হাত থেকে রক্ষা করবে।’
হ্যা, সেই রাতের কথা তার এখনো মনে আছে।
সেদিনও এমন ঠান্ডা ছিল, আকাশে ঝুলছিল একটা সরু বাঁকা চাঁদ। সে ছিল শহরতলির ছোট্ট একটা হাসপাতাল পাহারার দায়িত্বে। হাসপাতালটিতে মাত্র চারটি পাথরের ঘর আর সামনে ছোট্ট একটুকরা বাগান। জর্ডানের সামরিক বাহিনী আরব লিজিয়নরা এটি বানিয়েছিল। সেই হাসপাতালের আটটা বিছানাই ভর্তি ছিল যুদ্ধাহত মানুষদের দিয়ে, যারা নাহারিয়া নামক ইহুদি বসতি ও আক্রা শহরের আশপাশের আরব গ্রামের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছিল। হ্যা, সেদিন রাতেও খুব ঠান্ডা ছিল আর তার ভারী কোট কিছুতেই ঠান্ডা ঠেকাতে পারছিল না। তাই সে পায়চারি করছিল, যাতে শরীরের ভেতর রক্ত জমে না যায়। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে যখন সে আবার সেই হাসপাতালের দেয়ালে হেলান দিল, তখনো শহরটা দূরে কাঁপছিল, হঠাৎ কোনো হামলার আশঙ্কায় শহরটা তখনো সজাগ।
সে জানতেন না, তখন কয়টা বাজে। শুধু সদর রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো জ্বলছিল আর রাতটাও একেবারে নিস্তব্ধ, কেবল দূর থেকে মাঝেমধ্যে দুয়েকটি শিয়ালের ডাক ভেসে আসছিল।
হ্যা, সে ঠিক বলতে পারবেন না ঘড়িতে তখন কয়টা বাজছিল। হঠাৎই দেখল, নার্সের সাদা পোশাক পরা একটি মেয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে। মেয়েটি তার কাছে জানতে চাইল, সে এক কাপ চা খাবেন কি না। চায়ের কথা তো তার মাথায়ই ছিল না, আসলে কিছুই ছিল না মাথায়। তবু ভাবছিল, জমে যাওয়া আঙুলগুলোকে আরাম দিতে হাতে যদি গরম কিছু থাকে, তবে ভালোই হয়, তাই সানন্দ চায়ের প্রস্তাবটা নিল। যখন নার্সটি গরম চা নিয়ে ফিরে এল। সে মাত্র চার চুমুকেই চা শেষ করে ফেলল, যাতে মেয়েটার বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়। চা শেষ হতেই চুপচাপ খালি কাপটা ফেরত দিয়ে বিড়বিড় করে মেয়েটিকে ধন্যবাদ জানাল।
চলে যাওয়ার পর, তার মনে হলো, মেয়েটার সঙ্গে তার আরেকটু কথা বলা উচিত ছিল। সে জানালার পেছনে মেয়েটিকে খুঁজতে মাথা ঘোরাল, কিন্তু সেখানে তাকে দেখা যাচ্ছিল না। সে ঠিক করল, সকালে দেখা হলে তাকে ধন্যবাদ জানাবেন। কিন্তু মেয়েটি কে হতে পারে? হাসপাতালে দুজন নার্স ছিল আর সে মেয়েটির সাদা পোশাক ছাড়া আর কিছুই দেখেননি।
পরের রাতে সে ভাবল, আজ মেয়েটি এলে তার সঙ্গে একটু ভালোভাবে আলাপ করতে হবে। সে অপেক্ষা করতে লাগল, কিন্তু মেয়েটি তখনো আসেনি। ভাবল, নিশ্চয়ই ব্যস্ত। তার কি উচিত হবে দরজায় টোকা দিয়ে নিজেই চা চাওয়া? পরে ভাবল, এইভাবে নুইসেন্স ক্রিয়েট করা ঠিক হবে না।
বাতিগুলা নিভে গেছে, শহরটা আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আর এই ঘুমন্ত শহরটাকে পাহারা দেওয়ার জন্য জেগে আছেন শুধু সে আর তার কমরেডরা। গতকাল এ রকম সময়ই মেয়েটি তাকে চা দিয়েছিল। গত রাতের মতো বন্দুকের নলে হাত রাখতে রাখতে তার আঙুলগুলো ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিল। সে হাতের ওপর গরম নিশ্বাস ফেলে হাত গরম করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই সাদা পোশাক পরা মেয়েটি তার পাশে এসে দাঁড়াল।
‘আপনার জন্য চা নিয়ে এসছি, জিজ্ঞাসা না করেই। নেবেন তো নিশ্চয়ই?’
চোখ তুলে মেয়েটির দিকে তাকাল আর কাপটা নিতে তার ঠান্ডা হাত বাড়িয়ে দিল। চা শেষ করার আগেই মেয়েটির সঙ্গে একটু কথা বললে ভালো হবে ভেবে সে বলে বসল, ‘এখানকার কাজ করতে আপনার ক্লান্ত লাগে না?’ প্রশ্নটি শুনে মেয়েটি এমন এক গাম্ভীর্যের সঙ্গে উত্তর দিল, যা সে আশা করেনি, ‘আপনি কি মনে করেন, আমি এ কাজের যোগ্য নই?’
‘আমি… আরে না, একদমই না...’
প্রত্যুত্তরে তার কী বলা উচিত, খুঁজে পেল না। কাপটা তুলে একঢোকেই চা শেষ করে ফেলল, গলা পুড়ে যাচ্ছিল। কাপটা কোনোমতে ফেরত দিয়ে ধন্যবাদ পর্যন্ত বলতে ভুলে গেল। কিন্তু মেয়েটি কয়েক পা দূরে যেতেই, সে ডাক দিল, ‘মিস…’। মনে মনে ভাবছিল, মেয়েটির নাম জানতে চাওয়ার মধ্যে দোষের কী আছে?
মেয়েটা থেমে গেল।
সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘মাফ করবেন, আপনার নামটা জানতে পারি কি?’
মেয়েটি হেসে বলল, ‘আরেএএ… কেন নয়? আমরা তো সবাই এখানে সহযোদ্ধা। আমার নাম সুআদ।’
‘আমি রামিজ। বন্ধুরা আমাকে ‘সার্জ’ বলে ডাকে। আমরা কি হাত মেলাব?’
মেয়েটি হেসে হাত বাড়িয়ে দিল, তারপর যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমন করেই ধীরপায়ে নিঃশব্দে চলে গেল...
*
সুআদ। কী অদ্ভুত! আরও একজন সুআদ! মনে হচ্ছিল, নামটার সঙ্গে তার কোনো সৌভাগ্য জড়িয়ে আছে। কিছুদিন আগেই আক্রার নারী কমিটি আরব লিজিয়নের সৈন্যদের জন্য হাতে বোনা উলের শার্ট আর কম্বল উপহার পাঠিয়েছিল। প্রতিটি জামার পকেটে ছিল একটি কার্ড, যেখানে লেখা ছিল সেই তরুণীর নাম, যে সেটা বুনেছেন আর সঙ্গে একটা উৎসাহব্যঞ্জক বার্তা। রামিজ এখনো নিজেরটা রেখে দিয়েছে। পকেটে হাত দিয়ে সেটা খুঁজে বের করল, একটা ম্যাচ জ্বালিয়ে কার্ডের লেখাটা পড়ল:
‘সুআদ ওয়াহবি’
তার নিচে লেখা—‘এই শার্ট যেন একজন বীর পরিধান করে।’
ম্যাচটা নিভে গেল আর লেখাগুলো অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। রামিজ কার্ডটা আবার পকেটে রেখে দিল। এই নার্স মেয়েটাই যদি সেই সুআদ হয়? তাহলে ব্যাপারটা কী সুন্দর একটা কাকতালীয় ঘটনা হতো! রামিজ দরজার দিকে ফিরে তাকাল, কিন্তু সেটা বন্ধ হয়ে গেছে।
তৃতীয় রাতে রামিজ ইচ্ছা করে আগেই পাহারার দায়িত্বে এল, যাতে হাসপাতালে ঢুকে আহত মানুষদের সম্পর্কে ভালো করে খোঁজখবর নিতে পারে। দরজা খোলা ছিল, সে ভেতরে ঢুকল। দেখল, সুআদ একজন আহত সৈনিককে খাবার ট্রে দিয়ে যাচ্ছে। রামিজ সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, সে কি আহত মানুষদের সঙ্গে দেখা করতে পারে?
সুআদ বলল, ‘কেন নয়? আমি চাই, আপনি হাসানের সঙ্গে আলাপ করেন। ও আপনাকে যুদ্ধের বিস্তারিত বলতে পারবে। আমি নিজে বহুবার শুনেছি। আরও একবার বেশি শুনলেও ক্ষতি নেই। চলুন, আপনাকে হাসানের কাছে নিয়ে যাই।’
রামিজ সুআদকে অনুসরণ করে হাঁটতে হাঁটতে হাসানের বিছানার কাছে পৌঁছে গেল।
হাসানের ব্যান্ডেজ বাঁধা মাথার পাশে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই তারা দুজনই হেসে উঠল। কারণ, তাদের দেখেই হাসান বলছিল, ‘সুআদ তো একেবারে কড়া নার্স! আমাকে মরদেহের মতো সোজা হয়ে শুয়ে থাকতে বলে! এমনকি লুকিয়ে একটা সিগারেটও খেতে দেয় না।’
কথাগুলো বলে হাসান হাসছিল আর রামিজ লক্ষ করল, তার দাঁতগুলো ঝকঝকে সাদা আর চোখ দুটো অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে ভরা। হাসপাতালের কক্ষে সেই মুহূর্তে যে প্রাণখোলা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তাতে রামিজ সাহস করে জিজ্ঞাসা করে ফেলল, ‘তবু, তোমার কি মনে হয় না, সুআদ অনেক ভালো?’
‘ভালো? সে তো সবার মধ্যে সেরা। এমনকি আমার বুড়ি মায়ের চেয়ে ভালো। সে সব সময় সবার আশপাশে থাকে। একজনকে কিছু খাওয়ায় তো আরেকজনকে পানি দেয়, সব ঘরে ঘণ্টা বাজলেই ছুটে যায়। যদি একটুখানি অবসর পায়, তাকে দেখা যাবে দরজার পাশে বসে বুনে চলেছে।’
‘বুনছে?’
রামিজের তখনই উপহার পাওয়া শার্টটার কথা মনে পড়ল। হাত সরিয়ে কোটের মোটা বোতাম টিপে শার্টটা খুঁজল। কোট খুলে শার্টটা দেখিয়ে বলল, ‘এই শার্ট কি তোমার চেনা?’
সুআদ হেসে বলল, ‘ও, তাহলে তুমিই সেই যোদ্ধা যে আমার দেওয়া শার্টটা পেয়েছ।’
‘আমারই তো পাওয়ার কথা, তাই না? আমি এখনো কার্ডটা রেখে দিয়েছি। এটা আমাকে সব সময় মনে করিয়ে দেয় যে আমাকে একজন বীরের মতো দায়িত্ব পালন করতে হবে।’
ঠিক তখনই একটা টানাঘণ্টা বেজে উঠল আর সুআদ তাদের রেখে দৌড়ে চলে গেল। হাসান তখন রামিজকে বলল, ‘একটা সিগারেট দাও তো ভাই, তবে কথা দিচ্ছি, যতক্ষণ না সুআদ অনুমতি দেয়, আমি এইটা খাব না।’
*
দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। আহত ব্যক্তিরা প্রায় সবাই সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেছে। একজন মাত্র ছিল, যাকে অন্য একটা হাসপাতালে পাঠানো হবে বলেও এখনো এই হাসপাতালেই রাখা হয়েছে।
হাসপাতালে রামিজের পাহারার দায়িত্বও শেষ হয়। এবার তাকে নিযুক্ত করা হয় নতুন সৈনিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজে। সন্ধ্যা পর্যন্ত সে নতুন রিক্রুটদের গ্রহণ করত, আবার কিছু ছুটি দিত। আর রাত নামলেই আবার সেই নাইটগার্ডের ডিউটি। রাইফেল হাতে নিয়ে শহর পাহারা দেওয়া।
ভোরের আলো যখন আকাশ ছুঁত, কেবল তখনই সে ঘরে ফিরতে পারত। নিজের এক কামরার ছোট বাড়িতে লোহার খাটে শরীর এলিয়ে দিয়ে সে একটু ফুরসত পেত সুআদের কথা ভাবার।
*
সপ্তাহ পেরিয়ে গেল, এর মধ্যে সুআদকে একবারও দেখা যায়নি। সে কোথায় থাকতে পারে? রামিজের মাথায় আসছে না। কেন যেন সুআদকে মাথা থেকে সরাতেই পারছিল না আর তার হাতে বোনা শার্টটাও বিশেষভাবে প্রিয় হয়ে উঠছে রামিজের। গতকাল সকালে পোশাক পরতে গিয়ে হঠাৎ করেই সে একটা ব্যাপার আবিষ্কার করল। মেয়েটি তো না জেনেই সেই শার্ট বুনেছিল। কাকে দেবে, তা না জেনেই। হতে পারে, তার কল্পনায় একটা ছবিও আঁকা ছিল, কেমন হওয়া উচিত সেই পুরুষের যে এই শার্ট পরবেন। নিশ্চয়ই সে চেয়েছিল, সে যেন লম্বা হন; চওড়া কাঁধের একজন বীর। সে আয়নার সামনে গিয়ে নিজের পেশিবহুল বাহুগুলো ছুঁয়ে দেখল। নিজের এই সব পাগলামির জন্য হাসি পেল; এত বোকামি! কিন্তু এমন পাগলামিতে ক্ষতি কী? শার্টটিতে মুখ গুঁজে রাখা, কিংবা সেটিতে চুমু খাওয়া—এই সব করলে কী–ই বা ক্ষতি?
অষ্টম দিনে সে হঠাৎ করেই সুআদকে রাস্তায় আবিষ্কার করে। সে তখন নার্সের পোশাকে ছিল না। রামিজ তাকে থামায়, ‘আরে সুআদ, তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না।’
মেয়েটি হাত মেলাতে মেলাতে বলল, ‘হাসপাতাল সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আমি ভাবতে পারছিলাম না, আজ কী করব। তুমি কী করছ আজকাল?’
‘দিনে নতুন রিক্রুটদের প্রশিক্ষণ, রাতে নাইট গার্ডের ডিউটি—এই তো, আর কিছু না! ও হ্যা, এই সব চলছে চা ছাড়াই!’
চায়ের কথা শুনের সুআদ হেসে ফেলল। আর তখনই সুআদ লক্ষ করল যে রামিজ তার দিকে তাকিয়ে আছেন আর সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে উঠল। সুআদ হাঁটা শুরু করল, কিন্তু রামিজ তাড়াহুড়ার ভেতরই কথা বলতে থাকল। তার লজ্জা যেন তাকে পেছনে না ফেলে। ‘আমি জানি না, তুমি এটা কীভাবে নেবে। আমি কি মাঝেমধ্যে তোমার সঙ্গে কোথাও দেখা করতে পারি?’
‘শহরটা খুব ছোট।’
‘কিন্তু আমরা তো সহযোদ্ধা! আমি নারী-পুরুষ উভয়কেই প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। পোর্ট ক্লাবে এসো। ড্রিল শেষ হলে একটু কথা বলতে পারব।’
তারা তিনটায় দেখা করার সিদ্ধান্ত নিল। সে যখন নারীদের এক স্কোয়াডকে শেখাচ্ছিল, কীভাবে একটি ভারী রাইফেল ধরে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, তখন সে সুআদকে দেখতে পেল। রামিজ তার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার সঙ্গে কথা বলল না। পরে ক্লাস ছেড়ে দিয়ে সুআদকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বসার জন্যক একটি চেয়ার এগিয়ে দিল।
‘তুমি ক্লান্ত না?’ সে জিজ্ঞাসা করল।
‘কে না? কিন্তু আমি যখন জানলাম, ইহুদি বসতিগুলোয় কী রকম অস্ত্র জমা হচ্ছে, তখন থেকেই মনে হচ্ছে দিনে যদি ৬০ ঘণ্টা থাকত! আমাদের সামনে কঠিন সময়।’
‘তুমি কি ভয় পাচ্ছ?’
‘সতর্ক হচ্ছি। সহজ হবে না। ইহুদিরা অনেক অস্ত্র জমিয়েছে। আমরা অনেক কিছুই জেনেছি।’
‘তুমি কি ওখানে গিয়েছিলে?’
‘হ্যা, আগে যেতে পারতাম। এখন পারি না। তারা আমাকে ব্ল্যাকলিস্ট করেছে।’
রামিজ দেখল, সুআদ তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। কিছুক্ষণ পর সুআদ বলল, ‘জানো, আমি এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে তুমি সত্যিই কিছুটা বীর।’
‘বীর? না! তবে তোমার কার্ডটা আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।’
‘তুমি এখনো রেখেছ?’
‘এই যে।’
রামিজ তাকে কার্ডটা দিল আর ফেরত নেওয়ার সময় তার হাত আলতো করে একটু চেপে ধরল। পরে হঠাৎ করে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নীল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকল, যাতে সুআদ তার লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখ লুকাতে পারে।
তখন ছিল বসন্তকাল। এই অঞ্চলের বসন্ত মানেই ঝকঝকে নীল সমুদ্র, দিনে সাদা পালতোলা নৌকা আর রাতে মাছ ধরার বোটগুলোয় বাহারি আলোর ঝিকিমিকি। বাতাসে কমলার পাগল করা সুবাস।
সেই বসন্তে রামিজ শিখেছিল দুটি বিষয়—ভালোবাসা ও যুদ্ধ। আর ভালোবাসাই যুদ্ধকে অর্থবহ করে তোলে। যুদ্ধ কেবল শত্রুকে বিনাশ করার ব্যাপার নয়। বরং একজন বীরের ভালোবাসার ভূমি আর ভালোবাসার নারীর জীবনকে রক্ষা করার এক দৃঢ় অঙ্গীকার। প্রেমই তাকে শিখিয়েছিল, কেন এই যুদ্ধ এত জরুরি। ফিলিস্তিন মানে শুধু সমুদ্র নয়; কমলা, জলপাই নয়; সেটা ছিল সুআদের কালো চোখ, যাতে সে সমস্ত ফিলিস্তিনের মাধুর্য খুঁজে পেয়েছিল। সে এক সুখী সংসারের ছবি দেখতে পেল, এক স্ত্রী যে তাকে বীর সন্তান দেবেন এবং যার ভালোবাসাই হবে তার জীবনের অর্থ।
প্রতিটা দিন শুরু হতো সকালে পত্রিকায় প্রকাশিত যুদ্ধের খবর পড়ে। রামিজের চোখে–মুখে উদ্বেগ আর উত্তেজনা। কাসতালের যুদ্ধে ট্রায়াঙ্গাল অব টেরর থেকে তাদের ইহুদি বসতিতে পাল্টা আক্রমণ, ক্রমাগত হাইফা-আক্রা-নাহারিয়ার রাস্তা ধরে আসা ইহুদি সাঁজোয়া বাহন ধ্বংস করার অভিযান, সালামাসহ প্রতিটি শহর ও গ্রামে ফিলিস্সেহ জনগণের বীরত্বগাথা তাদের মাতিয়ে রেখেছিল।
তারপর এল হাইফা পতনের দিন।
দিনটি রামিজ কখনো ভুলতে পারবেন না।
রামিজ তখন রিক্রুটদের প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। হঠাৎ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দেখল, শত শত নৌকা শরণার্থীতে ভরা। আক্রার মানুষ শহরের দেয়াল ঘেঁষে ভিড় করে দাঁড়াল, পরিস্থিতির খোঁজ নিতে। তারা জানত, হাইফায় লড়াই চলছে আর ব্রিটিশরা গোপনে ইহুদিদের সাহায্য করছিল। তারা বলেছিল, ম্যান্ডেট শেষ হওয়ার কিছু মাস পর শহর ছাড়বে, কিন্তু হঠাৎ ঘোষণা দিল যে তারা এখনই ছাড়ছে।
ততক্ষণে করমেল পাহাড় থেকে তাণ্ডব নেমে এসেছে। ভয়ে লোকেরা বন্দরে জড়ো হলো। ব্রিটিশরা রটনা ছড়াল, বন্দরের গেট খুলে দিল, জাহাজ দিল পালানোর জন্য। লোকেরা ঠেলাঠেলি করে উঠল আর পাহাড়ের দিক থেকে আসতে লাগল ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি।
নৌকাগুলো তাদের আক্রার তীরে ফেলে দিল। কেউ আহত, কেউ ক্ষুধায় ক্লান্ত, কেউ আতঙ্কে বাকরুদ্ধ।
রামিজের শহরের ঘরবাড়ি, মসজিদ, গির্জা, চত্বর—সব শরণার্থীতে ভরে গেল।
সেই রাতে সে সুআদকে দেখল, ডজন ডজন নারী স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে বন্দরে দাঁড়িয়ে, আহত মানুষদের কাউকে হাসপাতালে, কাউকে বাড়িতে পাঠাচ্ছে।
পরদিন সকালে দরজায় জোর কড়া নাড়ার শব্দে তার ঘুম ভাঙল। দরজা খুলে সে অবাক! সামনে সুআদ, কাঁদছে।
সে বলল, তার ভাই একটা ট্রাক জোগাড় করেছে, সবকিছু ভরে স্ত্রী–সন্তানদের নিয়ে লেবাননে চলে গেছে। পাড়ার বিশটি পরিবার ইতিমধ্যে চলে গেছে। ভাই তাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, সে রাজি হয়নি। ঝগড়া হয়েছে। তার ভাই তাকে চড় মেরেছে। সে কেঁদেছে, তারপর পালিয়ে এসেছে।
সে বলল, ‘আমি সবার শেষে যাব।’
রামিজ স্তব্ধ, কী বলবে বুঝতে পারছিল না। সে বুকে মুষ্টি ঠুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কি এটা আমার জন্য করেছ?’
সে চিৎকার করে বলল, ‘না, তোমার জন্য না। হ্যা, আমি তোমাকে ভালোবাসি, ঠিক আছে। কিন্তু তুমি সবকিছু নও!’ তারপর চলে গেল।
সে দরজা খুলে শহরের রাস্তায় বের হলো। ছোট–বড় অগণিত গাড়ি ছুটে চলেছে; ভরা, ফাঁকা, দ্রুতগতিতে। সে অবাক, সে জানে না সে কি কাঁদবে, না চিৎকার করবে নাকি পাথর ছুড়বে।
*
এক সপ্তাহ পর শহরটি একরকম ফাঁকা হয়ে গেল। শুধু কিছু যোদ্ধা, কয়েকজন নারী নার্স, যারা ছোট ছোট হাসপাতালে ছড়িয়ে ছিল আর হাইফা ও আশপাশের গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীরা ছাড়া আর কেউ ছিল না। এখন আর সুআদের সঙ্গে দেখা করার সময় ছিল না। উত্তর ও দক্ষিণে শত্রু আক্রমণের জন্য ওত পেতে ছিল। দিনের বেলায় সে গ্রামে ঢুকে অস্ত্র ও গুলি সংগ্রহ করত; রাতগুলো কাটত ছাদে গড়ে তোলা ব্যারিকেডের পেছনে পাঁচজন সহযোদ্ধার সঙ্গে, পুরোনো একটি সিগারেট কারখানার ছাদে। শহরটাকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব রামিজদের কাঁধে। ম্যান্ডেট শেষ না হওয়া পর্যন্ত আরব বাহিনী না আসা পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে হবে।
এই দায়িত্বই তাকে দিয়েছিল আক্রার জাতীয় কমিটি। বিশ্রামের সুযোগ পেলেই তার মনে পড়ত সুআদের কথা—সে কেমন আছে, কোথায় আছে, কীভাবে আছে।
একদিন হঠাৎ সুআদকে দেখে রামিজ থমকে দাঁড়াল।
সুআদ একটা কোট পরা ছিল আর হাতে ছিল একটা বিশাল ঝুড়ি।
রামিজ বুঝতে পারছিল না কীভাবে কথা বলবে, সুআদ নিজেই সামনে এগিয়ে ঝুড়ি খুলে সবার উদ্দেশে বলল, ‘জাতীয় কমিটি ভয় পেয়েছে, তোমাদের হয়তো খাবার ফুরিয়ে যাবে, তাই আমাকে পাঠিয়েছে এইগুলো নিয়ে।’
ঝুড়িতে ছিল রুটি, সিগারেট আর ক্যান্ডি। সুআদের চোখে খেলা করছিল দরদ আর ভালোবাসার জেল্লা।
রামিজের ইচ্ছা করছিল, কমরেডদের সামনেই সুআদকে জড়িয়ে ধরতে।
তার মনে হচ্ছিল, তারই একমাত্র অধিকার আছে সুআদের সঙ্গে একটু পথ হাঁটার আর কাঁপা হাতে তার হাতের আঙুলগুলো ধরার। রামিজ মনে মনে সেই হাত ঠোঁটে তুলে চুপি চুপি অনুরোধ করল, আর যেন এমন পাগলামি কোরো না লক্ষ্মীটি।
সুআদ চলে গেল আর রামিজ তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল মোড় ঘুরে দৃষ্টির আড়াল হওয়া পর্যন্ত।
সুআদ বারবার আসত।
থাকত কয়েক মিনিট, কিন্তু সেই অল্প সময়েই রামিজের হৃদয় আলোড়িত হতো—একই সঙ্গে ক্লান্তি আর সুখে।
সপ্তাহের শুরুর দিনগুলা পর্যন্ত সবকিছু এভাবেই চলছিল।
তারপর যুদ্ধ তীব্র হয়ে উঠল। এক দিন ও দুই রাত ধরে গোলাবর্ষণ চলল, আংশিকভাবে তৃতীয় দিনেও।
শত্রুপক্ষের সাঁজোয়া গাড়িগুলো নাহারিয়াহ সড়ক ধরে অগ্রসর হচ্ছিল। যোদ্ধাদের বাধ্য হয়ে বাড়ির ছাদে কামান বসিয়ে ওদের ওপর হামলা চালাতে হয়।
লড়াই থামল পরদিন বেলা তিনটায়। কেউ ব্যারিকেডে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল, কেউ বা মাটিতে।
রামিজ হাত-মুখ ধুতে নিচে নামছিল, বাগানের কলের কাছে, তারপর সে শহরের দিকে যাবে। তার জানা দরকার, আরব লেজিয়নের পরিকল্পনা কী? ধ্বংস হওয়া গাড়িগুলো কীভাবে শহরে আনা হবে? মুখজুড়ে তখনো সাবান, এমন সময় গুলি চলার শব্দ; একটা, তারপর আরেকটা। সে চোখ থেকে সাবান মোছার আগেই শুনল একটা কণ্ঠস্বর, পরিচিত ও প্রিয়।
ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল, সুআদ দরজা পেরিয়ে ঢুকেছে। এক হাতে ঝুড়ি, অন্য হাত বুকের ওপর।
প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেি, কারণ সুআদ তখনো দাঁড়িয়ে ছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সুআদ হঠাৎ করেই রামিজের বাহুতে পড়ে গেল আর তার বুক থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। রামিজ হাত দিয়ে দ্রুত ক্ষত চাপা দিতে দিতে, তার কমরেডদের ডেকে তুলল। সবাই শার্ট ছিঁড়ে রক্ত আটকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
সুআদ কিছু বলার জন্য মুখ খুলল, কিন্তু একটা ঘড়ঘড় শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা গেল না। তারপর একটামাত্র গোঙানির সঙ্গে সবকিছু শেষ হয়ে গেল।
পুরো ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটল, রামিজ বিশ্বাস করতেই পারছিল না। চোখের পলকেই সব শেষ হয়ে গেল। আহা, সময় কেন থেমে গেল না? কীভাবে মৃত্যু এসে তাকে নিয়ে গেল আর রামিজ জীবন্ত থাকল? কেন রামিজের চুম্বন আর আর্তনাদ সুআদকে ফিরিয়ে আনতে পারল না? কেন সুআদের চোখের পাতাগুলো কাঁপল না ভালোবাসার ফিসফিস শব্দে?
সুআদ মৃত। অথচ বাতাসে তখনো তার চুলের সুবাস, হাতের উষ্ণতা, ঠোঁটের স্বাদ রয়ে গেছে। তার চোখের ভাষায় কখনো মৃত্যু লেখা ছিল না। তার চোখ বলত শুধু ভালোবাসা আর জীবনের কথা।
*
অশ্রুভরা চোখগুলো মুছে ভয়ানক সেই দুঃস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করল রামিজ, এই দুঃস্বপ্ন তাড়াতে চোখ ডলতে ডলতে সে ইব্রাহিমের দেওয়া পাইপটা শক্ত করে ধরল, যাতে তার নখগুলো হাতের তালুতে ঢুকে না যায়। সে তার কমরেডদের দিকে স্থিরচোখে তাকাল। হ্যা, সে মৃত। তাদের চোখ যেন এই কথাই বলছিল, ‘তাকে তোমার কাছ থেকে নিয়ে গিয়ে ওই পাহাড়ে কবর দিতে হবে আমাদের। আমরা তার কবরটা একটা পতাকা দিয়ে চিহ্নিত করব আর তাকে বীরঙ্গনা ঘোষণা করব।’
‘সে তোমাকে ভালোবাসত আর ইব্রাহিম, ওয়াদি, সালিহ, আহমদ আর আবদুল্লাহ—আমাদের সবার কাছেই সে একটা অনুপ্রেরণার প্রতীকে পরিণত হয়েছিল।’
*
একটি চিকন হলুদ চাঁদ এবং কিছু তারা। শুধু অন্ধকার আর জ্বলন্ত সিগারেটের শেষ অংশগুলা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ব্যারিকেডের পেছনে তাদের কাছে খাবার বা পানীয় কিছুই ছিল না এবং তাদের কারোরই ঘুম হয়নি।
বাকিটা রাত শান্তভাবেই কাটল, ভোরের দিকে এক-দুইটা ছোট্ট তুচ্ছ সংঘর্ষ ছাড়া। তারপর সবকিছু শান্ত হয়ে গেল আর ক্লান্ত মাথাগুলো ঘুমে ঢলে পড়ল, ক্ষুধা আর ভয় দ্বারা বিঘ্নিত আধমরা নিদ্রায়।
ভোরে আবদুল্লাহ চোখ মুছে পাশের কাঠের বাক্সগুলোর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘খাবার কিছুই কি নেই এইখানে?’
ওয়াদি উত্তর দিল, ‘হ্যা, আমাদের ক্ষুধা আছে।’
তারপর সে নীরব হয়ে রইল।
সেখানে সুআদের আনা রুটিগুলো ছিল, তার রক্তে মাখা। আহা! রুটিগুলা কী ভয়ংকর সস দিয়ে মাখানো।
তাদের ক্ষুধা এমনই তীব্র হয়ে উঠেছিল যে তারা আর দাঁড়াতেও পারছিল না।
রামিজ অনুভব করল যে পরিস্থিতি ক্রমেই অপমানজনক হয়ে উঠছে। এই অগ্নিপরীক্ষায় তার সঙ্গীদের ভেতর কেবল সে-ই সাহস করে সেই রুটি খেতে পারে, যা সুআদ তার রক্ত দিয়ে পবিত্র করেছে।
রামিজ চোখ বন্ধ করে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে, যখন সুআদের বন্ধুরা সুআদের রক্তমাখা রুটি খেতে বাধ্য হয়?
সে সহযোদ্ধাদের দিকে তাকাল। আবদুল্লাহ একটি কম্বলে শুয়ে ছিল, সালেহও। আহমাদ একটি স্যান্ডব্যাগে বসে ছিল, তার পেটের দিকে হাত চেপে ধরে।
তারা একটি কুকুরের মৃতদেহও খেতে প্রস্তুত ছিল, কিন্তু কেউই সেই রুটি, যা রক্তে ভেজা, ধরল না। তাকেই কিছু একটা করতে হবে। সে কি বলবে তার সহযোদ্ধাদের, ‘এটা খাও, সুআদ আমাদের জন্য এই রুটি আর সস হিসেবে রক্ত দিয়েছে?’
রামিজ মাথা নিচু করে রাখল কিছু সময়ের জন্য, তারপর নিজেকে টেনে তুলে দাঁড়াল। যদি রুটি খাওয়ার এই ভাবনা ভয়ংকর ও পৈশাচিক হয়, তবে নিশ্চয়ই তাকে শহরে গিয়ে কিছু খাবার জোগাড় করতে হবে।
রামিজ দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু সে খুবই দুর্বল ছিল। তার সহযোদ্ধারা ভালো করেই জানে, শহরে যাওয়ার মানেটা কী হতে পারে। একেকটি গুলি তাকে পাখির মতো মেরে ফেলতে পারে। তাদের অবস্থান আর শহরের কেন্দ্রের মাঝখানের খোলা জায়গাটা ছিল বিশাল আর অরক্ষিত। যেকোনো মুহূর্তে সাঁজোয়া গাড়িগুলো চারপাশে গুলি ছিটাতে ছিটাতে আসতে পারত। তাই সালেহ তার কাঁধে ধরে তাকে বসিয়ে দিল।
সে বসে পড়ল আর আবারও রক্তে মাখানো রুটি আর ক্ষুধার মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হলো।
সেখানে, এককোণায়, ঝুড়ির মধ্যে, ঠিক যেমন সুআদ রেখেছিল, এখনো স্তূপ হয়ে সেইখানে সেই রকমই রুটিগুলো আছে। ভয়ানক কষ্টকর, কিন্তু এটা পাঁচটি জীবন বাঁচাবে।
রামিজের আর কী মূল্য দিতে হবে? সে কি সহ্য করতে পারবে, দেখবে তার সহযোদ্ধারা রুটিগুলো টুকরো টুকরো করে কেটে খাচ্ছে আর সেই রুটির মধ্যে সুআদের রক্ত মিশে আছে? তার চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। না, এটা কখনোই হতে দেওয়া যায় না, যতক্ষণ না তারা সবাই মরবে। তারা তো সুআদের চেয়ে ভালো নয়, তাহলে যদি তারা মরেও যায়, তাতে কী আসে যায়? সে মরে গেছে তাদের কাছে রুটি নিয়ে আসার সময়, কিন্তু রামিজরা মরবে এই কারণে যে তারা তার রুটি স্পর্শও করবে না। সুআদের মৃত্যু তাদের জীবন বাঁচাতে পারবে না। তারা আত্মত্যাগের রুটি প্রত্যাখ্যান করবে, যা তাদের মানবতাকে অথবা অন্তত রামিজের নিজের মানবতাকে পরীক্ষা করার জন্য দেওয়া হয়েছে। তারা এমন কী করছিল যে তাদের না খেয়ে মরতে হবে? কিন্তু তারা যদি সত্যিই মারা যায়? তারা হয়তো রুটির কথা ভুলে যেতে পারে। যা–ই হোক, তারা এখনো এটি নিয়ে ভাবছে না। তারা নিজেদের এখন পর্যন্ত বিরত রেখেছে, নতুন কোনো খাদ্যের আশায়, অথবা মরতে প্রস্তুত এবং তাদের সঙ্গে মরবে সেই সুযোগ, যে সুযোগের মধ্য দিয়ে তারা সুআদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পারত।
প্রতিশোধ? হ্যা, সে কীভাবে তা ভুলে গেছে? কীভাবে সে ক্ষুধায় মরে যাওয়ার মতো একটা ছোটলোকি মৃত্যু পছন্দ করছে আর পাঁচজন সহযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে মরে যাবে? মৃত্যুর সঙ্গে এত বেশি সাক্ষাৎ যে সে তার ভয় বা দুঃস্বপ্নগুলো আর অনুভব করতে পারে না। তবে যদি সে মৃত্যুকে পছন্দ করতে পারত, তবে ক্ষুধায় মরে যাওয়া কোনোভাবেই সে পছন্দ করত না। সুআদ নিজে কখনোই একজন নায়ককে এমনভাবে মরতে দিত না।
রামিজ যন্ত্রণায় কেঁপে উঠল।
সে বুঝতে পারল, গত রাতের পুরোটা সময় সে নিজের ক্ষুধা নিয়েই বেশি চিন্তা করেছে, সুআদের ব্যাপারে নয়। ক্ষুধা যেন অন্য সব অনুভূতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। কী জঘন্য অভিজ্ঞতা!
সে তার কমরেডদের ডাকছিল আর তার সঙ্গীরা সামান্যই চোখ খুলতে সক্ষম হয়েছিল।
রামিজ এখন একে একে সবার নাম ধরে ডাকবে: ইব্রাহিম, ওয়াদি, সালেহ, আহমাদ, আবদুল্লাহ। তারা তার চারপাশে একটি বলয় তৈরি করবে। তারপর সে উঠে দাঁড়িয়ে রুটির ঝুড়ি নিয়ে আসবে। ঝুড়ি খুলে, সে তাদের একটি প্রাচীন গল্প শোনাবে, যা এই ভূমি আর এর মানুষের কাছে পরিচিত—একটি গল্প যা জীবনকে রক্ত ও মাংসের মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছিল। তারপর সে রুটিগুলো ঝুড়ি থেকে তুলে, এক ইউথিক ধর্মযাজক যেমন যিশুর রুটি উৎসর্গের গল্পটা বলে, সে তার গলায় তেমনই গাম্ভীর্য এনে বলবে: ‘খাও, কারণ এটি আমার শরীর; পান করো, কারণ এটি আমার রক্ত।’ সে নিজেও কিছু খাবে আর কিছুটা সুআদ তার মধ্যে থেকে যাবে। কীভাবে এ কথা তার মনে আগে আসেনি?
কিছু একটা এখন তাকে নাড়া দিয়ে বলছে, চিত্কার করছে, স্মরণ করাচ্ছে যে তাকে কিছু একটা করতেই হবে, সেই শরীরের জন্য, যেটিকে বাগানের এককোণায় পুঁতে রাখা হয়েছে।
*
রামিজ নিজেকে কোনোমতে উঠিয়ে অন্য কোণে চলে গেল আর তার গতিবিধি অনুসরণ করছিল পাঁচ জোড়া চোখ। সে বুঝতে পারছিল, তাদের দৃষ্টি তার পায়ের দিকে স্থির। কাঁপতে থাকা হাতে সে ঝুড়িটা নিল, খুলল এবং রুটিটা নিজের ঠোঁটে তুলল। তারপর সে তার সঙ্গীদের কাছে এগিয়ে গেল, হাঁটু গেড়ে বসল এবং রুটিগুলো এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘খাও... সুআদ চায়নি যে আমরা না খেয়ে মারা যাই।’
তারপর দুনিয়া শূন্য হয়ে গেল, বৃত্তের বাইরে চলে গেল পৃথিবী আর রামিজ অচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।