
ওয়ারিস শাহ (১৭২২-১৭৯৮) পাঞ্জাবের ইতিহাসে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন চিশতিয়া তরিকার অনুসারী পাঞ্জাবি সুফি কবি। পাঞ্জাবের লোককথা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে কবিতার মাধ্যমে তিনি অমর করে রেখেছেন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হলো ‘হির রান্ঝা’ কাব্য, যা পাঞ্জাবের ট্র্যাজিক রোমান্সের অন্যতম প্রতীক।
• উপস্থাপন ও অনুবাদ: সৈয়দ তারিক
ওয়ারিস শাহর পুরো নাম ছিল সৈয়দ মোহাম্মদ ওয়ারিস শাহ। তিনি ১৭২২ সালে পাঞ্জাবের জন্দিয়ালা শের খান (বর্তমান পাকিস্তানের শেখুপুরা জেলা) গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম গুলশের শাহ এবং মায়ের নাম কমল বানু। তাঁর পরিবার নবিজির বংশধর বলে পরিচিত ছিল।
শৈশবে তিনি কোরআন শিক্ষা লাভ করেন এবং ফারসি ও আরবি ভাষায় সুদক্ষ হন। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন কাসুর শহরের কুতুবিয়া মাদ্রাসায়।
অল্প বয়সে তাঁর মা–বাবার মৃত্যুর পর তিনি একাকী হয়ে পড়েন এবং আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। তিনি কাসুরের পীর মখদুম হাফিজ গুলাম মুর্তজার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর কাছ থেকে তিনি শিক্ষা লাভ করেন। এই শিক্ষা ছিল সুফি দর্শন ও সাহিত্যকেন্দ্রিক।
শিক্ষা সমাপ্তির পর ওয়ারিস শাহ পাকপত্তনের কাছে মালকা হান্স গ্রামে বসবাস শুরু করেন। সেখানে তিনি একটি হুজরা, অর্থাৎ ছোট কক্ষে থাকতেন। এটি একটি ঐতিহাসিক মসজিদের সংলগ্ন ছিল। বর্তমানে এটি ‘মসজিদ ওয়ারিস শাহ’ নামে পরিচিত। তাঁর জীবন ছিল সাধারণ ও আধ্যাত্মিক। তিনি কবিতা রচনায় মগ্ন থাকতেন।
ওয়ারিস শাহর জীবনকাল ছিল ১৮ শতকে। এটা ছিল পাঞ্জাবের জন্য রাজনৈতিকভাবে অস্থির ও বিক্ষুব্ধ সময়। তাঁর কবিতায় এই সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার ছাপ সুস্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায়। ১৭৪৮ সালে আহমদ শাহ আবদালির ভারত আক্রমণের সাক্ষী ছিলেন তিনি, যা লাহোরের যুদ্ধে পরিণত হয়। এ ঘটনায় তিনি মোগল সেনাপতি শাহ নওয়াজকে কাপুরুষ বলে কবিতায় নিন্দা করেন।
ওয়ারিস শাহ ছিলেন চিশতিয়া তরিকার একজন সুফি সাধক, তাঁর দর্শন ও কবিতায় সুফিবাদের গভীর প্রভাব লক্ষ করা যায়। তিনি ইশ্ক-ই-হাকিকি বা আল্লাহর সঙ্গে আত্মার মিলনের গূঢ়তত্ত্বকে সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলার জন্য ইশ্ক-ই-মাজাজি বা মানবীয় প্রেমের রূপক ব্যবহার করেছেন।
ওয়ারিস শাহ ১৭৯৮ সালে ৭৬-৭৭ বছর বয়সে লোকান্তরিত হন। তাঁর সমাধি পাঞ্জাবের জন্দিয়ালা শের খানে অবস্থিত। সেখানে প্রতিবছর ওরস উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। আশেকজনেরা সেখানে তীর্থস্থান হিসেবে যান।
যেহেতু ওয়ারিস শাহ ছিলেন চিশতিয়া তরিকার একজন সুফি সাধক, তাঁর দর্শন ও কবিতায় সুফিবাদের গভীর প্রভাব লক্ষ করা যায়। তিনি ইশ্ক-ই-হাকিকি বা আল্লাহর সঙ্গে আত্মার মিলনের গূঢ়তত্ত্বকে সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলার জন্য ইশ্ক-ই-মাজাজি বা মানবীয় প্রেমের রূপক ব্যবহার করেছেন। তাঁর বিখ্যাত কাব্য ‘হির রান্ঝা’কে অনেক গবেষক আত্মা ও পরমাত্মার মিলন এবং জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্তির প্রতীকী রূপায়ণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। এই কাব্যের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও প্রেম সামাজিক বাধা ও কুসংস্কারের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত আত্মা মুক্তি লাভ করে। তিনি বিশ্বাস করতেন, আত্মার মুক্তি প্রেম, ধ্যান ও আত্মজিজ্ঞাসার মাধ্যমে অর্জিত হয়। তাঁর কবিতায় ইহলোক ও পরলোকের, মানুষ ও ঈশ্বরের, প্রেমিকা ও প্রেমিকের মধ্যে সূক্ষ্ম দ্বৈততা প্রকাশিত হয়েছে। ওয়ারিস শাহ প্রেমকে এক অলৌকিক শক্তি হিসেবে দেখেন, যা আত্মাকে শুদ্ধ করে।
ওয়ারিস শাহ সমাজের ধর্মীয় ভণ্ডামি, লোভ, নারী অবমাননা ও শ্রেণিভেদের বিরুদ্ধে তীব্র কণ্ঠে সমালোচনা করেছেন। তিনি সাধারণ মানুষের কষ্ট, গ্রামীণ জীবনের অস্থিরতা ও সমাজের অবক্ষয়কে তুলে ধরেছেন। তিনি সমাজে দুর্বল ও শোষিত শ্রেণির যন্ত্রণা তুলে ধরেছেন। উদাহরণস্বরূপ, তাঁর লেখায় উঠে এসেছে যে কীভাবে সমাজে ক্ষমতাবানদের মিথ্যা গোপন করা হয় এবং ক্ষমতাহীন ব্যক্তিকে সর্বদা মিথ্যাবাদী ঘোষণা করা হয়। তিনি মানব সম্পর্কের এবং স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের ভিত্তি হিসেবে অর্থনৈতিক প্রয়োজনকে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর দর্শনে সমাজের শ্রেণিবিভাজন, জমি বিতর্ক ও লিঙ্গ–অসমতা—এগুলোর মূলে অর্থনৈতিক স্বার্থই প্রধান।
ওয়ারিস শাহ লিঙ্গসমতাকে গুরুত্ব দেন। নারীরা পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে একত্র হয়ে বিপ্লব ঘটাতে পারে। নারীকে তিনি কেবল কামনাবস্তু হিসেবে না দেখে আত্মশক্তির প্রতীক হিসেবে দেখিয়েছেন। ‘হির’ চরিত্রের মাধ্যমে তিনি নারীর স্বাধীনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও আত্মমর্যাদার প্রশংসা করেছেন। ভালোবাসা কোনো সামাজিক সীমা মানে না, এটি শ্রেণি, জাতি অতিক্রম করে। আধুনিক প্রেক্ষাপটে তাঁর দর্শন শ্রেণি-অসমতা, জোরপূর্বক বিয়ে ও ধর্মীয় শোষণের বিরুদ্ধে প্রাসঙ্গিক।
ওয়ারিস শাহ পাঞ্জাবি সাহিত্যে প্রধানত কিসসা বা আখ্যানমূলক দীর্ঘ কবিতার ধারার জন্য অমর হয়ে আছেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক পরিচিত সাহিত্যকর্ম ‘হির রান্ঝা’ ১৭৬৬ সালে রচিত হয়। এটি হির ও রান্ঝার লোককথাভিত্তিক ট্র্যাজিক প্রেমকাহিনি। এটি শুধুই একটি প্রেমের কাহিনি নয়, বরং এটি একটি সুফি রূপকথা, যেখানে ‘হির’ ঈশ্বর বা সর্বোচ্চ সত্যের প্রতীক, আর ‘রান্ঝা’ প্রতীক আত্মার—যিনি সেই সত্যের সন্ধানে জীবনভর পথ চলেন।
ওয়ারিস শাহর ‘হির-রান্ঝা’র সংস্করণটি পাঞ্জাবি লোককথার করুণ প্রেমের কাহিনির সবচেয়ে জনপ্রিয় রূপ। এর কারণ, তিনি কেবল একটি প্রেমের গল্পই বলেননি, বরং ১৮ শতকের পাঞ্জাবের নৃতাত্ত্বিক বিবরণ, ভাষা ও রীতিনীতি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন। এটি কেবল একটি রোমান্টিক মহাকাব্য নয়, বরং এই অঞ্চলের সামাজিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি বোঝার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এতে সমাজের জমি-বিতর্ক, শ্রেণিবিভাজন ও লিঙ্গ–অসমতা বর্ণিত। রান্ঝার যাত্রা (বাঁশি বাজানো থেকে যোগী হওয়া), সমাজের নেতিবাচকতা ও আধ্যাত্মিক জাগরণের প্রতীক।
পাঞ্জাবে কয়েক শ বছর ধরে, তাঁর হির রান্ঝা-এর কাব্যরূপটি প্রেমের করুণ পরিণতি এবং আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই কিসসাটি ঐতিহ্যগতভাবে ভৈরবী রাগে পরিবেশিত হয়।
ওয়ারিস শাহ লিঙ্গসমতাকে গুরুত্ব দেন। নারীরা পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে একত্র হয়ে বিপ্লব ঘটাতে পারে। নারীকে তিনি কেবল কামনাবস্তু হিসেবে না দেখে আত্মশক্তির প্রতীক হিসেবে দেখিয়েছেন। ‘হির’ চরিত্রের মাধ্যমে তিনি নারীর স্বাধীনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও আত্মমর্যাদার প্রশংসা করেছেন।
‘হির রান্ঝা’ ছাড়াও ওয়ারিস শাহ বেশ কিছু কবিতা ও পঙ্ক্তি রচনা করেছেন, যা পাঞ্জাবের লোকমুখে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। তাঁর অনেক উদ্ধৃতি জীবনের অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও মানুষের স্বভাব নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করে। যেমন তাঁর একটি বিখ্যাত পঙ্ক্তি, ‘একজন মানুষ কখনই তার অভ্যাস পরিত্যাগ করতে পারে না, এমনকি তাকে টুকরো টুকরো করে কাটা হলেও না।’ এই পঙ্ক্তি মানুষের বদ্ধমূল অভ্যাস ও প্রবণতার দিকে নির্দেশ করে।
ওয়ারিস শাহ পাঞ্জাবি সাহিত্যের এক নিপুণ রূপকার। তাঁর কবিতায় রয়েছে নাটকীয় গঠন, অলংকার, ছন্দ, লোকজ অভিব্যক্তি ও গভীর আধ্যাত্মিক বোধ। তিনি অত্যন্ত সরল অথচ হৃদয়গ্রাহী ভাষায় তাঁর কবিতা রচনা করেছেন, যা সর্বসাধারণের কাছে সহজবোধ্য। ‘হির রান্ঝা’ ছাড়াও তাঁর অনেক পঙ্ক্তি পাঞ্জাবের মানুষের মুখে মুখে ফেরে এবং নৈতিক শিক্ষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাঁর জীবনী নিয়ে ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে পাঞ্জাবি ভাষায় ‘ওয়ারিস শাহ’ নামে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।
ওয়ারিস শাহর উত্তরাধিকার অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। তাঁকে পাঞ্জাবি সাহিত্যের এক স্তম্ভ হিসেবে গণ্য করা হয়। বহু লোককবি ও সুফিকবি ওয়ারিস শাহর ছায়া অনুসরণ করেছেন, যেমন বুল্লে শাহ, শাহ হুসাইন, মিয়া মোহাম্মদ বখশ প্রমুখ। ওয়ারিস শাহর কবিতা আজও পাঞ্জাবের ঘরে ঘরে আবৃত্তি করা হয়। তাঁর ‘হির রান্ঝা’ কাব্য পাঞ্জাবি নাটক, কাওয়ালি, লোকগান ও চলচ্চিত্রে বারবার ফিরে আসে। আধুনিক পাঞ্জাবি সাহিত্য, নাটক ও আধ্যাত্মিক সংগীত তাঁর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত।
পাঞ্জাবি কবি অমৃতা প্রীতম ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের ভয়াবহতা দেখে শোকার্ত হয়ে ওয়ারিস শাহকে উদ্দেশ্য করে তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘আজ আখা ওয়ারিস শাহ নুঁ’ রচনা করেন। এই কবিতায় তিনি ওয়ারিস শাহকে তাঁর কবর থেকে উঠে এসে পাঞ্জাবের রক্তাক্ত ও বিভাজিত অবস্থা দেখতে আহ্বান জানান। এটি পাঞ্জাবিদের কাছে ওয়ারিস শাহর সাংস্কৃতিক ও নৈতিক গুরুত্বের গভীরতা প্রমাণ করে।
ওয়ারিস শাহ তাঁর কবিতার মাধ্যমে কেবল পাঞ্জাবি সাহিত্যকেই সমৃদ্ধ করেননি, বরং পাঞ্জাবি জনগণের আবেগ, সংগ্রাম ও ভালোবাসার এক গভীর প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন, যা তাঁকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রাসঙ্গিক করে রেখেছে।
ওয়ারিস শাহ পাঞ্জাবের আত্মা। তাঁর জীবন সাধারণের মধ্যে অসাধারণ, তাঁর দর্শন সমাজ-পরিবর্তনমুখী, তাঁর কার্যাবলি আধ্যাত্মিক-সামাজিক এবং তাঁর কবিতা অমর। তাঁর ‘হির রান্ঝা’ আজও পাঞ্জাবি সংস্কৃতির প্রাণ। তাঁর চিন্তা আধুনিক সমস্যার সমাধানে প্রাসঙ্গিক, যেমন লিঙ্গসমতা ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা। ওয়ারিস শাহর মতো কবিরা আমাদের শেখান, প্রেম ও দর্শন সমাজকে বদলাতে প্রণোদনা দিতে পারে।
১.
প্রথমে বন্দনা করি মহান আল্লার।
প্রেমকে করেন যিনি জগতের সার।।
তিনিই প্রথম হন প্রেমের আশেক।
নবিজি প্রেমাস্পদ, খোদার মাশেক।।
২.
সবাই নিজেকে সুফি বলে, কিন্তু আসলে তা নয়।
যে নিজের অস্তিত্ব ভুলে যায়, সে-ই সত্যিকারের সুফি।
৩.
আমি রান্ঝার নাম করতে করতে নিজেই রান্ঝা হয়ে গেছি।
সবার কাছে আমি রান্ঝা, কেউ আর আমায় হির বলে না।
৪.
শ্বাস নিতে পারি না, যেন দম আটকে আসে,
যদি প্রেম না পেতাম, তবে মরেই যেতাম।
৫.
সত্য বললে মার খেতে হয়,
আর মিথ্যে বললে শাসক খুশি হয়।
৬.
প্রেমের পথে বুদ্ধির কোনো স্থান নেই,
যেখানে প্রেম আসে, বুদ্ধি হার মানে।
৭.
মানুষে মানুষে পার্থক্য বুঝে চলো,
ঝলমলে পোশাকে থাকলেও অনেকের ভিতরে অন্ধকার।
৮.
যদি তুমি ঈশ্বরকে পেতে চাও, তবে নিজের ভেতরে খোঁজো,
তিনি তোমারই ভেতরে বসবাস করেন।
৯.
যদি প্রেম বাজারে পাওয়া যেত,
তাহলে তো সবাই প্রেমিক হয়ে যেত।
১০.
সাধুরা বনে থাকে না কেবল,
প্রেম কখনো মানুষের মতামত চায় না।
১১.
হিরের প্রেম আর রান্ঝার যন্ত্রণা—
এমন যে তা ঈশ্বরকেও কাঁদিয়ে ফেলে।
১২.
যারা প্রেমকে উপার্জন করেছে, একমাত্র তারাই বোঝে,
বাকিদের তর্কতর্কি সব বৃথা।
১৩.
প্রেমকে কখনো যুক্তির দাঁড়িপাল্লায় মাপা যায় না,
এ পথ পাগলের পথ।
১৪.
প্রেমের ধাক্কায় শ্বাসও ঠিকমতো ওঠে না,
প্রিয়জনের হাতে পড়ে থাকে প্রাণ।
১৫.
প্রাণ বেরিয়ে যায় তবু প্রেম ফুরোয় না,
প্রতিটি শ্বাসে প্রেম শুধু বাড়তেই থাকে।
১৬.
যার ভেতর প্রেম নেই, সে জীবন্ত হলেও মৃত,
তার মধ্যে কোনো আত্মার অস্তিত্ব নেই।
১৭.
যারা প্রেমের সত্যের পেয়ালা পান করেছে,
তারা দুনিয়ার রংচং থেকে দূরে সরে গেছে।
১৮.
প্রেমের কথা বড়ই নাজুক,
এ কথা সকলের আয়ত্তে আসে না।
১৯.
প্রেম আমাদের শরীরে রক্তিম ক্ষত দিয়ে গেছে,
আর ধনী-লোভীদের লালসা আমাদের মেরে ফেলেছে।
২০.
প্রেমিকের হৃদয়ে যে আগুন জ্বলে,
সে আগুন এমন নয় যে জলে নিভে যাবে।
২১.
প্রভুর সত্তা অদ্ভুত এবং অমোঘ,
যে তাঁকে খুঁজে পায়, সে-ই সত্যিকারের ভাগ্যবান।
২২.
প্রেমিক হলে কেউ পিছিয়ে যায় না,
চরম যন্ত্রণাও যদি আসে, প্রাণ দিয়েও পিছু হটে না।
২৩.
তুমি যদি প্রভুর কাছ থেকে প্রেমের ভিক্ষা চাও,
তবে মানুষের সামনে কেন মাথা নোয়াও?
২৪.
যদি প্রেম না থাকে, তবে জ্ঞানও বৃথা,
সে কেমন জ্ঞান, যা ঈশ্বরকে দেখাতে পারে না?
২৫.
যেখানে প্রেমের পথ শুরু হয়,
সেখানে আর কারোর হাত চলে না।
২৬.
প্রেমিকদের কখনো ঘুম আসে না,
তারা সব সময় মাতাল হয়ে কাঁদতে থাকে।
২৭.
যারা প্রেমকে সত্যভাবে পালন করেছে,
তারাই ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন।
২৮.
প্রভুর সঙ্গে মিথ্যে বলা চলে না,
তিনি জানেন, হৃদয়ের গভীরে কী লুকানো আছে।
২৯.
প্রেমের পথের প্রতিটি মোড়ে ফাঁসি ঝোলে,
তবু সেখানেও প্রেমিক হাসতে হাসতে প্রাণ দেয়।
৩০.
প্রেমকে কোনো বস্তু বা দামে মাপিস না,
এ তো ঈশ্বরেরই আলো, তা নষ্ট করিস না।
৩১.
ভক্ত প্রেমিকেরা জানে—
স্বর্গেও বিচ্ছেদের অগ্নি জ্বলে।
যেখানে প্রেম আছে,
সেখানে নিজের অস্তিত্ব লুপ্ত করে দিতে হয়,
নিজেকে বিলীন করতে হয়—
প্রেমিক নয়, প্রেম-ই সত্য।
৩২.
প্রেমের এক নব খেলা সৃষ্টি করল প্রভু,
যেখানে প্রবেশ করলেই মানুষ পাগল হয়ে ওঠে।
এই খেলার নিয়ম—
নিজেকে হারিয়ে দেওয়া,
নিজেকে ভুলে কেবল প্রেমে বুঁদ হয়ে থাকা।
এ এক এমন নেশা,
যার শেষ নেই,
শুধু উন্মাদ আনন্দ।
৩৩.
যে দেহে প্রেমের সাধনা জ্বলে,
সে দেহ থেকে সৃষ্টি হয় অদ্ভুত বিচ্ছেদের আলো।
এই প্রেম দুনিয়াদার প্রেম নয়,
এই প্রেমে—
আমি আর তুমি নেই,
রয় শুধু ‘তুমি’।
এই প্রেমেই মিলন, এই প্রেমেই মুক্তি।
৩৪.
যেখানে প্রেমের গ্রন্থ খোলা হয়,
সেখানে বুদ্ধির আর চল নেই।
প্রেমের আগুন একবার জ্বলে উঠলে
সত্তা নিঃশেষ হয়ে যায়, খবর থাকে না তার।
৩৫.
যেখানে প্রেমে মাতোয়ারা দরবেশ ঘোরে,
সেখানে জ্ঞান, ইচ্ছা কিছুই থাকে না।
নিজেকে ভুলে প্রেমে ডোবে যারা,
তারাই তো হয় মাস্ত ফকির, আউলিয়া।
৩৬.
তুমি হিরের, আর হির তোমার—
মুক্তা ও রুবির মিলন প্রেম।
তোমার প্রেম দুনিয়ায় ঝড় তুলবে,
তাদের ঠাট্টা সহ্য করো,
প্রেম ছেড়ো না—
প্রভুকে স্মরণ করো রাত্রি-দিবস।
৩৭.
ইশকের নদী গভীর বিরহে গড়া,
কেউ তার তীর খুঁজে পায় না।
৩৮.
যে একবার ইশকের ধাক্কা খায়,
সে দুনিয়া থেকে হারিয়ে যায়।
৩৯.
হিরের চোখে অশ্রুর দরিয়া,
রান্ঝাও দুঃখের রাজা।
৪০.
পানশালায় মাস্ত এক ফকির,
রবের রঙে সে রাঙা।
৪১.
আমার হৃদয়ের প্রথম গল্প পড়ো,
কাউকে অন্যায়ভাবে প্রিয় বানিয়ো না।
বুঝে-শুনে আমাকে মন দিয়ো,
আমার সাথে মজা কোরো না...
এই প্রেমে অনেক ঝড় আসে,
স্থির থাকো, ভয় পেয়ো না।
যদি তুমি চাও, আমি জীবন দেব,
তবে কাউকে অন্য প্রিয় বানিও না...
এই প্রেমের শত্রু তো সমস্ত জগৎ,
অপমানিতের ব্যথা বোঝে না।
হায় পৃথিবী, তুমি কত নিষ্ঠুর!
এদের কখনো দুঃখ শুনিয়ো না...
প্রেমের মর্যাদা সবাই দেয় নতুনজনকে,
আমার এই কথা ভুলো না।
ওয়ারিস, যদি সত্যি বন্ধু পেয়ে যাও,
তাকে কখনো হারিয়ো না...
রান্ঝা ছিল ঝাং অঞ্চলের তখ্ত হাজারার এক ধনাঢ্য জাট পরিবারের কনিষ্ঠ পুত্র। তার ভাইয়েরা যখন তাকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এবং তার জীবন অসহনীয় করে তোলে, তখন সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। সে বাঁশি বাজানোতে অত্যন্ত পারদর্শী ছিল।
হির ছিল ঝাংয়ের সিয়াল উপজাতির অত্যন্ত সুন্দরী, আত্মবিশ্বাসী ও প্রভাবশালী কন্যা। তার সৌন্দর্য ছিল প্রবাদপ্রতিম।
রান্ঝা দেশ–দেশান্তরে ঘুরতে ঘুরতে হিরদের গ্রাম ঝাংয়ে পৌঁছায়। সেখানে সে হিরের বাবা চুচাক সিয়ালের বাড়িতে গরু চরানোর কাজ নেয়। হির প্রথম দেখাতেই রান্ঝার বাঁশির সুর ও সুদর্শন রূপে মুগ্ধ হয়। একইভাবে রান্ঝাও হিরের প্রেমে পড়ে যায়।
হির ও রান্ঝা গোপনে একে অপরের প্রতি গভীর প্রেমে আবদ্ধ হয়। তারা সাত বছর ধরে গোপনে দেখা করে এবং গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলে। রান্ঝা গরু চরানোর আড়ালে হিরের কাছেই থাকত।
কিন্তু তাদের এই গোপন সম্পর্ক বেশি দিন স্থায়ী হয় না। কাইডো নামের এক কুটিল ও বিকলাঙ্গ ব্যক্তি, যে ছিল হিরের মামা, তাদের প্রেমের কথা ফাঁস করে দেয়।
প্রেমের কথা জানাজানি হলে হিরের পরিবার, বিশেষত তার মা-বাবা ও সিয়াল উপজাতির লোকেরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা রান্ঝাকে অপমান করে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়।
সিয়াল গোত্রের লোকেরা জোর করে হিরের বিয়ে খেড়াদের গ্রামের সৈদা নামের এক যুবকের সঙ্গে দেয়। হির জোরপূর্বক এই বিয়ে মেনে নিতে বাধ্য হলেও তার মন থেকে রান্ঝাকে মুছে ফেলতে পারে না। সে সৈদার ঘরে গিয়েও কেবল রান্ঝাকেই স্মরণ করে।
এদিকে রান্ঝা হিরের বিরহে পাগলপ্রায় হয়ে পড়ে। সে হিরের ফিরে আসার আশায় সুফি সাধক যোগী বালাগ নাথের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। সে কান ফুঁড়িয়ে, মাথায় জটা রেখে বৈরাগী যোগী সেজে হিরকে খুঁজতে বের হয়।
যোগী রান্ঝা বহু কষ্টে খেড়াদের গ্রামে পৌঁছায় এবং কৌশলে হিরের সঙ্গে দেখা করে। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, তারা এক হয়ে পালিয়ে যাবে।
পালানোর সময় তারা ধরা পড়ে এবং তাদের পুনরায় আদালতে পেশ করা হয়। কিন্তু রান্ঝা তার যোগী ক্ষমতার মাধ্যমে বা অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে সবাইকে ভয় দেখায় এবং আদালত তাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
হির ও রান্ঝা ফিরে আসে হিরের গ্রামে। হিরের পরিবার তখন লোকলজ্জার ভয়ে তাদের সম্পর্ক মেনে নেওয়ার ভান করে। তারা একটি আনুষ্ঠানিক বিবাহের আয়োজন করে।
কিন্তু তাদের মিলন হিরের পরিবার কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। বিবাহভোজের আয়োজন করার সময় হিরের পরিবারের লোকেরা (বিশেষত তার মামা কাইডো) খাবারে বিষ মিশিয়ে দেয়।
হির সেই বিষাক্ত খাবার খেয়ে ফেলে এবং রান্ঝাকে খবর দেওয়ার আগেই মারা যায়। রান্ঝা হিরের মৃত্যুর কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গেই সেই বিষাক্ত খাবার খায় এবং হিরের পাশেই শেষনিশ্বাস ত্যাগ করে। এভাবেই চিরতরে তাদের মিলন অসম্ভব হয়ে ওঠে এবং এই করুণ প্রেমের কাহিনির সমাপ্তি ঘটে।
হির রান্ঝা হলো প্রেম, আত্মত্যাগ, সামাজিক চাপ ও নিয়তির নিষ্ঠুরতার এক অসাধারণ আখ্যান, যেখানে দুই অমর প্রেমিক সমাজের অন্যায় ও পারিবারিক ঈর্ষার শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুতেই চিরন্তন মিলন খুঁজে পায়। এই কাহিনির মানবিক আবেদন ও দার্শনিক গভীরতা ওয়ারিস শাহকে পাঞ্জাবি সাহিত্যের এক অপরিহার্য সৃষ্টিতে পরিণত করেছে।