
ফাতিমার চার বছর হলো। কত কথা যে ও বলে। দুষ্টুমিতেও কম না। সারাক্ষণ ছোটাছুটি, হুড়োহুড়ি চলছে। কখনো টগবগে গরম পানির দিকে পা পাড়ায়। কখনো কাঁচি এনে নিজের চুল কাটে। শুধু তা-ই নয়, জামাকাপড়ও কেটে কুচি কুচি করে ফেলে। এসব দুষ্টুমি থামানোর একটাই উপায়, তা হলো বাঁশের কঞ্চি। কঞ্চি দেখালে চুপসে যায়।
এই কঞ্চিটা আমি বানিয়ে এনেছি গ্রামের বাড়ি থেকে। কচি বাঁশের ডগা দিয়ে তৈরি চিকন কঞ্চি। একটু লাগালেই হলো। তবে ফাতিমাকে এটা দিয়ে শুধু ভয় দেখাই। কখনোই মারিনি। দুষ্টুমি করলে বালিশের ওপর, বিছানার ওপর, টেবিলের ওপর, চেয়ারের ওপর জোরে জোরে আঘাত করি। সপাং সপাং আওয়াজ হয়। তাতেই কাজ হয়ে যায়। দুষ্টুমি বন্ধ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে ফাতিমা।
এই কঞ্চি নিয়ে ফাতিমার আব্বার সঙ্গে আমার প্রায়ই ঝগড়া হয়। তার কথা হলো, কঞ্চি দিয়ে ভয় দেখানোর কী হলো? বুঝিয়ে বললেই তো হয়। আমার মুখের কথায় যে কোনো কাজ হয় না—এ কথা ফাতিমার আব্বাকে আমি বোঝাতে পারি না। আর বুঝবেই বা কেন? সেই সকালে অফিসে যায়, আসে রাতে। ততক্ষণে ফাতিমা ঘুমে বিভোর। মেয়েটাও কম না। ছুটির দিনে বাবা বাড়িতে থাকলে তো হয়েছেই। তখন আমি হয়ে যাই শত্রু। বাবা যা বলে তাই শোনে। বাবার সব কথা তার মেনে নেওয়া চাই। এ কারণেই হয়েতো মেয়ের দুষ্টুমির কথা বাবা বিশ্বাসই করতে চায় না। ও যে কেন আমার কথা শোনে না, বুঝি না।
এক সকালে ফাতিমার বাবা কঞ্চিটা ফেলে দিয়ে আমাকে চোখ বড় বড় করে বলল, ‘এই কঞ্চি যেন আর না দেখি।’
ফাতিমা যেন সব বুঝতে পারল। মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।
এরপর মেয়েটা আরও বেপরোয়া আরও দুরন্ত হয়ে উঠল। অসহ্য হয়ে আমি ফেলে দেওয়া কঞ্চিটা কুড়িয়ে আনলাম। ভাগ্যিস, হারায়নি। কঞ্চি দেখামাত্রই সব ঠান্ডা। ওর বাবা যেন না দেখে, সে জন্য তোশকের নিচে লুকিয়ে রাখলাম। আর ফাতিমাকে বললাম, ‘একটা ভূত এসে এটা দিয়ে গেছে।’ ও খুবই ভয় পেল।
বেশ চলছিল।
সেদিন রান্নাঘরে কাজ করছিলাম। ফাতিমা বেডরুমে বসে কার্টুন দেখছিল। হঠাৎ কেমন যেন শব্দ এল। ভাবলাম টেলিভিশন থেকে। শব্দটা ক্রমশ বাড়তে লাগল। সঙ্গে ফাতিমার উঁচু গলাও শোনা যাচ্ছিল। কী কী যেন বলছে ও। দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখি, ফাতিমা সেই কঞ্চিটা দিয়ে টেলিভিশনের ওপর, ড্রেসিং টেবিলের ওপর, আমার মোবাইল ফোনের ওপর, বিছানার ওপর... সমানে আঘাত করছে। আর বলছে, ‘মশা! তুই যদি আবার আমাকে কামড় দিবি, তোকে মেরে হাড্ডিগুড্ডি ভেঙে ফেলব, খুব দুষ্ট হয়েছিস না?’ গা দিয়ে টপ টপ করে ঘাম ঝরছে, চোখ দুটো লাল টকটকে। আমাকে দেখে নাক-মুখ দিয়ে বলতে লাগল, ‘মশাটা আমায় দুবার কামড় দিয়েছে। তাই ওকে...।’ আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম আর ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলাম টেলিভিশনের গ্লাস, ড্রেসিং টেবিলের আয়না আর মোবাইল ফোনের দিকে। সব ভেঙে চৌচির।
ছুটে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘আর তোকে বকব না, মা।’