
ঝরে পড়া পাকা ফলে ছেয়ে গেছে গাছতলাটা। মেঘ শিরীষের ফল। চৈত্র মাসের শেষ দিকে পাকে। থাকে বৈশাখের দিন পনেরো পর্যন্ত। প্রতি রাতেই পাকা ফল ঝরে পড়ে। দেখতে অনেকটাই তেঁতুলের মতো। তবে লম্বায় বেশি, তেঁতুলের চেয়ে পাতলা। রং কালো। স্বাদ স্যাকারিনের মতো মিষ্টি। অনেক শিশু-কিশোর এই ফল খায়। পাখি ও বাদুড়েরা খায় না। গরুদের কাছে অতি প্রিয় ফল এটা। এই ফল খেলে গরুদের বল-শক্তি বাড়ে, গাভিদের দুধ দেড়-দুই গুণ বেশি হয়।
এই দুধ বেশি পাওয়ার জন্যই শাওন আর সুচি রোজ ভোরে দুটি চটের থলে হাতে বেরিয়ে পড়ে মেঘ শিরীষের ফল কুড়াতে। তিনটে গাইগরু আছে ওদের। ঘাসটাস তেমন জোটে না আজকাল—ঘাসের মাঠ কই! দূর দূর থেকে ঘাস লতাপাতা এনে খাওয়াতে হয়। তাতে কি আর পেট ভরে তিনটি অবোধ প্রাণীর! দুধ দেয় কম। তিনটি গাই দুয়ে মা রোজ কলসিতে ভরে রাখেন। গড়ে দুধ হয় আড়াই-তিন কেজি। গ্রামেই বাঁধা খদ্দের আছে তিনজন। এক ফোঁটা দুধও রাখা হয় না খাওয়ার জন্য। নয় বছরের শাওন আর সাত বছরের সুচিও খেতে চায় না দুধ। দুধ বেচে রোজ দেড়-দুই শ টাকা উপার্জন হয়। দুই ভাইবোন এই বয়সেই ভালোভাবে বোঝে—সংসারটা কী কঠিন, জীবনটা কত কষ্টসাধ্য। বাঁচার পথ তাদের সামনে মাত্র দুটো। গরুর দুধ আর দুই কাঠা জায়গা জোড়া পানের বরজ। দেড় কাঠা জায়গার ওপর বসতঘর তাদের। সেখানেও কলা-মানকচু-সফেদা-পেয়ারা-লাউ-শিমের চাষ। হাঁস-মুরগিও আছে অনেকগুলো। তবু চলতে চায় না চারজনের ছোট্ট সংসারটা।
আজ ভোরেও মোরগের ডাক শুনে উঠে পড়েছে দুই ভাইবোন। চটের থলে হাতে বেরিয়ে পড়েছে মোল্লাবাড়ির উদ্দেশে। ওখানে আছে বিশাল একটি মেঘ শিরীষগাছ। আগে না গেলে অন্য ছেলেমেয়েরা তাদের গরুর জন্য কুড়িয়ে নিয়ে যাবে সবগুলো ফল। আকাশভরা ঘন-কালো মেঘ আজ এই ভোরবেলাতেই। জোর বাতাসে যেন ঘূর্ণিঝড়ের গন্ধ! ভোর তাই সকালের দিকে দৌড়াচ্ছে যে বোঝা যাচ্ছে না তা। চরাচর অন্ধকার। ঝিঁঝিদের ডাক নেই। পাখিদের রাত পোহানোর গানও নেই।
ঝরে পড়া পাকা ফলে ছেয়ে যাওয়া মোল্লাদের সেই গাছতলাটায় পৌঁছে অন্ধকারেই যখন দুই ভাইবোন পায়ের তলায় ফেলে ফেলে আর হাত মাটির ওপরে বুলিয়ে বুলিয়ে মাছ ধরার কায়দায় পাকা ফল কুড়িয়ে চটের ব্যাগে ভরতে শুরু করেছে, তখন দক্ষিণাকাশে বিদ্যুৎ চমকাল বার কয়েক। থেমে গেল ঝোড়ো বাতাস। থমথমে হয়ে গেল চরাচর। দুজনে থলে দুটো যখন ভরে ফেলেছে ও থলে হাতে রওনা দিয়েছে বাড়িমুখো, তখন প্রবল বিক্রমে ‘খাই খাই’ শব্দে প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে এল—মোল্লাদের অত বড় মেঘ শিরীষগাছটার মুন্ডু ধরে এক টানে যেন আকাশে তুলে নিতে চাইল কোনো দানব—ঝরে পড়ল যেন সবগুলো কাঁচা-পাকা ফল, কিছু পড়ল শাওন-সুচির মাথা-পিঠে, ভয়ে দুজনে দিল দৌড়—ও মা! ঝড় যেন বুক বরাবর অদৃশ্য দেয়াল তুলে ফেলেছে, সেই দেয়ালই যেন ধাক্কা দিয়ে দুজনকে ফেলে দিল চিত করে। তারপর মুঠিতে পুরে যেন শূন্যে তুলে নিতে চাইল। ভয়ে চিত্কার দিয়ে শাওন বলল, ‘সুচিরে! আমার হাত ধইরে রাখ জোরসে! খবরদার! ছাড়বিনে হাত! ছাড়লেই কিন্তু উইড়ে যাবি আকাশে!’
সুচিও ভাইয়ের হাত ধরে চিত্কার দিয়ে বলল, ‘ভাইরে! ধরলাম তোর হাত! থলে কিন্তু ছাড়িসনে! তাইলে কিন্তু দুধ কম হবে!’
‘বোনরে! বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে! ঠাডা পড়তি পারে! ভাইঙ্গে পড়তি পারে মেঘ শিরীষগাছটা! তাহলি আর বাঁচপনা আমরা। উইঠে দাঁড়া। আমরা দৌড় দিয়ে ওই দিকির কুটোর পালার তলায় যাইয়ে শুইয়ে থাকি।’
‘ঝড়ে যদি উইড়ে যায় কুটোর পালা! পড়ে ঠাডা কুটোর পালার ওপরে! তাহলি তো আগুন ধইরে যাবে! পুইড়ে মরব না! ভাইরে! দুইজনে হাত ধইরে দিই দৌড় বাড়ির দিকি!’
শাওন চিত্কার দিয়ে বলে, ‘বোনরে! বাড়ি যাওয়ার পথে ম্যালা বড় বড় গাছ, যদি ডালপালা ভাইঙ্গে মাথায় পড়ে তো মইরে যাবরে দুইজনে। তাড়াতাড়ি চল—কুটোর পালার তলায় ঢুইকে পড়ি।’ সুচি অনেক জোরে চিত্কার দিয়ে বলে, ‘ভাইরে! কানে-কপালে কিছু শুনতিচিনে তো! চোখও মেইলে রাখতি পারতিছিনে ঠিকমতো!’
প্রচণ্ড ঝড়ের শব্দের ভেতরও শাওন শুনতে পেল বোনের কথা। মুখে কোনো কথা না বলে বোনের হাত ধরে এগোল কুটোর পালাটার দিকে। তারপর দুজনে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ল পালাটার তলায়। ওমা! একটু পরেই ঝড় যেন প্রচণ্ড এক থাবায় শূন্যে তুলে ফেলল কুটোর পালাটা—ছুড়ে দিল শূন্যে, পালা উল্টে গিয়ে লাটিমের মতোই শূন্যে পাক খেল বার কয়েক, তারপর ঝড়ের তোড়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কুটোর পালার গড়ন-ধরন লাটিমের মতোই। দৃশ্য দেখে ভয় পেল দুই ভাইবোন। দুজনেই চিত্কার দিল জোরে, শাওন বলল, ‘হাত ধর। দে দৌড়। হাতের থলে কিন্তু ছাড়বিনে! তাহলি থলে কিন্তু উইড়ে যাবে আকাশে!’
সুচি চিত্কার দিয়ে বলল, ‘আমারে উড়োয়ে নিলিও থলে আমি উড়োয়ে নিতি দেবনানে রে ভাই।’
দুজনে হাত-ধরাধরি করে ঝড় ও অন্ধকারের সঙ্গে প্রবল বিক্রমে লড়তে লড়তে দৌড়াতে শুরু করল বাড়ির দিকে। কালবৈশাখী এখন লন্ডভন্ড করে দিতে চাইছে পুরো চরাচর। হাজার হাজার রাক্ষস যেন চেঁচাচ্ছে পৃথিবীজুড়ে।