গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

ভ্রমণ

লিসবনে বড়দিনের বাতি

‘গাড়ি চলিবার সময়ে চালকের সহিত ফালতু কথা বলিবেন না’—এককালে বাংলাদেশের নানা রুটের বাসে চালকের ঠিক পেছনে এ কথাটি লেখা থাকত। অনেকটা একই সুরের কথা পেলাম পর্তুগালের লিসবনে এসে—‘খাবার কিনবার সময় বিক্রেতাকে অযথা ফালতু ব্যক্তিগত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবেন না।’ প্রথমে লেখাটি পড়ে একটু অবাক হয়েছিলাম। কারণ, সারা দুনিয়ায় দোকানিরা বরং এক–আধটু কথা বলায়, কুশল–পরিচয় বিনিময়ে প্রীত হয়। তাহলে এখানে কেন এমন সতর্কবার্তা? লিসবনের কেন্দ্রীয় রেলস্টেশনের ছোট্ট এক খুপরি দোকান। দোতলার বিশাল প্যাসেজের এক কোণে এমন বেশ কিছু দোকানে বিক্রি হচ্ছে স্ন্যাকস–জাতীয় খাবার। যাঁরা খাবার বিক্রি করছেন, চেহারা দেখে অনুমান করা যায় কেউই পর্তুগিজ নন। অভিবাসী। ভারতীয়, চায়নিজ, কেউ নেপালি। ‘রাধা কিচেন’ নামের এই দোকানে মাথায় উলের টুপি পরে যে ছেলেটি খাবার বানিয়ে ক্রেতার পাতে তুলে দিচ্ছে, সে ভারতীয়। মুখে চাপ দাড়ি। বয়স কুড়ি–একুশ। মুখাবয়বে কোথায় যেন দুশ্চিন্তা আর বিষণ্নতার ছাপ। দোকানে বিক্রি হচ্ছে বম্বে ভেলপুরি, চাট, এগ স্যান্ডউইচ আর থাপলা। আমি এগ স্যান্ডউইচ অর্ডার করলে ছেলেটি আমাকে পেছন রেখে বিপরীত পাশে তার ইলেকট্রিক চুলোয় রুটি গরম করতে লেগে যায়। সেই ফাঁকে আমি আশপাশের দোকানে আগত ক্রেতা–বিক্রেতাদের পর্যবেক্ষণ করি। এর আগে এই প্যাসেজে পৌঁছানোর জন্য একটা করিডর পেরোতে হয়েছিল। নভেম্বরের শীতের রাত। স্টেশনে লোকসমাগম কম। করিডরেও তেমন কারও পদচারণ নেই। সেখান দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় খেয়াল করি, দুপাশে কাঁথা–কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ার তোড়জোড় করছে অসংখ্য মানুষ। ছিটকে আসা কিছু টুকরা শব্দ থেকে বুঝতে পারি, স্টেশনে রাত কাটানোর জন্য অপেক্ষায় থাকা এই মানুষদের অধিকাংশই বাংলাদেশি। গত ১০ বছরে পর্তুগালে শরণার্থী হয়ে আসা মানুষের ঢল বেড়েছে। অধিকাংশই আসছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো থেকে। দুর্নীতিবান্ধব রাষ্ট্রীয় শিথিলতার কারণে পর্তুগালে এখনো থাকার পারমিট বের করে ফেলা অন্য দেশের তুলনায় সহজ। কে জানে, হয়তো ভেলপুরি বিক্রি করা ছেলেটিও সেভাবেই সুদূর পাঞ্জাব কিংবা গুজরাট থেকে দুবাই-লিবিয়া হয়ে ডিঙি নৌকায় করে এখানে পৌঁছেছে! কিন্তু উটকো অজানা লোকের কাছে নিজের ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাসের কথা ফাঁস করে দিয়ে বিপদে পড়তে চায় কে? সে জন্যই বোধ করি সেঁটে রেখেছে ওই সতর্কবার্তা।

এখানে যে হোটেলে আমি উঠেছি, সেটি অবশ্য এই রেলস্টেশন থেকে খানিকটা দূরে। মেট্রোতে কয়েক স্টেশনের দূরত্ব। সন্ধ্যার পর হোটেল থেকে বেরিয়ে প্রথমে ভেবেছিলাম, ওখানেই খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করব। পরে কী খেয়াল হলো, হুট করে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে নেমে মেট্রোতে চেপে চলে আসি এখানে। ভেবেছিলাম, সেন্ট্রাল স্টেশন হিসেবে এলাকাটি হবে গমগমে, মুখর। প্রকৃত চিত্র উল্টো। এর চেয়ে শিয়াদো আর বারিও আলতো এলাকার মাঝামাঝি যে অঞ্চলে আমি উঠেছি, ওদিকটাই বেশি আলোকিত ও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা। স্যান্ডউইচ শেষ করে তাই বিলম্ব না করে ফিরতি ট্রেন ধরি।

চেহারা দেখে অনুমান করা যায় কেউই পর্তুগিজ নন। অভিবাসী। ভারতীয়, চায়নিজ, কেউ নেপালি। ‘রাধা কিচেন’ নামের এই দোকানে মাথায় উলের টুপি পরে যে ছেলেটি খাবার বানিয়ে ক্রেতার পাতে তুলে দিচ্ছে, সে ভারতীয়। মুখে চাপ দাড়ি। বয়স কুড়ি–একুশ। মুখাবয়বে কোথায় যেন দুশ্চিন্তা আর বিষণ্নতার ছাপ।

সোলার দস পয়েতাস নামের যে হোটেলে উঠেছি, তার ঠিক উল্টো দিকে কাময়েস চত্বর। ষোড়শ শতকের পর্তুগিজ কবির নামানুসারে চত্বরের নাম। মাঝখানে বেশ উঁচু বেদিতে তার বিশাল ভাস্কর্য। পায়ের অংশে আরও কিছু ছোট ভাস্কর্য। সবগুলোই পর্তুগালের প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিকের। সকালে হোটেল ঘরের জানালার কপাট খুললেই কবি কাময়েসের মুখখানি ভেসে ওঠে। চমকে উঠে উড়ে চলে যায় বারান্দায় রোদ পোহানো কবুতর। আর কুয়াশার ওপারে অস্পষ্ট রেখায় দেখা দেয় দূর নদীর নীলচে ছায়া। চত্বরে খাঁজকাটা মোজাইক। লিসবনের বহু স্থানেই এমন। সাদার সঙ্গে কালোর নকশা করা মোজাইক। আলপনার মতো। কবির ভাস্কর্যের সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে বিশাল এক অস্থায়ী বাতি। অনেকটা গিফট বক্সের আদলে গড়া। গত রাতে আশপাশে ট্রাকের শব্দে ঘুম ভাঙলে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি, টুকরা-টুকরা আঁধার ঢেকে রেখেছে চারপাশ। পথের কোলাহল আর নেই। নিস্তব্ধ, ঘুমন্ত চারদিক। শুধু ভূতের মতো কিছু শ্রমিক খুব দ্রুত ট্রাক থেকে নামিয়ে লাগিয়ে ফেলছে বাতির কলকবজা। বাতির ব্যবস্থা যে বড়দিন উপলক্ষে, তখনই বুঝতে পেরেছিলাম। এ বেলায় বাতি জ্বলে ওঠায় পুরো এলাকাটি উৎসবের আনন্দে ঝলমল করছে।

হোটেলের আশপাশে বেশ কিছু হোটেল-রেস্তোরাঁয় উঁকিঝুঁকি মারার পর একটা ছোট্ট পানশালায় ঢুকব মনস্থির করি। পানশালাকে পর্তুগিজে বলে সেরভেজারিয়া। পানশালাটির নাম ‘সেরভেজারিয়া ও ত্রেভ’। বাইরে লেখা—‘আমাদের এখানে একটা ম্যাজিক্যাল খাবার পাবেন, যার নাম বিফানা।’ লোকে হুড়মুড় করে স্বল্পায়তনের এ পানশালায় ঢুকছে। ভেতরে অল্প কয়েকটি লম্বাটে টেবিল। অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিনের মতো। বসতে গেলে অপেক্ষা করতে হয়। কাউন্টারের পেছনে যারা আছে, বিক্রি করে কুলাতে পারছে না। কোণের দিকের উনুনে ডুবোতেলে ভাজা হচ্ছে বিফানা। হিসহিস শব্দে ফুঁসে উঠছে গ্যাসের চুলার আগুন। ঠিক যেন ঢাকার নিউমার্কেটের জিলাপি ভাজার দোকান। বিফানা নামটি শুনে বিফ–জাতীয় কিছু মনে হলেও এটি মূলত শূকরের শুঁটকি। শুঁটকিকে ওয়াইন, রসুন, পাপরিকা আর কিছু মসলা–সহযোগে মিশিয়ে তারপর ছেড়ে দেওয়া হয় গরম তেলে। ভাজা হয়ে গেলে দুপাশে দুটো রুটি যোগ করে পরিবেশন করা হয়। চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম, লোকজন প্লেটের পর প্লেট বিফানা খাচ্ছে ফেনা ওঠা বিয়ারের গ্লাসের সঙ্গে। টেবিলের সঙ্গে গ্লাসের ঘর্ষণের ঠকাঠক শব্দ, মানুষের কোলাহল, বিফানা ভাজার চনমনে তেজি ঝাঁজালো গন্ধ—সব মিলিয়ে পানশালাটিকে মনে হয় যেন কোনো সিনেমার সেট!

যে বস্তু কখনো খাইনি, সে আর এ বেলায় খেতে ইচ্ছা হলো না। তাই এখানকার সেরা আইটেম বিফানা বাদ দিয়ে ভাবতে থাকি অন্য কী নেওয়া যায়। আজ সারা দিন দুই পদের পর্তুগিজ স্ন্যাকস খেয়ে পার করেছি। একটি হলো বাখালো, দেখতে আলুর চপের মতো। খেতেও অনেকটা তেমনই। আলুর সঙ্গে এতে বাড়তি ব্যবহার করা হয় পর্তুগালের জনপ্রিয় কডফিশ। পর্তুগিজ খাবারের একটি বড় অংশজুড়েই কডফিশের উপস্থিতি। ফাস্ট ফুড থেকে মেইন ডিশ, সবখানেই কডফিশ। দ্বিতীয় স্ন্যাকসটির নাম রিসস দ্য কামাহ। এটার আকার অনেকটা পুলি পিঠার মতো। ভেতরে আলুর মধ্যে পুরে দেওয়া হয় সেদ্ধ চিংড়ি। খেতে বেশ সুস্বাদু। সুবিধা হলো, আমাদের দেশের শিঙাড়ার মতোই খাবার দুটো গলির মোড়ের টং দোকান থেকে শুরু করে দামি রেস্তোরাঁ—সবখানেই সহজলভ্য।

হোটেলের আশপাশে বেশ কিছু হোটেল-রেস্তোরাঁয় উঁকিঝুঁকি মারার পর একটা ছোট্ট পানশালায় ঢুকব মনস্থির করি। পানশালাকে পর্তুগিজে বলে সেরভেজারিয়া। পানশালাটির নাম ‘সেরভেজারিয়া ও ত্রেভ’। বাইরে লেখা—‘আমাদের এখানে একটা ম্যাজিক্যাল খাবার পাবেন, যার নাম বিফানা।’ ভেতরে অল্প কয়েকটি লম্বাটে টেবিল।

আবারও চেনাজানা স্ন্যাকস অর্ডার করি। বেয়ারা জানিয়ে দেয়, একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমি অপেক্ষা করতে থাকি। পাশের টেবিলে সেদিনের একটি সংবাদপত্র। পত্রিকার নাম টাইম আউট লিসবন। পাতা ওলটাতে থাকি। ভেতরের পাতায় একটা বেশ ইন্টারেস্টিং আর্টিকেল চোখে পড়ে, প্রতিপাদ্য এ এলাকারই একটি প্রখ্যাত রেস্তোরাঁ—তাভারেস রিকো। সময় ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। সারা বিশ্বে চলছে জ্বালানি তেলের সংকট। সংকটের একটি সমাধান বের করতে তেহরানে চলছে ওপেকের বৈঠক। ঠিক সেই সময়ে লিসবনে চাউর হলো—সৌদি প্রিন্স ইবনে সেদ্দাক দলবল নিয়ে এসেছেন লিসবনে। তাঁরা সন্ধ্যাকালীন পানাহার নিয়ে বসবেন তাভারেস রিকো রেস্তোরাঁয়। ব্যস, লিসবনের বাঘা বাঘা সাংবাদিকদের ঘাম ছুটে গেল। তাঁরা ভাবলেন, নিশ্চয়ই তেহরানের বদলে এখানেই চলছে কোনো অঘোষিত গোপন মিটিং। সংবাদের গন্ধ শুঁকে শুঁকে সবাই হাজির হলেন। প্রচুর ফ্ল্যাশলাইট, ছবি, চুরুটের ধোঁয়া, হার্ড লিকার আর কফির প্রাচুর্যে ভেসে গেল রেস্তোরাঁ। পরের দিনের পত্রিকায় বেশ বড় হেডলাইনসহ বেরোলো চটুল সংবাদ। নড়েচড়ে বসল পর্তুগিজ সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী। এ কেমন কথা, তাদের শহরে এসে এমন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক চলছে, অথচ তারাই জানে না এর হাঁড়ির খবর। আরও অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, পুরো ব্যাপারটাই আসলে নাটক। ভুয়া। ওসব আরবের শেখ-টেখ কিছু নয়। যৌবনের উদ্দীপনায় মত্ত কিছু লিসবনবাসী যুবক সাংবাদিকদের সঙ্গে ঠাট্টা করার জন্য পুরো নাটকটি সাজিয়েছে। এতে অবশ্য গোয়েন্দা-পুলিশ খুব রুষ্ট হয়। যুবকদের ডেকে এনে কয়েক দিন খানিকটা উত্তম-মধ্যম দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

লিসবনের সহজলভ্য স্ন্যাকস বাখালো এবং রিসস দ্য কামাহ

সকালটা ছিল হেমন্তের শেষে নেমে আসা দুধসাদা কুয়াশার চাদরে ঢাকা। মেঘলা আকাশ। চূর্ণ চূর্ণ আলোয় পথ চলছে মানুষ। আমার হোটেলের একেবারে দোর ঘেঁষে ছুটে যায় চব্বিশ নম্বর ট্রাম। পুরোনো আমলের ট্রামের মতো এগুলো। আধুনিক বগির নয়। হলদে রঙের। ভেতরটা কাঠের। চামড়ার গদিতে মোড়া বসার সিট। দোতলার প্রাতরাশের জায়গাটায় বসলে খোলা জানালা দিয়ে ট্রামের এই আসা-যাওয়া দেখতে বেশ লাগে। বিদ্যুতের তার ধরে ট্রাম আসে, লোকে ছুটে গিয়ে খোলা দরজাটি দিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়, কেউ হাতল ধরে দাঁড়ায়, কেউবা হয়তো পায় বসার ফাঁকা সিট। এমন সব দৃশ্য দেখতে দেখতেই খেয়াল করি, চত্বরে এসে জড়ো হয়েছে কিছু যুবক-যুবতী। হাতে ব্যানার। কোনো ব্যাপারে প্রতিবাদ সভার প্রস্তুতি। ব্যানারগুলো পর্তুগিজ ভাষায় লেখা বলে কী নিয়ে প্রতিবাদ, সেটা আর বুঝি না। দু–একজন সাংবাদিক একটু দূরে অপেক্ষা করছেন সভাটা আরও জমে ওঠার।

ধীরলয়ে প্রাতরাশ সেরে নিচে নেমে মনস্থির করি, ট্রামে উঠে চলে যাব যত দূর যায়, তত দূর অবধি। দেখাই যাক না, কোথায় শেষ গন্তব্য।

খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। শিগগিরই হাজির হয় পরের ট্রাম। এবারে ভিড় কম। হয়তো অফিসগামী যাত্রীর চাপ কমে এসেছে। বারিও আলটোর নানা অলিগলি, ঢাল পেরিয়ে ট্রামটি চলে আসে নির্জন বসতিতে। এখানে কোনো ট্রাম ডিপো নেই। দুপাশে বাড়িঘর। পুরোনো স্কুল। পরিত্যক্ত কয়েকটি গুদাম। ড্রাইভার ট্রাম থামিয়ে সিগারেট ধরাতে যায়। আবার মিনিট পনেরো পর এই একই ট্রাম যাত্রা করবে ফেলে আসা ঠিকানায়। ‘চাইলে ট্রামের ভেতরেও বসতে পারেন, নতুবা একটু আশপাশে হেঁটে আসুন’—সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে ড্রাইভার বলে।

আমি হাঁটি। হলদে রঙের এক বাড়ির সামনে এসে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি। সামনে বোগেনভেলিয়ার বন। বেশ বাহারি প্রবেশদ্বার। দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ি শুরু হয়েছে উঠান থেকেই। সিঁড়িতে শেওলা। গাড়িবারান্দায় ছোট্ট গাড়ি। ইচ্ছা হলো বেল টিপে বাড়ির কর্তাকে বলি, আপনার এই মায়াঘেরা বাড়িটি একটু ঘুরে দেখা যাবে কি?

হাঁটতে গিয়ে আবিষ্কার করি, এক শবযাত্রীর বহরের সঙ্গে অলক্ষে ঢুকে গেছি সমাধিক্ষেত্রে। সমাধিক্ষেত্র বলতে যেমন ঘন সবুজ মাঠে একটু পরপর এপিটাফের সারির কথা মনে ভেসে ওঠে, এটি কিন্তু মোটেও তেমন নয়। পাথরের টাইলস দেওয়া পথ। কিছু দূর পরপর দেবদারু আর সাইপ্রেসগাছ। বিবর্ণ বাকল।

এ পাড়ার প্রায় সব বাড়িই এমন। পুরোনো। বনেদি। ছায়াময়। শীতের ঝরাপাতায় মগ্ন। এদের মাঝে হাঁটতে গিয়ে আবিষ্কার করি, এক শবযাত্রীর বহরের সঙ্গে অলক্ষে ঢুকে গেছি সমাধিক্ষেত্রে। সমাধিক্ষেত্র বলতে যেমন ঘন সবুজ মাঠে একটু পরপর এপিটাফের সারির কথা মনে ভেসে ওঠে, এটি কিন্তু মোটেও তেমন নয়। পাথরের টাইলস দেওয়া পথ। কিছু দূর পরপর দেবদারু আর সাইপ্রেসগাছ। বিবর্ণ বাকল। চারদিক নির্জন। নিস্তব্ধ। একা হাঁটলে গা ছমছম করে। দুপাশে অসংখ্য ঘর। প্রস্তর-নির্মিত। প্রতিটিই কারুকার্যমণ্ডিত, ভাস্কর্যবহুল। কোনো ঘরে আছে কেবল একটি কফিন, আবার কোনোটিতে একাধিক। সঙ্গে কিছু পুরোনো ছবি, মোমবাতি। হয়তো এক পরিবারের সবাইকে রাখা হয়েছে ওই একই ঘরে। ঘরের মাথায় ক্রুশ কিংবা দেবশিশুর মূর্তি। মাটির গভীরে কফিনগুলোকে না শুইয়ে, তাদের শয়ন দেওয়া হয়েছে এই মৃত্যুপরবর্তী নিবাসে। সমাধিক্ষেত্রটিতে ঢোকার সময়ই খেয়াল হয়েছিল, ঠিক এমনটিই দেখানো হয়েছিল ‘ট্রেন টু লিসবন’ সিনেমায়। সুইজারল্যান্ডের বার্ননিবাসী এক অধ্যাপক একদিন কাকতালীয়ভাবে সন্ধান পান পর্তুগালের গৃহযুদ্ধকালীন এক প্রতিবাদী বিপ্লবীর ডায়েরি। সেটির পেছনে ছুটে নিজের সবকিছু ফেলে চলে আসেন লিসবনে। একবস্ত্রে। ঘোরগ্রস্ত অবস্থায়। লিসবনে এসে কথা বলেন সেই বিপ্লবীর প্রাক্তন প্রেয়সী, বোন ও পরিচিত সবার সঙ্গে। জানতে পারেন, সেই বিপ্লবী বাঁচতে পারেননি। অকালমৃত্যুর পর তাঁকে সমাহিত করা হয় এই সমাধিক্ষেত্রে। সিনেমার পর্দায় তখন ভেসে ওঠে আজকের এই শবযাত্রার মতোই বহুকাল আগের চিত্রায়িত এক শবযাত্রার ছবি।

লিসবনের হলদে মেট্রোরেল

সমাধিক্ষেত্রটি থেকে বের হয়ে ভাবি, ফিরে যাব ট্রাম ডিপোতে? চেনা পথ ধরে? কিন্তু যে পথে এসেছি, সে পথেই ফিরে গেলে নতুন কিছু আর দেখা হলো কী করে? তাই উল্টো পথে হাঁটি। দূর থেকে ভেসে আসে নদীর আর্দ্র ঘ্রাণ। গাঙচিলের ডানা ঝাপটানোর শব্দ। জাহাজের মাস্তুল। সকালের সূর্যঢাকা মেঘ একটু একটু করে সরে যায়। ফিকে হয় কুয়াশা। বাড়ির দেয়ালে লাগানো মুরিশ ডিজাইনের সাদা আর নীলের টাইলসগুলো হেসে ওঠে। লিসবনের বাড়িগুলোর দেয়ালে এই টাইলস লাগানোর কারণ নাকি কিছুটা সৌন্দর্যবর্ধন আর কিছুটা গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে ভেতরকে সুরক্ষাদান। আর ওই যে মুরিশ ডিজাইন, ওটা এসেছে উত্তর আফ্রিকার অঞ্চলগুলো থেকে।

ভাগ্যিস এই ঢালু পথে পা বাড়িয়েছিলাম। নয়তো ওটির শেষ প্রান্তে সাগরের দিকে মুখ করে থাকা জেরনিমস মঠের সন্ধান পেতাম কী করে! এ মঠের ডান দিকের ধূপধুনো ভরা কক্ষে ঢুকে দেখি, বুকের কাছটায় প্রণামের ভঙ্গিতে হাত দুটো রেখে ঘুমাচ্ছেন প্রখ্যাত এক ব্যক্তি। হাতের মধ্যে তাজা গোলাপের কলি। এ ঘুম চলছে প্রায় ৫০০ বছর ধরে। যদিও তিনি অন্তিম শয়ানে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এখান থেকে বহু দূরের শহর ভারতবর্ষের দক্ষিণের কোচিনে। ইউরোপ থেকে ভারতে যাওয়ার নৌপথ আবিষ্কারের পর পর্তুগালে তিনি পান বীরের সম্মান। সে কারণেই পর্তুগাল তাঁর দেহাবশেষ কয়েক বছর পরেই নিয়ে আসে স্বদেশে। তারপর তিনি প্রায় ৩০০ বছর শায়িত ছিলেন ভিদিহুগুয়েরা জনপদের মঠে। লিসবন থেকে বেশ খানিকটা দূরের পথ সেটি। পরে এই অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তাঁর, অর্থাৎ ভাস্কো দা গামার দেহাবশেষ এনে রাখা হয় এ মঠে। ভাস্কো দা গামার সঙ্গে কিন্তু আরও একজন শায়িত আছেন এ মঠে, যিনি তাঁর সঙ্গে ভারতযাত্রায় সহযাত্রী হয়েছিলেন। তিনি কোনো দুঃসাহসী নাবিক কিংবা যাজক নন। বরং একজন কবি। আমার হোটেলের উল্টো দিকে যাঁর ভাস্কর্য আছে, সেই কবি কাময়েস।

আমার পেশা কী জানতে চাইলে বলি, চাকরি ছেড়ে টুকটাক ব্যবসার চেষ্টা করছি। শুনে অভিজ্ঞ লোকের মতো পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘ব্যবসার সঙ্গে আমরা কৃষকেরা যেভাবে মাটিতে বীজ ছিটাই, তার একটা সম্পর্ক আছে। ধরুন জমিনে মোট পাঁচটি বীজ ছিটালাম। এর মধ্যে সর্বোচ্চ একটি কি দুটি থেকে চারা গজাবে। ব্যবসাও তেমন।

‘এ ক্যাফেতে এন্থনি বখদহ এসেছিলেন, জানেন সেটা? এ জন্যই তো এদের এত দেমাগ। খাবার চাইলে আধঘণ্টা বসিয়ে রাখে।’

আমি যে চেয়ারে বসেছিলাম, তার পাশে যে কখন এই ভদ্রলোক এসে বসেছেন, টেরই পাইনি। এখন তাঁর কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই। ষাটের কোঠার বুড়ো। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। অজস্র ভাঁজসহ রোদে পোড়া লালচে গলা। গায়ে ছাই রঙের সোয়েটার। বোঝাই যাচ্ছে, লোকটি স্থানীয় নন।

‘আমি যেখান থেকে এসেছি, সেখানে এখন দুই ফুট সমান বরফ। পালিয়ে এসেছি বলতে পারেন।’

হোটেলের উল্টো দিকে কবি কাময়েস চত্বর

লোকটি বেশ অমায়িক। নিজ থেকেই প্রচুর কথা বলেন। থাকেন কানাডার ম্যানিটোবায়। ফার্ম হাউস আছে। আমার পেশা কী জানতে চাইলে বলি, চাকরি ছেড়ে টুকটাক ব্যবসার চেষ্টা করছি। শুনে অভিজ্ঞ লোকের মতো পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘ব্যবসা শুরু করা ব্যাপারটার সঙ্গে আমরা কৃষকেরা যেভাবে মাটিতে বীজ ছিটাই, তার একটা সম্পর্ক আছে। বুঝিয়ে বলি। ধরুন আমি জমিনে মোট পাঁচটি বীজ ছিটালাম। এর মধ্য থেকে সর্বোচ্চ একটি কি দুটি থেকে চারা গজাবে। ব্যবসাও তেমন। আপনাকে বহু কিছু ট্রাই করতে হবে। একটি বা দুটিতে আপনি সফল হবেন। অন্যগুলোতে বিফল। তবে শুরুতেই বিফল হয়ে রণে ভঙ্গ দিলে জানবেন হেরে গেলেন।’

ভদ্রলোক বিফানা অর্ডার করেছিলেন। ওটা আমার খাবারের আগেই চলে আসে। টেবিলে রাখা কেচাপের বোতল থেকে খানিকটা খাবারে ঢেলে বলতে থাকেন, ‘তা, কোথায় কোথায় গেলেন? সিন্ত্রাতে গিয়েছেন?’

সিন্ত্রা লিসবন থেকে এক-দেড় ঘণ্টা দূরের পাহাড়ি শহর। অপূর্ব সুন্দর। ছবির মতো সাজানো। লিসবনে যারা আসে, তাদের একটা বড় অংশই সিন্ত্রায় ঘুরে আসে। ওখানে যাওয়ার মূল কারণটা পাহাড়ের চূড়ায় থাকা এক প্রাসাদ। নাম পেনা প্রাসাদ। উজ্জ্বল হলদে রঙে রাঙানো। রোদ উঠলে প্রাসাদের পুরো দেয়াল যেন আগুন ছড়ায়। দুই দিন আগে বিকেলের দিকে আমি যখন গিয়েছিলাম, শীতের সূর্য বহু আগেই পাততাড়ি গুটিয়ে সেদিনের মতো বিদায় নিয়েছিল। পাহাড়ের ঢালে থাকা প্রাসাদের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখি বাহারি উজ্জ্বল নকশায় ঢাকা চারধারের দেয়াল আর ছাদ। বিশেষ করে ছাদ, সেই রোমের সিসটিন চ্যাপেলে আঁকা মিকেলাঞ্জেলোর অমর ছবিগুলোর মতোই এ প্রাসাদের ছাদে আঁকা ছবিগুলো কল্পনার ধূম্রজাল তৈরি করে। বিশেষ করে ঠোঁটে গোলাপের ডাল নিয়ে উড্ডয়নের অপেক্ষায় থাকা পাখির ছবি—কেন যেন লেপটে আছে প্রাসাদের নানা কোণে। বাদবাকি জৌলুশ আর প্রাচুর্য দেখায় তেমন একটা আগ্রহ না থাকায় আমি গিয়ে বসেছিলাম প্রাসাদের শানুদেশে অবস্থিত প্যাস্টেল দে নাটার দোকানে। দোকানটি কেবল এ খাবারটিই বানায়, আর কিছু নয়। পর্তুগালের আরেকটি সেরা খাবার। কৌতূহলী হয়ে উনুনের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ কারিগরদের কাজ দেখি।

পথঘাট তেমন একটা চেনা নেই, জানালে বুড়ো বলেন, ‘এই সাত পাহাড়ের ওপরে থাকা শহরে আপনি চাইলেও হারাতে পারবেন না। হ্যাঁ, সরু, খাড়া ঢালের, সিঁড়িপূর্ণ, গাড়ি ঢোকার মতো নয় এমন অসংখ্য গলি-তস্য গলি এখানে-ওখানে আছে বটে, তবে দেখবেন, শেষ অবধি এসে পৌঁছেছেন আগের জায়গায়। অতএব চিন্তা নেই।’

ওরা প্রথম এই নাটার বাইরের খোলসটা বানায়। তারপর ওভেনে চড়ায়। কিছুক্ষণ পর খোলসটি পুড়ে লালচে হলে নামিয়ে তাতে যোগ করে নাটার ওপর থাকা ক্রিম আর ফলদ-কাস্টার্ডের মিশ্রণ। বিশ-ত্রিশটা করে বানানো হচ্ছে একেক চালানে। মুহূর্তেই শেষ। যদিও অন্য সবাই দুই–তিনটা করে কিনছে, আমি লজ্জার মাথা খেয়ে কেবল একটি প্যাস্টেল দে নাটা কিনি। তারপর একটু দূরে গিয়ে পাহাড়ের ঢালকে আড়াল করে রাখা দেয়ালে বসি। আমার অদূরে এক ভদ্রমহিলা ঠেলাগাড়ি এনে চুলোতে আগুন ধরান। ভুর ভুর করে ধোঁয়া বের হয়। সন্ধ্যার মুখে নামা কুয়াশার সঙ্গে সেই ধোঁয়া মিলেমিশে এক হয়ে হারিয়ে যায় পেছনের পাহাড়ের কোলে। উনুনের আগুনটা আরেকটু উসকে দিয়ে মহিলা এবারে ধোঁয়ার ওপর বসিয়ে দেন অ্যালুমিনিয়ামের বালতিসদৃশ তৈজস। ভেতরে ভাজা হতে থাকে কাঠবাদাম। বয়স্ক এক ভদ্রমহিলা, স্থানীয়ই হবেন, ধীরলয়ে হেঁটে এসে বসেন আমার খানিকটা কাছেই। কাঠবাদাম আরেকটু পুড়ে বাদামি থেকে ছাইবর্ণের রূপ পাওয়ার পর তিনি এগিয়ে যান হাতে থাকা দুটো ঠোঙা সম্বল করে। বিক্রেতা মহিলাটি ঠোঙা দুটো পুরো ভরে কাঠবাদাম দিলেও কোনো পয়সা নিতে অস্বীকৃতি জানান। সেটা বৃদ্ধার প্রতি সম্মানস্বরূপ নাকি করুণা থেকে উদ্ভূত, আমি ঠিক বুঝি না। সিন্ত্রার গল্প পাশের সেই গল্পবাজ বুড়োকে যখন বলছি, বেয়ারা এসে রেখে যায় আমার খাবার।

‘চলুন, আপত্তি না থাকলে কিছুক্ষণ হাঁটি একসঙ্গে।’ খাবার শেষে বুড়োর প্রস্তাব।

পথঘাট তেমন একটা চেনা নেই, জানালে বুড়ো থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এই সাত পাহাড়ের ওপরে থাকা শহরে আপনি চাইলেও হারাতে পারবেন না, সেটা সম্ভব নয়। হ্যাঁ, সরু, খাড়া ঢালের, সিঁড়িপূর্ণ, গাড়ি ঢোকার মতো নয় এমন অসংখ্য গলি-তস্য গলি এখানে-ওখানে আছে বটে, তবে দেখবেন, শেষ অবধি এসে পৌঁছেছেন আগের জায়গায়। অতএব চিন্তা নেই।’

পর্তুগালের আরেক সেরা খাবার প্যাস্টেল দে নাটা

লিসবনে এখন ঠান্ডা আছে, তবে হুল ফোটানোর মতো নয়। শীতপ্রধান ইউরোপের কিছুটা উষ্ণ দেশ পর্তুগালের এই হলো সুবিধা। এমনকি এই রাতের বেলায়ও দিব্যি জ্যাকেট গায়ে দিয়ে হাঁটা যাচ্ছে। আশপাশে যারা হেঁটে যাচ্ছে, তাদের একটা বড় অংশই পর্যটক। এই ঘোর শীতকালেও যদি এত পর্যটক থাকে, তাহলে গ্রীষ্মে কী অবস্থা হয়!

হুয়া দো কারমো নামের ব্যস্ত সড়কে পৌঁছে দেখতে পাই ইস্পাতের লিফট বেশ উঁচুতে উঠে যাচ্ছে। কম করে হলেও সাত-আটতলার সমান উচ্চতায় তো হবেই। প্রায় ১০০ বছর আগে নাকি বানানো হয়েছিল। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাওয়ার জন্য। এটির নকশা করেছিলেন গুস্তাভ আইফেলের ছাত্র রাউল দু পনশারড। লিফটে উঠে ওপারে যাব কি যাব না, এই ভাবার সময়ে বুড়োকে প্রশ্ন করি, ‘আপনি লিসবনে এলেন কি একাই?’

‘বউয়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে আজ প্রায় ১৫ বছর হলো। একমাত্র ছেলে থাকে ভ্যাঙ্কুভারে। একটা কুকুর ছিল, টিমি। গত বছর ক্যানসারে মারা গেল। আমি এখন একাই। তবে নিজেকে একা ভাবলেই একা, না ভাবলেই নয়। এই দেখুন না, আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ আগে পরিচয়, আর এই এখন আমরা একসঙ্গে হাঁটছি।’

কণ্ঠস্বরে খানিকটা যেন বিষাদের ছোঁয়া মিশিয়ে তিনি বলেন, ‘বউয়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে আজ প্রায় ১৫ বছর হলো। একমাত্র ছেলে থাকে ভ্যাঙ্কুভারে। একটা কুকুর ছিল, টিমি। গত বছর ক্যানসারে মারা গেল। আমি এখন একাই। তবে একাকিত্ববোধ ব্যাপারটা কিন্তু নিজের ওপর। নিজেকে একা ভাবলেই একা, না ভাবলেই নয়। এই দেখুন না, আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ আগে পরিচয়, আর এই এখন আমরা একসঙ্গে হাঁটছি।’

আমি সম্মতিসূচক মাথা দোলাই।

লিফটে না উঠে আমরা বরং ভিন্ন দিকে কিছুটা হাঁটতেই ঢুকে পড়ি হসিও ক্রিসমাস মার্কেটে। ছোটখাট অস্থায়ী মেলা। পেছনে বিশাল মনুমেন্ট। শ্বেত প্রাসাদ। প্রাসাদের সামনে সাদার মধ্যে কালোর ঢেউ খেলানো মোজাইকের নকশা করা যে চত্বর ছিল, সেখানেই বসে গেছে নভেম্বরের ২৫ তারিখ থেকে শুরু হওয়া এ মেলা। এক পাশে টয়ট্রেন। সাজানো হয়েছে ঝাউগাছের পাতা আর ক্রিসমাস বেল দিয়ে। ১০ ইউরোর টিকিট কেটে উঠলে মিনিট দশেক ঘুরে বেড়ানো যায়। বাদবাকি দোকান যা আছে, আলোয় ঝলমল করছে। দোকানগুলো বানানো হয়েছে গ্রামের বাড়ির আদলে। দোচালা ছাদ। ছাদের কোণে ক্রিসমাসের টুনিবাতি। মেলার ঠিক মাঝখানে ক্রিসমাস ট্রি। পুরোটাই আলো দিয়ে মোড়ানো। আর সড়কের ধারে যে গাছগুলো, ওগুলোর ডালেও লাগানো হয়েছে উজ্জ্বল বাতি। মেলার মধ্যে এত সব বাতি তো আছেই, সেই সঙ্গে আশপাশের বাড়ির দেয়ালে লাগানো উজ্জ্বল হলদে টুনিবাতির আলো রাতের আঁধারকে চিরে ফেলতে চাইছে উৎসবের আনন্দ-আতিশয্যে। লোকে যত-না কিনছে, তার চেয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছে বেশি। গল্প করছে, হাসছে। পরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় টুকটাক কুশল বিনিময় করছে। আর হ্যাঁ, প্রায় সবার হাতেই একটি করে কফির কাপ। এত সব দৃশ্যের মধ্যে হঠাৎ দেখি দুজন বাংলাদেশি। ভিড়ের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছে, হাত ধরাধরি করে। হয়তো হবে, খুব কাছের বন্ধু। সদ্যই লিসবনে এসেছে।

‘এখানে কাছেই একটা দারুণ দোকান আছে। জিজিনহার। চলুন ওখানে, এক শট খেয়ে আসি।’ বুড়ো এ কথা বলে যে দোকানের সামনে নিয়ে যান, সেটি মেলার এক কোণে। পথের উল্টো দিকে। জিজিনিহা লিসবনের অন্যতম জনপ্রিয় পানীয়। এ দেশে এলে এটি পান না করে যাওয়া রীতিমতো অন্যায়। মূলত চেরিকে ব্রান্ডির মধ্যে ফারমেনট করে তাতে যোগ করা হয় পানি, চিনি আর এলাচ। খুব একটা ঝাঁজ নেই এতে। দোকানের দিকে পেছন ফিরে শটের গ্লাস হাতে বুড়োকে জিজ্ঞেস করি, ‘লিসবনে কি এই প্রথম এলেন?’ তৃতীয় শটটি এক নিমেষে গলায় চালান করে দিয়ে বুড়ো বলেন, ‘নাহ। এর আগেও এসেছি। বান্ধবীর সঙ্গে। সেবারে ফারোতেও গিয়েছি।’ ফারো পর্তুগালের দক্ষিণে সাগরপারের শহর। শুনেছি স্বর্গসম। বান্ধবীর কথা উল্লেখ করায় আমি জিজ্ঞেস করি, ‘সেই বান্ধবী এখন নেই?’ হাসি হাসি মুখটায় কোথায় যেন একটু ম্লান ছায়া পড়ে। শেষ শটটা গলায় ঢেলে বুড়ো বলেন, ‘মোহ বলুন, ভালোবাসা বলুন, কোনোটাই চিরস্থায়ী নয়। আজ যাকে ভালো লাগে, ১০ বছর পরও যে তাকে ভালো লাগবে, এমন কোনো কথা নেই। আমার বান্ধবীরও আমাকে আর ভালো লাগেনি। ছেড়ে গেছে।’ বুড়োর কণ্ঠে কিছুটা যেন স্খলন আসে। হয়তো পুরোনো সেই বান্ধবীর কথা মানসপটে ভেসে ওঠায়, কিংবা ওই চারটি শটের গুণে। ঈষৎ জড়ানো কণ্ঠস্বরে আমাকে এবারে বলেন, ‘কাল এ তল্লাটে যদি থাকেন, দেখা হতে পারে। শরীরটা খুব একটা ভালো লাগছে না। এবারে হোটেলে ফিরব।’ বলেই কোনো বিদায় সম্ভাষণ না জানিয়ে হুট করে ভিড়ের মধ্যে মিশে কোথায় যেন হারিয়ে যান।

বুড়োর সঙ্গ-বিচ্ছিন্ন হয়ে আমি সিয়াদো পাহাড়ের ওপর বাঁধাই করা চত্বরে এসে বসি। পাথরে ঢাকা সর্পিল ঢালু পথ বেয়ে এখানে আসার সময়ে মেহনত হয়েছে। তখন বুঝিনি, এখন একটা আপেলগাছের তলে পেতে রাখা বেঞ্চে বসে টের পাচ্ছি। বহু দূর আটলান্টিক থেকে ভেসে আসা ঠান্ডা হাওয়া পাহাড়ের গায়ে বাধা পেয়ে কাঁপন ধরাচ্ছে আমার মতো স্থবির কয়েকজনের শরীরে। বহু নিচে শহর। ঝলমলে আলো। বড়দিনের আলো। দিনের বেলা হলে দেখা যেত শহরের ওই বাড়িগুলোর মাথায় লালচে টালি। কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে ফাদোর সুর। যে বুকভাঙা গান গায় পর্তুগালের জেলেরা। এ গানে থাকে আক্ষেপ, হতাশা, ক্ষোভ। এখন অবশ্য এই শহুরে পটচিত্রে সেই দুঃখী জেলেরা নেই। তবে পর্যটক তো আছে! তাই তাদের কাছে নিজেদের আদি সংগীত বেচে খাওয়ার ব্যবসাও জেগে উঠেছে রাতারাতি। যে সুর আমি শুনছি, সেটা হয়তো ভেসে আসছে নিচের শহরের কোনো এক স্টুডিও থেকে। জেলে-ঘর থেকে নয়। যেখান থেকেই হোক, রাতের কুয়াশামগ্ন ধূম্রতার মধ্যে এই সুর বেশ লাগে। হাত দুটোকে জ্যাকেটের উষ্ণ পকেটে ঢুকিয়ে আমি সেই সুরের ঘূর্ণাবর্তে তন্ময় হয়ে ডুবে যাই।