
এডগার অ্যালান পো ছিলেন একজন মার্কিন ছোটগল্পকার, কবি, সমালোচক এবং সম্পাদক, যিনি রহস্য ও ভয়ের সাহিত্যচর্চার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর গল্প ‘দ্য মার্ডার্স ইন দ্য রু মর্গ’ (১৮৪১) আধুনিক গোয়েন্দা কাহিনির সূচনা করে, তাঁর ভয়ের গল্পগুলোর আবহ বিশ্বসাহিত্যে অতুলনীয়। এডগার অ্যালান পোর ‘দ্য র্যাভেন’ কবিতার ক্ষেত্রে বিশ্বসাহিত্যে তাঁকে স্থান করে দিয়েছে।
পো ছিলেন ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া অভিনেত্রী এলিজাবেথ আর্নল্ড পো এবং বাল্টিমোরের অভিনেতা ডেভিড পো জুনিয়রের সন্তান। তাঁর মা ১৮১১ সালে ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডে মারা গেলে তাঁকে রিচমন্ডের ব্যবসায়ী জন অ্যালান ও তাঁর নিঃসন্তান স্ত্রীর ঘরে লালনপালন করা হয়।
১৮২৬ সালে এডগার অ্যালান পো ১১ মাসের জন্য ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন, কিন্তু জুয়ার নেশায় জড়িয়ে গেলে তাঁর অভিভাবক তাঁকে পড়াশোনা চালাতে দিতে অস্বীকার করেন। দুর্ভাগ্য যেন পিছু ছাড়ে না, তিনি রিচমন্ডে ফিরে এসে দেখেন তাঁর প্রেমিকা সারা এলমিরা রোয়েস্টার শেল্টন বাগ্দান সম্পন্ন করেছেন।
দারিদ্র্য ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। দারিদ্র্যের কারণে তিনি ‘এডগার এ. পেরি’ নাম নিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কিন্তু তাঁর পালক মা মারা গেলে জন অ্যালান তাঁর সেনাজীবন থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করেন এবং তাঁকে ওয়েস্ট পয়েন্ট সামরিক একাডেমিতে ভর্তি করান। সেখানে যাওয়ার আগে, পো বাল্টিমোরে ‘আল আরাফ, টেমারলেন ও মাইনর পোয়েমস’ (১৮২৯) প্রকাশ করেন। এখানে ‘টেমারলেন’ এবং অন্যান্য ছোটখাটো রচনার পাশাপাশি তাঁর ‘আল আরাফ’ কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এটি ছিল পোয়ের দ্বিতীয় প্রকাশিত সংকলন এবং ‘এডগার এ. পো’ নামে প্রকাশিত প্রথম সংকলন।
নিউইয়র্ক থেকে পো বাল্টিমোরে ফিরে এসে গল্প লেখা শুরু করেন। ১৮৩৩ সালে তাঁর ‘মিস ফাউন্ড ইন আ বটল’ একটি পত্রিকা থেকে ৫০ ডলার পুরস্কার পায়। এটি পোর সমুদ্রভিত্তিক রহস্য ও গথিক কল্পনার মিশ্রণে গড়া প্রথম দিককার বিখ্যাত গল্প। একজন নামহীন লোক এক জাহাজে ভ্রমণরত অবস্থায় ভয়ংকর ঝড়ের মুখে পড়ে। ঝড়ে জাহাজ ডুবে গেলে আরেকটি বিশাল ও প্রাচীন জাহাজ ভেসে ওঠে। এই নতুন জাহাজটি রহস্যময়, যেখানে নাবিকেরা বয়সে বৃদ্ধ আর চুপচাপ ধরনের। তারা নায়কের অস্তিত্ব লক্ষই করে না। ধীরে ধীরে জাহাজটি দক্ষিণ মেরুর দিকে ছুটে চলে, সেখানে ছিল প্রকাণ্ড জলপ্রপাত। গল্পের নায়ক নিজের অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর আগের অভিজ্ঞতাগুলো একটি পাণ্ডুলিপিতে লিখে বোতলে ভরে সমুদ্রে ছুড়ে দেন। গল্প এখানেই শেষ হয়।
গল্পটি মানুষের অদম্য কৌতূহল আর ভয়ের মিশ্রণকে তুলে ধরে। দক্ষিণ মেরু সেই সময়ে মানুষের কাছে এক রহস্যময় অঞ্চল ছিল। নায়ক বুঝতে পারে সে বাঁচবে না, তবু তার শেষ প্রচেষ্টা হলো নিজের অভিজ্ঞতা লিখে যাওয়া—যাতে তার অস্তিত্ব একেবারে হারিয়ে না যায়।
১৮৩৫ সালে রিচমন্ডে পো ‘সাউদার্ন লিটারারি মেসেঞ্জার’-এর সম্পাদক হন এবং তখনই তাঁর খ্যাতি শুরু হয়। এ সময়েই তিনি তাঁর মাত্র তেরো বছর বয়সী চাচাতো বোন ভার্জিনিয়া এলিজা ক্লেমকে বিয়ে করেন। পো ছিলেন একজন হৃদয়বান এবং স্নেহশীল স্বামী।
পো রহস্য ও ভয়ের সাহিত্যচর্চার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর গল্প ‘দ্য মার্ডার্স ইন দ্য রু মর্গ’ (১৮৪১) আধুনিক গোয়েন্দা কাহিনির সূচনা করে, তাঁর ভয়ের গল্পগুলোর আবহ বিশ্বসাহিত্যে অতুলনীয়। এডগার অ্যালান পোর ‘দ্য র্যাভেন’ কবিতার ক্ষেত্রে বিশ্বসাহিত্যে তাঁকে স্থান করে দিয়েছে। তাঁর ‘দ্য বেলুন হোক্স’ গল্পটিকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির প্রাথমিক উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা হয়।
পো মদ্যপানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। মদ্যপানের জন্য তাঁর রিচমন্ডের চাকরিটা হারান এবং এরপর নিউইয়র্কে থিতু হন। একসময় মদ তাঁর জীবনের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও তিনি পুরোপুরি মাতাল হতেন না, তবু জনসমক্ষে তাঁকে প্রায়ই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় দেখা যেত। এ কারণে ধারণা ছড়ায় যে তিনি আফিমাসক্ত ছিলেন, যদিও চিকিৎসকদের মতে তাঁর মস্তিষ্কে আঘাতজনিত সমস্যা ছিল।
১৮৩৯ সালের শেষের দিকে তাঁর ‘টেলস অব দ্য গ্রোটেস্ক অ্যান্ড অ্যারাবেস্ক’ প্রকাশিত হয়। এখানে তিনি ভয়, মানসিক জটিলতা, কল্পনা আর শৈল্পিক সৌন্দর্য মিলিয়ে অনন্য এক সাহিত্যধারা তৈরি করেন। এটি তাঁর গথিক ঐতিহ্যের শিকড় ও ভবিষ্যৎ রচনার ভিত্তি।
তিনি ১৮৪০ প্রকাশ করেন প্রথম গোয়েন্দা গল্প ‘দ্য মার্ডার্স ইন দ্য রু মর্গ।’ এটিকে বিশ্বের প্রথম গোয়েন্দা কাহিনি বলে ধরা হয়। গল্পের প্রধান চরিত্র সি অগাস্ট ডুপাঁ নামের এক বুদ্ধিমান যুবক, যিনি বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও যুক্তি দিয়ে অপরাধের রহস্য উদ্ঘাটন করেন। প্যারিস শহরে রু মর্গ নামের একটি বাড়িতে ভয়াবহ খুন সংঘটিত হয়। এক বৃদ্ধা মহিলা ও তার কন্যাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ঘরটি ভেতর থেকে বন্ধ ছিল, প্রতিবেশীরা ভয়ংকর চিৎকার শুনেছিল, কিন্তু যখন দরজা ভাঙা হলো, তখন লাশের দৃশ্য ছিল রক্তাক্ত ও রহস্যময়। প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দিতে দেখা যায়, তারা এক অচেনা, ভয়ংকর কণ্ঠস্বর শুনেছিল, যেটি মানুষের বলে মনে হয়নি।
পুলিশ হতবাক হয়ে যায়, কারণ খুনির প্রবেশ ও বের হওয়ার কোনো স্পষ্ট রাস্তা নেই। তখন ডুপাঁ যুক্তি প্রয়োগ করে রহস্য বিশ্লেষণ শুরু করেন। তিনি দেখান যে ঘটনাটি মানুষের খুন নয়; একটি ওরাং-ওটাং নামের একধরনের বৃহৎ বানর পালিয়ে এসে ভয়ংকর আক্রমণ চালিয়েছিল। মালিকের কাছ থেকে পালিয়ে আসা ওই প্রাণী নারীদের হত্যা করে এবং ঘরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এই গল্পের মাধ্যমেই পো গোয়েন্দা সাহিত্যের নতুন ধারা সূচনা করেন।
১৮৪৩ সালে এডগার অ্যালান পোর ‘দ্য গোল্ড বাগ’ ফিলাডেলফিয়ার একটি পত্রিকা থেকে ১০০ ডলারের পুরস্কার পায়। এটি একটি অ্যাডভেঞ্চার ও ধাঁধা-ধরনের গল্প, যেখানে গুপ্তধন অনুসন্ধান এবং রহস্যময় ঘটনার মিশ্রণ আছে। গল্পে মূল চরিত্র উইলিয়াম লেগ্র্যান্ড, যিনি সাউথ ক্যারোলিনার এক দ্বীপে বসবাস করেন। একদিন তিনি একটি সোনালি রঙের পোকা খুঁজে পান। আর পান একটি পুরোনো কাগজে লেখা রহস্যময় প্রতীক। তিনি সেই প্রতীক বা ক্রিপ্টোগ্রাম সমাধান করে জানতে পারেন, এটি আসলে সমুদ্র ডাকাত ক্যাপ্টেন কিডের গুপ্তধনের মানচিত্র। গোপন সংকেতের ব্যাখ্যা ও যুক্তি অনুসরণ করে তারা এক অভিযানে বের হয়। অনেক কষ্টে সূত্র মিলিয়ে অবশেষে তারা এক স্থানে খনন করে বিপুল সোনার ও রত্নের গুপ্তধন উদ্ধার করে। এটি এডগার অ্যালান পোর সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পগুলোর একটি। এখানে রহস্য, প্রতীক, সাইফার সমাধান এবং ধন অনুসন্ধান—সব মিলিয়ে রোমাঞ্চকর কাহিনি তৈরি হয়েছে। এই গল্পে পো দেখিয়েছেন কীভাবে বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও যুক্তি দিয়ে জটিল সংকেত উন্মোচন করা যায়।
‘দ্য বেলুন হোক্স’ গল্পে দাবি করা হয় যে ইউরোপীয় বেলুনচালক মঙ্ক ম্যাসন মাত্র ৭৫ ঘণ্টায় আটজন সদস্যসহ একটি গ্যাস বেলুনে আটলান্টিক মহাসাগর পার করেছেন। এতে বেলুনের বিস্তারিত নকশা ও যন্ত্রাংশের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। গল্পটি এতটাই বিশদ ও বাস্তবসম্মতভাবে লেখা হয়েছিল যে অনেক পাঠক এটিকে সত্য ঘটনা হিসেবে বিশ্বাস করেছিলেন।
১৮৪৪ সালে তিনি নিউইয়র্কে ফিরে আসেন, ‘দ্য বেলুন হোক্স’ লেখেন এবং নিউইয়র্ক মিররের উপসম্পাদক হন। ‘দ্য বেলুন হোক্স’ এডগার অ্যালান পোর একটি বিখ্যাত সাংবাদিকতাভিত্তিক ছোটগল্প, যা ১৮৪৪ সালের ১৩ এপ্রিল নিউইয়র্কের ‘দ্য সান’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গল্পটি প্রথমে একটি বাস্তব সংবাদ হিসেবে উপস্থাপিত হলেও, পরবর্তী সময়ে এটি একটি বানোয়াট রচনা হিসেবে প্রকাশিত হয়। গল্পে দাবি করা হয় যে ইউরোপীয় বেলুনচালক মঙ্ক ম্যাসন মাত্র ৭৫ ঘণ্টায় আটজন সদস্যসহ একটি গ্যাস বেলুনে আটলান্টিক মহাসাগর পার করেছেন। তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ উপকূলে পৌঁছেছেন। এতে বেলুনের বিস্তারিত নকশা ও যন্ত্রাংশের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। গল্পটি এতটাই বিশদ ও বাস্তবসম্মতভাবে লেখা হয়েছিল যে অনেক পাঠক এটিকে সত্য ঘটনা হিসেবে বিশ্বাস করেছিলেন। পো এই গল্পটি লিখেছিলেন ‘দ্য সান’ পত্রিকায় কাজ পাওয়ার জন্য। বেলুনচালনা তখনকার যুগে একটি নতুন ও আকর্ষণীয় প্রযুক্তি ছিল। পো এই প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে একটি কল্পিত ভ্রমণ বর্ণনা করেন, যাকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির বা সায়েন্স ফিকশনের প্রাথমিক উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা হয়। পোর এই রচনার প্রভাব পরবর্তী লেখকদের ওপর পড়েছিল; জুলভার্ন তাঁর ‘আশি দিনে বিশ্ব ভ্রমণ’ উপন্যাসে বেলুন ভ্রমণের ধারণা গ্রহণ করেছিলেন।
১৮৪৫ সালে পোর ‘দ্য র্যাভেন’ প্রকাশিত হয় এবং তৎক্ষণাৎ এটি তাঁকে জাতীয় খ্যাতি এনে দেয়। কবিতাটি ১৮টি স্তবকে গঠিত, যেখানে নির্দিষ্ট ছন্দ এবং এর ছন্দরীতি ভৌতিক আবহ সৃষ্টি করে। এই কবিতাটি পোর সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা, যেখানে অতিপ্রাকৃত ভয়ের আবহ, দুঃখ, প্রেমহারা মানুষের মানসিক যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে। এতে দেখানো হয়, একজন একাকী মানুষ, যিনি তাঁর প্রিয়তমার মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে মধ্যরাতে নিজের ঘরে বসে আছেন। বই পড়ে তিনি দুঃখ ভুলতে চাইছিলেন। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা যায়। দরজা খুললে কিছু দেখা যায় না, কিন্তু তিনি অনুভব করেন রহস্যময় এক উপস্থিতি। এরপর জানালায় একটা কাক এসে বসে। আশ্চর্যের বিষয়, কাকটি মানুষের মতো করে শুধু একটাই শব্দ বলে—‘আর কখনো নয়।’
শোকাহত মানুষটি কাকের এই উত্তরকে বারবার নানা প্রশ্নের সঙ্গে মেলাতে থাকেন। তিনি জানতে চান—লেনোরকে মানে তাঁর প্রেমিকাকে তিনি পরকালে আবার পাবেন কি না। তাঁর দুঃখ কি কখনো লাঘব হবে? আর তাঁর কি ভবিষ্যতে কোনো আশার আলো আছে? কিন্তু কাক প্রতিবার একই শব্দই বলে, ‘আর কখনো নয়।’
অবশেষে তিনি বুঝতে পারেন, কাকের উপস্থিতি যেন তাঁর জীবনের অনন্ত দুঃখ, একাকিত্ব ও মৃত্যুর প্রতীক, যা থেকে তাঁর মুক্তি নেই। এই কবিতায় কাককে অশুভ, অমঙ্গল ও মৃত্যু-অনিবার্যতার প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছে। ‘আর কখনো নয়’ বলতে জীবনে হারানো প্রেম ও আশা আর কখনো ফিরে আসবে না—এটা বোঝানোর মাধ্যমে একেই নিয়তির প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কবিতায় এক হতাশ, প্রেমহারা মানুষের মানসিক যন্ত্রণা ও আশাহীনতার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এটি শুধু শোকের গল্প নয়, বরং মানুষের গভীর অবচেতন ভয়, মৃত্যু ও চিরবিচ্ছেদের অনিবার্যতাকে প্রতীকীভাবে প্রকাশ করেছে।
১৮৪৮ সালে অ্যালান পো ‘ইউরেকা’ নামে মহাবিশ্ব বিষয়ক লেকচার প্রকাশ করেন, যাকে কেউ কেউ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে মানেন, কেউ আবার একে বলেন অসার রচনা। ইউরেকা একধরনের দার্শনিক-সাহিত্যিক বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ, যেখানে তিনি বলেছেন—মহাবিশ্ব এক বিন্দু থেকে শুরু হয়েছে, প্রসারিত হচ্ছে, আর একসময় আবার সেই বিন্দুতে ফিরে যাবে।
১৮৪৭ সালের জানুয়ারিতে এডগার অ্যালান পোর স্ত্রী ভার্জিনিয়া মারা যান। পরের বছর তিনি কবি সারা হেলেন হুইটম্যানকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, যদিও সে সম্পর্ক ভেঙে যায়। ১৮৪৮ সালে অ্যালান পো ‘ইউরেকা’ নামে মহাবিশ্ব বিষয়ক লেকচার প্রকাশ করেন, যাকে কেউ কেউ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে মানেন, কেউ আবার একে বলেন অসার রচনা।
ইউরেকা একধরনের দার্শনিক-সাহিত্যিক বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ, যেখানে তিনি বলেছেন—মহাবিশ্ব এক বিন্দু থেকে শুরু হয়েছে, প্রসারিত হচ্ছে, আর একসময় আবার সেই বিন্দুতে ফিরে যাবে। এখানে তিনি মহাবিশ্বের উৎপত্তি, গঠন ও সমাপ্তি নিয়ে নিজের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেছেন। পো বলেছেন, শুরুতে ছিল একক অবিভক্ত ইউনিটি অর্থাৎ সমস্ত কণা ও শক্তি এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত ছিল। এটি একধরনের কসমিক এককতার ধারণা, যা আজকের বিগ ব্যাং থিউরির সঙ্গে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়।
এটি সেই ঐক্যবদ্ধ বিন্দু, যেখান থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। পো বিশ্বাস করতেন, মহাকর্ষ আসলে ঈশ্বরপ্রদত্ত একটি মৌলিক শক্তি, যা সবকিছুকে আবার একত্রে টেনে আনবে। যেমনভাবে মহাবিশ্ব বিস্তার লাভ করেছে, তেমনি এক সময় এটি আবার সংকুচিত হয়ে মূল ঐক্যে ফিরে আসবে। অর্থাৎ ঐক্যের পতন ঘটবে।
ইউরেকা ছিল সময়ের অনেক আগের ধারণা, যেখানে মহাবিশ্বের প্রসারণ ও সংকোচনের কথা বলা হয়েছে। এটিকে অনেক সমালোচক সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের এক বিরল সংমিশ্রণ হিসেবে দেখেন। যদিও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এতে ভুল ধারণাও আছে, তবু পোর দূরদর্শী চিন্তা ভবিষ্যৎ পদার্থবিদ্যা ও মহাজাগতিক ধারণার সঙ্গে বিস্ময়কর মিলে যায়।
১৮৪৯ সালে সারা এলমিরা রোয়েস্টার শেল্টনের সঙ্গে তাঁর বাগ্দান সম্পন্ন হয়। সে বছরই বিয়ের ১০ দিন আগে সেপ্টেম্বরে বাল্টিমোরে এডগার অ্যালান পো মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর কারণ আজও অনিশ্চিত। তাঁকে বাল্টিমোরের ওয়েস্টমিনস্টার প্রেসবিটারিয়ান চার্চইয়ার্ডে সমাহিত করা হয়।
পোর সাহিত্য রোমান্টিসিজমের গুপ্তবিদ্যা বিষয়কে কেন্দ্র করে রচিত। স্বপ্ন ও কল্পনাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার তাঁর বিরল ক্ষমতা ছিল। ছোটগল্পকে তিনি এক দিন, এক স্থান ও এক ঘটনায় সীমিত রাখার নিয়ম প্রস্তাব করেন। পোর সৃষ্ট ভয়, অপরাধ, মৃত্যু ও মানসিক দ্বন্দ্ব বিশ্বসাহিত্যে অনন্য। তাঁর গোয়েন্দা কাহিনি আধুনিক গোয়েন্দা সাহিত্যের ভিত্তি স্থাপন করে তাঁকে অমর করে রেখেছে।