গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

‌‘উন্মাদ শিল্পীসত্তা’র উদ্বোধন

কানহীন মানুষের শোনা

ভ্যান গঘের কান কাটা নিয়ে যে সিদ্ধান্তে আমরা সবচেয়ে দ্রুত পৌঁছে যাই, সেটা হলো—লোকটা ছিল পাগল। বাক্যটা খুব সহজ আর আরামদায়কও। কারণ, এতে করে একটা ঘটনার ওপর একটা নাম বসিয়ে দেওয়া যায়। একবার নাম বসে গেলে ব্যাখ্যার চাপ কমে যায়। আমরা ভাবতে চাই না, ঘটনাটা ঠিক কীভাবে ঘটনা হলো। কোন ভাষা তাকে ঘটনা বানাল। কোন চোখ তাকে দেখল। কোন প্রতিষ্ঠান তাকে নথিতে পরিণত করল। ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের নিজের কান কেটে ফেলার ঘটনা শুধু একটি নাটকীয় মুহূর্ত নয়, এটি আধুনিক সময়পর্বের সেই প্রক্রিয়ার চিহ্ন, যেখানে ব্যক্তিগত ভাঙন সমাজের শ্রেণিবিভাগে ঢুকে পড়ে একটি ‘কেস’ হিসেবে স্থির হয়ে যাচ্ছে।

এখানে ফুকোকে পাশে বসিয়ে পড়া জরুরি। মিশেল ফুকো উন্মাদনা নিয়ে লিখতে গিয়ে আমাদের যে পাঠটা দেন, তার কেন্দ্রবিন্দু হলো ‘ম্যাডনেস’ কোনো নিরপেক্ষ, চিরন্তন চিকিৎসাবৈজ্ঞানিক সত্তা নয়। এটি ইতিহাসের মধ্যে গড়ে ওঠা একটি সামাজিক বিভাগ। কে স্বাভাবিক, কে অস্বাভাবিক, কে যুক্তিসংগত, কে বিপজ্জনক—এগুলো ‘প্রাকৃতিক’ পার্থক্য নয়। এগুলো তৈরি করা পার্থক্য। আধুনিক সমাজ হাসপাতাল, আইন, পরিবার, নৈতিকতা ও চিকিৎসা-ভাষা দিয়ে এমন এক ব্যবস্থা নির্মাণ করে, যেখানে কিছু আচরণকে বোঝা হয় ‘অসুস্থতা’ হিসেবে এবং সেই বোঝার মধ্য দিয়েই আচরণকে নিয়ন্ত্রণযোগ্য করা হয়। ফুকোর ভাষায়, ক্ষমতা শুধু শাস্তি দেয় না, ক্ষমতা জ্ঞান তৈরি করে। আর এই তৈরি জ্ঞানের ভেতর দিয়েই ব্যক্তি—রোগী, নাগরিক, অপরাধী, স্বাভাবিক মানুষ বা উন্মাদ মানুষ হিসেবে নির্মিত হয়।

ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের কান কাটার ঘটনাটি ফুকোর এই ধারণাকে প্রায় পরীক্ষাগারের মতো স্পষ্ট করে তোলে। কান কাটার সঙ্গে সঙ্গে শুধু রক্তপাতই হয়নি, শুরু হয়েছে নথিপত্র তৈরি হওয়া। হাসপাতালে ভর্তি, রিপোর্ট লেখা, শহরের গুজব, পুলিশের উপস্থিতি, চিকিৎসকের ডায়াগনোসিস—সব মিলিয়ে এক রাত একটি ‘পাবলিক’ ঘটনা হয়ে ওঠে। একজন মানুষ আর তার নিজের শরীরের অধিকারী থাকেন না, একটি ‘কেস’–এ পরিণত হয়ে যায়। আর কেস মানে—যাকে দেখা যায়, ব্যাখ্যা করা যায়, শ্রেণিবদ্ধ করা যায় এবং প্রয়োজন হলে আলাদা করে রাখা যায়। এই কেস তৈরির মুহূর্তেই ‘উন্মাদ শিল্পী’ নামের একটি সাংস্কৃতিক ফিগার জন্ম নেয়। ফলে কান কাটা কেবল ব্যক্তিগত আত্মঘাতী আচরণের ইতিহাস নয়, এটি একধরনের সামাজিক-প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা তৈরির ইতিহাসও, যেখানে ভ্যান গঘের পরবর্তী জীবন ও শিল্প আগেই ব্যাখ্যাযোগ্য হয়ে পড়ে, আগে থেকেই একটি সংজ্ঞার মধ্যে বন্দী হয়ে যায়।

ভ্যান ঘগ কান কাটার সঙ্গে সঙ্গে শুধু রক্তপাতই হয়নি, শুরু হয়েছে নথিপত্র তৈরি হওয়া। হাসপাতালে ভর্তি, রিপোর্ট লেখা, শহরের গুজব, পুলিশের উপস্থিতি, চিকিৎসকের ডায়াগনোসিস—সব মিলিয়ে একজন মানুষ আর তার নিজের শরীরের অধিকারী থাকেন না, একটি ‘কেস’–এ পরিণত হয়ে যায়। এই কেস তৈরির মুহূর্তেই ‘উন্মাদ শিল্পী’ নামের একটি সাংস্কৃতিক ফিগার জন্ম নেয়।

এই সংজ্ঞা শিল্পের ওপরও ভারী হয়ে বসে। কান কাটা সম্পর্কে আমরা যা জানি, সেসবকে প্রায়ই আমরা তার ছবির দিকে নিয়ে যাই এবং তারপর ছবিকে পড়ি ‘অসুস্থতার ভাষা’য়। নীলের ঘূর্ণি মানে অস্থিরতা, হলুদের তীব্রতা মানে উৎকণ্ঠা, রেখার কাঁপুনি মানে স্নায়ুর ভাঙন—এ রকম একটি প্রস্তুত ব্যাখ্যা তৈরি হয়। কিন্তু এই ব্যাখ্যার মধ্যেও একধরনের সহিংসতা আছে, কারণ এটি শিল্পকে তার নিজের শক্তি থেকে সরিয়ে এনে চিকিৎসাসাধ্য ‘লক্ষণ’ হিসেবে স্থাপন করে। ভ্যান গঘকে তখন আমরা শিল্পী হিসেবে নয়, রোগের বাহক হিসেবে দেখতে শুরু করি।

‘ওমেন অন হার ডেথ বেড’, ১৮৮৩। শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান ঘগ

মিশেল ফুকোর চোখ দিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এই রিডিংটা নিরপেক্ষ নয়। এটা আধুনিক সমাজের সেই প্রবণতার অংশ, যে প্রবণতা অস্বাভাবিকতাকে ব্যাখ্যা দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়, যাতে তা আর সামাজিক অস্বস্তি তৈরি না করে। এখানে প্রশ্নটা উল্টোভাবে করা দরকার। ভ্যান গঘের ছবি কি অসুস্থতার প্রকাশ, নাকি এটি দেখার ভিন্ন এক রীতি? শিল্প কখনো কখনো সেই বিষয়কে দেখায়, যা ‘স্বাভাবিক’ চোখ দেখতে শেখে না। স্বাভাবিকতা সব সময় সত্য নয়, স্বাভাবিকতা অনেক সময় অভ্যাস। আর অভ্যাস একধরনের সীমাবদ্ধতা। ভ্যান গঘের ক্যানভাস সেই সীমাবদ্ধতাকে নাড়িয়ে দেয়। তার ছবিতে আকাশ স্থির থাকে না, আলো শুধু আলো থাকে না, রং শুধু রং থাকে না। দৃশ্য অনুভব হয়ে ওঠে। বাস্তবতা চেতনার ভেতর দিয়ে তৈরি হয়। এটাকে ‘হ্যালুসিনেশন’ বলে শেষ করলে আমরা আসলে একটা দার্শনিক সুযোগ হারাই, এই সুযোগটা হলো, বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কের ভিন্ন সম্ভাবনাকে ভাবার সুযোগ। অর্থাৎ ভ্যান গঘের শিল্পকে ‘রোগ’ নয়, ‘দৃষ্টির রাজনীতি’ হিসেবে পড়া যায়। তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন যে দেখা মানে শুধু চোখের ক্ষমতা নয়, দেখা মানে সামাজিকভাবে শেখানো একটি অভ্যাস, একটি ফ্রেম। এবং সেই ফ্রেম ভাঙা মানেই কেবল উন্মাদ হওয়া নয়, কখনো কখনো তা বাস্তবতার গভীরতাকে স্পর্শ করা।

আরতো এখানে একধরনের র‍্যাডিক্যাল সংকেত দেন। আন্তোনাঁ আরতো ভ্যান গঘকে নিয়ে লিখেছিলেন, ‘ভ্যান গঘকে আত্মহত্যা করিয়েছে সমাজ।’ এই বাক্য কোনো অতিরঞ্জিত সাহিত্যিক নাটক নয়, এটি আসলে একটি তর্ক। আরতো বলছেন, সমাজ ভ্যান গঘকে প্রথমে বহিষ্কার করেছে, তাকে অসুস্থ বলে চিহ্নিত করেছে, তারপর সেই অসুস্থতার গল্পকে সাংস্কৃতিক পুঁজি বানিয়েছে। জীবিত অবস্থায় অবহেলা, মৃত্যুর পরে পূজা—এই দ্বৈততা আধুনিক সংস্কৃতির খুব পরিচিত কৌশল।

‘আ রোড অ্যাট সেন্ট-রেমি উইথ ফিমেল ফিগার’, ১৮৮৯। শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান ঘগ

মিশেল ফুকোর সঙ্গে আন্তোনাঁ আরতোকে পড়লে বোঝা যায়, উন্মাদনা শুধু ব্যক্তির ভেতরে নেই, উন্মাদনা এমনও হতে পারে, যা সমাজ নির্মাণ করে এবং যার দ্বারা সমাজ নিজের স্বাভাবিকতাকে রক্ষা করে। ভ্যান গঘের কাহিনি একজন মানুষের ভেঙে পড়ার কাহিনি নয়, এটি সেই প্রক্রিয়ার কাহিনি, যেখানে সমাজ ভেঙে পড়া মানুষকে একধরনের নথিভুক্ত সত্যে পরিণত করে, এবং তারপর সেই সত্যকে উপভোগ করে। এই উপভোগের দিকটা বোঝাতে বেঞ্জামিনও কাজে লাগে, যদিও তিনি ভ্যান গঘের কান কাটা নিয়ে সরাসরি লিখেছেন—এমন কথা বলা কঠিন। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন আধুনিকতার অভিজ্ঞতাকে ‘শক’ হিসেবে বর্ণনা করেন—শহর, ভিড়, সংবাদ, দ্রুততা, আকস্মিকতা মানুষের ইন্দ্রিয়কে বারবার আঘাত করে। এই আঘাতে মানুষ হয় অসাড় হয়ে পড়ে, নয়তো অতিসংবেদনশীল হয়ে ওঠে। ভ্যান গঘের কান কাটা যেন সেই শকের নাটকীয় রূপ। সমাজ এই ঘটনাকে শকের মতো গ্রহণ করে, তারপর শককে পণ্যে পরিণত করে—গল্প, কিংবদন্তি, বায়োগ্রাফি। এতে আমাদের নিজের আধুনিকতা-সংক্রান্ত উদ্বেগও ঢুকে আছে, এমন কারও দিকে তাকিয়ে আমরা স্বস্তি পাই, যাকে ‘পাগল’ বললে নিজেদের ভেতরের অস্থিরতাকে দূরে রাখা যায়। কিন্তু সেই দূরে রাখার কাজটাই বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের কথায় একধরনের আধুনিক অভ্যাস—শকে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার অভ্যাস। ভ্যান গঘের ঘটনাকে আমরা বারবার দেখি, কিন্তু তার অর্থটাকে আর শুনতে চাই না।

কান কাটা সম্পর্কে আমরা যা জানি, সেসবকে প্রায়ই আমরা তার ছবির দিকে নিয়ে যাই এবং তারপর ছবিকে পড়ি ‘অসুস্থতার ভাষা’য়। নীলের ঘূর্ণি মানে অস্থিরতা, হলুদের তীব্রতা মানে উৎকণ্ঠা, রেখার কাঁপুনি মানে স্নায়ুর ভাঙন—এ রকম একটি প্রস্তুত ব্যাখ্যা তৈরি হয়। কিন্তু এর মধ্যেও সহিংসতা আছে, কারণ এটি শিল্পকে তার নিজের শক্তি থেকে সরিয়ে এনে চিকিৎসাসাধ্য ‘লক্ষণ’ হিসেবে স্থাপন করে।
‘সেলফ-পোর্ট্রেট উইথ আ ব্যান্ডেজড ইয়ার’, ১৮৮৯। শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান ঘগ

ভ্যান গঘের কানকে যদি একটি দার্শনিক অবজেক্ট হিসেবে ধরা যায়, তাহলে এটি আমাদের তিনটি বিষয় একসঙ্গে দেখায়। প্রথমত, এটি দেখায় কীভাবে ব্যক্তিগত ঘটনা ‘ডিসকোর্স’ হয়ে ওঠে অর্থাৎ সামাজিক ভাষায় ঢুকে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট অর্থ ধারণ করে। দ্বিতীয়ত, এটি দেখায় কীভাবে প্রতিষ্ঠান এই অর্থকে স্থির করে—রোগ, বিপদ, অস্বাভাবিকতা, কেস—এ ধরনের শব্দ দিয়ে। তৃতীয়ত, এটি দেখায় কীভাবে শিল্প সেই স্থির অর্থের বাইরে দাঁড়িয়ে ‘অন্য এক সত্য’ তৈরি করতে পারে।

মিশেল ফুকো আমাদের শেখান যে ক্ষমতা জ্ঞান তৈরি করে, আর সেই জ্ঞান মানুষ তৈরি করে। ভ্যান গঘের কান কাটা ‘উন্মাদ শিল্পী’ নামের জ্ঞান তৈরি করেছে। কিন্তু ভ্যান গঘের শিল্প সেই জ্ঞানকে অতিক্রম করেছে, কারণ তা আমাদের এমন এক অভিজ্ঞতা দেয়, যা রিপোর্টের ভাষায় ধরা যায় না। ক্যানভাসে থাকা সত্যটি ক্লিনিকের সত্যের মতো নয়, এটি অনুভবের সত্য, দৃষ্টির সত্য, বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কের সত্য।

‘ট্রি রুটস’, ১৮৯০। শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান ঘগের শেষ কাজ

এখানে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের ঘটনাকে ‘কেন’ প্রশ্নে আটকে না রেখে অন্যভাবে ধরতে হয়। প্রশ্নটা হওয়া উচিত, কোন মুহূর্তে কান কাটা একটি ব্যক্তিগত কাজ থেকে একটি সামাজিক ব্যাখ্যায় পরিণত হলো? কোন ভাষা সেটা ঘটাল? কোন প্রতিষ্ঠান সেটাকে স্থায়ী করল? আমরা কেন এই ব্যাখ্যাকে এত সহজে গ্রহণ করি? এবং সেই গ্রহণের ফলে আমরা কী হারাই? ফুকোর সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো—মানব অভিজ্ঞতা সব সময়ই ক্ষমতার কাঠামোর মধ্যে ঘটে; আমরা যে শব্দ দিয়ে মানুষকে বুঝি, সেই শব্দগুলো নিষ্পাপ নয়।

শেষে বলা যায়, ভ্যান গঘের কান কাটা এক টুকরো অঙ্গ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনা নয়। এটি আধুনিকতার একটি সীমারেখা। এখানে ব্যক্তি শেষ হয় না, বরং সমাজ শুরু হয়। সমাজের চোখ, সমাজের ভাষা, সমাজের প্রতিষ্ঠান—সব মিলিয়ে একটি মানুষকে ‘উন্মাদ’ বানিয়ে দেয়। অথচ সেই মানুষটি ক্যানভাসে যা রেখে গেছেন, তা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, উন্মাদনা শব্দটা দিয়ে হয়তো আমরা মানুষকে আটকে রাখতে পারি, কিন্তু শিল্পকে আটকে রাখা যায় না।

শিল্প সাক্ষ্য দেয়, স্বাভাবিকতার ভেতরেও কত অস্বাভাবিক সত্য লুকিয়ে থাকে এবং কখনো কখনো সেই সত্যটাই সবচেয়ে বাস্তব। ভ্যান গঘের কান তাই আমাদের সামনে একটি প্রশ্ন হয়ে থাকে—আমরা কাকে স্বাভাবিক বলি এবং সেই স্বাভাবিকতার দাম কারা দেয়!