প্রতিকৃতি ও অলংকরণ: মাসুক হেলাল
প্রতিকৃতি ও অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মূল্যায়ন

কেন উপেক্ষিত ছিলেন শহীদুল জহির

শহীদুল জহিরের প্রথম উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ (১৯৮৭) মূলত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে রচিত। এতে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির প্রত্যাবর্তন, পুনর্বাসন, ক্ষমতায়ন এবং উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে। দেখানো হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে কীভাবে আদর্শের চেয়ে ক্ষমতার রাজনীতি সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর চেপে বসেছে। এটিও প্রামাণ্য হয়ে উঠেছে যে রাজনৈতিক বাস্তবতায় সত্য বলে কিছু নেই। থাকলেও তা বদলে যায় এবং এই পরিবর্তনের সামনে ব্যক্তির অস্তিত্ব ঠুনকো কিংবা মূল্যহীন হয়ে পড়ে।

উপন্যাসটির আখ্যানপট প্রধানত ঢাকার লক্ষ্মীবাজার এবং এর সংলগ্ন এলাকা; আর সময়পরিধি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। তবে রূপকার্থে কিংবা সমকালীন বাস্তবতার দিক থেকে তা আরও প্রসারতা দাবি করে। কাহিনিবিধৃত ১৫ বছরের বেশি সময়ের মধ্যে এত কিছু ঘটে যে এগুলোর কোনোটিকেই একক কিংবা আলাদা কোনো ঘটনা বলে মনে হয় না। অথবা বলা যায়, সেগুলোর যোগফল থেকে জন্ম নেয় স্থানিক জীবনের এমন এক রূপক, যা অনির্ণেয় সমগ্রতাকে আকর্ষণ অথবা ধারণ করে। অর্থাৎ ব্যক্তির বিপন্নসংকুল লক্ষ্মীবাজার হয়ে ওঠে বাংলাদেশ ও পৃথিবীর দেশে দেশে স্বাধীনতার জন্য সংঘটিত যুদ্ধ আর তৎপরবর্তী জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার রূপক; কিন্তু এই বিবেচনার সীমা পেরিয়ে প্রতীকদ্যোতক কিছু মোটিফ বা ঘটনা কিংবা অনুষঙ্গ ব্যক্তির রাজনৈতিক উদ্বেগ ও সাংস্কৃতিক অবচেতনের সূত্রে স্পন্দমান।

উল্লেখ বাহুল্য নয়, উপন্যাসে রূপকের অংশ হিসেবে দ্যোতিত হতে পারে প্রতীক—বিশেষ অর্থ, ধারণা বা তাৎপর্য নিয়ে। জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতায়ও দেখা যায়—কোনো কোনো মোটিফ, ঘটনা, চরিত্র, স্থান বা দৃশ্য সরাসরি কিংবা প্রচলিত অর্থের বাইরে চলে গেছে এবং প্রবেশ করেছে পরোক্ষ, অনেকান্ত ও অনিশ্চিত অর্থের জগতে। যেমন আবদুল মজিদের স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে যাওয়া; আকাশে কাকের আক্রমণাত্মক উপস্থিতি ও উইপোকার পলায়নদৃশ্য; কর্তিত পুরুষাঙ্গের দিকে মনোযোগের কারণে দ্বিতীয় স্ত্রীকে বদু মাওলানার তালাক দেওয়া; তুলসীগাছ নিয়ে খেদোক্তি এবং অন্যান্য ঘটনা; পাকিস্তানি হামলায় নিহত খাজা আহমেদ আলী ও তাঁর পুত্র খাজা শফিকের কবরের পাশে কুকুরকে সমাহিত করা; আবদুল মজিদের মেয়ের নাম মুক্তিযুদ্ধে সম্ভ্রমহারা নিহত বোনের নামে মোমেনা রাখা ইত্যাদি।

কেন শহীদুল জহির লেখক হিসেবে জীবদ্দশায় উপেক্ষিত ছিলেন? জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা–য় এ প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। উপন্যাসটি মোটাদাগে জানিয়ে দেয়—মুক্তিযুদ্ধের পর রাজাকারের প্রতি বিজয়ী শাসকের সাধারণ ক্ষমা ভিকটিমরা মেনে নিতে পারেনি। এর মধ্য দিয়ে লেখক স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমালোচনা করেছেন; বুঝিয়ে দিয়েছেন, নিপীড়িত সাধারণ মানুষের অনুভূতির কোনো মূল্য নেই। পরাজিত ব্যক্তিদের দৃষ্টিভঙ্গিও একই। সেই সূত্রে উপন্যাসটি বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় আজও গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক।

‘সময়ের সঙ্গে সত্য বদলে যায়’ বার্তাকে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার ভাবকেন্দ্র বলে ধরে নেওয়া যায়। তবে ‘রাজনীতিতে চিরদিনের বন্ধু অথবা চিরদিনের শত্রু বলে কিছু নেই। কাজেই অতীত ভুলে যাওয়া ছাড়া কীই–বা করার আছে মানুষের।’ আজিজ পাঠানের এই উক্তি মুক্তিযুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক বাস্তবতা উপলব্ধিতে সাহায্য করে। উল্লেখ্য, এর শুরুর বাক্যটি সম্ভবত প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন লর্ড পামারস্টোন, লন্ডনের হাউস অব কমন্সে ১৮৪৮ সালে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রনীতি–সম্পর্কিত এক বক্তব্যে। পামারস্টোন বলেছিলেন যে ব্রিটেনের কোনো স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নেই, আছে কেবল স্থায়ী স্বার্থ। এই বক্তব্যের সঙ্গে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের অভিজ্ঞতায় পূর্ণ আজিজ পাঠানের উক্তির কোনো সম্পর্ক নেই, তবে উপলব্ধিগত মিল আছে। এটি এই অর্থে যে স্বার্থের কারণে সম্পর্ক বদলে যায়। স্বাভাবিকভাবেই সত্যের রূপও আর আগের মতো থাকে না। তা হোক সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক। প্রসারিত তাৎপর্যে এর মধ্য দিয়ে লেখক ইতিহাস ও সমকালীন বাস্তবতার সঙ্গে স্থায়ী স্বার্থ ও পরিবর্তনশীল সত্যের সম্পর্ক দেখিয়েছেন।

২.

জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উপন্যাসে ব্যক্তির সংগ্রামশীল জীবনের চেয়ে অসহায়ত্ব বেশি পরিস্ফুট। দু–চারটি ব্যতিক্রমী লক্ষণ ছাড়া এর চরিত্রগুলো নিরুপায় দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। তবে বদু মাওলানার সক্রিয়তা বেশি দেখা যায়। অন্যদের অধিকাংশের কার্যকলাপে মনে হয়, তারা পরিস্থিতির শিকার, অনুগামী বা ক্রীড়নক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের প্রাণ রক্ষার আবশ্যকতা তাদের চালিত করে। ১৫ বছরের যে ঘটনাগুচ্ছ, সেগুলোর বিপুল-অধিকাংশের সঙ্গে প্রায় কারোরই অংশগ্রহণমূলক কোনো সম্পর্ক লক্ষ করা যায় না। অধিকন্তু তাদের জীবনের কী উদ্দেশ্য, তা–ও বোঝা মুশকিল। চরিত্রগুলোর এ রকম নীরবতা থেকে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে ক্ষমতাকাঠামোর চাপিয়ে দেওয়া বাস্তবতার মধ্যে তারা বসবাস করছে।

অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে উপন্যাসটি রচিত হয়েছে বলে মনে হয় না; তবে এতে রয়েছে এই সংবেদনশীলতার কিছু উপাদান। যেমন এর অধিকাংশ চরিত্র বিদ্যমান সমাজকাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন এবং তাদের প্রত্যেকের সংকটের রূপ আলাদা; সামাজিক মূল্যবোধ কিংবা ধর্মীয় অনুশাসনে প্রভাবিত না হয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত তারা নিতে পারে এবং এর ফল ভোগ করে; স্বাধীন সিদ্ধান্তহেতু চরিত্রগুলোর মধ্যে ভয় ও উদ্বেগ লক্ষণীয়। অধিকন্তু মৃত্যুর অনিবার্যতা, জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব বা অনিশ্চয়তা এই উপন্যাসে বারবার প্রাসঙ্গিক হয়েছে। মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে জীবনের অর্থ সন্ধানের চেষ্টাও লক্ষ করা যায়।

উপন্যাসটির কাঠামোবাদী বিশ্লেষণ বেশ জটিল। কারণ, এতে ভাষার অভ্যন্তরীণ কাঠামো এবং উপাদানগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর জোর দেওয়া হয়। কেননা, এই পদ্ধতিতে কোনো রচনাকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কাঠামো হিসেবে বিবেচনা করে, এর পাঠপ্রসূত অর্থকে বাহ্যিক প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার রীতি রয়েছে। জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোচনায় এমন কিছু উপাদানের সাক্ষাৎ মেলে, যেগুলো কাঠামোবাদী পাঠপদ্ধতিতে বিবেচ্য হতে পারে। যেমন বাইনারি অপজিশন অর্থাৎ বিপরীত জোড়ের নমুনারূপে এই উপন্যাসে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার; সত্য-মিথ্যা; স্মৃতি-বিস্মৃতি; নীতি-সুবিধাবাদ; অতীত-বর্তমান ইত্যাদি। এগুলই কাহিনির চালিকাশক্তি হিসেবে ক্রিয়াশীল থেকেছে।

দ্বিতীয়ত, উপন্যাসটির কাহিনি লিনিয়ার অর্থাৎ রৈখিক ধারায় গতিশীল নয়; ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে অতীত ও বর্তমানের মধ্যে এর যাতায়াত ঘটেছে। ১৯৮৫ সালের একটি ঘটনা থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় ফিরে যাওয়া এবং বর্তমানে প্রত্যাবর্তন—বর্ণনাত্মক এই কৌশলটি উপন্যাসের কাঠামোকে জটিল ও স্তরযুক্ত করে। ফলে পরিস্থিতির কার্যকারণ-সম্পর্ক উপলব্ধির পরিবর্তে ঘটনার বিন্যাস ও অবস্থানের ওপর পাঠকের মনোযোগ অবধারিত হয়ে ওঠে।

বাংলা কথাসাহিত্যে শহীদুল জহিরের প্রসিদ্ধি অনন্য শৈলীর জন্য; এর মূলে রয়েছে জাদুবাস্তবতার প্রকরণ ব্যবহারে তাঁর প্রশ্নাতীত দক্ষতা। উপন্যাসের অভ্যন্তরীণ কাঠামোয় এটি এক বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। জাদুবাস্তবতামূলক বর্ণনারীতি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ঘটনার বাস্তবতাকে ভেঙে নতুন এক বাস্তবতা তৈরি করেন তিনি। এই আলাপে উল্লেখ প্রয়োজন, ক্ষমতার রাজনীতি থেকে উদ্ভূত বাস্তবতায় বিপন্ন নিজের পরিবারকে অন্যত্র স্থানান্তরের যে সিদ্ধান্ত আবদুল মজিদ নেন, তা জাদুবাস্তবতার গল্প-উপন্যাসে দেখা যায়। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের (১৯২৭-২০১৪) কথাসাহিত্যে তা রয়েছে। বৈশিষ্ট্যটি জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মূলকাঠামোর অনপনেয় অংশ হয়ে উঠেছে ।

বাংলা কথাসাহিত্যে শহীদুল জহিরের প্রসিদ্ধি অনন্য শৈলীর জন্য; এর মূলে রয়েছে জাদুবাস্তবতার প্রকরণ ব্যবহারে তাঁর প্রশ্নাতীত দক্ষতা। উপন্যাসের অভ্যন্তরীণ কাঠামোয় এটি এক বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। জাদুবাস্তবতামূলক বর্ণনারীতি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ঘটনার বাস্তবতাকে ভেঙে নতুন এক বাস্তবতা তৈরি করেন তিনি। উত্তর-কাঠামোবাদী সংবেদনশীলতায় এ ধরনের টেক্সটে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হিসেবে দেখা হয় না; বরং একে বিবেচনা করা হয় একটি প্রচ্ছন্ন কর্তৃপক্ষরূপে, যা ভাষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ করে।

তৃতীয়ত, এই উপন্যাসে ব্যবহৃত কিছু মোটিফ বা প্রতীক, যেমন স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে যাওয়া, তুলসীগাছ, বদু মাওলানার খয়েরি জোব্বা ইত্যাদি পরস্পর সম্পর্কিত হয়ে বিশেষ এক অর্থ তৈরি করেছে।

এই উপন্যাসে সমকালীন বাস্তবতা, রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং ব্যক্তিপরিচয়ের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। উত্তর-কাঠামোবাদী বিবেচনায় সাহিত্যের অন্বিষ্ট বাস্তবতা কোনো একক বা স্থির ধারণা নয়; বরং একটি সামাজিক নির্মাণ। আলোচ্য উপন্যাসের চরিত্রগুলো তাদের নিজস্ব সত্য আর বাস্তবতার মধ্যে বিভক্ত। শহীদুল জহির বর্ণনা, স্মৃতি আর স্বপ্নের মাধ্যমে বাস্তবতাকে ভেঙে দিয়েছেন, যা একক বাস্তবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। উত্তর-কাঠামোবাদী সংবেদনশীলতায় এ ধরনের টেক্সটে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হিসেবে দেখা হয় না; বরং একে বিবেচনা করা হয় একটি প্রচ্ছন্ন কর্তৃপক্ষরূপে, যা ভাষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ করে। শহীদুল জহির এই উপন্যাসে দেখান, কীভাবে ভাষা এবং বর্ণনা বাস্তবতার উপলব্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করে। চরিত্রগুলোর ভাষাগত অবস্থান থেকে এটা স্পষ্ট যে কোনো বিশেষ বাস্তবতা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রশ্ন ওঠে, ‘সত্য কী?’ এবং ‘কে তা নির্ধারণ করে?’ এই বিশ্নেষণের সূত্রে বলা যেতে পারে, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা কেবল একটি রাজনৈতিক সময়ের দলিল নয়; বরং এক গভীর দার্শনিক ও সাহিত্যিক অন্বেষণ, যা বাস্তবতা ও ভাষার মধ্যকার সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জ করে।

৩.

পরিবর্তনশীল সমাজ ও রাজনীতি মোকাবিলা করতে গিয়ে ব্যক্তি যে সংকটের মধ্যে পড়ে, তা থেকে উত্তরণের সংগ্রাম উপন্যাসের প্রধান এক বিবেচ্য। এই সূত্রে উপন্যাসে রচিত হয় ব্যক্তির সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস। লেখক যখন সেই ন্যারেটিভ তৈরি করেন, তখন বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোর মুখোমুখি হন। বয়ানের বিভিন্ন স্তরে সেই চিহ্ন রয়ে যায়। জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিধৃত আবদুল মজিদের জীবনসংক্রান্ত ন্যারেটিভের উৎস ‘মহল্লার লোকদের‘ স্মৃতি, পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ক্ষমতাকাঠামোর চাপিয়ে দেওয়া ইতিহাসকে যা অগ্রাহ্য করে। পাঠক ও ন্যারেটরের (স্থানীয় লোকজন) মধ্যবর্তী অবস্থান থেকে লেখক সেটি জানিয়ে দেন, যেন তিনি উভয়ের সম্পর্কের ঘটকালি করছেন। কৌশলটি গৃহীত হওয়ার কারণ সম্ভবত পরিবর্তনশীল বাস্তবতার চাপ; এবং এটিও ক্ষমতাকাঠামোর বিপরীতে লেখকের অবস্থানকে প্রতিভাত করে। ‘মহল্লার লোকদের’ উদ্ধৃত করে ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনার অর্থ কিংবা উদ্দেশ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসকে মূল্যায়নের পরিসর তৈরি করা। এই ইতিহাস বিজয়ী শাসকদের নয়, পরাজিত শাসিতদেরও নয়, এটি নিপীড়িতের ইতিহাস, যা বর্ণিত হয় নিপীড়নের শিকার সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে। ‘ইলুমিনেশন্স’ (১৯৬৮) গ্রন্থের অন দ্য কনসেপ্ট অব হিস্ট্রি (১৯৪০) প্রবন্ধে ওয়াল্টার বেঞ্জামিন (১৮৯২-১৯৪০) জানিয়েছেন, অতীতের ঘটনাগুলো বিজয়ীদের ইতিহাসে বর্ণিত হয় সরল, একরৈখিক ও ‘প্রগতিশীল’ ধারায়, যার ফলে নিপীড়িত মানুষের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি হারিয়ে যায়। প্রবন্ধটিতে এটিও বলা হয়েছে যে বিজয়ীদের কবল থেকে ইতিহাসকে মুক্ত করে প্রতিমুহূর্তে ‘বিস্ফোরণ’ ঘটিয়ে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সংযোগ তৈরি করতে হবে। আলোচ্য উপন্যাসে শহীদুল জহির ফিরিয়ে এনেছেন নিপীড়িতের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি; অতীত-বর্তমানের সংযোগসূচক ‘বিস্ফোরণ’ও ঘটিয়েছেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায়। তাতে ঘটেছে ইতিহাসের বিনির্মাণ, যা কেবল বিজয়ী শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রত্যাখ্যান করে না, পরাজিত শাসিতদের অভিপ্রায়কেও অগ্রাহ্য করে; কিন্তু এড়িয়ে যায় না। পাকিস্তানি সৈন্যের গুলিতে নিহত হওয়ার পূর্বমুহূর্তে খাজা আহমেদ আলীর আজান সম্পর্কে বদু মাওলানা ও এলাকাবাসীর পরস্পরবিরোধী বয়ানের অবতারণা, রাজাকার আবদুল গণিকে হত্যার পর বদু মাওলানা কর্তৃক তাকে ‘শহীদ’ ঘোষণার উল্লেখ থেকে এটা বোঝা যায়।

কেন শহীদুল জহির লেখক হিসেবে জীবদ্দশায় উপেক্ষিত ছিলেন? আগের অনুচ্ছেদে যা বলার প্রয়াস করা হয়েছে, তাতে সহজে অনুমেয় যে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। উপন্যাসটি মোটাদাগে জানিয়ে দেয়—মুক্তিযুদ্ধের পর রাজাকারের প্রতি বিজয়ী শাসকের সাধারণ ক্ষমা ভিকটিমরা মেনে নিতে পারেনি; বদু মাওলানার পুনরুত্থান, মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন এক ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এবং তার ছেলে আবুল খায়েরের রাজনৈতিক আবির্ভাব সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেনি। এর মধ্য দিয়ে লেখক স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমালোচনা করেছেন; বুঝিয়ে দিয়েছেন, শাসকশ্রেণির কাছে আদর্শ বা চেতনা নয়, ক্ষমতাই বড়; এবং নিপীড়িত সাধারণ মানুষের অনুভূতির কোনো মূল্য নেই। পরাজিত ব্যক্তিদের দৃষ্টিভঙ্গিও একই। সেই সূত্রে উপন্যাসটি বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় আজও গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। একেকটি বাইনারি অপজিশনের মধ্য দিয়ে যে রূপক এতে সৃষ্টি হয়েছে, তাতে অনুধাবনীয় হয়ে উঠেছে ক্ষমতাকাঠামোর প্রতি শহীদুল জহিরের আপত্তি ও অসন্তোষ, যা বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের জন্য তো বটেই, তাদের অনুসারীকুলের পক্ষেও স্বস্তিকর হতে পারে না। ফলে তাঁর সম্পর্কে যেমন প্রধান দুটি (মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং এর বিরোধী) রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত গণমাধ্যম ও লেখকেরা নীরবতা পালনে আন্তরিক ছিলেন, তেমনি আজও কারও কারও সাক্ষাৎকারে তাঁকে চিহ্নিত করা হয় ‘ওভাররেটেড’ বলে। তবে শহীদুল জহির লেখক হিসেবে জিতে যান, তাঁর আপসহীন ও স্বাধীন কণ্ঠস্বর নিয়ে। কেননা, তাঁর সত্য অপরিবর্তনীয় এবং তা নিপীড়িতের পক্ষেই; কোনো প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক বাস্তবতা, মতাদর্শিক চাপ এর ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না।