গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

জন্মদিনে স্মরণ

মুক্তচিন্তার অভিভাবক কাজী মোতাহার হোসেন

শুভবুদ্ধিসম্পন্ন চিন্তাধারা বাঙালি মুসলমান সমাজে যাঁদের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়েছে, তা প্রত্যক্ষ করতে আমাদের চোখ ফেরাতে হয় কাজী মোতাহার হোসেনের (৩০ জুলাই ১৮৯৭–৯ অক্টোবর ১৯৮১) দিকে। ধরা হয়, ব্যক্তির মুক্তির মাধ্যমেই নিশ্চিত হতে পারে বৃহত্তর সমাজের মুক্তি। কাজী মোতাহার হোসেন এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন। তাই ব্যক্তির মুক্তিকে প্রাধান্য দিতেই যোগ দিয়েছিলেন বুদ্ধির মুক্তির দলে। আজ থেকে ৯৯ বছর আগে ১৯২৬ সালে বৃহত্তর মুসলিম সমাজের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুসলিম সাহিত্য সমাজ। যার মুখপত্র ছিল শিখা নামের পত্রিকা। যে পত্রিকার শুরুতেই লেখা থাকত ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ঠ, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ এই যে মুক্তির হাওয়া বাঙালি মুসলমান সমাজে শিখাগোষ্ঠী বয়ে দিতে চেয়েছিল, তার সদস্য ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেনও। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সেই পটভূমিতেই তাঁর জীবন ও চিন্তাধারার পর্যালোচনা আবশ্যক।

কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন যুক্তিবাদী। সেই যুক্তির মাধ্যমেই তিনি পৌঁছাতে চেয়েছেন আপন আনন্দের স্বর্গে; আর সেই বিশ্বাসই তিনি তাঁর লেখা ও কর্মের মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছেন। বাইরে থেকে দেখার মাধ্যমে, বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে সংশয় কাটবে না; মুক্তিও মিলবে না। তা হতে হবে ভেতর থেকে, ব্যক্তির একান্ত আপনার জগৎ থেকে। মানুষের মনের গভীর থেকে যতক্ষণ না তার ‘আপনার’ কথাটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তির মুক্তি নেই। তিনি এ কথাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানারূপে প্রকাশের মাধ্যমে ব্যক্তিকে আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলতে চেয়েছেন। চাপিয়ে দেওয়ার উন্মাদনা নয়; বরং তাঁর অন্বেষণের মূলে ছিল যুক্তি ও বিজ্ঞান। যার মাধ্যমে তিনি ধ্বংসের উন্মত্ততা থেকে প্রবৃত্তিকে বাঁচানোর পথ দেখিয়েছেন।

আপনি বিচিত্র ভাবকে এবং আলোচনার বিষয়কে স্বচ্ছ প্রাঞ্জল ভাষায় রূপ দিয়ে প্রবন্ধগুলি আপনার সঞ্চরণ গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন, তা পড়ে পরিতৃপ্ত হয়েছি। আপনার বলার সাহস এবং চিন্তার স্বকীয়তা সাধুবাদের যোগ্য। সাহিত্যপথে আপনার অধ্যবসায় জয়যুক্ত হোক, এই কামনা করি
কাজী মোতাহার হোসেনের প্রবন্ধ পাঠের প্রতিক্রিয়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কাজী মোতাহার হোসেনের প্রথম প্রবন্ধের বই ‘সঞ্চরণ’। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৭ সালে। এ বই সম্পর্কে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্তব্য করেছিলেন, ‘আপনি বিচিত্র ভাবকে এবং আলোচনার বিষয়কে স্বচ্ছ প্রাঞ্জল ভাষায় রূপ দিয়ে প্রবন্ধগুলি আপনার সঞ্চরণ গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন, তা পড়ে পরিতৃপ্ত হয়েছি। আপনার বলার সাহস এবং চিন্তার স্বকীয়তা সাধুবাদের যোগ্য। সাহিত্যপথে আপনার অধ্যবসায় জয়যুক্ত হোক, এই কামনা করি।’

কাজী মোতাহার হোসেনের প্রবন্ধ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই সংক্ষিপ্ত মন্তব্য তাঁর লেখার স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করে। যুক্তি ও ভাষার যে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে তিনি চিন্তাকে ছড়িয়ে দিতে প্রয়াস পেয়েছেন, তারও পূর্বাভাস মেলে রবীন্দ্রনাথের উক্তিতে।

‘সাহিত্য প্রসঙ্গে দুয়েকটি কথা’ প্রবন্ধে কাজী মোতাহার হোসেন লেখেন, ‘সমাজ-মনের প্রকাশ থাকাতেই সাহিত্য হৃদয়গ্রাহী হয়। তাই সমাজ-মনটাকে বুঝে নেওয়া, সাহিত্য রচনার পক্ষে অত্যন্ত আবশ্যক। এত দিন যাঁরা বাংলা সাহিত্য রচনায় অগ্রণী ছিলেন, তাঁরাও অবশ্য সমাজ-মনকেই রূপায়িত করতে চেয়েছেন; কিন্তু তাঁদের সমাজ গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন কলকাতা শহর এবং তার উপকণ্ঠের জীবনপ্রণালিই তাঁদের সাহিত্যে বিশেষ করে ফুটে উঠেছে। অবশ্য এটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ, ইংরেজ আমলে জীবনচাঞ্চল্যের প্রথম শিহরণ ওইখানেই আরম্ভ হয়েছিল। জীবনচাঞ্চল্যের প্রকাশে তাঁরা যে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, তাতে কলকাতার ভাষা, বাচনভঙ্গি এবং ব্যবসায়িক ও সামাজিক রীতি-পদ্ধতির প্রাধান্য ঘটেছে। এর বাইরে যে বিপুল পল্লিসমাজ—ঋণগ্রস্ত কৃষক, দিনমজুর, কুমার, ধীবর, কামার, স্কুলমাস্টার, হাতুড়ে ডাক্তার, ছোটখাটো জোতদার, মধ্যবিত্ত গৃহস্থ নিজ নিজ সমস্যা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন, তার পরিচয় ততটা পাওয়া যায় না। তাঁদের মধ্যে যাঁরা শিক্ষিত, তাঁরাও নিজেদের সমাজ সম্বন্ধে সচেতনতার পরিচয় দিয়ে মৌলিক রচনা রেখে যেতে পারেন নাই। তার কারণ সাহিত্য-বিচারের মালিক যাঁরা, তাঁরা নিজেদের প্রথাবহির্ভূত সাহিত্যকে সাহিত্য পর্যায়ে স্থান দিতে সর্বদাই নারাজ। তাই অনাদর ও হতাদরের মধ্যে বৃহৎ পল্লিসমাজের কৃতী ছেলেদেরও মানসিক বিকাশে কৃত্রিম বাধার সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষত অনুকরণ করেই যখন যাহাই–বা পাওয়া যায়, তখন মৌলিকতার কঠিন পথে চলবার লোক পাওয়াই ভার হয়।’

সাহিত্য যে রূপেই হোক, তাকে যে সাধারণের উপলব্ধির কাতারে পৌঁছাতে হবে, ভাষার সৌন্দর্য ও স্বভাবানুকারিতায় তাকে যে মাটি ও মানুষের কাছাকাছি যেতে হবে, সে সত্যটিও তিনি মুসলিম সমাজের সাহিত্যিকদের জন্য অনুভব করেছেন। ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই যে বাংলাদেশের সাহিত্যে নিজস্বতা গড়ে তুলতে হবে, সেই উপলব্ধি থেকেই তিনি একই প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘এই নতুন পরিস্থিতিতে আমাদের নতুন ক’রে বুনিয়াদ গড়ে তুলতে হবে, এখন আর কলকাতার দিকে তাকিয়ে থাকার দরকার নেই। ঢাকার দিকেই যে তাকাতে হবে, তারও মানে নাই। এই সময় ভাষার লোহার ফ্রেম ভেঙ্গে দিয়ে তাকে স্বাভাবিক পথে চলতে দিতে হবে।। এতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিং, যশোর, বরিশাল, দিনাজপুর প্রভৃতি অঞ্চলেরই নিজস্ব দান থাকবে। সমস্তটা মিলে হবে ঔদার্যময় পাকিস্তানি সাহিত্য। এতে আমরা প্রাদেশিকতার নামে চমৎকার ভাব-প্রকাশী শব্দ বা বাক্‌রীতি বাদ দিব না, ইসলামি ও হিন্দু কালচারের যেসব ভাব ও ভাষা প্রচলিত আছে, সাদরে সেসবকে স্থান দেব। দেশবাসীর জীবনসমস্যার সব বিষয় নিয়ে রসোত্তীর্ণ সহিত্য গড়ে তুলব। এই ভাবেই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সাহিত্য হবে ব্যাপক, বিরাট ও  সর্বজনগ্রাহ্য!’

ব্যক্তিসত্তার বিকাশকে তিনি সব পরিকল্পনার কেন্দ্রে স্থাপন করেছিলেন। ব্যক্তিকে আশ্রয় করেই প্রকাশ ঘটে যুক্তি ও বিবেকের। ফলে ব্যক্তিকে উপেক্ষা করে সামষ্টিক মুক্তির সন্ধান পাওয়া যাবে না—এই ছিল তাঁর চিন্তার দৃষ্টিকোণ। ব্যক্তির মুক্তির মাধ্যমেই মিলবে একটি নির্ভরযোগ্য সমাজকাঠামো, তা-ই ছিল তাঁর চেতনায়। ব্যক্তিকেই কাজী মোতাহার হোসেন চেতনার আধার করে তুলেছিলেন।

এই যে ভবিষ্যতের সাহিত্য সম্পর্কে তার উপলব্ধির মৌলিকতা, তা যে কত সূদুরপ্রসারী ছিল, সে রেশ আজও স্পষ্ট। মুসলমান সমাজের দুর্দশা তাদের পিছিয়ে পড়ার পেছনে যে যুক্তিহীন, দৃষ্টিহীন, উদ্দেশ্যহীন গোঁড়ামি, তা তিনি কখনোই প্রশ্রয় দেননি।

সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির মুক্তির প্রশ্নেও কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন আশ্চর্য রকমের স্বচ্ছ ও প্রাগ্রসর। যখন ধারণা করা হচ্ছে এবং জোর দেওয়া হচ্ছে মানুষকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে টানার। যাতে করে ব্যক্তির ভেতরে ও বাইরে তৈরি হচ্ছিল দ্বন্দ্ব, আদর্শ ও জীবনবোধের মধ্যে অসামঞ্জস্য তৈরি হচ্ছিল, সেখানে চিন্তার প্রসারে কাজী মোতাহার হোসেনের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। একটি নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া, আবদ্ধ চিন্তার জাল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে তিনি যে দুঃসাহসের প্রশ্রয় দিয়েছেন, তা–ই তাঁকে মুক্তির পথ খোঁজার প্রয়াসে অনন্য করেছে। নির্দিষ্ট বৃত্তের প্রতি নয়; বরং আদর্শ ও আনুগত্যের সর্বশেষ ভিত্তি হিসেবে, মানুষের অগ্রগতির মূল প্রেরণা হিসেবে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন।

ব্যক্তিসত্তার বিকাশকে তিনি সব পরিকল্পনার কেন্দ্রে স্থাপন করেছিলেন। ব্যক্তিকে আশ্রয় করেই প্রকাশ ঘটে যুক্তি ও বিবেকের। ফলে ব্যক্তিকে উপেক্ষা করে সামষ্টিক মুক্তির সন্ধান পাওয়া যাবে না—এই ছিল তাঁর চিন্তার দৃষ্টিকোণ। ব্যক্তির মুক্তির মাধ্যমেই মিলবে একটি নির্ভরযোগ্য সমাজকাঠামো, তা-ই ছিল তাঁর চেতনায়। ব্যক্তিকেই তিনি চেতনার আধার করে তুলেছিলেন। সমাজের বহিরঙ্গে পরিবর্তনের মাধ্যমে এই মুক্তি আসবে না; বরং তাঁর এই মুক্তির লক্ষ্য ব্যক্তির সংস্কার, ব্যক্তির অন্তর্গত পরিবর্তন। যা অস্তিত্বের গভীরে ছড়িয়ে থাকা যুক্তি ও ব্যাখ্যাহীন কোনো অস্তিত্বের সঙ্গে নয়, অন্ধ মুগ্ধতার সঙ্গেও নয়, এ অভ্যাসের বাইরে যুক্তির সেতু ধরে সুন্দরের মহিমা খুঁজে ফেরা।

কাজী মোতাহার হোসেন পেরেছিলেন মুক্তির সেই অনুভূতিকে ভাষায় প্রকাশ করতে। সেই আত্মপ্রত্যয়ে নিজেকে উজ্জ্বল করে তুলতে। যা তাঁর জীবন ও কর্মে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল।

প্রগতিবাদী দৃষ্টিতে যুক্তিগ্রাহ্য ভিত্তির মাধ্যমে তিনি সব অনিষ্ট থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে সহায়তা করেছেন। আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে আত্মশক্তিকে জাগাতে চেয়েছিলেন। গোঁড়ামি আর প্রগতিবিমুখতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অজ্ঞান-অন্ধকার দূর করতে চেয়েছিলেন। নবজাগরণের ধারায় চালিত করতে চেয়েছিলেন।

কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর আত্মজৈবনিক বই স্মৃতিকথার (নবযুগ প্রকাশনী, তৃতীয় মুদ্রণ অক্টোবর ২০১৩) ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ গদ্যে লেখেন, ‘আমার যৌবনকালে যখন বাংলাদেশের মুসলমানদের মাতৃভাষা উর্দু না বাংলা—এই নিয়ে উদ্ভট বিতর্ক হতো (পাকিস্তান হওয়ার পরে) তখনো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সমর্থন করেছি। এমনকি বঙ্গ-বিভাগের আগে থেকেই “মুক্তবুদ্ধি”র অন্যতম পরিপোষক হিসেবে ১৯২৬ সালে “মুসলিম সাহিত্য-সমাজ” নামের একটি সার্বজনীন সংস্থা গঠিত হয়েছিল। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, এ সংস্থার প্রথম শব্দটিই যখন “মুসলিম”, তখন এটিকে সর্বজনীন বলা যায় কেমন করে? উত্তর: এর শীর্ষস্থানে ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ (মস্তিষ্ক), সৈয়দ আবুল হুসেন (হাত-পা-দেহ) কাজী মোতাহার হোসেন (হৃদয়); বন্ধনীর ভেতর যে শব্দগুলো আছে, এগুলো প্রবর্তন করেন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের প্রিন্সিপাল সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র। ইনি আমাদের প্রায় সমুদয় মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতেন; এবং সময়–সময় বক্তৃতাও দিতেন। এই “সমাজে”র মুখপত্র ছিল শিখা নামে একটি বার্ষিক পত্রিকা; এতে বার্ষিক সভায় পঠিত সমুদয় প্রবন্ধ এবং সভাপতির ভাষণ ও সম্পাদকের মন্তব্য লিপিবদ্ধ হতো। অন্যান্য সভায় পঠিত বহু প্রবন্ধ সওগাত, মোহাম্মদী, প্রবাসী, ভারতবর্ষ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। এসব প্রবন্ধের কোনোটাই সাম্প্রদায়িক বা কোনো বিশেষ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করত না। তবু বুদ্ধি ও জ্ঞানকে উচ্চস্থান দেওয়া হতো বলে তৎকালীন পশ্চাৎপদ মুসলমান সমাজ যাতে আমাদের নাসারা, নাস্তিক, ইহুদি বা পৌত্তলিক মনে না করেন, সে জন্যই (বোধহয়) সতর্কতাসূচক “মুসলিম” শব্দটা অগ্রভাগেই জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। এ সতর্কতাটুকু সম্ভবত সৈয়দ আবুল হুসেনের কারসাজি; তবু এত করেও আমাদের যে কম ঝামেলা সহ্য করতে হয়েছে, তা নয়।’

ক্রান্তিকালেও কাজী মোতাহার হোসেন সত্যানুসন্ধান করেছেন। বাঙালি মুসলমান তথা বাঙালি সমাজের উন্নতির কথা ভেবেছেন। আর তাই  ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর মুখপত্র শিখার বার্ষিক প্রতিবেদনেও তাঁর সেই অনুভূতির প্রকাশ দেখা যায়। একটি বার্ষিক বিবরণীতে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা চক্ষু বুজিয়া পরের কথা শুনিতে চাই না বা শুনিয়াই মানিয়া লইতে চাই না; আমরা চাই চোখ মেলিয়া দেখিতে, সত্যকে জীবনে প্রকৃতভাবে অনুভব করিতে। আমরা কল্পনা ও ভক্তির মোহ আবরণে সত্যকে ঢাকিয়া রাখিতে চাই না। আমরা চাই জ্ঞানশিখা দ্বারা আসল সংস্কারকে ভস্মীভূত করিতে এবং সনাতন সত্যকে কুহেলিকামুক্ত করিয়া ভাস্বর ও দীপ্তিমান করিতে।...আমরা চাই সমাজের চিন্তাধারাকে কুটিল ও পঙ্কিল পথ হইতে ফিরাইয়া, প্রেম ও সৌন্দর্যের সহজ–সত্য পথে চালিত করিয়া আমাদের দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে। এককথায় আমরা বুদ্ধিকে মুক্ত রাখিয়া, প্রশান্ত জ্ঞানদৃষ্টি দ্বারা বস্তুজাতি ও ভাব জগতের ব্যাপারাদি প্রত্যক্ষ করিতে ও করাইতে চাই।’

হতাশা ও অপ্রাপ্তি থেকে যে সংকট তৈরি হচ্ছিল, কাজী মোতাহার হোসেন স্বভাবতই তা থেকে উত্তরণ চেয়েছিলেন, বাঙালি মুসলমানের বিকাশ ও বৃদ্ধি চেয়েছিলেন। ধর্মকে অবলম্বন করে যে গুরুতর সমস্যা তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, সম্প্রদায়গত যে বিরোধ তীব্র হয়ে উঠছিল, যে অসাম্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছিল, সদ্ভাবের অভাব থেকে যে সংকট দানা বাঁধছিল, তা কাজী মোতাহার হোসেনকে চিন্তিত করেছে। ফলে প্রগতিবাদী দৃষ্টিতে যুক্তিগ্রাহ্য ভিত্তির মাধ্যমে তিনি সব অনিষ্ট থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে সহায়তা করেছেন। আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে আত্মশক্তিকে জাগাতে চেয়েছিলেন। গোঁড়ামি আর প্রগতিবিমুখতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অজ্ঞান-অন্ধকার দূর করতে চেয়েছিলেন। নবজাগরণের ধারায় চালিত করতে চেয়েছিলেন। যেখানে হাত ধরাধরি করে চলবে নীতি ও সৌন্দর্য; যা সব সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে চালিত করবে উচ্চতর আদর্শিক সমাজের দিকে।

যুক্তি ও বিজ্ঞানমনস্ক কাজী মোতাহার হোসেন মূল্যবোধ ও ভেতরের শক্তিকে জাগিয়ে তোলায় প্রদর্শকের যে দায়িত্ব পালন করেছেন, তার সদর্থতা আজও হারায়নি, ম্লান হয়নি।