গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

জন্মদিনে দেরিদাকে স্মরণ

মৃত্যুর উপহার—অপরের জন্য বিলীন হবার দায়

জ্যাক দেরিদা উত্তর-কাঠামোবাদী চিন্তার একজন প্রবাদপুরুষ; ১৯৩০ সালের ১৫ জুলাই আলজেরিয়ার এল-আসন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। দেরিদার দর্শন যেমন ভাষা, পাঠ ও উপস্থিতির ধারণাকে নাড়া দিয়েছে, তেমনি তাঁর নৈতিকতা ও দায়িত্ব নিয়ে ভাবনাও আধুনিক চিন্তাকে গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাঁর রচনাগুলোর মধ্যে দ্য গিফট অব ডেথ বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে, যেখানে দেরিদা খ্রিষ্টীয় নৈতিকতা, গোপনতা, আত্মবলিদান ও দায়বদ্ধতা নিয়ে গভীর দার্শনিক আলোচনায় অবতীর্ণ হন।

এই নিবন্ধে আমরা দ্য গিফট অব ডেথ বইয়ের মূল ভাবনা ও দেরিদার বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতির দিকে সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিপাত করব—জন্মদিনে তাঁর চিন্তার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলিস্বরূপ।

সবাই জানে, একদিন মরতে হবে। কিন্তু মৃত্যুকে আসলে আমরা বুঝি কতটা? মৃত্যু কি কেবল শরীর থেমে যাওয়া? নাকি এর মধ্যে আছে আরও কিছু? গোপন, গভীর, যাকে চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়? এসব প্রশ্নের পথে পা বাড়িয়ে ১৯৯২ সালে ফরাসি দার্শনিক জ্যাক দেরিদা প্রকাশ করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত বই দ্য গিফট অব ডেথ। দেড় শ পৃষ্ঠার সেই বইজুড়ে দেরিদা বিনির্মাণ করেছেন কিছু সহজ প্রশ্নের জটিল উত্তর।

দেরিদা নিজের কাছেই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন, দায়িত্ব মানে কী? আমরা কার কাছে জবাবদিহি করি? মৃত্যু কেন উপহার? আর কেনই–বা সত্যিকারের দায়িত্ব নেওয়া মানে একধরনের আত্মত্যাগ?

ধরা যাক, একসকালে ঘুম ভাঙার পর কেউ একটি চিঠি পেল। চিঠিটি কে লিখেছে বোঝা যাচ্ছে না, তাতে লেখা আছে, তোমাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্য কেউ বিষয়টির দায় অনুভব করতে পারছে না। কিন্তু তুমি যেই সিদ্ধান্তই নাও, দায় কিন্তু তোমার একারই।’

এমন চিঠি বাস্তবে কেউ পায় না। কিন্তু জীবনে এমন পরিস্থিতি প্রায়ই আসে। যখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়—পড়াশোনা করব, না কাজ করব? সত্য বলব, না চুপ থাকব? কারও পাশে দাঁড়াব, না নিজের স্বার্থটুকুই দেখব? এই সিদ্ধান্তগুলোতে কোনো সরল নিয়ম মেনে নেওয়া যায় না। মা-বাবা, শিক্ষক, এমনকি ধর্মীয় গ্রন্থও অনেক সময় এসব পরিস্থিতিতে কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। তখন যে সিদ্ধান্ত আমরা নিই, তা-ই হয় আমাদের আসল দায়িত্ব।

জ্যাক দেরিদা বলেন, সত্যিকারের দায়িত্ব আসে এমন এক জায়গা থেকে, যেখানে যুক্তি অনেক সময় থেমে যায়। এই দায়িত্ব একান্ত, গোপন আর অনেক সময়ই ব্যাখ্যার বাইরে।

দ্য গিফট অব ডেথ বইয়ের শুরুতেই দেরিদা বলেন, দায়িত্ব মানে হলো এমন এক ‘অপরের’ প্রতি সাড়া দেওয়া, যাকে আমরা চিনি না, দেখি না, কিন্তু অনুভব করি। এই ‘অপরটা’ আসলে কে?

এই অপর হতে পারেন ঈশ্বর, হতে পারে এমন কোনো মানুষ, যার নাম আমরা জানি না, হতে পারে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, কিংবা এমন এক আদর্শ, যা এখনো সমাজে বাস্তবায়ন হয়নি। এই অপর আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর আমরাও অনুভব করতে থাকি, কোনো একভাবে, সে আমাদের পথ চেয়ে আছে।

এই অপরের দিকে সাড়া দেওয়াটাই হচ্ছে দায়িত্ব। এটি নিয়ম মেনে চলে না, এর সঙ্গে যুক্ত হয় ভয়, দ্বিধা ও বিশ্বাস। এর সঙ্গে যুক্ত হয় একধরনের ঝুঁকি। কারণ, আমরা নিশ্চিত হতে পারি না, সিদ্ধান্তটি শেষ পর্যন্ত সঠিক কি না। তবু আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, কারণ সেই ঝুঁকিই শেষ পর্যন্ত আমাদের মানুষ করে তোলে।

এখানে এসে দেখা যায় গিফট অব ডেথ বা মৃত্যুর উপহার কথাটির গভীরতা। মৃত্যু হলো সবচেয়ে নিশ্চিত সত্য। সবচেয়ে একান্তও বটে। কারণ, কারও পক্ষে অন্যের হয়ে মরা সম্ভব নয়।

কেরানির কাজ, প্রেম, বাড়িঘর—সবকিছুই ভাগাভাগি করা যায়। কিন্তু মৃত্যু? সেটি কেবল একজনের। এ কারণে, মৃত্যু এক বিশেষ ধরনের উপহার। এই উপহার নিজেকে কেবল একবারই দেওয়া যায় এবং তা ফিরিয়ে নেওয়ার উপায় নেই।

এই উপহার চূড়ান্ত, একান্ত, কিন্তু একই সঙ্গে এটি সবকিছু শেষ করে দেয়। তাই এই উপহারকে দেরিদা বলেন একধরনের অস্বীকারও। এটি একসঙ্গে দেয় এবং কেড়ে নেয়।

এই দ্ব্যর্থতার নাম তিনি দেন ‘অ্যাপোরিয়া’—অর্থাৎ এমন অবস্থা, যেখানে কোনো একমুখী সমাধান নেই। মৃত্যু সেই ধাঁধার নাম, যাকে বোঝা যায় না, কিন্তু না বুঝে উপেক্ষাও করা যায় না। যখন আমরা আত্মত্যাগ, আত্মহত্যা অথবা কারও জন্য মরার কথা ভাবি, তখন আমরা সেই গোপন উপহারের মুখোমুখি হই। দেরিদার মতে, এসব সিদ্ধান্ত কখনো পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় না। এগুলো ব্যক্তিগত, নির্জন এবং বেশ রহস্যময়।

এই সিদ্ধান্তগুলো হলো অন্ধকার পথে পা বাড়ানোর মতো। জানা নেই সামনে কী আছে, তবু এগিয়ে যাওয়াই পথের নিয়ম। এই জায়গায় এসে দেরিদা দার্শনিক সেরেন কিয়ের্কেগার্ডের ‘নাইট অব ফেইথ’ বা ‘বিশ্বাসের বীর’–এর ধারণা সামনে নিয়ে আসেন। বিশ্বাসের বীরের উদাহরণ হিসেবে তিনি হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর কাহিনি বলেন। আল্লাহ তাঁকে আদেশ দিয়েছিলেন সন্তানকে উৎসর্গ করতে। ইব্রাহিম (আ.) যুক্তি খোঁজেননি, প্রশ্ন করেননি। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আদেশ পালনের। যখন আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিই, তখন আমরা অন্য অনেক কিছুকে ‘না’ বলে দিই। একজন মানুষ যদি চিকিৎসক হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সে হয়তো কবি, সংগীতজ্ঞ, কিংবা শিক্ষক হওয়ার সম্ভাবনাকে হত্যা করে।

দেরিদা বলেন, প্রতিটি সিদ্ধান্তই একধরনের ‘মৃত্যু’—কেননা এটি সব বিকল্পকে অস্বীকার করে দেয়। আর এই অস্বীকার করার মধ্যেই জন্ম নেয় একটি ‘উপহার’—কারণ নিজের কিছু বিসর্জন না দিলে সত্যিকারের দায়িত্ব আসে না। এ কারণেই, প্রতিটি সিদ্ধান্ত একধরনের আত্মত্যাগ এবং প্রতিটি আত্মত্যাগ একধরনের ট্র্যাজেডি।

দেরিদা বলেন, অনেক সময় নৈতিকতা আমাদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়। আমরা নিয়মের আড়ালে লুকিয়ে থাকি, যাতে নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত না নিতে হয়। কিন্তু সত্যিকারের দায়িত্ব আসে যখন নিয়ম ভেঙে যায়, যখন কেউ বলার নেই, যখন নিজেকেই নিজের উত্তর খুঁজে নিতে হয়। এই একাকিত্বের মধ্যেই জন্ম নেয় দায়িত্ব।

এবার উপহারের কথায় ফেরা যাক। দেরিদা বলেন, উপহার কেবল তখনই উপহার, যখন তা নিঃস্বার্থ। আমরা অনেক সময় উপহার দিই, কিন্তু তার পেছনে প্রত্যাশা থাকে—ভালো লাগা, প্রশংসা, সম্পর্ক রক্ষা। সেটা মূলত একধরনের উপহার বিনিময়ের অংশ। আর সত্যিকারের দায়িত্ব এমন এক উপহার, যেখানে কোনো বিনিময়ের সুযোগ নেই। এমনকি সেই উপহারের বদলে ‘ধন্যবাদ’ আশা করাও পুরোপুরি নিষ্প্রয়োজন। এটি একতরফা নীরব আত্মদান।

ধরুন, আপনি পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। হঠাৎ এক অচেনা মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখলেন। তিনি আপনার আত্মীয় নন, বন্ধু নন, এমনকি হয়তো একই জাতিরও নন। তবু তাঁকে দেখে আপনি থেমে যান। পুলিশে খবর দেন। অন্তত একটি কাপড় দিয়ে তাঁর মুখটি ঢেকে দেন। এই কাজটি কোনো আইন বা চুক্তি থেকে আসে না। আসে একধরনের নৈতিক চাপে, যাকে দেরিদা বলতেন ‘অপরের আহ্বান’। আপনি জানেন, তিনি আপনাকে কোনো দিন ধন্যবাদ দেবেন না। কোনো দেনা-পাওনা হবে না। তবু আপনি এই দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।

দেরিদার দ্য গিফট অব ডেথ শুধু একটি দার্শনিক বই নয়। এটা মূলত এক আয়না, যেখানে মানুষ নিজের মুখ দেখে। ভয়ের, দ্বিধার আর আত্মত্যাগের মুখ। দেরিদা আমাদের মনে করিয়ে দেন, প্রতিটি সত্যিকারের সিদ্ধান্ত একা নিতে হয়। সেই সিদ্ধান্ত বেশির ভাগ সময়ই অন্য কেউ বুঝবে না। কেউ হয়তো তার মূল্য দেবে না। তবু নিতে হয়। এই দায়িত্ব কেউ চাপিয়ে দেয় না, এটি আসে ভেতর থেকে। একটি গভীর, অদৃশ্য অথচ শক্তিশালী সত্তার পক্ষ থেকে।

দেরিদা আমাদের বলে যান না, কী করতে হবে। তিনি আমাদের এমন এক আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেন, যেখানে নিজের দিকে তাকানোই দায় হয়ে ওঠে। কারণ, সেখানে দেখা যায়, আমরা একজনকে বাঁচিয়ে যখন নিজেদের ন্যায়পরায়ণ ভাবি, তখনই হয়তো আরেকজনকে বেছে নিই না বাঁচানোর জন্য। আমরা ভালোবাসার নামে যখন ত্যাগ করি, তখনই হয়তো কোনো অন্যমুখে ঘৃণার ছায়া পড়ে যায়।

এই বই মনে করিয়ে দেয়, নির্বিকার নৈতিকতা বলে কিছু নেই। যে মুহূর্তে আমরা দায়িত্ব নিই, সেই মুহূর্তেই অন্য কোনো দায়িত্বকে এড়িয়ে যাই। তবু দেরিদা আমাদের হাতে এক উপহার তুলে দেন। এমন এক উপহার, যাকে আমরা ফিরিয়ে দিতে পারি না; যাকে পুরোপুরি বুঝতেও পারি না; যাকে নিজের বলে দাবি করার ভাষা আমাদের জানা নেই। এই উপহার হয়তো ঈশ্বরের নয়, মৃত্যুরও নয়, হয়তো এই নিঃসঙ্গ পৃথিবীরই। যেখানে একজন মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে আমরা মনে মনে বলি—জানি না কেন, তবু তোমার দিকে তাকানোর মধ্যেই আমি দায়বদ্ধ হয়ে গেলাম।