গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

জগজ্জয়ী চার সুফি কবির অজ্ঞাত প্রভাবক

একাদশ শতকের সুফি কবি হাকিম সানায়ি গজনভি

শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদি, খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি ও ফরিদ উদ্দিন আত্তার দুনিয়াজুড়ে যতটা খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, সে তুলনায় হাকিম সানায়ি গজনভি অখ্যাত তো বটেই, সর্বসাধারণের কাছে আজও অনেকটা অজ্ঞাতই রয়ে গেছেন। অথচ উক্ত চার কবিরই অগ্রজ ছিলেন হাকিম সানায়ি। শেখ সাদির জন্মের ১০০ বছর আগে ১০৮০ খ্রিষ্টাব্দে আফগানিস্তানের গজনিতে জন্মগ্রহণকারী আবুল মজ্দ মজদুদ বিন আদম হাকিম সানায়ির প্রভাব কোনো-না-কোনোভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই চার কবির ওপর পড়েছে। কবিখ্যাতির ক্ষেত্রে যে জালাল উদ্দিন রুমি আজ বিশ্বজুড়ে অনন্য স্থান অধিকার করে আছেন, তাঁর জীবনের বাঁকপরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছে তাঁর অনবদ্য একটি শের।

আল্লামা শিবলি নোমানির ‘সওয়ানেহ-ই-মওলানা রুম’ (প্রকাশ: ১৯০৬ খ্রি., কানপুর) বইয়ের সূত্রে আমরা জানতে পারি ইতিহাসের সেই স্মরণীয় দিনের কথা, যেদিন তুরস্কের কুনিয়ায় পৌঁছে শামস তাবরেজি তাঁর ভবিষ্যৎ মুরিদ জালাল উদ্দিন রুমির পথ আগলে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন:

কুপ্রবৃত্তি এবং যে কারণে তার উদ্ভব, তা থেকে বাঁচার উপায় কী?
রুমি জবাব দিলেন, শরিয়ত অনুসরণ করা।
শামস তাবরেজি বললেন, এ কথা তো সবাই জানে।
রুমি বললেন, এর চেয়ে উত্তম উপায় তাহলে আর কী হতে পারে?
শামস বললেন, সেই জ্ঞানই আসল জ্ঞান যা তোমাকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে দেয়।

এ কথার পক্ষে তিনি হাকিম সানায়ির একটি শেরের ভাবার্থ রুমিকে শোনান: যে জ্ঞান তোমাকে আত্মহারা করতে পারে না, তার চেয়ে অজ্ঞানতাই উত্তম। এই শের রুমিকে আত্মহারাই করেনি শুধু, শামস তাবরেজির শিষ্যত্ব বরণে ব্যাকুল করে তোলে। পরবর্তী সময়ে সানায়ির জ্ঞান ও প্রেমের অপূর্ব মিশ্রণের কথা মাথায় রেখে এ সম্পর্কে জালাল উদ্দিন রুমি তাঁর ‘মসনবি’তে বলেছিলেন:

‘তরক-জুশি র্কদ-অন নিম্ খাম্
হকিম্-ই-গজনবি বশনু তমাম্’

শেখ সাদির জন্মের ১০০ বছর আগে ১০৮০ খ্রিষ্টাব্দে আফগানিস্তানের গজনিতে জন্মগ্রহণকারী আবুল মজ্দ মজদুদ বিন আদম হাকিম সানায়ির প্রভাব কোনো-না-কোনোভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই চার কবির [শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদি, খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি ও ফরিদ উদ্দিন আত্তার] ওপর পড়েছে।

অর্থাৎ সানায়ির লেখায় প্রেমের যে উন্মাদনা আছে, আমার লেখায় তা নেই। এই সানায়ির শের রুমিকে জ্ঞান থেকে প্রেমের পথে তাড়িত করলেও শুরুতে তিনিও যে দিশাহারা ছিলেন, সে ঘটনাও ইতিহাসে কম আলোচিত নয়। তিনি যত দিন গজনির দরবারে ছিলেন, অন্য কবিদের মতো প্রশস্তি গেয়েছেন, এরপর রাজদরবার ভেঙে যাওয়ার পর তিনি প্রথমে মক্কায়, এরপর খোরাসান পর্যন্ত সব রাজ্যে ঘুরে বেড়ান এবং জ্ঞানী-গুণী সাধকের সান্নিধ্যে এসে দিব্যজ্ঞান অর্জন করে ইশকের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠলেন। কিন্তু কারও কারও মতে, গজনির দরবার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই একটি ঘটনার অভিঘাতে তাঁর ভাবান্তর ঘটে।

বাহরাম খান যখন ভারতবর্ষ আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন রাজকবি হিসেবে হাকিম সানায়ি সুলতানের প্রশস্তিমূলক কসিদা রচনা করে তাঁকে শুনিয়ে খুশি করার জন্য যখন যাচ্ছিলেন, তখন পথের পাশের অতিথিশালায় সুরা পানরত এক ব্যক্তি এবং সুরার পেয়ালা পরিবেশনকারী এক সাকির মধ্যকার কথোপকথন শুনে বিস্মিত হয়ে যান। তিনি শুনলেন, সেই সুরাপায়ী ব্যক্তি সুলতানের বোকামির স্মারক হিসেবে প্রথমে এক পেয়ালা সুরা এগিয়ে দেওয়ার জন্য সাকিকে বললেন আর দ্বিতীয় পেয়ালা হাকিম সানায়ির নির্বুদ্ধিতার জন্য, কারণ সালতানাতের দুর্বলতা জানার পরও তার তারিফ করে মিথ্যা কসিদা রচনা করা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কী! এই কথোপকথন শুনে একদম অস্থির হয়ে ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেলেন সানায়ি এবং পুরোপুরি সুফিজীবন অবলম্বন করলেন। এমনকি তাঁর সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ার পর সুলতান যখন সানায়ির সঙ্গে তাঁর বোনের বিয়ে দেওয়ার আগ্রহ দেখান, তখন তিনি সে প্রস্তাব তো অস্বীকার করেনই, এ ছাড়া এ কথাও বলেন, ‘গর তু তাজম দেহি জে আহসালাম/ ব সেরে তুকে তাজ না সোতাজম।’ অর্থাৎ ‘আপনি যদি সদয় হয়ে আপনার মাথার সুলতানি তাজ আমাকে উপহার দেন, তবু আমি তা গ্রহণ করতে পারব না।’ সানায়ির এমন উক্তির কারণ, তিনি তখন প্রচলিত পোশাক ও জুতা পরিত্যাগ করে প্রায় পাগলবেশই ধারণ করেছিলেন। তাঁর সেই সময়কার অবস্থা ধারণ করে আছে নিম্নোক্ত কবিতাটি:

‘মন্ অজ আতিশ-ই-ইশক্ হম নরম র্গদম্
অর্গ চিজ পুলাদ-ই-সখ্ত অস্ত লাদম্॥
মনম্ বন্দ-ই-ইশক তা জিন্দ বাশম্
অর্গ চিজ মা র্দ মন্ আজাদ বাশম্ ॥’
‘মন্ অজ আতিশ-ই-ইশক্ হম নরম র্গদম্
অর্গ চিজ পুলাদ-ই-সখ্ত অস্ত লাদম্॥
মনম্ বন্দ-ই-ইশক তা জিন্দ বাশম্
অর্গ চিজ মা র্দ মন্ আজাদ বাশম্ ॥’

অর্থাৎ ‘আমার চরিত্র যদিও কঠিন ইস্পাতে তৈরি, তবু ইশকের আগুনে তা বিগলিত হয়ে গেছে। বাস্তবে যদিও আমি আমি স্বাধীন, তবু যতক্ষণ বেঁচে আছি, আমি তার অধীন হয়ে থাকব।’ এ হলো কামপ্রবৃত্তি থেকে মুক্ত পরম সত্তার প্রতি এক সুফি কবির আত্মসমর্পণের স্বীকারোক্তি।

গাজ্জালির কাছেই তিনি [হাকিম সানায়ি] ধর্মতত্ত্বের অন্তরঙ্গ পাঠ নিয়েছিলেন এ কথা সত্য, কিন্তু সুফিতত্ত্বের ক্ষেত্রে তিনি গাজ্জালির মতো সাবধানী ও শুদ্ধতাপন্থী ছিলেন না, ফলে তাঁর সুফিগ্রন্থের বিষয়বস্তু, বিশেষত আহলে বায়েতদের প্রতি সবিশেষ দুর্বলতা ধর্মশাস্ত্রীদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল।

পরবর্তীকালে তিনি ও ইমাম গাজ্জালি যেভাবে নিজেদের পথ বেছে নিয়েছিলেন, তাতে এটা মেনে নেওয়া কঠিন যে তাঁরা দুজনই ছিলেন একই পীরের মুরিদ অর্থাৎ গুরুভাই এবং দুজনই আবু ইউসুফ হামদানির কাছ থেকে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তবে আল্লামা শিবলি নোমানি তাঁর ‘শের-উল-আজম’ (প্রকাশ: ১৯১৮ খ্রি., আজমগড়) বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ইমাম গাজ্জালির পীর ছিলেন আবু আলি কারমদি, যিনি হাকিম সানায়ির দাদাপীর, সেই সূত্রে তিনি গাজ্জালির ভাতিজা। গাজ্জালির কাছেই তিনি ধর্মতত্ত্বের অন্তরঙ্গ পাঠ নিয়েছিলেন এ কথা সত্য, কিন্তু সুফিতত্ত্বের ক্ষেত্রে তিনি গাজ্জালির মতো সাবধানী ও শুদ্ধতাপন্থী ছিলেন না, ফলে তাঁর সুফিগ্রন্থের বিষয়বস্তু, বিশেষত আহলে বায়েতদের প্রতি সবিশেষ দুর্বলতা ধর্মশাস্ত্রীদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল। তবে একই সঙ্গে সুফিতাত্ত্বিক ও সুফিমতের অনুসারী হিসেবে তাঁর জ্ঞানচর্চা শেষ পর্যন্ত প্রেমধর্মে মিলে গিয়ে পরবর্তীকালের সুফি কবিদের আদর্শ হয়ে উঠেছিল। জ্ঞান ও প্রেমের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা হাকিম সানায়ির উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো: ‘ইশকনামা’, ‘আকলনামা’, ‘গরিবনামা’, ‘তরিকুত তাহকিক’, ‘হাদিকাত-উল-হকিকত’, ‘সিয়ার-উল-আবাদি’। হাকিম সানায়ি এতগুলো গ্রন্থ লিখলেও সেগুলো বৃহত্তর পাঠক সমাজের সামনে আসেনি। ১০ হাজার বয়েতের সমষ্টি ‘হাদিকাত-উল-হকিকত’ শিরোনামক গ্রন্থে রয়েছে সুফিতত্ত্ববহ ইঙ্গিতময় গল্প ও বাণীর মধ্য দিয়ে খোদা, নবী, দরবেশদের গুণগান, আধ্যাত্মিক রহস্য ইত্যাদির আলোচনা। এই বই পড়লে পরবর্তীকালে রচিত ফরিদ উদ্দিন আত্তারের মনতিকুত্ তয়ের (পাখিসম্মেলন) এবং জালাল উদ্দিন রুমির ‘মসনবি’র গল্পের কথাও মনে পড়তে পারে। এই বইয়ের একটি অণুগল্পের সারানুবাদ হলো: ‘একটি উটকে মাঠে চরতে দেখে কোনো এক বোকা লোক তাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার আকার এ রকম কেন?” উটটি জবাব দিল, “খবরদার, আমার এই বক্র আকৃতির মধ্যে খোদার ত্রুটি তালাশের চেষ্টা করো না; বরং সহজ–সরল পথে কীভাবে চলা যায়, আমার দিকে তাকিয়ে তা জানার চেষ্টা করো।”’ তাঁর একটি বয়েতে আছে:

‘তু বগুফতার ঘিরায়ে শবর রুজ
লিক মালুম-ই-তু নগুশ্ত ইমরুজ ॥
বিশ, মশনুজ নি কর বদ গুফতার।
আন চি বশনিদি বকার দর আর॥’

অর্থাৎ ‘দিনে–রাতে যে অকারণ কথা বলে যাচ্ছ, তা তুমি বুঝতে পারছ না। কী ভালো, কী খারাপ সেই সব আলোচনায় সময় নষ্ট না করে যা শুনতে পেরেছ, তা কাজে লাগানোর জন্য মনোযোগী হও।’ কুতর্কে লিপ্ত না হয়ে সহজ–সরল পথে নিজেকে সমর্পণ করার এই সব বাণীই সুফি কবির কবিতার বৈশিষ্ট্য।

হাকিম সানায়ি রচিত এই সব লেখার মধ্যে হাদিকাত-উল-হকিকত ও আরও কিছু দিওয়ান ছাড়া বাকি লেখাগুলো পাঠকের সামনে আসেনি। আসলে হাকিম সানায়ি গজনভি এতটাই অবহেলিত যে তাঁর জন্ম-মৃত্যুর সাল সম্পর্কেও নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। তাঁর অনুমিত জন্মসাল ১০৮০ খ্রিষ্টাব্দ, তা আগেই বলেছি। অনুমান করা হয় যে ১১৩১ থেকে ১১৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে তিনি গজনিতে মৃত্যুবরণ করেছেন।

অন্য আলো–য় লিখতে পারেন আপনিও। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ আপনার সৃজনশীল ও মননশীল যেকোনো লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের ঠিকানায়।ই–মেইল: info@onnoalo.comঅন্য আলোপ্রথম আলো ভবন (৭ম তলা)১৯ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫